মিলন দত্ত
জেনে না-জেনে জেহাদ এখন শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কথাবার্তায় হামেশা এসে পড়ছে। সে আলোচনায় জেহাদকে সাধারণভাবে বেপরোয়া, অযৌক্তিক এবং সর্বাত্মক যুদ্ধ হিসেবে দেখা হয়। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, জেহাদ বলতেই অ্যাসল্ট রাইফেলধারী জঙ্গিদের ছবি ফুটে ওঠে। সহজ করে বললে জেহাদের দুটো প্রকার আমরা পাই: সশস্ত্র জেহাদ আর আধ্যাত্মিক জেহাদ। জেহাদ কিন্তু এতটাই সরল কোনও বিষয় নয়, বরং তা অত্যন্ত জটিল এবং বিতর্কিত। জেহাদ ব্যাখ্যা করে হাজার হাজার বই লেখা হয়েছে। তার পরেও জেহাদ নিয়ে হাজারো প্রশ্ন— জেহাদ কি কাফেরদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ধর্মযুদ্ধের শরিয়তি নিদান, তা কি শুধুই যুদ্ধ আর হিংসা সংক্রান্ত, ইসলামি সন্ত্রাসবাদীদের গণসংহারের হাতিয়ার, আল্লার পথে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে নিজেকে নিয়োজিত করা নাকি রিপু কামনা ও অন্যায় করা ইচ্ছা থেকে বিরত থেকে সৎ ও খোদা-বিশ্বাসী জীবনযাপন করার লড়াই? এ নিয়ে বহুদিন ধরে বিস্তর আলোচনা হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু জট ছাড়েনি। প্রশ্ন থেকে গেছে অমীমাংসিত। তাহলে ইসলামের বহু চর্চিত এই কৃত্যটিকে আমরা কীভাবে দেখব?
বাংলায় ‘জেহাদ’ সাধারণভাবে বিদ্রোহ বা প্রতিবাদ অর্থে বহুল প্রচলিত। বাঙালি কথায় কথায় যে জেহাদ ঘোষণা করে তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য। শব্দটা ব্যবহারের সময় কারও সম্ভবত মনেই থাকে না যে জেহাদ আসলে মুসলমানদের অবশ্য পালনীয় একটি ধর্মীয় বিধান। জেহাদ বাঙালির প্রাত্যহিক ব্যবহারে ঢোকার সময় তার গা থেকে ধর্মগন্ধ এবং ধর্মপরিচয়টা মুছে সে তার সুবিধামতো একটা অর্থ গড়ে নিয়েছে। বাংলা ভাষায় জেহাদের সর্বাত্মক সেকুলার প্রয়োগ থাকা সত্ত্বেও প্রচলিত এই অর্থটি কিন্তু অভিধানে নেই। সংসদ বাংলা অভিধানে ‘জেহাদ’কে বলা হয়েছে ‘বিধর্মীদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ধর্মযুদ্ধ’। বঙ্গীয় শব্দকোষে রয়েছে ‘জেহেদ (আ. জেহাদ) মুসলমানদিগের ধর্মার্থ যুদ্ধ’। এমনকী ঢাকা বাংলা অ্যাকাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধানেও ‘জেহাদ’ অর্থে ‘ধর্মযুদ্ধ’কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। জেহাদকে ‘ধর্মযুদ্ধ’ বা ‘পবিত্র যুদ্ধ’ বলতে নারাজ মুসলমানদের একাংশ। তাঁরা বলেন, এটা পশ্চিমীদের তৈরি করা ব্যাখ্যা। জেহাদের সঙ্গে হিংসাকে জুড়ে তার একটা ভয়াবহ ছবি তৈরি করেছে।
আরবি জেহাদ শব্দটি এসেছে ‘জুহদ’ থেকে। অর্থ হল আপ্রাণ চেষ্টা, সংগ্রাম। বাংলাদেশ ইসলামি ফাউন্ডেশনের ‘ইসলামি শব্দকোষ’ গ্রন্থে জিহাদের অর্থ করা হয়েছে, ‘চেষ্টা, পরিশ্রম, অধ্যবসায়, ধর্মযুদ্ধ’। ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য ধনপ্রাণ দিয়ে সব রকমের সংগ্রাম বা যুদ্ধই জেহাদ। যারা জেহাদ করে বা জেহাদে অংশ নেয় তাদের বলা হয় ‘মুজাহিদ’। তারা কাফেরদের ধর্মান্তরিত করার মধ্যে দিয়ে ইসলামকে প্রসারিত করবে। কাফের আর পৌত্তলিকদের ধ্বংস করে ইসলামের বিস্তার ঘটাবে। বিধর্মী (কাফের), অবিশ্বাসী (মুনাফেক) এবং পৌত্তলিক (মুসরিক)-দের ইসলামে ধর্মান্তরিত করার জন্য যারা জিহাদে অংশ নেবে তাদের জন্য কোরানের (সুরা আনফাল ৮:৩৮) নির্দেশ, ‘তোমরা তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে যতক্ষণ না ফিতনা (অনিষ্ট, ক্ষতি) দূর হয় এবং আল্লাহর ধর্ম সামগ্রিক রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।’ কোরান বা হাদিস জেহাদ ছাড়া মুসলমানের জন্য অন্য কোনও যুদ্ধ অনুমোদন করেনি। জেহাদ কোনও ব্যক্তিকে ধর্মান্তরিত করার বিষয় নয়। জেহাদ কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কৃত্যও নয়, তা করবে কেবলমাত্র একটি মুসলিম রাষ্ট্র বা মুসলমান শাসক। মুসলমানদের মধ্যে একটা বিশ্বাস রয়েছে, বিশ্বজুড়ে ‘দারুল হরব’ (অমুসলিম শাসিত বিধায় শত্রুর দেশ)-কে সম্পূর্ণ পরাভূত করে ‘দারুল ইসলাম’ (মুসলিম শাসিত রাষ্ট্র) কায়েম না হওয়া পর্যন্ত জেহাদ চলবে। মক্কা জয় করে কোরেশদের ধর্মান্তরিত করার পরে মুহাম্মদ বলেছিলেন, ‘(মক্কা) বিজয়ের পর আর হিজরত নেই, বরং রয়েছে জেহাদ আর নিয়ত (সংকল্প)। যদি তোমাদের জেহাদের ডাক দেওয়া হয়, তাহলে সেই ডাকে সাড়া দিয়ে বেরিয়ে পড়’ (সহি বুখারি। হাদিস ৯৫০)।
কোরানে এবং হাদিসেও বলা হয়েছে, জেহাদ করতে গিয়ে শহিদ হলে সে সরাসরি জান্নাতে যাবে। কিয়ামতের দিন পর্যন্ত তাকে কবরের নীচে অপেক্ষা করতে হবে না। জেহাদে মৃত্যু হলে তাদের ‘গাজী’ উপাধিতে ভূষিত করা হত। আবু হুরাইয়া নামে এক সাহাবি নবির কাছে জানতে চান, ‘মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম করে?’ নবি রসুল বলেছিলেন, ‘যে মুমিন তার জান মাল নিয়ে আল্লাহর পথে জেহাদ করে’ (সহি বোখারি শরিফ। হাদিস ৯৪৬)। পরেই ৯৮৭ সংখ্যক হাদিসে নবি বলেছেন, ‘আল্লাহ তাঁর পথে জেহাদকারীর ব্যাপারে এ দায়িত্ব নিয়েছেন যে, সে মৃত্যুবরণ করলে তাকে বেহেশত দান করা হবে অথবা গাজী বানিয়ে নিরাপদে পুরস্কারসহ ফিরিয়ে আনা হবে।’ দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সুন্দরবন সংলগ্ন অনেক গ্রামে বহু মানুষের পদবী গাজী। বাংলায় ইসলাম প্রতিষ্ঠায় তাঁদের ভূমিকার জন্যই সম্ভবত গাজী পদবী পেয়েছিলেন তাঁরা। ক্রমে গাজীর ধর্মযোদ্ধা পরিচয় বিলুপ্ত হয়ে সে হয়ে ওঠে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় বিপদ বাঘের দমনকারী, বীর। সুন্দরবনে কিংবদন্তীর নায়ক বড়খাঁ গাজী বা জেন্দাগাজী আজও হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষ পূজিত। বাদা অঞ্চলে লৌকিক দেবদেবীর মূর্তির পাশে ঠাঁই করে নিয়েছে গাজীরা।
কোরান এবং হাদিসে শহিদদের গুণকীর্তন এবং জান্নাতে তাদের অগ্রাধিকার থেকেই জিহাদের সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। সুরা ফতেহার একটি আয়াতে (৪৮:১৭) আছে, ‘অন্ধ, খঞ্জ ও রুগ্নদের জন্য কোনও অপরাধ নেই (যদি তাঁরা জেহাদে অংশ না নেন); আর যে-কেউ আল্লাহ্ ও তার রসুলের আনুগত্য করবে আল্লাহ্ তাকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতে, যার নীচে নদী বইবে। কিন্তু যে-লোক পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে তিনি তাকে শাস্তি দেবেন।’ কোরানে (সুরা তওবা ৯:২০) আছে, ‘আল্লাহর কাছে তাদের সবচেয়ে বড় মর্যাদা আর তারা তো সফলকাম যারা বিশ্বাস করে, হিজরত করে ও ধনপ্রাণ দিয়ে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে।’ আরও আছে (সুরা তওবা ৯:৪১), ‘অভিযানে বের হয়ে পড় যুদ্ধ সামগ্রী নিয়ে, (তা) হালকা হোক বা ভারী হোক, আর তোমরা ধনপ্রাণ দিয়ে আলিলার পথে সংগ্রাম করো। এ-ই তোমাদের জন্য মঙ্গল, যদি তোমরা বুঝতে পার।’ জেহাদে যারা অংশ নিল তাদের যেমন পার্থিব এবং পারলৌকিক পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তেমনই জেহাদে যাদের অনীহা তাদের জন্য ভয়ানক সব পরিণতির কথাও বলা হয়েছে কোরানে। আল্লাহর পথে যুদ্ধ বলতে ঠিক কি বোঝায় তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন নবি: ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কলেমা ঊর্ধ্বে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করল, সেই আল্লাহর পথে যুদ্ধ করল’ (সহি বুখারি। হাদিস ৯৬৭)।
