মধুময় পাল
লোকটাকে খুবই চেনা মনে হচ্ছিল বিহানের। এতদূর থেকেও, রাধাচূড়া কদম্বের মায়া পেরিয়ে, এই রাত্রির আবছায়ায় আনমনায় লোকটার প্রসরমান কপাল সে চিনে নিতে পারে। না দেখেও বলে দিতে পারে, তার জোড়া ভুরুর নিচে কবেকার বাতিল স্বপ্নের মতো পুরাবস্তুর চোখ, মোটা নাক, পুরু ঠোঁট, ভোঁতা চিবুক। এসব দিয়ে কাউকে চেনা যায় না। আসলে কিছু চিহ্ন। চিহ্ন চিনে রাখা এবং চিহ্ন দিয়ে চেনা। কোনও কোনও চিহ্নে হয়তো নৃতত্ত্ব, শ্রুতি সেইসব থাকে, বিহান অতশত বোঝে না। জানালায় পা ঝুলিয়ে বসে সে লোকটাকে দেখছিল। লোকটার সঙ্গে কোনও কোনও দিন দেখা হয় তার। দেখা হলে হয়তো কথা হয়। কথা হলে হয়তো দুঃখ হয়। দুঃখ হলে হয়তো আনন্দ হয়। মনে হয়, দেখা না হলেই ভালো হত। আর যেন কোনওদিন দেখা না হয়। তবু দেখা হয়ে যায়। দেখা হলে কথা হয়। কথা হলে দুঃখ হয়। দুঃখ হলে আনন্দ হয়। লোকটা চলে যায়। বিহান ভুলে যেতে চায়। কিছু কিছু চিহ্ন লেগে থাকে। আয়নায় দেখা নিজেরই শরীরের চিহ্নের মতো সেসব। নিজেকে তার চেয়ে বেশি চেনে কি বিহান? চিনলেও ভুলে যেতে চায়। সে-চেনা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
সব কটা শিক খুইয়ে জানলাটা কবেই যে ফোকলা হয়ে গেছে। তবু বিহানের কাছে কোনও প্রাচীন রাত্রির কন্যার মুখের মতো এ জানলা। এ মুখের ভেতর শরীর ঢুকে যেতে চায় সেই ছেলেবেলা থেকেই। জানালায় উঠে শরীরটা একবার গলিয়ে দিতে পারলেই কী আরাম, কী বাতাস, কী গরম, কী ঠান্ডা, কী বন্য মদিরতা ঘুরে ঘুরে মাথার ভেতর ছড়িয়ে যায়। মা চিৎকার করতেন, খোকা পড়ে যাবি। ইটগুলো নড়বড়ে। পড়লে কেউ বাঁচাতে পারবে না। দেখিস, তোর বাবা এলে আজ যদি না বলি। ওগো শুনছ, খোকাকে ওই জানালায় উঠতে বারণ করো তো। আমার কথা একদম শোনে না। মড়াখেকো জানালাটা বন্ধ করে দিলেই হয়। আমার কোল খালি করার জন্য হাঁ করে আছে। মা আর কোনওদিন নিষেধ করতে আসবেন না। বাবাও আর কোনওদিন শাসন করতে আসবেন না। পিসিদের তখনও বিয়ে হয়নি, নিজেরা বলাবলি করত, বিহু একটা আস্ত শয়তান। এই বয়সেই যা চড়াও ভাব, বড় হয়ে খুব জ্বালাবে। বিহান বলার চেষ্টা করত, ওই জানালায় আমি ভালো থাকি। মা একবার জহির মিস্ত্রিকে অনেক বলেকয়ে রাজি করিয়েছিলেন। মুর্শিদাবাদের শেখ জহির তখন খুচরো কাজ বন্ধই করে দিয়েছেন। চারদিকে তখন পুকুর জলা বুজিয়ে, গাছপালা প্রতিবাদী মানুষ খুন করে পেল্লায় পেল্লায় বহুতল হচ্ছে। বাস্তুযজ্ঞ হচ্ছে কোটি কোটি টাকার। জহির মিস্ত্রি দারুণ ব্যস্ত। তিন-চারটে কনস্ট্রাকশনের লেবার কন্ট্রাক্ট হাতে। মেহেন্দি-করা আবক্ষ প্রলম্বিত দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে মাকে বলেছিলেন, আপনি বললে আমি কী করে না করি। এই বাড়ি তো আমার প্রাইমারি ইস্কুল। সুধাবাবু ভরসা করে কাজ না দিলে মুর্শিদাবাদের ছোকরা কি আর জহির মিস্ত্রি হত? সুধাবাবু মানে সুধাময় পাল, বিহানের