সীমান্ত গুহঠাকুরতা
জনগণেশের ঘাড়ে চেপে কেন্দ্রে আরও একবার ক্ষমতাসীন ‘মোদি-সরকার’। এবং যথারীতি, আরও একবার আত্মসমালোচনার বদলে পরাজিত নেতানেত্রীদের একাংশের তরফে তাদের হারের যাবতীয় দায় চাপানোর প্রচেষ্টা দেখা গেল ইভিএমের ঘাড়ে। বস্তুত একজিট পোলের ফলাফল প্রকাশের পর থেকেই (নিন্দুকে বলে, বিপদ বুঝে) তাঁরা ইভিএম-কারচুপি নিয়ে সুর চড়াতে শুরু করেছিলেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ফেসবুক-হোয়াটস অ্যাপে ছড়িয়ে পড়া কিছু ভিডিও, যা বিভ্রান্তি বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ। পাশাপাশি প্রথম থেকেই সন্দেহ ছিল ভিভিপ্যাট নিয়েও। সন্দেহ নিরসনে কোর্টের নির্দেশানুযায়ী বিধানসভা পিছু পাঁচটি বুথের ইভিএম এবং ভিভিপ্যাটের ফলাফল মিলিয়ে দেখার ঘোষণা করেছিল কমিশন। সকলকে আশ্বস্ত করতে এও জানানো হয়েছিল যে, যদি দুটি ফলের অমিল দেখা যায় তবে ভিভিপ্যাটের ফলাফলকেই চূড়ান্ত বলে ঘোষণা করা হবে। যদিও গণনা পর্বে কোথাও কোনও বুথের ফলাফলেই ইভিএম এবং ভিভিপ্যাটের হিসেবে গরমিল হয়েছে বলে জানা যায়নি।
যাওয়ার কথাও নয়। প্রায় দেড়মাস ব্যাপী এই নির্বাচন-পর্বে, দশ লক্ষ পোলিং বুথের কোনও একটি থেকেও ইভিএমের ভোটের সঙ্গে ভিভিপ্যাটের স্লিপে প্রদর্শিত চিহ্ন মিলছে না– এমন অভিযোগ শোনা যায়নি। এমনকি যে রাজনৈতিক দলগুলো রিগিং, বুথ-জ্যাম বা ছাপ্পা নিয়ে সদাই সরব ছিল, তাদের তরফেও এমন কোনও দাবি তোলা হয়নি। অতএব ওই যন্ত্রটির কার্যকারিতা গণনার অনেক আগেই প্রমাণিত হয়ে গেছে।
ভিভিপ্যাট নিয়ে অনর্থক মাথা ঘামানোর বদলে তাই সাধারণ মানুষ যে যন্ত্রটিকে নিয়ে সর্বাধিক চিন্তিত এবং বিভ্রান্ত, সেই ভোটযন্ত্র বা ইভিএমের নিরাপত্তার ব্যাপারটা একটু বিশদে বুঝে নেওয়াই ভালো। ইভিএম নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আপত্তির জায়গা মূলত দুটি। এক. প্রযুক্তিগত কারচুপি করে এর ফলাফল নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এবং দুই, গণনার আগে গোপনে মেশিনের সব ভোট মুছে নতুন করে ভোট ভরে দেওয়া হয়। প্রযুক্তিগত কারচুপি আবার দুভাবে হতে পারে বলে সন্দেহ– ভোট চলাকালীন দূর-নিয়ন্ত্রিত কোনও ব্যবস্থার মাধ্যমে যন্ত্রটি হ্যাক করে ফেলা যেতে পারে, অথবা আগে থেকেই বিশেষভাবে মেশিনটিকে এমনভাবে ‘প্রোগ্রাম’ করে রাখা যেতে পারে যাতে যে বোতামই টেপা হোক না কেন, যাবতীয় ভোট গিয়ে একই জায়গায় জমা পড়ে। এই দ্বিবিধ সন্দেহের নিরসন জরুরি।
ইলেকট্রনিক্স নিয়ে সামান্য পড়াশুনা আছে, এমন কারওকে জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবেন– ইলেকট্রনিক্স ‘ডিভাইস’ মূলত দুপ্রকারের হয়– এক, যার ‘প্রোগ্রাম’-কে বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব আর দুই, যার ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব নয়। ইভিএম হল ওই দ্বিতীয় শ্রেণির যন্ত্র। এর ভিতরে একটি মাইক্রোচিপ থাকে বটে, কিন্তু রেডিও-র মত কোনও ‘ফ্রিকোয়েন্সি রিসিভার’ অথবা স্মার্ট ফোনের মত কোনও ‘ডেটা ডিকোডার’ তাতে থাকে না। ফলে যে তথ্য সংগৃহীত হয়, বাইরে থেকে ওয়াই-ফাই, ব্লু-টুথ বা ডেটা-কেবল জাতীয় কোনও কিছু দিয়েই সেই তথ্য মুছে দেওয়া বা বদলে দেওয়া সম্ভব না। তাই একে কোনওভাবেই ‘হ্যাক’ করা যায় না।
ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির আপত্তি তো আজকের নয়। ২০১৭ সালের শুরু দিকেও একবার এদেশের ষোলোটি রাজনৈতিক দল একযোগে নির্বাচন কমিশনের কাছে লিখিতভাবে ইভিএমের কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ ব্যক্ত করে সাবেক ব্যালট-ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার দাবি জানিয়েছিল। তৎকালীন ইলেকশন কমিশনার নসিম জৈদ পালটা আয়োজন করেছিলেন ‘ইভিএম হ্যাকাথন’। ওই বছর ৩ জুন থেকে টানা সাতদিন দিল্লির অশোক রোডে অবস্থিত কমিশনের সদর দপ্তরে প্রকাশ্যে একাধিক ইভিএম রেখে দেওয়া হয় এবং তাদের মধ্যে যেকোনও একটিকে ‘হ্যাক’ করে তার ভিতরকার তথ্য (ডেটা) মুছে দেওয়া বা বদলে দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলিকে ‘ওপেন চ্যালেঞ্জ’ দেওয়া হয়। বলা বাহুল্য, কোনও রাজনৈতিক দলের তরফে কোনও সাইবার বিশেষজ্ঞ, হ্যাকার বা ইলেকট্রনিক্সের ইঞ্জিনিয়ার সেই চ্যালেঞ্জ নিতে হাজির হননি।
‘হ্যাক’ না হয় না-ই করা গেল, কিন্তু যন্ত্রটির ‘প্রোগ্রামিং’-এর সময়ই কি আগাম কিছু কারিকুরি করে রাখা যায় না? হ্যাঁ, তা অবিশ্যি যায়। তবে সেরকম কিছু করা হয়ে থাকলে যাতে শুরুতেই তা ধরা পড়ে, তার জন্যও ‘মক পোল’ নামের একটা মোক্ষম ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিনিধিদের প্রত্যক্ষ উপস্থিতিতে এই ‘মক পোল’ বা ‘নকল ভোট’ নেওয়া হয় একবার নয়, দুবার। প্রথমবার হয় কমিশনের ঘরে, ইভিএম প্রোগ্রামিং-এর সময়। আর দ্বিতীয়বার হয় ভোটের দিন, নির্দিষ্ট বুথে, ভোটগ্রহণ শুরুর একঘণ্টা আগে। সেসময় প্রতিটা ইভিএমে কমপক্ষে পঞ্চাশটি ভোট দিয়ে তার ফলাফল মিলিয়ে দেখা হয়। ‘মক পোল’ ঠিকঠাক হয়েছে– এজেন্টদের কাছ থেকে এই মর্মে লিখিত প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেলে তবেই আসল ভোট শুরু হয়। কাজেই বোঝাই যাচ্ছে, প্রোগ্রামিং-এ কোনও রকম কারচুপি বা ত্রুটি থাকলে দু-দুবার মকপোলের পর তা ধরা পড়তে বাধ্য।
ভোটগ্রহণ এবং গণনার মধ্যবর্তী পর্বে ইভিএমের সুরক্ষার বিষয়টিও বিস্তারিত বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। অনেকেই হয়তো জানেন না, প্রতিটা ইভিএমে আসলে দুটি অংশ থাকে। আপনি ভোটিং কম্পার্টমেন্টের ভিতরে গিয়ে যে যন্ত্রটিতে বোতাম টিপছেন– সেটা ‘ব্যালট ইউনিট’। আর আপনার প্রদত্ত ভোট এসে জমা পড়ছে টেবিলে বসে থাকা ভোটকর্মীর সামনে রাখা ‘কন্ট্রোল ইউনিট’-এ। এই কন্ট্রোল ইউনিটের ‘রেজাল্ট’ বোতামটি টিপেই ‘ভোটের ফল’ বার করে আনা হয়। এই যন্ত্রটির বোতামগুলি দুটো ঢাকনার ভিতর আলাদা