হাদিসেও জেহাদকে সর্বোচ্চ স্থানে বসানো হয়েছে। হজরত মুহাম্মদ বলেছেন, ‘এমন কোনও আমল (কর্তব্য, অনুশীলন) আমি পাই না যা জেহাদের সমতুল্য হতে পারে’ (সহি বুখারি। হাদিস ৯৪৫)। নবি বলেছেন, ‘আল্লার রাস্তায় মুজাহিদদের জন্য আল্লাহ জান্নাতে একশোটি স্তর প্রস্তুত রেখেছেন’ (সহি বুখারি। হাদিস ৯৫২)। জেহাদে যারা অংশগ্রহণ করবে তাদের জন্য পার্থিব লাভের প্রতিশ্রুতি রয়েছে কোরানে (সুরা ফতেহা ৪৮:১৯-২০): ‘যুদ্ধে (তারা) লাভ করবে বিপুল সম্পদ।’ এবং ‘আল্লাহ্ তোমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তোমরা যুদ্ধে লভ্য বিপুল সম্পদের অধিকারী হবে।’ যুদ্ধ করে যে সম্পদ অর্জিত হয় ইসলামে তাকে বলা হয়েছে মাল এ গনিমত অর্থাৎ গনিমতের মাল। মুহাম্মদের সময় থেকেই, যুদ্ধের শেষে সেই যুদ্ধার্জিত সম্পদ মুজাহিদদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া রীতি ছিল। গনিমতের মাল কীভাবে ভাগ হবে তারও বিধান রয়েছে কোরানে (সুরা আনফাল ৮:৪১)। দরিদ্র আরবদের কাছে জেহাদের অংশ নেওয়ার জন্য গনিমতের মালও ছিল অন্যতম বড় কারণ। নবি তাঁর সহনাগরিকদের সে ব্যাপারে সাবধানও করেছেন। হাদিস গ্রন্থে (সহি বুখারি শরিফ। হাদিস ৯৫২) তার উল্লেখ আছে।
আল্লার রসুল নবি মুহাম্মদ নিজেই ছিলেন মুজাহিদ। মক্কা থেকে হিজরতের পর আমৃত্যু যুদ্ধ তাঁর পিছু ছাড়েনি। ওই সময়ের মধ্যে নবি স্বয়ং সাতাশটি যুদ্ধে অংশ নেন। বলাই বাহুল্য ওই যুদ্ধগুলোতে তিনি প্রধান সেনাপতির ভূমিকা পালন করেন। আরব জাতিকে ধর্মীয় ও রাজনৈতিকভাবে ইসলামের অধীনে আনার জন্য জিহাদে যোগ দেওয়ার ডাক দিয়েছিলেন নবি। পরবর্তীকালে বিভিন্ন খলিফা, অটোমান সুলতানেরা এবং অন্যান্য প্রভাবশালী সামন্ত মুসলমান শাসকরা আগ্রাসনের হাতিয়ার হিসেবে জেহাদকে ব্যবহার করেছেন। গণ বিক্ষোভ দমনের জন্যও জেহাদকে ব্যবহার করেছেন মুসলিম শাসকরা। ইদানীংকালের জিহাদি সংগঠনের কোনও কোনও সদস্যের স্বীকারোক্তি থেকে জানা গেছে, তারা সরাসরি জান্নাতে পৌঁছনোর লোভে জিহাদি হয়েছেন। বিশেষত যারা গায়ে বিস্ফোরক বেঁধে ‘মানব বোমা’ হয়ে গণ-সংহারের আয়োজন করে তারা আত্মঘাতী হামলা চালায় স্রেফ সরাসরি জান্নাতে পৌঁছনোর লোভে।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর থেকে গোটা বিশ্ব জুড়ে কত জেহাদি গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে তার হিসেব রাখা প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করার পরে ১৯৮৯ সালে আবদুল্লা জামান আর ওসামা বিন লাদেন আল-কায়দা নামে ইসলামি জঙ্গি সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। বিন লাদেনকে অবশ্য ২০১১ সালে পাকিস্তানে খুঁজে বের করে মার্কিন বাহিনী হত্যা করে। তার আগে আফগানিস্তানে পাকিস্তান সীমান্ত এলাকায় তালিবান প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এখনও বিভিন্ন দেশে যে জিহাদি গোষ্ঠীগুলো সক্রিয় তারা হল আল-কায়দা, ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড লেভান্ত (আইএসআইএল) যারা ‘আইএস’ নামে অধিক পরিচিত, নাইজিরিয়ার ভয়াবহ জেহাদি গোষ্ঠী বোকো হারাম, সোমালিয়ার আল-সাবাব, লিবিয়া এবং তিউনিশিয়ার আনসার আল-সারিয়া, ইন্দোনেশিয়ার জেম্মাহ ইসলামিয়া, ফিলিপিন্সের আবু সাইয়াফ আর মিশরের আনসার বাইয়াত আল-মাকদিস। এছাড়াও আছে পাকিস্তানের হরকাতুল মুজাহিদিন, বাংলাদেশের জামাত উল মুজাহিদিন এবং আনসারুল ইসলাম। ২০১০ সালের পরে এদের কোনও কোনও সংগঠন আল-কায়েদা বা আইএসের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে। আন্তর্জাতিকভাবে সক্রিয় রাষ্ট্রবহির্ভূত বা নন-স্টেট সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে এখনও পর্যন্ত আইএস এবং আল-কায়েদা সবচেয়ে প্রভাবশালী। ইউরোপ আমেরিকা সমেত বিশ্বের বহু দেশ থেকে ওই দুটি সংগঠনে যোগ দেওয়ার জন্য শিক্ষিত মুসলিম তরুণরা মাতৃভূমি ত্যাগ করেছে। তাদের একটাই উদ্দেশ্য: বিশ্বজুড়ে ইসলাম কায়েম করার লক্ষ্যে জেহাদে অংশ নেওয়া। কেরল থেকে অন্তত একুশ জন তরুণ সিরিয়া এবং ইরাকে গিয়ে আইএস-এ যোগ দিয়েছে। তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার ভারতে এই সংখ্যাটা নেহাতই কম। বাংলাদেশ বা মালদ্বীপ থেকে আরও অনেক বেশি সংখ্যায় সেনা পেয়েছে জেহাদিরা। এই বাড়বাড়ন্তের পেছনে ধর্মপ্রাণ সাধারণ মুসলমানের একাংশের প্রকাশ্য এবং প্রচ্ছন্ন সমর্থনও রয়েছে। তবে মুসলিম সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আস্থা নেই এই খুনখারাবির জেহাদে। তারপরেও জেহাদ নিয়ে সুফি এবং উদার মুসলমানদের আত্মশুদ্ধির তত্ত্ব বিশেষ ঠাঁই করে নিতে পারেনি।
মুহাম্মদের মৃত্যুর পরে ইসলামের বিস্তারের সময় জিহাদের ভয়ানক অপব্যবহার দেখে উদার ধর্মতাত্ত্বিক এবং মূলত সুফি পণ্ডিতেরা নবম এবং দশম শতকে জিহাদের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দেন। তাঁরা বলেন, আল্লাহকে জানার সঠিক পথের অন্বেষণে ব্যক্তির আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টাই জেহাদ। তাঁরা পাঁচ প্রকার জিহাদের কথা বলেন:
- হৃদয়ের বা আত্মার জেহাদ: মনের ভিতরের দুষ্টকে পর্যুদস্ত করতে অন্তরের সংগ্রাম তৌহিদের মাধ্যমে।
- বাচনিক জেহাদ: সমাজের শত্রু এবং শয়তানদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম খুতবা ইত্যাদির মাধ্যমে।
- কলম ও জ্ঞানের জেহাদ: অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে ইজতিহাদ বা মুক্তবুদ্ধি ও স্বাধীন বিচারবুদ্ধির মাধ্যমে ইসলামি জ্ঞানের চর্চা।
- হাতের জেহাদ: নিজের কাজ বা অর্জিত সম্পদের সাহায্যে অশুভের বিরুদ্ধে লড়াই। যেমন হজযাত্রা, বয়স্ক বাবা-মার যত্ন বা ইসলামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ।
- তলোয়ারের জেহাদ: জিহাদের এই কোরান স্বীকৃত পথটি বহুল প্রচলিত, ব্যবহৃত এবং প্রচারিত। অস্ত্র নিয়ে আল্লার পথে যুদ্ধ করা।
দ্বিতীয় পর্ব
বলাই বাহুল্য সুফি ঘরানার তাত্ত্বিকেরা এবং উদারপন্থী আধুনিক মুসলমানেরা বলেন, ধর্মবিদ এবং আইনজ্ঞরা জেহাদকে যুদ্ধ বলে ব্যাখ্যা করলেও তার বুৎপত্তিগত অর্থ— সংগ্রাম তো কখনও মুছে যাবার নয়। তাঁদের মতে, কোরান এবং হাদিস একটু মন দিয়ে পড়লেই বোঝা যাবে কেবল হিংসা আর যুদ্ধের বাইরেও বিস্তৃত হয়েছে জেহাদের অর্থ। সুফিরা মনে করে জেহাদ আসলে ব্যক্তির অন্তরের সঙ্গে যুদ্ধ। নিজের ভিতরকার রিপু এবং আত্মার দূষণ প্রতিহত করার লড়াই। দেহ হল একটা নগর, আত্মা তার শাসক আর তাকে চারিপাশ থেকে ঘেরাও করে রেখেছে মানুষের ক্ষুদ্র কামনা বাসনা। সেই কামনা আর বাসনাকে লাগাম পরানোই জেহাদ। সুফি তাত্ত্বিকেরা তাই জিহাদের দুটি প্রকারভেদের কথা বলেছেন: বড় জেহাদ (আল জেহাদ আল আকবর) এবং ছোট জেহাদ (আল জেহাদ আল আসগর)। ভিতরের শত্রুকে পর্যুদস্ত করতে আল্লাহর পথে আধ্যাত্মিক লড়াই হল বড় জেহাদ। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ হল ছোট জেহাদ। কোনও যুদ্ধ থেকে ফেরার পরে এক সাহাবির প্রশ্নের উত্তরে মহম্মদ এ কথা বলেছিলেন বলে জানা যায়। জিহাদ নিয়ে নবির এই বাণী অনেকে বলেন হাদিস গ্রন্থে আছে। কোন হাদিসে? তার কোনও স্পষ্ট উল্লেখ মেলে না। কেউ বলেন তিরমিজি শরিফে, কেউ বলেন মুসলিম শরিফে। তবে সুফি তাত্ত্বিকেরা ছাড়াও উদারপন্থী পণ্ডিতেরা বড় জেহাদের ওই ব্যাখ্যাকে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেছেন।
