কিন্নর কথা

রিমি মুৎসুদ্দি

 

মেঘেদের জলছবি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গিয়ে ঝকঝকে আকাশে ফুটে উঠেছে গোল টিপের মত রূপালি চাঁদ। তুষারশুভ্র কিন্নর-কৈলাসের উপর তার স্নিগ্ধ শরীর থেকে নির্গত রূপালি আলো এক আদিম মায়ার খেলায় মেতে উঠেছে। সন্ধে নামলেই হিমালয় থেকে ঠান্ডা বাতাস এসে শীতের কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়। রহস্য রোমাঞ্চে ঘেরা তুষার পর্বতের সানুদেশে এই স্বপ্নমাধুরীর সন্ধ্যায় কাজের শেষে তিন যুবক ফিরে আসছে তাদের ঘরে। কিন্নরদেশের বেশ কিছুটা উপরে কানম গ্রামে ওদের বাড়ি। যুবক তিনটি সহোদর। একভাই সমতল থেকে পাহাড়ে বেড়াতে আসা ট্যুরিস্টদের ড্রাইভার বনাম গাইডের কাজ করে। সে আসছে সাংলা থেকে। আরেকভাই রেকংপিও-তে এক অফিসে চাকরি করে। আরেকজন কল্পার এক অতিথি-নিবাসের কর্মচারী। সামনেই ওদের পরব ইউখিয়াং বা ফুলেচ। সেই পরব উপলক্ষেই তিন সহোদর তাদের প্রিয়ার জন্য কিছু উপহার নিয়ে এসেছে। সাংলা থেকে একভাই এনেছে চিলগোজা। পাইন গাছের এই বাদাম এখানে খুবই জনপ্রিয় ফল। আরেকভাই, কল্পা থেকে নিয়ে এসেছে একগুচ্ছ চেরি। অবশিষ্টজন রেকংপিও থেকে কিনে এনেছে একজোড়া কানের মাকড়ি। এই তিন সহোদরের প্রিয়া অর্থাৎ স্ত্রী কিন্তু ভিন্ন নয়। এরা মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডবের মত এক দ্রৌপদীকেই সবাই মিলে পত্নীরূপে গ্রহণ করেছে।

বাড়ি পৌঁছেও, প্রিয়ার ঘরে অবশ্য এরা তক্ষুণি প্রবেশ করতে পারে না। স্ত্রীর ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। বন্ধ কাঠের দরজায় লাগানো লোহার কড়ায় ঝুলছে বড়ভাই-এর সবুজ টুপি। এর অর্থ বড়ভাই আর ওদের প্রিয়া এখন লিপ্ত তাদের নিজস্ব অন্তরঙ্গ মুহূর্তে। বড়ভাই-ই প্রথম বিয়ে করে আনে সেই কিন্নরীকে। পরে কিন্নরদেশের প্রথা অনুযায়ী বাকি তিনভাই-এর সাথে এক এক করে বিয়ে হয় নব-বিবাহিত কিন্নরী তরুণীর। বড়ভাই হল ওদের লাড়ি (দুলহান)-র প্রথম লাড়াহ (দুলহা)। ওরা কিন্তু ওদের অন্যভাইদের এই নিজস্বতাকে সম্মান দেয়। তাই ওরা ফিরে যায় যে যার ঘরে। সেই রাতে কিন্নরী যুবতীটির ঘরের দরজায় এক এক সময়ে এক এক ভাই-এর টুপি ঝোলানো ছিল। বাকি ভাই ও পরিবারের অন্য সদস্যরা বুঝতে পারত তাদের বাড়ির বধূটি এখন সে বাড়ির কোন পুত্রের সাথে যাপন করছে একান্ত ঘনিষ্ঠ সময়। এই পর্যন্ত পড়ে পাঠক মনে করতে পারেন এ কোনও গল্প। মহাভারতের দ্রৌপদীর কনসেপ্ট নিয়ে লেখা কোনও অলীক কাহিনি। না, এ দৃশ্য আজকের কিন্নরদেশের।

