ব্যান্ডের গান, Banned গান

আর্কাদি গাইদার

 

ব্রিটেনের বিখ্যাত মিউজিক ফেস্টিভাল গ্ল্যাস্টনবারি। প্রতি বছর হাজার হাজার সঙ্গীতপ্রেমী মানুষ গোটা পৃথিবী থেকে আসেন এই ফেস্টিভালে। কোল্ড প্লে, রেডিও হেড, ওয়েসিস, ফু ফাইটারসদের মতন আন্তুর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পীরা পারফর্ম করেন এই মঞ্চে। গতকাল গ্ল্যাস্টনবাড়িতে স্টেজে অতিথি হিসেবে এসেছিলেন জেরেমি করবিন। শেলির কবিতা আবৃত্তি করবার পর তিনি বলেন ‘Another World is possible. If we come together’. দর্শকদের ভিড় হাততালি এবং স্লোগানে ফেটে পড়ে।

জেরেমি করবিন একজন পুরোদস্তুর রাজনৈতিক ব্যাক্তি। গ্ল্যাস্টনব্যারির মঞ্চে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বক্তব্য রাখলেও তা নিয়ে উদ্যোক্তা বা দর্শক, কারুরই অসুবিধে হয়নি। হয়তো ওনার সব কথার সাথে সবাই সহমত নন, তবুও বৃহত্তর ক্ষেত্রে সঙ্গীতের সাথে রাজনীতিকে ‘মেলানো’ নিয়ে কেউ আপত্তি জানিয়েছেন বলে জানা যায়নি।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সঙ্গীত, বিশেষ করে রক এবং তার ফলস্বরূপ ‘ব্যান্ড’ সংস্কৃতি কখনওই রাজনীতি বিমুখ ছিল না। যেখান থেকে উৎপত্তি, অর্থাৎ কালো মানুষদের ব্লুজ, বা আমেরিকার খেতখামারের ফোক সঙ্গীত, সেই শিকড়েই লুকিয়ে ছিল মূলধারাকে অস্বীকার করবার মন্ত্র। গানের সুর, কথা, ব্যাকরণ, সব মিলিয়ে সমসাময়িক স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। এবং এই বিদ্রোহ যখন হয়ে দাঁড়াল মূলধারার বিকল্প, তখন এ আর শুধু সংগীতের একটা ধারা রইল না, হয়ে গেল একটা আস্ত বিশ্ববীক্ষা। পাঁচের দশক থেকে শুরু করে আমেরিকার সিভিল রাইটস মুভমেন্ট, যৌন বিপ্লব, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, সমস্ত মাইলস্টোনের হাতে হাত ধরে এগিয়েছে রক মিউজিক। সমাজ, সংস্কৃতি, নৈতিকতা সবকিছুকে প্রশ্ন করেছে, আঘাত করেছে, ভেঙেছে। এবং বহু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সাথে সরাসরি সংঘাতে গেছে। সেন্সরের সাথে লড়েছে। প্রতিরোধের পাশে সরাসরি দাড়িয়েছে। ‘দ্য হু’-এর পিট টাউনশেন্ড বলেছিলেন–- Rock is not a music store genre label, it is a way of life’. তারপর বাণিজ্যিকীকরণের হাত ধরে একসময় এই সঙ্গীতও বিকল্প থেকে মূলধারার হয়ে গেল। সেই সময়কালেও কিন্তু গানের মাধ্যমে সরাসরি রাজনৈতিক স্ট্যান্ড নেওয়ার থেকে পিছিয়ে আসেননি শিল্পীরা। পিঙ্ক ফ্লয়েড, রেজ এগেন্সট দ্য মেশিন, পার্ল জ্যাম, গ্রীন ডে’র মতন মূলধারার কমার্শিয়াল ব্যান্ডরা দিনের পর দিন প্রচণ্ড রাজনৈতিক বক্তব্য প্রচার করে গেছে তাদের গানের মধ্যে দিয়ে।