আসগর আলি ইঞ্জিনিয়ারের দাবি, ‘কোরানে জেহাদ সংক্রান্ত যে ৪১টি আয়াত আছে তার একটিতেও যুদ্ধ বা হিংসা নেই। বিংশ শতকের গোড়ায় যখন সন্ত্রাসবাদ আজকের মতো মাথাচাড়া দেয়নি, প্রখ্যাত ইসলামি ধর্মবেত্তা মৌলবি চিরাগ আলি জোহাদ সম্পর্কে একটা বইয়ে দেখিয়েছিলেন, কোরানে একটিবারের জন্যও জেহাদকে যুদ্ধ বা হিংসা হিসেবে দেখানো হয়নি। কোরানের জেহাদ কীভাবে আছে তা বোঝার জন্য সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।’ ইঞ্জিনিয়ার আরও অনেকটা এগিয়ে জেহাদকে বিশ্ব উষ্ণায়ন রদ করার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলেও দাবি করেছেন। কীভাবে? তার বক্তব্য, ‘আমাদের লাগামছাড়া ভোগের পরিণতি বিশ্ব উষ্ণায়ন। ভোগের এই বিপজ্জনক পরিণতির কথা বিবেচনা করে আমরা এর বিরুদ্ধে জেহাদ করতে পারি। সুফিরা তাঁদের সংযম এবং কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্যে দিয়ে এটাই করেছিলেন। ইঞ্জিনিয়ার বলেছেন, ‘অপ্রয়োজনীয় ভোগবিলাসের মধ্যে দিয়ে যারা এই গ্রহকে ধংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, আমরা মুসলিম (আল্লাহর প্রতি সমর্পিত) এবং মুমিন (কোরান কথিত মূল্যবোধে বিশ্বাসী) হিসেবে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম বা জেহাদ করব।’ এই ধরনের জিহাদ ব্যক্তিগত বা সঙ্গবদ্ধ— দুই রকমই হতে পারে। ব্যক্তি তার ভোগকে কমিয়ে পরিবেশ সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে যাবে। আর সঙ্ঘবদ্ধভাবে আমরা গোটা বিশ্বের ভোগের বাড়াবড়ি কমানোর জন্য শাসকের ওপর চার সৃষ্টি করতে পারি।’ বিশ্বের আজকের পরিস্থিতিতে এ কথা খানিকটা অবাস্তব মনে হলেও কেউ তো জেহাদের এই সব ব্যাখ্যায় বিশ্বাস করছেন। এই বিশ্বাস অবশ্যই আজকের মৌলবাদী ওয়াহাবি সালাফি সন্ত্রাসবাদীদের গণসংহারের বিপরীতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সাদিয়া দেহলভি তাঁর ‘সুফিজম: দ্য হার্ট অব ইসলাম’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘জেহাদের নামে সংঘটিত হিংসা ও অপরাধ ইসলাম ও তার অনুসারীদের সম্বন্ধে সাধারণের ধারনাগুলোকে নষ্ট করেছে। ইসলামে জেহাদের সঙ্গে আধ্যাত্মিক সংগ্রামের অপরিহার্য সস্পর্ক। অথচ জঙ্গিরা তাকে অপহরণ করে অসহিষ্ণুতা আর হিংসার সঙ্গে ওতপ্রোত করেছে।’
তারপরেও আয়েশা জালাল (পার্টিজান অব ইসলাম গ্রন্থে) প্রশ্ন তোলেন, ‘তাহলে ইসলাম অনুসারে জেহাদের সঠিক অর্থ কী? এর মানে কি যুদ্ধ? এর কোনও সহজ উত্তর নেই। কারণ মুসলমানদের মধ্যে প্রায় হাজার বছর ধরে এই প্রশ্নে মতপার্থক্য দূর করা যায়নি।’ আয়েশা জানান, ‘প্রাক-আধুনিক যুগে দুটি পৃথক ধারণার সহাবস্থান ছিল। একটি ছিল পরিষ্কার রাজনৈতিক মতবাদ। সেখানে বলা হত, দারুল ইসলামের বিস্তৃতির জন্য ইসলামি শাসন এবং বিস্তৃতি অব্যাহত রাখতে জেহাদ হল প্রতিটি মুসলমানের জন্য বাধ্যতামূলক। অন্যটি হল সুফি মতবাদের নিজের ভিতরকার জেহাদ। এই দুই মতের ফারাক বা বলা ভালো বিরোধ আজকেও সমানভাবেই রয়েছে। যাকে আমরা সুফি মতবাদ বলছি, বাংলায় তাই মারফতি বা সহজিয়া ধারা। মূলধারার মুসলমানদের একটা বড় অংশই তাকে শরিয়ত বিরোধী বলে কেবল প্রচার করে না, তারা মারফতিদের বিরুদ্ধে সক্রিয়ও বটে। মুর্শিদাবাদ জেলায় আজও মারফতি বা সুফিদের নিগৃহীত হতে হয় গোঁড়া মুসলিমদের হাতে।
জেহাদকে অনেকে সাহাদা (আল্লাহ্ ছাড়া কোন উপাস্য নাই এবং মুহাম্মদ তার রসুল), নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতের মতো মুসলমানদের আর একটি ফরজ (অবশ্যপালনীয় কর্তব্য) বলে চিহ্নিত করেছেন। অর্থাৎ তাঁদের মতে জেহাদ ইসলামের ষষ্ঠ স্তম্ভ। তবে আচার হিসেবে জেহাদ কোনও সার্বক্ষণিক বা নিয়মিত কর্তব্য নয়। বরং নির্দিষ্ট সময়ে পালনীয় কর্তব্য। আগেই বলা হয়েছে, সুফিদের আস্থা নেই অস্ত্রের জিহাদে। তাঁরা মনে করেন, নিজের ভিতরকার কুপ্রবৃত্তিগুলোর সঙ্গে নিয়ত আধ্যাত্মিক লড়াই চালিয়ে যাওয়াই জেহাদ।
