সুমন সেনগুপ্ত
নির্বাচনের ফল আমাদের কাছে চলে এসেছে। জনাদেশের কোনও সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ জানা নেই। তাই বলতে হচ্ছে যে ভারতের নাগরিকেরা জনাদেশ দিয়ে দিয়েছেন। প্রায় ৩০০র উপর সিট নিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় এসেছেন নরেন্দ্র মোদি। বিরোধীরা কেউ কেউ ইভিএম নিয়ে প্রশ্ন তুললেও কেউ জোরের সঙ্গে বলতে পারছেন না এটা কীভাবে সম্ভব হল? অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন মাত্র ৩ মাস আগে যে ৩টি রাজ্য বিজেপির হাতছাড়া হয়েছে সেই জায়গাগুলোতে এই ফলাফল কীকরে সম্ভব হল? তাহলে কি অন্য কিছু সমস্যা? তাহলে কি বিরোধী পক্ষ বুঝতে পারেনি যে এই পরিমাণ উগ্র জাতীয়তাবোধ তলে তলে প্রায় সমস্ত মানুষের মধ্যে বিগত ৫ বছরে ঢোকানো হয়েছে? নাকি এর শিকড় আরও গভীরে প্রোথিত হয়ে আছে? সেই অনুসন্ধান করাটা জরুরি।
আর কেউ বুঝতে পারুক বা না পারুক, দুজন মানুষ খুব ভালো করে জানেন কী সুনিপুণ দক্ষতায় এই প্রচারটা চালানো হয়েছে, যার মধ্যে কখনও একবারও উন্নয়নের কথা আসেনি, চাকরির কথা আসেনি, কৃষক আত্মহত্যা বা শ্রমিক অসন্তোষের কথা আসেনি। খুব সচেতনভাবে একটা ধারণা বেশিরভাগ নাগরিকদের মধ্যে প্রবেশ করানো গেছে যে মুসলমানেরা প্রচুর পরিমাণে বেড়ে গেছে এবং হিন্দুরা প্রচুর বিপদে আছে এবং নরেন্দ্র মোদির মতো একজন শক্তপোক্ত নেতার প্রয়োজন যে মুসলমানদের শায়েস্তা করতে পারে এবং সন্ত্রাসবাদীদের মোকাবিলা করতে পারবে। চারিদিকে ফলাফলের পরেও এখনও একই আলোচনা শোনা যাচ্ছে যে কই খিদিরপুরে তো হেলমেট নিয়ে এত কড়াকড়ি করা হয় না? কেন মুসলমানদের তোয়াজ করা হয়েছে? তাহলে কি এটা বলা যায় যে হিন্দু মননটা কোথাও অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে? যে হিন্দু মননে চিরকাল অন্য ধর্মের প্রতি কোনও ঘৃণা বিদ্বেষ ছিল না সেই হিন্দু মননটাকেও এঁরা নিজেদের মতো করে প্রভাবিত করে ফেলতে পেরেছেন? না হলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ‘সাধনা’ করছেন কেদারনাথে সেটা ক্যামেরাবন্দি করে সারা ভারতের মানুষের কাছে দেখানোর মধ্যে দিয়ে কী প্রমাণ করতে চাওয়া হল? মানুষও সেগুলো বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। মানুষের মন এতটাই ফাঁপা হয়ে গেছে যে তাঁরাও এই ‘সাধনা’-কে মনে করতে শুরু করেছেন যে এটাই হয়তো ধার্মিক যাত্রা। যে মানুষটির মন প্রধানমন্ত্রীর নোটবন্দি এবং জিএসটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল সেই মানুষটির মননও কি তবে হিন্দু হয়ে গেছে? যে বাঙালিটির বিদ্যাসাগর নিয়ে, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বা বাংলার অন্যান্য মনীষীদের নিয়ে গর্ব ছিল সেই মানুষটিও কি তবে মননে হিন্দু ছিলেন? সেই মানুষটিও কি তবে প্রথম থেকেই মুসলমানদের ঘৃণা করতেন? তবে কি বাংলার হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতি এই শব্দটির কোনও অস্তিত্বই ছিল না? আমরা যারা এতদিন শুধু সম্প্রীতির কথা বলে গেছি তা কি সম্পূর্ণ মিথ্যে? আমরা যারা আসামে নাগরিকপঞ্জী এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের নামে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষদের বাদ যাওয়ার কথা বলেছি তার কি কোনও মূল্য নেই?
