সত্যব্রত ঘোষ
লোকসভা নির্বাচনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে পশ্চিমবঙ্গে যুযুধান দুটি রাজনৈতিক দলকে যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শরণাপন্ন হতে হবে, এমনটা কেউ ভাবতে পেরেছিলেন কিনা জানা নেই। আমি পারিনি। কিন্তু বিদ্যাসাগরের মূর্তি নতুন করে ভাঙাকে কেন্দ্র করে বাঙালির যে আবেগের বিস্ফোরণ ঘটেছে, তার অভিঘাত রবিবার ভোটদান পর্বে পড়বেই। যে কারণে পরিস্থিতি আজ এখানে পৌঁছেছে, তা আরেকবার বুঝে নেওয়া যাক।
১৫ মে সকালে বিজেপি-র ন্যাশনাল আইটি সেল-এর তত্ত্বাবধায়ক অমিত মালব্য তাঁর একটি টুইটবার্তায় বিরাজ নারায়ন রায় নামে বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্রের প্রত্যক্ষ জবানবন্দি উদ্ধৃত করে অভিযোগ তোলেন তৃণমূল কংগ্রেসের গুণ্ডারাই রাজনৈতিক স্বার্থে কলেজের ভিতরে রাখা বিদ্যাসাগরের মূর্তিটি ভেঙেছে। তিনি আরও জানান, কলেজের ভিতর থেকে র্যালির দিকে ইট ছোঁড়া হয়েছে এবং মোটরবাইকে আগুন লাগানো হয়েছে। ফেসবুক পোস্টে তাঁর যুক্তি, ভিতরে থাকা তৃণমূল সদস্যরা যা করেছে, বাইরে থেকে কলেজের দুটি তালাবন্ধ গেট অতিক্রম করে ভিতরে ঢুকে বিজেপি কর্মীদের পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। সেই পোষ্ট সাংসদ স্বপন দাশগুপ্ত এবং ডানপন্থী বিকাশ পাণ্ডেও টুইট করেন। কিন্তু মজার কথা হল, যে বিরাজ নারায়ন রায়-এর ফেসবুক পোস্ট নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় হল, সেই মানুষটির ফেসবুক অ্যাকাউন্টই এর পর গায়েব। নেতাদের পোষ্ট ইতিমধ্যে ফেসবুক ও টুইটারে কিন্তু ভাইরাল হয়ে সাব্যস্ত করল বিদ্যাসাগরের মূর্তি বিজেপি ভাঙেনি। অবস্থা এমন এক জায়গায় পৌঁছায় যে প্রায় প্রত্যেকে ফেসবুকে নিজের পোস্টে “আমি বিদ্যাসাগর কলেজের একজন ছাত্র / ছাত্রী।” – এই পরিচয় দিয়ে ঘটনার নিজস্ব বর্ণনা দেয়।
কিন্তু অকুস্থলে উপস্থিত বিভিন্ন সংবাদপত্র ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমের প্রতিনিধি স্পষ্ট জানাচ্ছেন যে কলেজের বাইরে থেকে ভিতরে ইট ছোঁড়ার পরই ঝামেলা সৃষ্টি হয়। আনন্দবাজার পত্রিকার রিপোর্টে বলা হচ্ছে গেরুয়া রঙের ‘নমো এগেইন” ছাপা গেঞ্জি পরিহিত মানুষগুলিই রাস্তা থেকে কলেজের ভিতরে ইট ছুঁড়ছিল। কোনও টেলিভিশন কভারেজে দেখান হয়নি ক্যাম্পাস থেকে বাইরে ইট এসে পড়ছে।
অমিত মালব্য পাল্টা একটি ভিডিও ক্লিপ আপলোড করে এই বক্তব্য পুষ্ট করেন যে “বিজেপি সভাপতির রোড শো বানচাল করবার পরিকল্পনা নিয়ে টিএমসি দুষ্কৃতিকারীদের জড়ো করেছে।” অথচ, তাঁর আপলোড করা ক্লিপটি থেকে “দুষ্কৃতিকারীদের” সক্রিয়তার নিদর্শনই পাওয়া যায়নি। বরং তাতে দেখা যাচ্ছে, বিজেপি সমর্থকদের ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টাতে বাধা দিচ্ছে পুলিশ। আর রাস্তার অন্যদিকে টিএমসি সমর্থকরা শ্লোগান দিচ্ছে কালো পতাকা তুলে। তাদের মধ্যে একজন ক্যামেরার সামনে একটি বোতল দেখিয়ে বলছে বিজেপি-র লোকরা সেটি ছুঁড়েছে।