ইদানীং সারা বিশ্বজুড়ে আইএস, আল কায়দা, বোকো হারাম, তালিবান, হিজবুল মুজাহিদিনদের মতো অসংখ্য মুসলিম সংগঠন নিজেদের জিহাদি সংগঠন বলেই পরিচয় দেয় (অথচ জিহাদি শব্দটাই ভুল। দেশি বিদেশি সংবাদমাধ্যম তৈরি করে বিশ্বজুড়ে চালু করে দিয়েছে এই শব্দটা। জিহাদ যারা করে তারা জিহাদি নয়, মুজাহিদ)। আল কায়দার কর্ণধার ওসামা বিন লাদেনও ছিল মুজাহিদ। তারা ‘দারুল হরব’-কে ‘দারুল ইসলাম’ করার কাজে ব্রতী। বস্তুত ইসলাম সকল মুসলমানকে এই দায়িত্ব দিয়েছে। কোরানে সেইরকমই বলা হয়েছে। যে সমস্ত মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্রে এখনও গণতন্ত্রের সামান্য অবশেষ থেকে গিয়েছে সেখানে ‘আল্লাহর আইন’ বা শরিয়তি আইন কায়েম করতে চায় তারা। জেহাদের স্পষ্ট প্রতিফলন পাওয়া যায় আমেরিকার বিরুদ্ধে ওসামা বিন লাদেনের হুমকিতে। আমেরিকার প্রতি লাদেনের ঘোষণা ছিল: ‘হয় ইসলাম গ্রহণ করো, নয় ধ্বংসের জন্য প্রস্তুত হও’।
কিন্তু ইসলামি ধর্মতত্ত্ব মানলে দেখা যাবে, জেহাদ সেই রাষ্ট্রের জন্য বাস্তব যে রাষ্ট্র গোটা ইসলামি উম্মাকে শাসন করে। সেই উম্মার দায়িত্ব জেহাদের মাধ্যমে যত বেশি সংখ্যক ভিন্ন ধর্মীকে ইসলাম ধর্ম ও শাসনের মধ্যে এনে রাষ্ট্রের পরিধি বাড়িয়ে চলা। অন্তত রসুল সেই রকম একটা জেহাদই জীবনভর অনুশীলন করেছেন। অন্যান্য সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে জেহাদিদের পার্থক্য একটা বিশেষ ক্ষেত্রে। অন্যান্য সন্ত্রাসবাদীরা নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য সরকারকে চাপ দেয়। কিন্তু জেহাদিরা যখন জেহাদ করে, তখন শুধুমাত্র সরকারই তাদের লক্ষ্য নয়। জেহাদ সম্পর্কে এই মতের প্রবক্তারা বলেন, এই কাজ তারা করে গোটা মুসলিম জাতিকে উন্নত, জটিল, বহুমাত্রিক এই সমাজ থেকে আলাদা করে দিতে, যাতে গোটা সমাজ তাদের দিকে সন্দেহ ও ঘৃণার নজরে দেখে। যাতে তারা আরও গুটিয়ে নেয় নিজেদের, আরও সংহত করে নেয়, আরও সচেতন হয়ে পরে নিজেদের ধর্মীয় আইডেন্টিটি সম্পর্কে, যেটা তাদের মিথ্যা বিশ্বাসেরই অঙ্গ। ধর্মীয় আইডেন্টিটি সম্পর্কে নিজেদের মিথ্যা বোঝানো ওই অতি-সচেতন সংহত একটি মানবগোষ্ঠীকে খুব সহজেই ধর্ম বিষয়ে বিভ্রান্ত করা যায়। জেহাদিরা সেটা করে খুব দক্ষতার সঙ্গে। তারা ‘প্যান-ইসলাম’ (গোটা বিশ্বের ইসলামীকরণের তত্ত্ব)-এর দিবাস্বপ্ন দেখিয়ে তাদের ব্যবহার করে যন্ত্র হিসেবে। আর এই মানুষগুলো অন্যদের ঘৃণা ও সন্দেহ থেকে বাঁচার জন্য এই পথটাকেই সঙ্গত মনে করে। তারা যন্ত্রিকভাবেই প্যান-ইসলামের সমর্থক হয়ে পড়ে। সমর্থক হয়ে পড়ে জেহাদের, নিজের অজান্তেই। অন্যদিকে গোঁড়া মুসলমানেরা ইসলামি বিশ্বভ্রাতৃত্বের স্বপ্নে এতটাই ডুবে থাকে যে, যে দেশের নাগরিক হিসেবে তারা যাবতীয় সুযোগসুবিধা ভোগ করে, সেই দেশের জাতীয় জীবন থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখে। এই বিচ্ছিন্নতাই তথাকথিত বিশুদ্ধ ইসলাম এবং মৌলবাদ চর্চাকে প্রাসঙ্গিক করে তোলে। জাতীয় পরিচয়কে ছাপিয়ে উম্মার বিশ্বজনীনতা তাদের কাছে বড় হয়ে ওঠে। ফলে সিরিয়া, ইরান বা ইরাকের মুসলমানের শত্রু ব্রিটিশ, আমেরিকা, বা রাশিয়া ভারতীয়, বাংলাদেশি বা পাকিস্তানের মুসলমানের শত্রু হয়ে ওঠে। সম্ভবত একই কারণে এখন স্বৈরাচারি হয়ে ওঠা তুরস্কের মৌলবাদী প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িপ এরদোয়ান ভারতের মুসলমানের ‘প্রাণপ্রিয় নেতা’। কেবল ভারত নয় এই উপমহাদেশে মুসলমানের সামনে তিনি নতুন ভারসার মুখ। কারণ ৫৭টি মুসলিম দেশের সেনা বাহিনী ‘আর্মি অব ইসলাম’ গঠন করতে চেয়েছেন তিনি। এই প্যান ইসলামি সেনা তৈরি হবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জিহাদ করার জন্য। কারণ এরদোগান বলেছেন, ‘ধর্ম একটাই, ইসলাম’। কারণ তিনি বলেছেন, ‘জন্মনিয়ন্ত্রণ বা পরিবার পরিকল্পনা কোনও মুসলিম পরিবারের জন্য উচিত নয়।’ দেশের সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পরে ওই ‘বিশ্ব নায়ক’ ইসলামকে সাফ-সুতরো করতে নেমেছেন। এটাও এক ধরনের জেহাদ বইকি!