পিতামহ। সেসব বিহানের জন্মের অনেক আগের কথা। বিহানদের অ্যালবামে জহির মিস্ত্রির একটা সাদাকালো ছবি আছে। একবার বিড়লা আকাদেমিতে বিকাশ ভট্টাচার্যের একক প্রদর্শনীতে তেলরঙের একটা কাজ দেখে চমকে গিয়েছিল বিহান। লুঙ্গি পরা ছিপছিপে একটা লোক দুই গ্রামীণ বাঙালিনিকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পায়ের নিচে মোজাইকের পৃথক পৃথক চতুষ্কোণ। এ যে জহির মিস্ত্রির ছবি। একতলার বাইরের ঘরের মেঝে চটিয়ে মোজাইক করার সময়ে বিহানের বাবা জহির ও তার দুই বউকে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলেছিলেন। জানালা দিয়ে আসা দিনের আলোর দারুণ ব্যবহারের নমুনা হিসেবে বাবা ছবিটা অ্যালবামে রেখে দেন। সেই শেখ জহির এখন বেবাক পালটে গেছেন, সিনেমা-নাটকের জোতদারের মতো লাগে। তবে মার অনুরোধ কায়দাবাজির কথা দিয়ে তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি। রোজের কড়ারে এক মিস্ত্রি ও এক জোগাড়ে পাঠিয়েছিলেন। হঠাৎ সেদিন ভোরেই বাবার ধুম জ্বর, অসহ্য মাথা যন্ত্রণা। ভয়ে, উদ্বেগে মা মিস্ত্রিদের ফিরিয়ে দিলেন। সাঙ্ঘাতিক একটা ভুল করতে চলেছিলেন বলে তিনি আক্ষেপ করলেন। হয়তো তার স্বামী মারা যেতে পারতেন, কিংবা খোকা, কিংবা বাড়ির আর কেউ। ঠাকুর করুণাময় যে খোকার বাবাকে শুধু জ্বরে ফেলে সতর্ক করে দিলেন। জানালার ফোকরটা বন্ধ হলে কত বড় সর্বনাশই না হত! মা সত্যনারায়ণ পুজো দিলেন বড় করে। বাবা বললেন, আমরা অন্য কোথাও চলে যাব। বাড়ি খুঁজছি। বাবার মুখে বহুবার একথা শুনেছে বিহান। যাওয়া আর হয়নি। তাঁর বাড়ি খোঁজা কতটা ছলনা ছিল, কতটা অপারগতা, বিহান বিচার করতে চায় না। জানালায় পা ঝুলিয়ে বসে মাথার ভেতর ছড়িয়ে পড়া বন্য মদিরতায় নিজের নিষ্ক্রিয় জিতে যাওয়ার রমণীয় আনন্দ পায়।
লোকটা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে পেট্রল পাম্প। মানুষের ঘরবাড়ির রুচিহীন বোধহীন বিবেকহীন বাড়বৃদ্ধি বা নিরুপায় ঝাড়বৃদ্ধির মধ্যে জায়গাটা লক্ষণীয়ভাবে প্রশস্ত উদার। গরিব-গুর্বো সমাজে ক্যালবেলিয়ে বাড়তে থাকা জনসংখ্যার পার্সেন্টেজের ভেতর একটু নিরালা একটু উদাসীন আশ্রমিক পরিবেশ যেন। বড় হতে হতে কবে যেন এই উপমা বিহান পেয়ে গেছে। হয়তো সমাজবাদের কল্পনালতার পাতা খসার সময় তখন। বিহানের ছোটবেলার চোখে পেট্রল পাম্প ছিল থিয়েটারের মঞ্চ। বাবা যে অফিসে অর্ডার সাপ্লাই করতেন, সেখানকার রিক্রিয়েশন ক্লাব স্টারে কী একটা ঐতিহাসিক নাটক করেছিল। সবাই দারুণ সেজেছিল। বাবাকে তো চেনাই যাচ্ছিল না! অফিসে কাজ না করলেও, লম্বা চওড়া ফর্সা বলে বাবাকে সাহেবের পার্ট দেওয়া হয়। হ্যাট বুট বেল্ট পরে একটা লালমুখো মানুষ উৎকট বাংলায় লাফিয়ে লাফিয়ে তড়পাচ্ছিলেন। মা বললেন, তোমার বাবাকে চিনতে পারছ? একদম সাহেব। বিহান লোকটার সঙ্গে বাবার মিল পায়নি। লাইটে মিউজিকে মেকআপে সব