আলাদা কম্পার্টমেন্টে থাকে। ভোট শুরুর আগে প্রতিটি বুথে এজেন্টদের সামনে সেই ঢাকনা দুটিকে দুটি পাতলা কাগজের ফালি দিয়ে ‘সিল’ করা হয়। কাগজদুটির নাম যথাক্রমে ‘পেপার সিল’ এবং ‘স্ট্রিপ সিল’। ওই কাগজদুটিকে না ছিঁড়ে কোনওভাবেই মেশিনের ঢাকনাদুটো খোলা সম্ভব হয় না। ওই কাগজদুটিতে একটি করে ‘ইউনিক আই-ডি’ নম্বর থাকে। তাছাড়া প্রিসাইডিং অফিসার সহ প্রতিটি রাজনৈতিক দলের এজেন্টরা তাতে সই করেন। গণনার দিনে সবার আগে ওই কাগজদুটির আইডি নম্বর এবং উক্ত সইগুলি মিলিয়ে দেখে নেওয়া হয়। উক্ত ‘পেপার সিল’ দুটি অক্ষত এবং অপরিবর্তিত থাকার অর্থই হল ইভিএমে মজুত ভোটও একশো ভাগ সুরক্ষিত।
এত খুঁটিনাটি ব্যাপার আমজনতার জানার কথা নয়। তাই তাদের বিভ্রান্তি স্বাভাবিক। কিন্তু প্রতিবার ভোটের আগে রীতিমত ক্যাম্প করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীদের এ সব বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও এই যে পুনঃপুনঃ ব্যালটে প্রত্যাবর্তনে জিগির, তার পিছনে আসল কারণটা সম্ভবত এই যে, টাকা বা পেশিশক্তির জোরে ইভিএমের ফলাফলকে কোনওভাবেই বদলে দেওয়া যায় যায় না। কিন্তু ব্যালট পেপারে নির্বাচন হলে গণনার কাজটি যন্ত্র নয়, মানুষ করে। এবং কে না জানে, যন্ত্রের চেয়ে মানুষকে ‘বাইরে থেকে’ নিয়ন্ত্রণ করা অনেক বেশি সহজ। দুর্জনে বলে, বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিভিন্ন গণনাকেন্দ্রে তার প্রচুর নমুনা দেখা গিয়েছিল।
একথা ঠিক যে, উন্নত বিশ্বের একাধিক দেশে কিছুদিনের জন্য ইভিএম চালু হলেও পরে তারা ব্যালট-নির্ভর ব্যবস্থাতেই ফিরে গেছে। কিন্তু জনসংখ্যা, রাষ্ট্রীয় চরিত্র, রাষ্ট্র-ব্যবস্থার প্রতি মানুষের বিশ্বাস– কোনওদিক থেকেই সেসব দেশের সঙ্গে ভারতের তুলনা চলে না। যেমন নেদারল্যান্ডে ইভিএম তৈরি হত একটি বেসরকারি কোম্পানিকে বরাত দিয়ে। সেদেশের সরকার এত স্পর্শকাতর একটি বিষয়ে বেসরকারি কোম্পানির অন্তর্ভূক্তি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করায় ব্যবস্থাটি বাতিল হয়ে যায়। আমাদের দেশে কিন্তু ইভিএম তৈরির দায়িত্বে রয়েছে দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। প্রায় নোট ছাপার মত নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা-বলয়ের ভিতর আমাদের দেশে ইভিএম তৈরি আর প্রোগ্রামিং করা হয়।
নির্বাচন কমিশনের অন্যান্য অনেক আচরণ নিয়ে সন্দেহ জাগতেই পারে, উঠতে পারে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগও। কিন্তু ইভিএম নিয়ে এই অনর্থক কাজিয়া একেবারেই অভিপ্রেত নয়। মনে রাখা দরকার, এদেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দলই কখনও না কখনও ইভিএম-মারফৎ বিপুল জয় হাসিল করেছেন। কাজেই হেরে গেলেই ইভিএমের দিকে আঙুল তোলার এই পলায়নবাদী প্রবণতা এবার বন্ধ হোক।
বরং ভরসা থাকুক ইভিএম এবং ভিভিপ্যাটে, ভরসা থাকুক ভারতীয় গণতন্ত্রের সাবালকত্বে।