এত কথা বলবার একটাই কারণ, আমাদের দেশ, বিশেষ করে আমাদের বাংলার ব্যান্ড সংস্কৃতি নিয়ে একজন সঙ্গীতপ্রেমী এবং একজন সামাজিক জীব হিসেবে আমি ভীষণভাবেই নিরাশ। পাশ্চাত্যের যে সঙ্গীতের ধারা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এবং বিশ্বসংস্কৃতির মেলবন্ধনের যে জোয়ারের ছোঁয়ায় এখানে ব্যান্ড মিউজিকের উৎপত্তি, গত ২০-২৫ বছর ধরে তার ছায়া থেকে বেরিয়ে সে আস্তে আস্তে সাবালক হয়ে উঠেছে এই মাটিতে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, কিছু হাতে গোনা ব্যাতিক্রম বাদ দিলে, এই ব্যান্ড মিউজিক নিজেকে একটা নিরাপদ পরিসরের মধ্যে আবদ্ধ রেখেছে। সঙ্গীতের ব্যাকরণ, সুর, পোশাক, এবং আচার আচরণ বাদ দিয়ে রক মিউজিকের বিদ্রোহের সেই আসল নির্যাসটাই আপন করে নিতে তারা ব্যর্থ থেকেছে। আঞ্চলিক ভাষা এবং ইংরেজি, দু ক্ষেত্রেই ব্যান্ডদের মধ্যে এই সংকট দৃশ্যমান। আগেই বলেছি হাতে গোনা ব্যাতিক্রম রয়েছে কিছু। যেমন উত্তর পূর্বের বেশ কিছু ব্যান্ড শুনেছি যারা সরাসরি আফস্পা, মিলিটারি, রাষ্ট্র এদের বিরুদ্ধে গান লিখেছে। কিন্তু ভারতের মূল অংশের বড় বড় শহরের যে ব্যান্ডগুলো, এবং আমাদের বাংলা ব্যান্ডরা, এদের গান কোনওদিনই এই নিরাপদ সীমানাগুলোকে অতিক্রম করবার চেষ্টা করেনি। এদের মধ্যে থেকে সবচেয়ে রাজনৈতিক যে গান বেরিয়েছে, তা হল ওই ‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই’, বা ‘সবার মধ্যে সম্প্রীতি’ এই ধরনের আপ্তবাক্য প্রচার করা কথনে, যা শুনতে ভালো হলেও, কোনওদিন ‘ক্ষমতা’কে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানায়নি, তাকে অস্বস্তিতে ফেলবার চেষ্টা করেনি, মোটের ওপর স্থিতাবস্থার ওপর একটা আঁচড়ও কাটবার চেষ্টা করেনি। তাই আমাদের সময়ের ব্যান্ডের গান বলতে আমরা শুনেছি প্রেম, দুঃখবিলাসিতা, অপূর্ণতা, নেশা, মাদক, এলিয়েনেশন, একাকিত্ব, আমাদের সার্বিক urban angst এবং বিবিধ ব্যাক্তিগত ‘সমস্যা হতে চাই’ থিম নিয়ে বক্তব্য। কিন্তু এর বাইরে বেরনোর সাহস কোথাও দেখতে পাইনি।

পরিচিত চিত্র, এই দেশের কোনও শহরের কোনও বড় হোটেলের পাব বা নাইট ক্লাব। আলোআঁধারির মধ্যে স্টেজে একটি ব্যান্ডের শো চলছে। একদম সামনে দাঁড়িয়ে গান শুনছে কয়েকজন। স্টেজের দুদিকের জনগণের পোশাক পরিধান মোটামুটি একইরকমের। এর বাইরের বৃত্তে বাকি জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আরও বেশ কিছু মানুষ। কেউ প্রেম করছে, কেউ ফোনে মগ্ন, কেউ বা আড্ডা মারছে। স্টেজে যা চলছে তা তাদের কাছে আবহসঙ্গীত মাত্র। কারণ একটাই। বক্তব্য। আমাদের কোনও বক্তব্য নেই। ভীতু প্রেম, আপাতসাহসী নেশা, নিরীহ নৈরাশ্য, এরই মধ্যে ঘোরাফেরা করছে স্টেজের শিল্পীদের বক্তব্য। শিল্পী এবং দর্শক, মোটামুটি সবার আর্থ-সামাজিক অবস্থান এক। We are the 10%. এর বাইরে কলেজ ফেস্ট বা পাড়ার ফাংশান, সেখানে ব্যান্ডের গান স্রেফ ক্ষণিকের বিনোদন। শো শেষ হলেই যা জনমানস থেকে উবে যায়। কারণ তার বক্তব্য বড়ই নিরাপদ, বড়ই ঘর-পোষা। ডেসিবেলের উচ্চতায়ও গানের নিস্তেজ মনোভাবকে লুকিয়ে রাখা যায় না। অথচ পাশ্চাত্যে ব্লুজ এবং তার পর রক ছিল আদতে খেটে খাওয়া মানুষের ভাষা। সাধারণ মানুষ ছিল শ্রোতৃবৃন্দ, তাদেরই কথা তাদেরই ভাষায় উঠে আসত গানে। সমাজের উচ্চশ্রেণীর মানুষেরা নাক সিঁটকাত এই ধরনের গানবাজনায়। শাসক শ্রেণীও মনে করত শিল্পের এই ধারা বিপজ্জনক, প্রথমে সেন্সরশিপ, তার পরে বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে তারা বারবার চেষ্টা করেছে একে বশ মানানোর। বহু ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে দিয়েও এই গান লড়াইয়ের নতুন নতুন রাস্তা খুজে নিয়েছে। অর্থনৈতিক শোষণ, বর্ণবাদ, লিঙ্গ বৈষম্য-– আমাদের শতাব্দীর সমস্ত বড় বড় লড়াইগুলো স্থান পেয়েছে এই গানের ধারায়।

অথচ, আমাদের মাটিতে, অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সমস্ত লড়াইকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলেছে এই ধারা। যেন দুটো পুরোপুরি আলাদা জগত পাশাপাশি অবস্থান করছে, যার মধ্যে সমস্ত জানলা বন্ধ। আমাদের গানে দলিতদের স্থান নেই, নেই ধর্মীয় অত্যাচারের কথা, নেই দেশের কৃষক, দেশের শ্রমিকের অসম লড়াইয়ের গল্প, নেই প্রতিরোধের আহ্বান। আমাদের গানে খালি রয়েছে ‘আমি’, ‘আমি’, ‘আমি’ আর কিছু গিটারের পাওয়ার কর্ড।