যেন পালটে যায়। পৃথিবীর ভেতর অন্য পৃথিবী নেমে আসে। অবশ্য বিহানের পৃথিবী তখন কতটুকুই বা। সেই পৃথিবীর ভেতর পেট্রল পাম্প ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম, স্টেজের মতন। চারদিক থেকে জোরালো আলো পড়ছে ফাঁকা জায়গাটার ওপর। তারই ভেতর সুন্দর একটা কাচের ঘর। সেখানে নরম আলোয় একটা লোক সেজেগুজে বসে থাকে। বসে বসেই নড়ে চড়ে, চেয়ারে দোল খায়, বই পড়ে। কখনও কখনও কেউ এলে কথা বলে। কখনও বাইরে এসে দাঁড়ায়, যেখানে টবে টবে বাহারি পাতার গাছে বাগান হয়ে আছে। কখনও বাইরের আলোয় পায়চারি করে, যেখানে ছোট ছোট থামে আটকানো মোটা শেকলের টানায় সার সার লাল বালতি ঝুলে আছে। কখনও কখনও মঞ্চের সম্মুখপ্রান্তে রেলিঙের কাছে এসে দাঁড়ায়, যেখান থেকে সে কিলবিল পৃথিবীকে দেখে। মঞ্চের ভেতর গাড়ি ঢোকে, থামে, চলে যায়। নীল উর্দি পরা দুটো লোক সমাধিস্তম্ভের রবারের নলের হাত টেনে এনে গাড়ির নির্দিষ্ট ফুটোয় গুঁজে দেয়। কাজ হয়ে গেলে হাতটা যথাস্থানে ঝুলিয়ে রাখে। গাড়ি না এলে ওরা কাচের ঘরের পাশে বেঞ্চে বসে কথা বলে। এই পার্টটাই তারা তিনজন দিনভর করে যায়। বিহানের মনে হত, কোনও ভোরে উঠে দেখবে সে মঞ্চটা নেই। তার অনেক মনে হওয়ার মতো এটাও মেলেনি। দিব্য আছে পেট্রল পাম্প। শুধু সিঁদুর টিপের মতো কপালের গোল লাল সাইনবোর্ডের লেখা কয়েকবার পাল্টেছে। বিএ পড়ার সময়ে, বাস স্ট্যান্ডে দোলার চোখচোখি হলে বুকটা যখন ধড়াস ধড়াস করে উঠত, কতবার বিহান ভেবেছে, একটি কথা জিজ্ঞেস করবে বলে দোলাকে পেট্রল পাম্পের নিরালায় নীরবতায় ডাকবে। ডাকতে পারেনি। শ্যামার সঙ্গে পেট্রল পাম্পের গা ঘেঁষে রাধাচূড়ার নিচে কয়েক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়েছিল বিহান। বিকট গন্ধে শ্যামার গা গোলায়; বমি করে, ভাঙা ভাত টুকরো সবজি হলুদ লালা জল দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।
পিসিদের তখনও বিয়ে হয়নি, জানালার হাঁ মুখের পাশে গরমের সন্ধ্যায় চেয়ার এনে বসে ট্রানজিস্টর বাজিয়ে তাদের অদ্ভুত বলাবলি বিহানের কানে এসেছে। পল্লীমঙ্গল গোছের আসরে চাষিভাইদের জন্য সার ও বীজের নানাবিধ কথাবার্তা বা তবলা ও হারমোনিয়মের পাড়াটে বাজনে ‘ফুল দলে সে চলে গেল দুলে দুলে’ গোছের গানের ভেতর পিসিদের ভাঙা ভাঙা কথাবার্তা ছিল রহস্যের ঘরবাড়ি: রুমাবৌদি বাবুঘাটে নৌকো চড়ে, বিন্নির বাবা এক বিধবার কাছে যায়, সুদক্ষিণার তালুর চুল ফাঁকা হয়ে গেছে, খুশিদির বর মিতাকে ঝাড়ি করেছে, নেপালদা এখন কাশীর কোবরেজ করছে। বিহান সেইসব ঘরবাড়ির কাছে ছুটে এসে জানতে চেয়েছে। পিসিরা বলত, বড্ড পাকা ছেলে তো! কী দরকার তোমার বড়দের কথায়? স্কুলে গিয়ে বদ হচ্ছে। মা-র কাছে বিহান পিসিদের রহস্যময় কথোপকথন ও বকাঝকা নিয়ে বলে বকুনি খেয়েছে, তুমি দোতলায় যাও কেন? মুখ ব্যথা হয়ে গেছে বারণ করে করে। তবু তুমি যাবে!