নির্বাচন কমিশন এবং মোদি
২০১৯ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারী কাশ্মিরী পুলওয়ামাতে যে ৪৪ জন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মানুষ মারা গেলেন জঙ্গিদের হাতে সেটাকে প্রচারে নিয়ে আসেন মোদি। এতটাই নীচে নামিয়ে আনেন নিজেকে যে বিভিন্ন নির্বাচনী সভায় প্রায় কান্নাকাটি করে তাঁদের নামে ভোট চাইতে থাকেন। বলেন যে মোদি যদি না জেতে, তাহলে সন্ত্রাসবাদ মাথা চাড়া দেবে আর তাহলে দেশের দুর্দিন আসবে। বিরোধীরা বারংবার এই বিষয়ে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানালেও নির্বাচন কমিশন দেখেও না দেখার ভান করলেন বা শুনেও না শোনার ভান করলেন। শুরু হল নতুন একটা প্রচার ‘আমিও চৌকিদার’। নরেন্দ্র মোদি সহ মন্ত্রীসভার সমস্ত সদস্যেরা মোদির সঙ্গে সঙ্গে নিজেদেরকেও চৌকিদার বলা শুরু করলেন। এই প্রচার ধীরে নয় দ্রুতগতিতে সমাজের শেষতম মানুষটির কাছে পৌঁছনোর জন্য যা করণীয় তাই করেছেন। অথচ বিরোধী দলেরা এই বিষয়ে কীভাবে প্রতি আক্রমণ করবেন সে সম্পর্কেই দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন। মোদিকে প্রশ্ন করলে দেশজোড়া চৌকিদারেরা উল্টে তাঁদের দিকেই আঙুল তোলা শুরু করেছিলেন– দেশ এখন আক্রান্ত। এখন প্রশ্ন করা যাবে না, প্রশ্ন করলেই সে দেশদ্রোহী। নির্বাচন কমিশন চোখ বুজে থাকার ফলে মোদি এবং শাহ আরও একধাপ এগিয়ে সাধ্বী প্রজ্ঞা, যিনি নিজে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে অভিযুক্ত তাঁকেই মধ্যপ্রদেশের ভুপাল থেকে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করানোর কথা ঘোষণা করে দেন। শুধু তাই নয় কংগ্রেসের তরফে রাহুল গান্ধি যখন কেরলের ওয়েনার কেন্দ্র থেকে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন তখন সেটাকে নিয়ে মোদি প্রশ্ন তোলেন, যে জায়গায় সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখান থেকে কেন এই দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত? নির্বাচন কমিশন তখনও চুপ করে থাকেন আর মোদির পেটোয়া মিডিয়া আরও বেশি করে মোদির এই ভাষণ সারা দেশ জুড়ে প্রচার করতে থাকেন। অসম থেকে বাংলা হয়ে উত্তরপ্রদেশের কোণায় কোণায় এই প্রচার পোঁছে যায় যে কংগ্রেস সংখ্যালঘু তোষণকারী এবং একমাত্র মোদিই পারেন এই মুসলমানদের বাড়বাড়ন্ত থেকে হিন্দুদের মুক্তি দিতে। ফলত রুটি রুজির প্রশ্ন থেকে বেকারত্ব, কিংবা জিএসটি-তে ছোট ব্যবসার ক্ষতি কিংবা আধারের ফলে মানুষের ভোগান্তি এবং মৃত্যু যেগুলো নির্বাচনী লড়াইতে আলোচিত হওয়ার কথা ছিল তা ক্রমশ পিছনের দিকে চলে গেছে। তার পরিবর্তে সামনে এসেছে দেশের নিরাপত্তা এবং শক্তিশালী সরকারের বিষয়টি। যেহেতু নির্বাচন কমিশনও এই বিষয়ে কোনও নির্দেশ জারি করেনি বা বলা ভালো করতে চায়নি তাই বিরোধীরা এই বিষয়গুলিকে সামনে আনার চেষ্টা করলেও অন্য দিকের উগ্র দেশপ্রেমের আড়ালে এই প্রশ্নগুলো চাপা পড়ে