কৌশিক মজুমদার
গুটিগুটি পায়ে আমরা উঠছি সরু সিঁড়িটা বেয়ে। তলায় ফ্যানটাস্টিক পত্রিকার অফিস। সেখান থেকে দুটি বই কিনেছি সবে। এবার বড় ইচ্ছে আমাদের শৈশব আর কৈশোর গড়ে দেওয়া মানুষটার একখানা সই নেব। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই ডানদিকে দরজা। এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। “বলুন কাকে চাই? বাবা অসুস্থ। দেখা হবে না।” আমরা তখন ঠিক না শুনব আশা করে আসিনি। শুরু হল কাকুতিমিনতি। একটি বার কি পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করা যায় না! জানি না কেন দয়া হল ভদ্রলোকের। গলা নরম হল। “বেশিক্ষণ সময় নেবেন না প্লিজ। ওঁর শরীরটা বড্ড খারাপ।”
ঘরে বড় একটা খাটে বসেছিলেন একমুখ দাড়ি নিয়ে অদ্রীশ বর্ধন। ঠান্ডা লেগেছিল। কাশছিলেন খুব। আসলে সদ্য ডিসেম্বরের সেই ঠান্ডাটা জাঁকিয়ে পড়েছিল সে বছর। ভাঙা গলায় বললেন, “এসো।” হাতের বইদুটো বাড়িয়ে দিলাম। সই করে দিলেন। কানে বোধহয় ঠিকঠাক শুনতে পাচ্ছিলেন না। ছেলে কানের কাছে মুখ নিয়ে কথা বলছিল। আর আমার চোখের সামনে সিনেমার মত ভেসে যাচ্ছিল একের পর এক ছবি।
সেই ছোট্টবেলায় বাবা একটা বই কিনে দিয়েছিল। টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দি সি। জুলে ভার্নের লেখা। অনুবাদকের নামটাও চোখে পড়েছিল। অদ্রীশ বর্ধন। আমি তখন ক্লাস ফোর। তবু সেই অসামান্য ভাষা কেমন করে এক ফরাসি লেখককে রাতারাতি বাঙালি বানিয়েছিল, ভাবা যায় না।
বড় হতে লাগলাম। হাতে এল শার্লক হোমস, প্রফেসর চ্যালেঞ্জার (যার লাল মলাটে বিমল দাসের অপূর্ব ছবি), টারজানের গল্পগুলো। আর এখানেও সেই এক মজা। মনেই হত না কোনও অনুবাদ, এ যেন এক মৌলিক সৃষ্টি। হোমসের গল্পগুলোই ধরা যাক না কেন। কি অদ্ভুত অ্যালিটারেশান তাঁদের নামে— “বোহেমিয়ার কুৎসা কেলেঙ্কারি”, “ছদ্মবেশীর ছলনা”, “বিকলাঙ্গর বিচিত্র উপাখ্যান” এমনি সব। আর অনুবাদও দারুণ মুচমুচে।
কিছু দরকারি কথা বলে নেই এই ফাঁকে। কলকাতায়, এক শিক্ষক পরিবারে, ১৯৩২-এর ১ ডিসেম্বরে তাঁর জন্ম। বাবা অনিল বর্ধন ছিলেন স্কুলশিক্ষক, ঠাকুরদা চণ্ডীচরণ বর্ধন বউবাজারের সার্পেন্টাইন লেনে ‘হিন্দু বয়েজ স্কুল’ নামে একটি বিদ্যালয় চালাতেন। সেই স্কুলেই বিদ্যারম্ভ অদ্রীশের। পরবর্তীকালে পড়াশোনা বিজ্ঞান নিয়ে। ছোটবেলা থেকেই অজানার প্রতি দুর্নিবার টানা। শিব্রাম চক্রবর্তীর ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ পড়ে কুড়ি বছর বয়সেই বোম্বে (মুম্বই) পালালেন তিনি। হরেকরকম চাকরি করে শেষ পর্যন্ত ‘ক্যালকাটা কেমিক্যাল’-এ থিতু হলেন। পোস্টিং ছিল ব্যাঙ্গালোরে। কর্মসূত্রে দক্ষিণ ভারতের নানা জায়গা দেখা। অবসর সময়ে লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। এক জায়গায় আটকে থাকার মানসিকতা ছিল না অদ্রীশের। চাকরি পালটাতে