এই জানালার হাঁ মুখের পাশে বসে বিহানের বাবা নাটকের মধ্যে থাকতেন। কখনও চড়া পর্দায় আবেগের স্পুটনিকে ভেসে ভেসে দূর কোনও অভিপ্রায়ে চলে যেত দীর্ঘ সংলাপ। কখনও দরদি উচ্চারণে কাছের মানুষের সঙ্গে সুখ-দুঃখ বিনিময় করত। কখনও তীব্র ক্রোধে ফেটে পড়ত। চমকে মা হেসে ফেলতেন, দানীবাবু। মা যে খুব নাটক দেখেছেন তা নয়। তাঁর বাবার কাছে শুনেছেন শিশির ভাদুড়ি, অমরেন্দ্র দত্ত, অহীন্দ্র চৌধুরী, যোগেশ চৌধুরী এইসব নাম। দানীবাবু নামটা মা-র মনে গেঁথে গিয়েছিল। কখনও নিচু স্বরে, ফিসফিসিয়ে, শান দেওয়ার শব্দে বাবা উচ্চারণ করতেন ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র। বিহান ভয় পেত। ষড়যন্ত্রের সাফল্যে বাবা হাসতেন। ক্রূর হাসি, বিস্ফারিত চোখ, শক্ত মুঠোর ভেতর কোনও অস্তিত্বের পিষ্ট হতে থাকা— বিহান এ-দৃশ্য সহ্য করতে পারত না। পালাত। মা-কে বাবা জিজ্ঞাসা করতেন, খোকা কিছু বলেছে আমার অভিনয় সম্পর্কে? মা জবাব দিতেন, ভয়ে পালিয়ে এসেছে। আমারই ভয় করে। ও তো বাচ্চা। এসব কথায় বাবা হয়তো তৃপ্তি পেতেন। তাঁর অভিনয় দর্শকদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে, যেমন তিনি চান, সেটাই তো বিরাট সাফল্য, সেটাই তো একজন অভিনেতার পুরস্কার। বাবা কোথায় অভিনয় করেন, কোন দলে, এমনকী মা-ও জানতেন না। জিজ্ঞেস করলে বাবা জবাব দিতেন না। বিহান বড় হয়েও দেখেছে, ওই জানালার পাশে হাঁটতে হাঁটতে সেই অভিনেতা একা একা বিড়বিড় করছেন। অস্পষ্ট সে-সংলাপ, জড়ানো, যেন নিজেকেই বলছেন, যেন কাউকে শোনানোর আর প্রয়োজন নেই, নেই দর্শকের শ্রোতার প্রতিক্রিয়া জানার কোনও লোভ, সাফল্যের উৎকণ্ঠা নেই, বরং যেন গোপন করতে চান নিজস্ব আনন্দকে, যেন কাউকে ভাগ দেবেন না। বাবা তখন অন্য নাটকে লিপ্ত।
বিহানের বাবা কি পেট্রল পাম্পের রঙ্গমঞ্চ দেখেছিলেন? তিনিও কি এইখান থেকে দেখতেন ওই কাচের ঘর, আলোর পরিধি, গাড়িদের আসাযাওয়া? কাচের ঘরের ভেতর সাজুগুজু করা লোকটাকে? ওই উর্দিপরা দুটি লোককে? তিনি কি প্রতিস্পর্ধায় নিজস্ব মঞ্চ তৈরি করতে চেয়েছিলেন জানালাবর্তী এই পরিসরে? বিহান ভেবে ভেবে জবাব পায়নি, শুধু কিছু অনুমান, কিছু হ্যাঁ, কিছু না।