গেছে। নির্বাচনের প্রাক্কালে বিভিন্ন জায়গা থেকে এটা শোনা গেছেও যে অনেকাংশেই হয়তো মোদি অসফল, কিন্তু তাও আরও একবার ওঁকে সুযোগ দেওয়া উচিত। যেহেতু এর বিপরীতে কোনও সমতুল্য শক্তিকে পাওয়া যায়নি যিনি মোদির সমকক্ষ হতে পারেন। কিংবা অন্য সব দলের মানুষ বা নেতারা চোর কিন্তু মোদি নিজে তো সৎ। এই সমস্ত বিষয়গুলোকে যদি ধরা যায় তাহলে দেখা যাবে যে শুধুমাত্র ঘৃণা ও বিদ্বেষের জন্য কিন্তু নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসেননি এর সঙ্গে আরও কিছু বিষয় যুক্ত হয়েছে।
মোদির জয়ের প্রধান কয়েকটি কারণ
প্রচুর পরিমাণে টাকা খরচ করা হয়েছে বিজেপির পক্ষ থেকে। নির্বাচন কমিশনের আইন অনুযায়ী এক একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ৭০ লক্ষ টাকা অবধি খরচ করতে পারবেন। অথচ বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা গেছে যে প্রায় ৩৫০০ কোটি টাকা বিভিন্ন সময়ে বিজেপি কর্মীদের থেকে আটক করা হয়েছে। মানুষ কিন্তু তখনও প্রশ্ন করেননি যে তাহলে এগুলো কি কালো টাকা না সাদা টাকা? নোটবন্দিতে যে বলা হয়েছিল কালো টাকা ধরা পড়বে তাহলে এই টাকাগুলো কী? তাঁরা কিন্তু সারদা, নারদা, রাজীবকুমারের গ্রেপ্তারি ইত্যাদি মুখরোচক গল্পে মেতে থেকেছে বা বলা ভালো তাঁকে মাতিয়ে রাখা হয়েছে। যে মানুষ ব্যক্তিগতভাবে অসৎ সেও নেতানেত্রীদের এই টাকা নেওয়া নিয়ে প্রশ্ন করেছেন। তাঁকে এই ভুলিয়ে রাখার জন্য যে দায়ী সে হল মিডিয়া। মোদিকে জেতানোর অন্যতম কারিগর বা কারণ হিসেবে মিডিয়াকে কি দায়ী বলা যায় না? যে মিডিয়া সর্বক্ষণ একজন মানুষকে দেখিয়ে গেছেন উনি মহান, উনি ভুল করতে পারেন না। যে মিডিয়া সর্বক্ষণ আপনার কানের কাছে একটা মানুষের সম্পর্কে প্রচার করতে থাকে তাকে কি আদৌ গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা যায় নাকি তাকে সরকারের প্রচার মাধ্যম বলা উচিত? এর বাইরে গিয়ে যারা কথা বলতে গেছেন সেই সাংবাদিকদের হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে এবং তাঁদের নামে মিথ্যে মামলা অবধি দায়ের হয়েছে। মোদির মন্ত্রীসভার প্রায় সমস্ত সদস্যেরা চূড়ান্ত মিথ্যাচার করে গেছেন কিন্তু কোনও সাংবাদিককে পাওয়া যায়নি যিনি এই বিষয়ে প্রশ্ন করবেন। এর বিপরীতে বিরোধীরা চেষ্টা করেছেন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার করতে সেখানেও তাঁরা পরাজিত হয়েছেন কারণ সংখ্যার দিক থেকে বলুন কিংবা ফেসবুকের নিয়মে বলুন বা অন্য যেকোনও কারণেই হোক, বিরোধীদের করা প্রচার চাপা পড়ে গেছে। মিথ্যেগুলো এত বড় করে বলা হয়েছে যে তার অনুপাতে সত্যিটা চাপা পড়ে গেছে। এর পাশাপাশি নীচের তলায় স্বয়ংসেবক সংগঠনের উপস্থিতি বিজেপিকে আরও ভালোভাবে সহায়তা করেছে। সরকারি স্তরের সুবিধা কোন মানুষের কাছে কী কীভাবে পৌঁছেছে এটা যদি কোনও একটি রাজনৈতিক দলের কাছে থাকে তাহলে সেই মানুষটিকে প্রভাবিত করা কি খুব বেশি কঠিন কাজ?