এবার আসা যাক মোটরবাইকে অগ্নিসংযোগ প্রসঙ্গে। ভিডিয়ো ফুটেজে দেখা যাচ্ছে বাইকগুলি রাস্তার ধারে আছে। সেগুলিতে গেরুয়া গেঞ্জিপরা লোকজনই আগুন লাগাচ্ছে। অন্য একটি ভিডিয়ো ক্লিপে অনেকটা উপর থেকে আমরা এই অগ্নিসংযোগের মুহূর্তটি দেখছি। সমগ্র এলাকাটিতে গেরুয়া গেঞ্জি আর বিজেপি-র পতাকা ভর্তি।
প্রেস কনফারেন্সে অমিত শাহ একটি ফোটো হাতে নিয়ে দেখিয়েছেন কোথায় কাঁচের ঘেরাটোপে বিদ্যাসাগরের মূর্তিটি ছিল। তাঁর বক্তব্য, “তালাবন্ধ করা দুটি ঘরের মধ্যে থাকা মূর্তিটি জনসমক্ষে নেই। আমার একটাই প্রশ্ন – সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ যখন মূর্তি ভাঙার ব্যাপারটি ঘটে, তখন কলেজ বন্ধ এবং গেটগুলিতেও তালা পড়েছে। তাহলে ঘরগুলি কে খুলল? চাবি কার কাছে ছিল? তালা তো ভাঙা হয়নি। টিএমসি-র লোকরাই যে চাবি খুলেছে। বিজেপি-র সমর্থকেরাও তো রাস্তায় ছিল। ওরা কী করে ভিতরে যাবে? বাঙলার মানুষ জানুক। বিদ্যাসাগরের মূর্তি টিএমসি-র লোকরাই ভেঙেছে।” এভাবে অমিত শাহ বিজেপি-কে যতই নির্দোষ সাব্যস্ত করবার চেষ্টা করুক, সেই সময়ে তোলা একাধিক ভিডিয়ো ক্লিপ যে অন্য কথা বলছে। সেগুলিতে আমরা দেখছি গেরুয়া রঙের ‘নমো এগেইন” ছাপা গেঞ্জি পরিহিত মানুষগুলি বারবার লাঠির ঘায়ে গেটের তালা ভাঙছে। তালা ভেঙে ক্যাম্পাসের ভিতরেও যে তারা ঢুকেছে, তাও আমরা দেখছি। যিনি এই ভিডিয়োটি
তুলছেন, তাঁর কণ্ঠ শুনতে পাই আমরা, “ওরা ভিতরে ঢুকে ভাঙচুর শুরু করেছে।”
বিদ্যাসাগর কলেজে বিদ্যাসাগরের একাধিক মূর্তি আছে। যে মূর্তিটি ভাঙা হয়েছে তা প্রবেশদ্বারের সামনেই অবস্থিত। বিজেপি-র সমর্থকেরা লোহার গেটের তালা ভেঙে বলপূর্বক প্রবেশ করবার পরে প্রেস কনফারেন্সে অমিত শাহ যে ন্যারেটিভ সাজাচ্ছেন, তাতে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে বটে। তবে বিজেপি-র সমর্থকরা যে বিদ্যাসাগরের মূর্তিটি ভাঙেনি, তা প্রমানিত হয় না। ভিডিয়ো ক্লিপ রেকর্ডিং-এর সময় রাত ১২.১৩ মিনিট। আমরা দেখি একটি সাদা বস্তু, সম্ভবত প্লাস্টার অফ প্যারিস – কলেজের বাইরে এনে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। আবার রাত ১২.২১-এ তা তুলে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলা হয়। তারপর প্রায় ২০ মিনিট তাতে কেউ হাত দেয়নি। ১২.৪২-এ একজন এসে জিনিষটি তুলে আবার ছুঁড়ে তা ভাঙে। ভিডিয়োটিতে অন্তত দুজনকে দেখা যাচ্ছে যারা গেরুয়া গেঞ্জি পরে ছিল।