পালটাতে নামী কোম্পানির পারচেজ ম্যানেজার ও ডিরেক্টরের বিশেষ সচিব। শেষ পর্যন্ত সেই চাকরিতেও ইস্তফা দিয়ে কলকাতায় ফিরে এলেন অদ্রীশ। এবার থেকে আর চাকরি নয়, এ বার দেওয়াল পত্রিকা দিয়ে সাহিত্য সাধনা শুরু। লিখলেন ভূতের গল্প ‘পোড়োবাড়ির খাঁড়া’। এর আগেই অবশ্য ‘উল্টোরথ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল গোয়েন্দা গল্প, ‘আমার বান্ধবী সুনন্দা’, বোম্বে থেকে পাঠানো।
বিদেশে তখন সায়েন্স ফিকশনের স্বর্ণযুগ। পাগলের মত পড়তেন সেই সব কাহিনি। বাংলায় অবশ্যি ‘বিজ্ঞানভিত্তিক কাহিনি’র তেমন কদর নেই। অদ্রীশের মাথায় এল বিষয়টা। ষাটের দশকের গোড়াতেই কল্পবিজ্ঞানের গল্প লিখতে শুরু করলেন অদ্রীশ। “ভূতের গল্প যেমন ভূতেদের জন্য নয়, ঠিক তেমনি কল্পবিজ্ঞানও বৈজ্ঞানিকদের জন্য নয়”— এমন আপ্তবাক্য মাথায় রেখেই ১৯৬৩-র জানুয়ারিতে আকাশ সেন ছদ্মনামে অদ্রীশ বর্ধন সূচনা করেন ভারতের প্রথম কল্পবিজ্ঞান পত্রিকা মাসিক ‘আশ্চর্য!’। একই সঙ্গে স্থাপন করেন একটি প্রকাশনা সংস্থাও, ‘আলফা-বিটা পাবলিকেশন্স্’। অল্প দিনেই সেই পত্রিকা জনপ্রিয় হয়ে উঠল। তবে কিছুদিনের মধ্যে বুঝতে পারলেন, নিজস্ব প্রেস না থাকলে পত্রিকা ঠিক সময়ে প্রকাশ করা সমস্যার। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। বাড়ির একতলাতেই বসিয়ে ফেললেন ‘দীপ্তি প্রিন্টার্স’। ‘আশ্চর্য!’ পত্রিকার প্রথম দিন থেকেই প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, এবং প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সত্যজিৎ রায়। ‘আশ্চর্য!’ পত্রিকায় কল্পবিজ্ঞানের সাহিত্য ছাড়াও প্রকাশিত হত বিজ্ঞানের নানা খবর, দেশবিদেশের বিচিত্র সব ঘটনার কথা। ছদ্মনাম নিলেন আকাশ সেন। তবে এক সময় ছদ্মনাম ছেড়ে স্বনামে পত্রিকা সম্পাদনা করতে থাকেন অদ্রীশ। ‘কল্পবিজ্ঞান’ শব্দবন্ধের জন্মদাতাও তিনি। তার আগে বাংলায় ছিল স্রেফ ‘বিজ্ঞানভিত্তিক কাহিনী’। বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা বা বিজ্ঞানে বাংলার অবদানের প্রতি বারবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তাঁর কলম। তাঁর লেখায় কঠিনতম বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও হয়ে উঠত সাধারণ মানুষের বোধগম্য, তা তিনি যে বয়সেরই হোন না কেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত সাহিত্য বাসরের বিষয় বিজ্ঞানভিত্তিক বারোয়ারি গল্প। ‘সবুজ মানুষ’ নামে সেই গল্পটি লিখলেন এবং পড়লেন যাঁরা, তাঁদের নাম প্রেমেন্দ্র মিত্র, সত্যজিৎ রায়, দিলীপ রায়চৌধুরী এবং অদ্রীশ বর্ধন। ‘মহাকাশ যাত্রী বাঙালী’ নামেও একটি গল্প লেখেন বাংলা সাহিত্যের তিন দিকপাল সাহিত্যিক, শ্রী প্রেমেন্দ্র মিত্র, শ্রী দিলীপ রায়চৌধুরী ও শ্রী অদ্রীশ বর্ধন। সত্যজিৎ রায়ের সভাপতিত্বে প্রথম ‘সায়ান্স