রেজ এগেন্সট দ্য মেশিন একদা ওয়াল স্ট্রীটকে অবরুদ্ধ করে মঞ্চ বানিয়ে শো করে একটা গোটা দিনের জন্যে ওয়াল স্ট্রীট বন্ধ করে দিয়েছিল। তার জন্যে তাদের পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হতে হয়। পিঙ্ক ফ্লয়েডের রজার ওয়াটার্স সরাসরি মার্গারেট থ্যাচারকে নাম ধরে আক্রমণ করে গান লিখেছিল। জর্জ বুশ তো ব্যান্ড শিল্পীদের প্রিয় টার্গেট ছিল। রেডিও হেড তাদের একটি গোটা অ্যালবামের নাম দিয়েছিল জর্জ বুশকে কটাক্ষ করে। এবং গ্রীন ডে তাদের বহু গানে জর্জ বুশ এবং মার্কিন যুদ্ধনীতিকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছিল। এই তো সেদিনই রজার ওয়াটার্স তার শোতে স্টেজের পেছনে ব্যানার টাঙিয়ে দিলেন– Trump is a Pig. অত দূরে যেতে হবে না, আমাদের বাংলাতেই একদা মহীনের ঘোড়াগুলি নামে একটি গানের দল ছিল। তারাও গান লিখেছিল, চূড়ান্ত রাজনৈতিক গান। ‘চৈত্রের কাফন’ থেকে শুরু করে ‘পড়াশোনার জলাঞ্জলি ভেবে’। অথচ তাদের উত্তরাধিকার হিসেবে দাবী করা মানুষগুলো আটকে গেছে এক অদ্ভুত আবদ্ধ জলাশয়ে-– in limbo.

আমরা এই সমস্ত শিল্পীদের থেকে পোশাকের স্টাইল, চুলের ছাঁট এবং সুরের নান্দনিকতা শিখেছি বটে, কিন্তু বাদবাকি সিলেবাসটা আমাদের আর পড়া হয়ে ওঠেনি। তাই, বর্তমান সময়ে এবং পরিস্থিতিতে এমন একটা সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও সেই নিরাপদ পরিসর ছেড়ে আমাদের গান বেরোতে পারছে না। বা বলা ভালো, বেরোতে সাহস পাচ্ছে না। আমাদের গান আমাদের কথা বলে না। আমাদের গান আর আমাদের বাস্তবের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে না। আমাদের গান পলায়নের গান। পারিপার্শ্বকে অস্বীকার করে এক কল্পিত জগত তার বিচরণক্ষেত্র-– যেখানে এক সুন্দর উষ্ণ আর্দ্রতার মধ্যে সবাই খেলে বেড়াচ্ছে-– সেখানে রোজ ধর্ম, জাত বা পদবীর জন্যে কেউ খোলা আকাশের নিচে খুন হয়ে যাচ্ছে না, যেখানে পুলিশের মারে রাজপথে খুবলে আসা চোখ আর ঘিলুর টুকরো ছড়িয়ে থাকছে না, যেখানে পেলেট গানের মুখে শিশু আর রাইফেলের মুখে রোগা চাষী রাস্তায় লুটিয়ে পড়ছে না, যেখানে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত একটু একটু করে আমাদের ভাবনার স্বাধীনতা, বলবার স্বাধীনতা, খাওয়ার স্বাধীনতা, ভালোবাসার স্বাধীনতাকে খুন করা হচ্ছে না। ‘ক্ষমতা’ আমাদের নির্দেশ দিয়েছে, এই তোমাদের খেলার মাঠ, এই যে গণ্ডি কেটে দিলাম, এর মধ্যে খেলাধুলো করো, এর বাইরে বেরনোর সাহস দেখিয়ো না, আর আমরা টুপি হাতে মাথা নিচু করে ‘ইয়েস স্যার’ বলে মেনে নিয়েছি।

ব্রেখট লিখেছিলেন– ‘অন্ধকার সময়ে কি গান হবে না? হবে। অন্ধকার সময়কে নিয়েই গান হবে।’
আমরা চূড়ান্ত সফলতার সঙ্গে ব্রেখটকে ভুল প্রমাণ করেছি। অন্ধকার সময়ে আমরা পলায়নবৃত্তির গান লিখেছি।

তাও অন্ধকার সময় নেরুদার কাছে ভরসার সন্ধান করি–

And you’ll ask: why doesn’t his poetry

Speak of dreams and leaves

And the great volcanoes of his native land?

Come and see the blood in the streets.

Come and see

The blood in the streets.

Come and see the blood

In the streets.

 

 

(আর্কাদি গাইদার বর্তমান লেখকের ছদ্মনাম। রুশ লেখক আর্কাদি গাইদারের সাথে তার কোনও সম্পর্ক নেই)

(ছবি: ইন্টারনেট)

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...