পেট্রল পাম্পের পাশে, রাধাচূড়ার এপারে, আলোর পরিধির বাইরে ভুষো কম্বলের মতো অন্ধকারে খুবই চেনা চেনা লাগা লোকটা জল ছেড়ে এল। জামা-প্যান্ট ঠিক করে নিল। আলোর সীমানায় দাঁড়িয়ে শরীর টানটান করল। একলাফে ঢুকে পড়ল আলোর ভেতর। মাইকেল জ্যাকসন কি এভাবে হাঁটে? শরীর ভেঙে ভেঙে? আসলে শরীরটা যে সত্যিই ভাঙা, টুকরো টুকরো, রসের জোরে অখণ্ড মনে হয়, সেটা বোঝাতেই হাত পা কোমর কাঁধ গলা মুণ্ডুর বিচ্ছিন্নতা দেখাতে দেখাতে হেঁটে যাওয়া? শরীর ভাঙতে পারলেই যে নতুন ভাষার খোঁজ মেলে সে কথা বোঝাতে এভাবে হাঁটা? নাকি প্রতিবন্ধিতা? ল্যাংড়া হারু হাঁটলে শরীর এভাবে ভেঙে যেত। নাকি সুস্থতার অভ্যন্তরীণ প্রতিবন্ধিতাকে চিহ্নিত করা? উপরের আঁটোসাঁটো সুস্থতাকে উপহাস করা? লোকটা এভাবে হাঁটতে হাঁটতে, এটা যদি নাচ হয়, নাচতে নাচতে পেট্রল পাম্পের রেলিঙের বাইরে, মঞ্চের সম্মুখভাগে বেশ কয়েকবার এ-মাথা ও-মাথা ঘুরে নিল। অসমবেত দর্শকদের প্রণাম জানাল, অভিবাদন গ্রহণ করল। এক প্রান্তে ছুটে গিয়ে দেখল কেউ আসছে কি? একইভাবে অন্য প্রান্তে। যেন কারও আসার কথা রয়েছে। সবাইকেই কারও না কারও জন্য অপেক্ষা করতে হয়, অপেক্ষায় অস্থির হতে হয়। কিন্তু এভাবে কপালে হাত রেখে নজর দূরগামী করতে হয় কি? আসলে এটা চিহ্ন, অপেক্ষার, অপেক্ষার অস্থিরতার। ওয়েটিং ফর গোডো-র বাংলা মঞ্চরূপে আসাদুজ্জামান নূর এভাবে ঈশ্বরবাবুর জন্য অপেক্ষা করেছেন। কেউ আসেনি, লোকটা কী আর করবে ভেবে উবু হয়ে বসে দু’মুঠো বালি তুলে উড়িয়ে দিল। বিহান অবাক, ওখানে বালি থাকার কথা নয়। ওখানে ইট-সিমেন্টের কর্কশ ফুটপাথ। লোকটা বালি ওড়াতে লাগল। বিহান দেখতে থাকল। তার ভালো লাগে। তবে কি সমুদ্র সৈকত? দীঘা, চাঁদিপুর, পুরী, জুহু? বা পাম বিচ বা বিদেশি সিনেমায় গৃহীত সুন্দর সুন্দর সৈকতের ছবি? যেখানে মেয়েরা সুসঙ্গত নিরাবরণে রোদ পোহায়, যেখানে ভলিবল ফুটবল খেলা হয়, যেখানে সমুদ্রের হাওয়া সব সম্পরক্ক কেবলই এলোমেলো করে দেয়, নক্ষত্রের নীল রাতে যুবকযুবতীরা যেখানে গান গায়, গানে গানে কথা কয়, কাঠের আগুনে ঝলসে নেয় মাংস, পানীয় থাকে মাদকতাময়, শ্যাওলা-সবুজ তাঁবুর ভেতর নেমে আসে ঘুম। লোকটা কি সমুদ্র দেখতে পাচ্ছে? ফুলে ওঠা জলের মাথায় তুষার অবগুণ্ঠন, নাকি নিস্তরঙ্গ বিস্তার অনন্ত অবধি? লোকটা পা টেনে টেনে হাঁটতে থাকল, যেন বালিতে তার পা বসে যাচ্ছে। সে মাথা দোলাতে লাগল, যেন সুর পেয়েছে। তালে তালে হাত দোলাতে লাগল, যেন তার ভেতর অর্কেস্ট্রা বসেছে। হয়তো তার মনে পড়েছে বা রক্তের কোষাগার থেকে উঠে এসেছে কোনও সুর, যা এই সমুদ্র শব্দ বাতাস ও রাত্রি ও কারও জন্য অপেক্ষা করার সঙ্গে মানানসই। হয়তো সে নিজেই সুর রচনা করছে, অপেক্ষার সময় সুরের জন্ম হয়। লোকটা শঙ্খচিলের মতো ডানা উড়িয়ে