আরও আছে, বিশ্বজুড়ে মুসলমানের বিপন্নতার একটা ছবি এঁকে তার জন্য আমেরিকা এবং পশ্চিমী দুনিয়াকে দায়ী করার প্রবণতা। মুসলমানকে কারা বিপন্ন করছে? সাধারণভাবে দেখতে পাই ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো প্রায় প্রতিদিন কোনও না কোনও দেশে হামলা চালিয়ে শয়ে শয়ে নিরীহ মানুষ হত্যা করছে। তাদের মধ্যে মুসলমানই বেশি। এ সবই তারা করছে ইসলামে সম্পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করে। ইসলামি রাষ্ট্রগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য এই তাদের জেহাদ। উদার এবং শিক্ষিত মুসলিমদের কাছে ওই জিহাদ একই সঙ্গে আতঙ্ক, লজ্জা ও আশার নাম। তারা বোঝে যে, এই জগতে নিজেকে টিকিয়ে রাখাটাই সবচেয়ে বড় সংগ্রাম; তারা বোঝে, বর্তমানে আরবি ভাষা শিখে কোরান মুখস্থ করার চেয়ে কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন পড়া কাজের। কোরান হাদিসকে ধর্মগ্রন্থের বেশি কিছু মনে করার সময় নেই তাদের। ইসলাম বা জিহাদের সূক্ষ্ম তত্ত্ব তারা বোঝে না। এইসব নামেমাত্র মুসলিমরা প্রতিদিন দেখছে, জেহাদ কীভাবে বর্তমান বিশ্বকে সন্ত্রস্ত করে রেখেছে। এমনকী মুসলিম দেশগুলিও সন্ত্রাসের বাইরে থাকছে না। বিভিন্ন ইসলামি গোষ্ঠীর প্রত্যেকটিই মনে করছে, অন্য গোষ্ঠী হল তাদের ইসলামের বিরোধী। ফলে তারা একে অন্যের ওপর সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ চালাচ্ছে, পরিণতিতে প্রাণহানি। বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র ধ্বংসের পর থেকে আজ পর্যন্ত কুড়ি হাজারের ওপর সন্ত্রাসী আক্রমণ হয়েছে। হতাহতের সংখ্যা বেশ কয়েক লক্ষ। অমুসলিমরা তো এর শিকার হচ্ছেই, মুসলিমরা শিকার হচ্ছে আরও বেশি।
আর এক পক্ষ নিয়ম করে সাধারণ মুসলমানকে বুঝিয়ে চলেছে, ইসলামি সন্ত্রাসবাদী বলে যে প্রচার চলছে তা সবৈব মিথ্যা। এ সবই আমেরিকা এবং পশ্চিমী দুনিয়ার বানানো জেহাদিদের কাজ। এর সঙ্গে ইসলাম বা মুসলমানদের কোনও সম্পর্ক নেই। এই প্রচার চলছে। ইসলামি নানা সংগঠন ব্যক্তিগতভাবে বা সংগঠিত প্রচারে সাধারণ মানুষকে এই সবই বোঝাচ্ছে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিক সংবাদপত্রে প্রায়শই এই ধরনের লেখা বেরোয়। ২৯ অগস্ট প্রকাশিত একটি লেখা থেকে কিছু কিছু অংশ পাঠ করলে বুঝতে সুবিধা হবে জেহাদের কোন ব্যাখ্যা বাংলার সাধারণ মুসলমানের কাছে পৌঁছচ্ছে। উবায়দুর রহমান খান নদভি লিখেছেন, ‘আল কায়েদা, বিন লাদেন, আল আওলাকি, আইমান আল জাওয়াহেরি এসব নাম পশ্চিমাদের বহু অপকর্মে ব্যবহৃত হয়েছে। তারা প্রকৃতই যে আদর্শ নিয়ে যে সংগ্রাম চালিয়ে গেছে, সে বিষয়ে আলোচনা থাকতেই পারে। পশ্চিমাদের দ্বিমত ও বিদ্বেষ থাকাও স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের জড়িত না থাকা বহু ঘটনা পশ্চিমারা নিজেরা ঘটিয়ে তাদের নামে চালিয়ে দিয়েছে, এমন ঘটনাও কম নয়। মজার ব্যাপার হল, আইএস যত মানুষ মেরেছে তার ৯৯ ভাগ মুসলমান। অমুসলিম হত্যা বা ইজরায়েলে আক্রমণ আইএসের কার্যতালিকায় নেই।