কিন্নরে বিশেষ করে আপার কিন্নরে দ্রৌপদী প্রথা এখনও বর্তমান। কিন্নরীদের জমি সুরক্ষা আইন ‘ওয়াজিবুল-আরজ’ এই প্রথাকে বৈধতাও দিয়েছে। ২০১৬ সালে যখন কিন্নরও স্মার্ট জনপদে পরিণত হওয়ার লড়াই-এ সামিল, তখনও অনেক কিন্নর তরুণ এই প্রথাকে সমর্থন করে। মূল্যবৃদ্ধি, রাজনীতি, খরা-বন্যা আইপিএল, বলিউড-টলিউড এইসব নিয়ে বিধ্বস্ত সমতলের বাঙালি টুরিস্ট আঁতকে উঠেছিলাম দিল্লিতে পড়াশুনা করা এক কিন্নর তরুণের মুখে এই তথ্য শুনে। হিমাচল-প্রদেশ সরকারের লাইসেন্সপ্রাপ্ত এক ট্রেকিং-গাইড কোম্পানির মালিক নভ নেগি এই প্রথার স্বপক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেন, “ম্যাডামজি, আপনি যে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের মোহজালে আকৃষ্ট হয়ে আমাদের এখানে বেড়াতে এসেছেন, সেই প্রকৃতি কিন্তু আমাদের, কিন্নরীদের জীবনধারণের পক্ষে অত্যন্ত নির্দয়। এখানকার রুক্ষ পাথুরে অনুর্বর জমিতে চাষাবাদ অত্যন্ত কষ্টকর। যদিও আপেল, চেরি, পাহাড়ি আলু ও অন্যান্য কিছু ধাপ-চাষের মাধ্যমে সামান্য কিছু ফলন হচ্ছে তবুও খাদ্যশস্য ও শাকসব্জির জন্য এখনও আমরা প্রধানত অপেক্ষাকৃত নীচু জেলার মুখাপেক্ষী। তাই সীমিত সম্পদের বণ্টন আমরা চাই না। ভাইদের আলাদা আলাদা বিবি মানে তো অল্প যেটুকু জমিন আছে তাও ভাগ-বটোয়ারা হয়ে ছোট হয়ে যাবে। ভাইদের কমন বিবির জন্যই তো আমাদের সম্পত্তি এখনও ভাগ হয়নি। টুরিস্ট-থেকে কতই বা রোজগার করি? আলাদা বিবি থাকলে সম্পত্তির ভাগ পাব না।” সমতলের রোমান্টিক বিদ্রোহী মন ছিছিকার করে উঠেছিল ঘৃণায়! শুধুমাত্র জমি, সম্পত্তির ভাগের জন্য এই আদিম প্রথা! কেমন আছে সেই সব দ্রৌপদীরা? যদিও স্থানীয় কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিলাম, কিন্নরে নাকি মহিলাদের খুব সম্মান। বাড়ির যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত মেয়েরাই নেয়। আর পণপ্রথাও এখানে রিভার্স। ছেলেদের মেয়ের বাবাকে অনেক টাকা-পয়সা দিয়ে বিয়ে করার অনুমতি নিতে হয়। জিজ্ঞেস করেছিলাম মেয়েরা কি রাজী হয় দ্রৌপদী হতে? কোনও কিন্নরী মেয়েকে জিজ্ঞেস করার সৌভাগ্য হয়নি। সাংলা, কল্পা, রক্ষম, কানম, পু আর ভারত-চিনের সীমান্তে শেষ ভারতীয় গ্রাম চিতকুল পর্যন্ত গিয়েও কোনও কিন্নরী মেয়েকে জিজ্ঞেস করতে পারিনি ওদের কথা, ওদের মতামত এই দ্রৌপদী প্রথা নিয়ে। যদিও অচেনা পথিককে পথের সন্ধান দিয়ে গৃহের পথে ফেরা কিন্নরী তরুণীরা সাহায্য করে তবুও কথাবার্তা বলায় তারা আগ্রহী নয়। এর একটা কারণ হয়ত ইংরাজি বা হিন্দি ভাষায় তাদের দক্ষতার অভাব। আর কোনও কারণ আছে কিনা তাদের এই সঙ্কোচের তা অবশ্য অজানাই রয়ে গেছে। তবে মহাভারতেও দ্রৌপদী সুখী ছিল না। কারণ সে তো অর্জুনকে ভালবাসত। অথচ জ্যেষ্ঠের অধিকারে যুধিষ্ঠিরই তার প্রথম অঙ্কশায়িনী হয়। এরপরও কত বিচ্ছেদ সইতে হয় প্রিয় অর্জুনকে কাছে পেতে! এ কাহিনি তো আমরা সবাই জানি। কিন্নরের দ্রৌপদীদের কাহিনি অজানাই রয়ে গেল।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...