চার নম্বর নিউজডেস্ক
দমদম ক্যান্টনমেন্ট। স্টেশন। অফিস যাওয়া, আসা, পূতিগন্ধ, ব্যস্ততা, সবজি-বাজার— এসবের মাঝে বছর ছাব্বিশের পথিকৃৎ সাহা। নামটুকুই। তখনও ‘রোলকাকু’ হননি। কে ‘রোলকাকু’? পথিকৃৎই বা কে? গল্পটা শুরু করি। ক্যান্টনমেন্টে একদিন সকালে পথিকৃতের পা আঁকড়ে ধরল একটি ছেলে। নেশাতুর। মদ্যপ। পথিকৃৎ বোঝালেন। বকলেন। একসময়ে হাল ছেড়ে একটি সটান থাপ্পড়। লাভ? সেরকম কিছুই হয়নি। পথিকৃৎ অবশ্য নিজের কাছে তৃপ্ত হলেন। কী হত একটি পয়সা ছুড়লে? ড্রাগ। মদ। এইসব। ছেলেটিকে আরেকটু অন্ধকারের দিকে টানত। তার চেয়ে কারণটা বোঝা দরকার। সাহায্য শুধুমাত্র কিছু পয়সা দিয়ে হয় না। ছেলেগুলোকে জোগাড় করলেন। সন্ধেয় স্টেশনে ফ্রিতে ক্লাস। পড়াশুনো। পরিবারের অবস্থা শোনা। জানা, আসলে কী অবস্থার মধ্যে দিয়ে ওদের সারা দিন, রাত। কাজ, অবলম্বন, চাকরি। ওদের চাকরি দরকার। তারও আগে শিক্ষা। নিয়ম করে সন্ধের দিকে রাস্তার ছেলেমেয়েগুলোকে ফ্রিতেই পড়ালেন। সে ক্লাস এখনও ছাড়েননি পথিকৃৎ। তার পাশাপাশি জুস, মিনারেল ওয়াটার-এর দোকান খুলে ওদের বসালেন। একটা স্টেডি ইনকাম। পথিকৃৎ জানেন, কোনও মহৎ দান না, ভিক্ষে না, একমাত্র স্থায়ী রোজগারই ওদের আলো দেবে।
কিন্তু, জল বয়ে চলে অন্য দিকে। পাশে দাঁড়ানোর কত আলো, কত রং, কত দিক। পথিকৃৎ নিজে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনে ছিলেন। ছেলেমেয়েগুলোর পাশে দাঁড়াতে গেলে সময় দরকার। চাকরি ছাড়লেন। কিন্তু নিজের বাড়ি? পরিবার? অর্থ? একটা সময় আর পারলেন না। জোম্যাটোর ডেলিভারি বয়ের চাকরি নিলেন। ব্যস্ত কলকাতাকে খাবার খাওয়াতে বাধ্য হলেন। একঘেয়ে জীবন। তবু, এর মধ্যেই অন্যরকম পথিকৃৎ। দমদমের একটি রেস্তোরাঁ মালিকের সঙ্গে আলাপ হল। আরও আলো পেলেন। সেখান থেকে জোমাটোর ক্যান্সেল অর্ডার পথিকৃৎ নিজে না নিয়ে কিংবা রেস্তোরাঁ মালিক সেইসব খাবার ফেলে না দিয়ে পথিকৃৎকে দিলেন। আর পথিকৃৎ সেইসব খাবার রাস্তার ছেলেমেয়েদের। ওদের মুখে খাবার, খাবার থেকে আলো, শিক্ষা, চাকরি, বেঁচে থাকা, ভারতবর্ষ। পথিকৃৎ জানেন এক এক করে এইটুকুও অনেক।
জোমাটো অ্যাপ। কিছু বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে নষ্ট হয়ে যাওয়া খাবার যা তখনও সতেজ আছে, কিংবা কাস্টমার কেয়ার থেকে ফোন আসা বাতিল খাবার একটা সময়ে ডেলিভারির ছেলেরা নিজেরাও পরিবারের জন্য নিয়ে যেত। অন্তত, খাবার তৈরির পর যে সমস্ত আইটেম ডেলিভারির ছেলেদের কাছে চলে যেত, সেগুলিই বিশেষত। এগ রোল, চিকেন রোল, বিরিয়ানি। রাস্তার ছেলেমেয়েদের মুখে অমৃত সমান। পথিকৃৎ অন্যান্য ডেলিভারি বয়ের মতো সেইসব নিতেন না। নেন না। ওদের দেন। আর তাই, দমদম ক্যান্টনমেন্টের পথিকৃৎ সাহা ওদের ‘রোলকাকু’। পথিকৃৎকে দেখে এখন অনেকেই ডেলিভারি বয় এই রাস্তায় হাঁটছেন। স্টেশনের সন্ধের ক্লাসে চলছে পড়াশুনো, খাওয়া, শিক্ষা। কখনও ওদের নিয়ে পিকনিক। পথিকৃতের ছাত্রছাত্রীরা। ওদের মধ্যে এখনও অবধি ২১ জন সরকারি স্কুলেও ভর্তি হচ্ছে। সাহস দেখাচ্ছেন স্যার। ওদের ‘রোলকাকু’। বাকিদের রোলমডেল। জোমাটো অ্যাপের পক্ষ থেকেও পথিকৃতের পাশে থাকার অঙ্গীকার এসেছে। এই আশাকে ভরসা করেই আর কোনও খাবার ফেলা যাচ্ছে না। বাচ্চাগুলো খেতে পাচ্ছে।
অটো ইউনিয়নের লোকেরা পাশে দাঁড়িয়েছেন। ট্রেনের শব্দের ভেতর পড়াশুনো? ইউনিয়নের অফিস ব্যালকনিটা ওদের জন্য পাওয়া গেল। আলোও।
পথিকৃতের বেসরকারি সংস্থা ‘হেল্প ফাউন্ডেশন’ এনজিও হিসেবে অফিসিয়াল রেজিস্ট্রেশন পেয়েছে। ওরা কাজটাকে বড় করছে। পাশে এক এক করে এলাকার সাধারণ মানুষ। দমদম থেকে বেরিয়ে শহর, জেলা, রাজ্য। স্বপ্নটাকে ছড়াতে হবে যে। অর্থ দরকার। পথিকৃৎ আবেদন করছেন।
পর্দার এক্কেবারে এদিকে আমরা অন্তত কিছু চেষ্টা করতেই পারি। যারা দমদমের কাছাকাছি থাকেন, যোগাযোগ করতে পারেন হেল্প ফাউন্ডেশনের সঙ্গে। ছেলেমেয়েগুলোর বই, খাতা, পেন— সাহায্য। পথিকৃৎকে কিছু আর্থিক যোগাযোগের রাস্তা দেখানো। ছোট ছোট ব্যক্তিগত সাহায্য। এইসব। ছোট হলেও প্রকৃত ভারতবর্ষ। পাশে দাঁড়ানোর ভারতবর্ষ। গড়া যায় না?
পথিকৃৎ বা তাঁর সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ফোন নম্বর: ৯৮০৪৭৮৮৪০৬ অথবা ৯১২৩৩৪৮৩০১।