ফিকশন সিনে ক্লাবে’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন তিনি। ইন্দ্রনাথ রুদ্র, ফাদার ঘনশ্যাম, প্রফেসর নাটবল্টু চক্র, রাজা কঙ্ক, জিরো গজানন, নারায়ণী, এবং চাণক্য চাকলাদার তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলির অন্যতম। নাটবল্টু চক্রে অ্যাডভেঞ্চার আর হিউমার যেভাবে মিলেছে, বাংলা সাহিত্যে তেমন উদাহরণ বিরল। ইন্দ্রনাথ রুদ্রের গল্পে তাঁর আলঙ্কারিক ভাষা গল্পকে এক নতুন উচ্চতায় তুলে দেয়। এই ভাষার জাদু জীবনের প্রায় শেষদিকে লেখা “অসহ্য সাসপেন্স”-এও একটুও টসকায়নি। উদাহরণ দিই,
আপনি বিশ্বাস করেন? বললে ইন্দ্রনাথ। শুনলে গায়ে কাঁটা দেবে আপনারও। ওরাই তো ছেলেটার মাথায় পাথর ফেলেছিল, দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন রামধন চক্রবর্তী। ভদ্রলোক যেমন লম্বা, তেমনি রোগা। ফর্সা। চোখে সোনার চশমা। গায়ে আদ্দির পাঞ্জাবি আর ধুতি। শৌখিন পুরুষ। বয়স ষাটের উর্ধ্বে। গোটা মুখখানায় দাম্ভিকতা মাখানো। যেন, ধরাকে সরাজ্ঞান করছেন। ছোট ছোট দুই চোখ বেশ কুটিল। জগৎটাকে সোজাভাবে দেখতে অভ্যস্ত নন। কথা হচ্ছে ইন্দ্রনাথের সুভাষ সরোবরের বাড়িতে। সকালের রোদ জানলা দিয়ে এসে পড়েছে বামধনবাবুর পিঠে। মাথা নেড়ে কথা বলার সময়ে পেছনের রোদ মাথার পাশ দিয়ে চশমার পুরু লেন্সে পড়ে ঝিলিক দিচ্ছে। কুটিল চোখ দুটোর ওপর যেন ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ ঝলসাচ্ছে। রৌদ্র-ঝলকিত চোখ দুটোর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল ইন্দ্রনাথ।
বিয়ের দু’ বছরের মাথায় ১৯৭২ সালে এক বছরের সন্তানকে রেখে মারা যান অদ্রীশ বর্ধনের স্ত্রী। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন অদ্রীশ। পত্রিকার ভার যায় দাদা ড. অসীম বর্ধনের হাতে। সেই বছরেই অনিয়মিত হয়ে পড়ে পত্রিকা প্রকাশনা। শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায় ‘আশ্চর্য!’। পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেই জুল ভের্নের রচনাবলি অনুবাদের কাজে হাত দেন অদ্রীশ। স্ত্রীবিয়োগের পর থেকেই মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যেত অদ্রীশবাবুর। বাকি রাতটা ঘুমোতে না পেরে জুল ভের্ন অনুবাদ করে কাটিয়ে দিতেন। এই ভাবেই সমগ্র রচনাবলি অনুবাদ হয়ে গেল। ১৯৭৫ সালে স্বনামেই শুরু করলেন ‘ফ্যানটাসটিক’ পত্রিকা সম্পাদনার কাজ। লেটারহেড বানিয়ে দিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। এই প্রসঙ্গে সম্পাদক গল্পচ্ছলে বলেছিলেন, “‘আশ্চর্য!’