অতঃকিম?
পরিস্থিতি কি আদৌ বদলাবে? বিরোধীরা কি সংগঠিত হতে পারবে? এগুলো সব সময় বলবে। কিন্তু ভারতবর্ষের রাজনৈতিক মানচিত্রের দিকে যদি তাকানো যায় তাহলে দেখা যাবে প্রায় পুরো মানচিত্রটা গেরুয়া হয়ে গেছে। যে মানচিত্রের মধ্যে শুধু জল জমি জঙ্গল নয় মানুষেরাও থাকেন যারা দুহাত তুলে ‘আরও একবার মোদি সরকার’ এই স্লোগানে গলা মিলিয়েছে। বাংলার ক্ষেত্রে বলা যায় যে মানুষেরা এতদিন ঘরের মধ্যে নিজেদের বিশ্বাস যাপন করেছেন তাঁরাও হঠাৎ বেশ জোর গলায় ‘জয় শ্রীরাম’ বলা শুরু করেছেন। তার জন্য হয়তো অধুনা রাজ্য সরকারের ভ্রান্ত মুসলমান নীতিই দায়ী। যে নীতি মুসলমান মানুষকে সমাজে পাশাপাশি স্থান দেওয়ার বদলে করুণা করতে শেখায় কিন্তু তাও হঠাৎ করে সম্পূর্ণ গোবলয়ের সংস্কৃতিকে আপন করার মধ্যে দিয়ে কী পাচ্ছে তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ বাঙালি? তাহলে কি বলতে হয় বাঙালি নিজের ভাষা, সংস্কৃতিকে বিসর্জন দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলই যা সমাজবিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেননি? যে শহর একসময়ে বলেছিল ‘তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম’ কিংবা ১ দশক আগেও যে শহর উচ্চগ্রামে রাস্তায় নেমেছিল এই বলে যে ‘লড়াইয়ের আরেক নাম সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রাম’ সেই শহরটা কি এত বদলে গেছে যে তাঁরা একে অপরকে ফোনে সম্ভাষণ করছে ‘জয় শ্রীরাম’ বলে? রাস্তায় দেখা হলে ওই বলেই সম্বোধন করছেন? শহরটা কি এত তাড়াতাড়ি বদলে গেল?
সময় খুব দ্রুত পাল্টায় হয়তো এই দমবন্ধ করা উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধেও মানুষ কথা বলবেন, হয়তো বা আমার শহরেও কিছু মানুষ এখনও বলছেন না যে সংসদে সাধ্বী প্রজ্ঞার মতো সন্ত্রাসবাদীরা জায়গা পায়, যে সংসদে আখলাখ, পেহেলু খানদের হত্যার সমর্থনকারীরা একসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর পাশে বসেন সেই সাংসদেরা আমার সাংসদ নয়। কিন্তু সেই সংখ্যাটা খুব নগণ্য। তবে এটুকু আশা করা কি খুব অন্যায় হবে গত ৫ বছরের রেকর্ড দেখে এই সংখ্যাটা শীঘ্রই বাড়বে।
‘কার তাতে কী, আমরা যদি এই আকালেও স্বপ্ন দেখি’!
স্বপ্ন দেখার মতো আপনার লেখা থেকে কিছু পেলাম না, সুমন! বরং যেভাবে মানুষকে কাঠগড়ায় তুললেন গোটা লেখায়, রাজ্য সরকারের মুসলমান নীতি (তোষণ বলেননি, ভাগ্যিস!!)-র কথা তুললেন… তাতে আপনিও কতটা স্বপ্ন দেখতে পারছেন, সে বিষয়ে সংশয় তৈরি হল… 🙂