ভাসতে চাইল। তবে কি সে সমুদ্রপাখির গান শুনেছে? আইস স্কেটিংয়ে মেয়েদের একপায়ের ডগায় পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক রেখে ললিত পাখির মতো ভেসে যেতে দেখেছে বিহান। লোকটা ভাসতে পারছে না। নরম বালির মাটি তাকে টানছে। লোকটা কি হাঁপিয়ে গেল? বয়স হয়েছে। এ-বয়সে ফুসফুস কতটা দম নিতে পারে। ইচ্ছের ধকল কতটা নিতে পারে। লোকটা হাঁটু মুড়ে বসে থাকে ক্লান্তির মতন। কার জন্য অপেক্ষা করছে? অপেক্ষার সব লক্ষণ বাঞ্ছিত নারীর আভাস দেয়। কোনও পুরুষ বন্ধুর জন্য স্বাভাবিক পুরুষ এভাবে উদ্বেল হয় না। অবৈধ উপার্জনের সুখ শরীরে একটা আলোড়ন সৃষ্টি করে বটে, তবে তার রকমটা অন্য। আরবসাগরের তীরে অপেক্ষমান মাফিয়াদের হাসি-টাসির ছবি দেখা যায়, সেখানে এই মগ্নতা থাকা সম্ভব নয়। লোকটা কোনও নারীর প্রস্তাব পেয়েছে হয়তো। কিছুক্ষণ পর ক্লান্তি থেকে নাচের ভঙ্গিমায় উঠে দাঁড়ায়। তার হাতের আঙুল, বাহু, গ্রীবা, চিবুক, চোখ ও কোমর, জানু, পা অসংখ্য মুদ্রা ফুটিয়ে তুলতে থাকে। বিহান মুদ্রা চেনে না, অভিব্যক্তির চিহ্ন চেনে না। সে শুধু রূপ গড়ে ওঠা আর ভেঙে যাওয়ার খেলা দেখে। সে অনুমান করতে পারে, কোনও রূপ প্রার্থনার, কোনওটি প্রত্যাখ্যানের। কোনও রূপ পরাক্রমের, কোনওটি পরিতাপের। ছোট বড় দলের শ্যামা চিত্রাঙ্গদার এইসব রূপ বিহান দেখেছে। কিন্তু লোকটা সেইসব প্রাথমিকতা থেকে পর্বে পর্বে এগিয়ে, আলোর সীমান্ত ছেড়ে কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে, পেট্রল পাম্পের সমাধিস্তম্ভ-কাচের ঘর-টবের বাগানের আশ্রমিকতায় কিছু ব্যঞ্জনা মূর্ত করে, মঞ্জুশ্রী-রঞ্জাবতীর কুমারী মাটির কান্নার স্মৃতিতে বিহান প্রদীপ্ত হয়। আশ্চর্য গতি ক্ষিপ্রতা স্থিতি পেলবতা আর্তি আকুলতায় লোকটাকে একাধিক মনে হয় বিহানের। যত দেখে, মুগ্ধ হয়। লোকটা বয়সহীন, বহমান। তার নাচ দেখে একটি রাধাচূড়া ঝরেনি, একটি শ্বেতকরবী উড়ে আসেনি। একটি গাড়ি দাঁড়ায়নি। একটি পুলিশ অন্যমনস্ক হয়নি। একটি জানালা খোলেনি। কোনও কালিদাস কৃত্তিবাস নেমে আসেনি। বিহান দেখে, লোকটা যেন সঙ্গিনী পেয়েছে। তাকে সে জড়িয়ে আছে। সংলগ্ন হয়ে একসঙ্গে পা ফেলছে। ভালোবাসা হলে যেমন হয়, কখনও এ ওর ওপর কখনও ও এর ওপর নেমে আসছে। এ নাচে ততটা রূপ নেই, যতটা জীবন। সহজ। শিশিরের জল আর সুরে হাতে হাত ধরে ঘুরে ঘুরে নাচ। পুরনো ক্ষেতের গন্ধে এইখানে ভরেছে ভাঁড়ার।
বিহান কোনও মানুষীর কোলে মানুষটির মরে যাওয়ার চিহ্ন দেখল।