র পরে ‘অত্যাশ্চর্য’ বের করার উপদেশ দিয়েছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। চন্দ্রনাথ দে প্রচ্ছদও এঁকে ফেলেছিলেন। কিন্তু অনুমতি পাওয়া গেল ‘ফ্যানটাসটিক’ নামের।” উপযুক্ত লেখার অভাবে ‘ফ্যানটাসটিক’ অনিয়মিত হয়ে পড়ে। ১৯৮৩ সালে আরও একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশে উদ্যোগী হন অদ্রীশ। কিন্তু বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৮৪ সালের জুলাইয়ে ইত্যাদি প্রকাশনীর ‘কিশোর মন’ পত্রিকা সম্পাদনার কাজে যোগ দেন। ১৯৮৬-র ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই পত্রিকার ৫০টি সংখ্যা সম্পাদনা করার পর ইস্তফা দিয়ে চলে আসেন ‘ফ্যানটাসটিক’-এর কাজে। সারা জীবনে দেড়শোরও বেশি বই লিখেছেন ও অনুবাদ করেছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য চার খণ্ডে ‘জুলে ভের্ন সমগ্র’, ১৩ খণ্ডে ‘গোয়েন্দা ইন্দ্রনাথ রুদ্র সমগ্র’, ৩ খণ্ডে ‘আমার মা সব জানে’, ২ খণ্ডে ‘প্রফেসর নাটবল্টুচক্র সংগ্রহ’, ২ খণ্ডে ‘শার্লক হোমস সমগ্র’, ৩ খণ্ডে এডগার অ্যালান পোর রচনা সংগ্রহ’ ইত্যাদি। কিছু মৌলিক বা বিদেশি গল্প আশ্রিত বই আমার নিজের ছোটবেলার নিত্যসঙ্গী ছিল। হাঙরের কান্না, সমুদ্র শয়তান, কালো গর্ত এদের অন্যতম। শুধু সাই-ফাই না। বাংলা ভয়ের গল্পে নতুন দিক খুলে দিয়েছিলেন তিনি। যদি খুব ভুল না করি, বাঙালি পাঠককে লাভক্রাফটের ভয়ের গল্পের সঙ্গে পরিচয় অদ্রীশ বর্ধনই করিয়েছিলেন। আমার মা সব জানে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হত সানন্দার পাতায়। সঙ্গে দেবাশীষ দেবের ছবি। এই বইটা থেকে যে কত কী শিখেছিলাম, তাঁর ইয়ত্তা নেই। এই বই মায়েদের জন্য। এই বই সেই ছেলেমেয়েদের জন্য, যাদের ধারণা তাদের মা সব জানে। আমার মা সব জানে— ছোটদের এই বিশ্বাসকে ভেঙে দিতে কোনও মায়েরই মন চায় না। কেননা একটা বয়স পর্যন্ত যত আবদার, যত জিজ্ঞাসা সব মায়ের কাছেই চলে। অথচ সংসারের হাজার রকমারির মধ্যে মায়ের পক্ষে সজীব, সর্বস্ব, বিশ্বকোষ হয়ে উঠা সম্ভবপর নয়। মাঝে মাঝে তাই চটজলদি বানিয়ে বানিয়েও দিতে হয় জবাব। তার মধ্যে অনেক ভুলও থেকে যায়। থেকে যাওয়াটা আশ্চর্য কিছু নয়। ছোটরা কিন্তু সেই জবাবই বেদবাক্য হিসেবে রেখে দেয়। কেননা, তাদের অটল বিশ্বাস— আমার মা সব জানে। এইভাবেই অজান্তে, কখনও বা অসতর্কতায় ছোটদের মনের গভীরে চারিয়ে যায় কিছু ভুল, কিছু কুসংস্কার। সে সবকে ভাঙতে এই বইয়ের জুড়ি নেই। এত সহজ ভাষায় ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান আমাদের আগে কেউ বোঝাননি।
সারা জীবনে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার আর সম্মান। পরপর দুবছর “দক্ষিণীবার্তার শ্রেষ্ঠ গল্প” পুরস্কার পেয়েছেন। অনুবাদের ক্ষেত্রে পেয়েছেন সুধীন্দ্রনাথ রাহা পুরস্কার। বয়সের ভারে শেষদিকে হারিয়েছিলেন কর্মক্ষমতা, হারিয়েছিলেন স্মৃতিশক্তিও। দেহটা ছিল। সেটাও চিরতরে চলে গেল। আমাদের কৈশোরবেলার শেষ প্রতিনিধি হয়তো এখন নিজেই গুটিগুটি পায়ে চলেছেন এক আশ্চর্য জগতের দিকে।
তথ্যঋণ– কল্পবিশ্ব পত্রিকা।