অমিত মালব্য আরেকটি ভিডিয়ো পোস্ট করেছেন। ঘটনাস্থলে মমতা ব্যানার্জি পৌঁছে পরিদর্শন করবার আগের মুহূর্তটি ধরা পড়েছে তাতে। ভিডিয়োতে যেখানে মূর্তিটি ভাঙা হয়েছে দেখিয়েছে, সেখানেই। মালব্যের টুইটের দ্বিতীয় অংশটি লক্ষ্যনীয়। তিনি বলছেন, “ভাঙা মূর্তিকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে মমতা ব্যানার্জির জন্য।” কথাটি বিভ্রান্তিমূলক। কারণ, ইতিমধ্যেই আগের ভিডিয়ো ক্লিপগুলি থেকে প্রমাণ করা গেছে যে মূর্তিটি কাঁচের ঘেরাটোপে থাকলেও তা ভেঙে মূর্তিটি বার করে বাইরে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে।
বিজেপি-র পক্ষ থেকে বাবার বলা হচ্ছে মূর্তিটি টিএমসি-র সমর্থকরাই ভেঙেছে। কিন্তু ভিডিয়োগুলিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি গেরুয়া গেঞ্জি পরা লোকরাই গেট ভেঙে কলেজে ঢুকে ভাঙচুর চালাচ্ছে। অর্থাৎ, টিএমসি-র সমর্থকরাই যে যাবতীয় অনর্থের জন্য দায়ী – বিজেপি-র এই অভিযোগ কিন্তু দৃশ্যত প্রমাণ হচ্ছে না।
………
বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার পর যে পাঁচটি কথা মনে আসছে তা এখানে বলা যাক :
১। এবারের নির্বাচনে বিজেপি প্রমাণ করতে উদগ্রীব যে সত্যি বলে যা কিছুই থাক না কেন, তা একটি কাউন্টার ন্যারেটিভ-এর মাধ্যমে খণ্ডন করা যায়। বিশেষজ্ঞরা এই প্রয়াসটিকে পোস্ট-ট্রুথ আখ্যা দিচ্ছেন।
২। পশ্চিমবঙ্গই সম্ভবত একমাত্র রাজ্য যেখানে বিজেপি-কে একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক দলের সঙ্গে মরিয়া হয়ে লড়াই চালাতে হচ্ছে।
৩। নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ নামক দুটি ব্যক্তি আজ ঘটনাচক্রে বিজেপি-র মুখ। আগ্রাসী এই ব্যক্তিদ্বয়ের আচরণে বিজেপি-র অন্য নেতৃবৃন্দ স্বস্তিতে নেই। এঁদের মুখ বন্ধ করবার জন্যেও নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ-কে এমন মরিয়া লড়াই চালাতে হচ্ছে।
৪। দেশের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি থেকে সরিয়ে সাধারন মানুষের আবেগমথিত করবার জোরদার চেষ্টা চালানো হলেও তা যে বিশেষ লাভদায়ী হবে, তেমন কোনও লক্ষণ এখনও আমরা পাচ্ছিনা এবং
৫। মমতা ব্যানার্জির শাসনকালে পশ্চিমবঙ্গে যে বিভাজন এবং মেরুকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়, বাঙলার সমাজের সেই খণ্ডিত সত্তার সুযোগ নিচ্ছে বিজেপি। তাই একজন জনপ্রিয় নেত্রী হিসেবে মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি-র আগ্রাসন তথা মোদি এবং শাহের একাধিপত্যকে আটকানোর জন্য কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন, তা প্রকৃতপক্ষে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করবে।
ক্লিপ গুলো দেখেছি,তাই বলতে পারি সত্যব্রত বাবুর দেওয়া যুক্তি গুলি খুব জোরালো ও প্রায় সত্যের কাছাকাছি! লেখাটি আমার সন্দেহ কে বিশ্বাসে বদলে দিয়েছে! ধন্যবাদ সত্যব্রত বাবু! যে বিষয় নিয়ে লিখুন,মেজাজটা কিন্তু এই থাকা চাই!