… কুরান সুন্নাহর অনুসারী প্রকৃত মুজাহিদদের স্বদেশ স্বজাতির স্বাধীনতা ও সম্মান পুনরুদ্ধারে বিশ্বব্যাপী ন্যায়ের যোদ্ধাদের ধ্বংস করতে দুশমনরাই ডামি মুজাহিদ তৈরি করে। এদের বিপক্ষে কেউ কথা বললে বলে এ লোক জিহাদকে অস্বীকার করছে। দুনিয়ার কোনও নীতিনিষ্ঠ মানুষই জিহাদকে অস্বীকার করতে পারে না। তাহলে যুগে যুগে ন্যায়ের সংগ্রাম ও মুক্তির লড়াই চলত না। পশ্চিমারা জিহাদকে ভয় পায়। তাই জিহাদি পরিবেশে তারা দালাল ঢুকিয়ে এর যৌক্তিকতা ও পবিত্রতা নষ্ট করে। নাসারাদের দীর্ঘ পরিকল্পনা থাকে, তারা মুসলমান সন্তানদের বাবা-মা থেকে আলাদা করে শরণার্থী বানায় এবং পরে ‘ছেলেধরার মতো নিয়ে যায়। অজ্ঞাতস্থানে তাদের লালনপালন করে হিংস্র বানায়। ধর্ম ও মনুষ্যত্বের দুটোই কেড়ে নেয়। এরপর যেখানে প্রয়োজন মনে করে লেবাস পাগড়ি লাগিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কাউকে মুজাহিদ বানায়, কাউকে আত্মঘাতী, কাউকে বিশাল ইসলামিক লিডার। আসলে এরা ভাগ্যহত রোবট মাত্র।…’ অদ্ভুত এই প্রচার কেবল খবরে কাগজে সীমাবদ্ধ নেই। ইসলামি জলসায় চিৎকৃত বক্তৃতার মাধ্যমে গ্রাম-গঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। সাধারণ মুসলমান জেহাদের এই ব্যাখ্যাই শুনছে। বড় জেহাদের তত্ত্ব তাদের কাছে অবান্তর অপ্রাসঙ্গিক। সহজিয়াদের আত্মার শুদ্ধির তত্ত্ব এদের কাছে শরিয়ত বিরোধী।
তৃতীয় পর্ব
আধুনিক রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে সর্বপ্রথম জেহাদ ঘটিয়েছিল ভারতীয় মুসলমানেরাই। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পরে। এক রাজদ্রোহী সিপাই উত্তর ভারতের জৌনপুর শহরে দিল্লির নবাবের শাসন ঘোষণা করে স্থানীয় এক দরবেশের কাছে ইংরেজের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার ফতোয়া প্রার্থনা করেন। কারণ মুসলমানদের একটা অংশ মনে করেছিলেন, মুসলমান শাসকদের পরাজিত করে ইংরেজ ভারত দখল করার পরে এই দেশ আর ‘দারুল ইসলাম’ নেই। ‘দারুল হরব’ মুসলমানের বসবাসের যোগ্য নয়। প্রকৃত মুসলমানকে হয় জেহাদ করে ভারতকে ফের দারুল ইসলামে পরিণত করতে হবে, নয়তো এ দেশ থেকে হিজরত করে কোনও মুসলিম দেশে চলে যেতে হবে। প্রথমে সাহ আবদুল আজিজ নামে এক আলেম, পরে বৃহত্তর আলেম সমাজ ফতোয়া দেয়, ভারত দারুল হরব— শত্রুর দেশ। কারণ কলকাতা থেকে দিল্লি সর্বত্রই পৌত্তলিকতা (কুফর ও শিরক) বলবৎ হয়ে গেছে এবং আমাদের শরিয়তি আইন আর প্রতিপালিত হয় না। তাঁদের সিদ্ধান্ত ছিল, কলকাতা ও তার অধীন অঞ্চল সমূহ শত্রুর দেশ (দারুল হরব)। তাতে ওয়াহাবিরা এই সিদ্ধাম্তে উপনীত হয় যে, ভারতের শাসকের বিরুদ্ধে জেহাদ করা কর্তব্য।
তাই নিয়ে গোটা দেশে মুসলমানদের মধ্যে তুমুল বিরোধ ও বিতর্ক শুরু হয়। শিয়া এবং সুন্নি দুই সম্প্রদায়েরই আলেমরা ফতোয়া আর পাল্টা ফতোয়া দিতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত নানা যুক্তি দেখিয়ে ভারত দারুল ইসলাম না হলেও এই দেশ দারুল হরব হয়ে যায়নি বলে সিদ্ধান্ত নেন আলেমরা। জেহাদের পথে গিয়ে ভারতের লাখো মুসলমানকে অনিবার্য দুর্গতির হাত থেকে বাঁচাতে এমনকি এই মতের পক্ষে মক্কার মুফতিদের কাছ থেকেও ফতোয়া আনানো হয়। তাঁদের ফতোয়া ছিল, ‘যতদিন ভারতে ইসলামের কোনও বিশিষ্ট আচার-অনুষ্ঠান পালিত হবে, ততদিন সেটা দারুল ইসলাম। এবং দারুল ইসলাম কাফেরদের হাতে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দারুল হরব হয়ে যায় না। তা হয় যখন সব কিংবা অধিকাংশ ইসলামের বিধিবিধান সেখানে রদ হয়ে যায়। উত্তর ভারতের আলেম সমাজ ফতোয়া দেয়, যে দেশে মুসলমানের আমান (ধর্মীয় নিরাপত্তা) থাকে সে দেশে জেহাদ থাকে না। কারণ জেহাদের সবচেয়ে দরকারি শর্ত হল, দেশে মুসলমানের আমান এবং আজাদি থাকবে না। এই অবস্থা এখানে নেই। কলকাতা মোহামেডান সোসাইটির ফতোয়া ছিল আরও স্পষ্ট এবং কড়া। তাঁরা বলেন, ‘যদি কোনও বিপথগামী দুর্বৃত্ত দেশের শাসকদের বিরুদ্ধে জোহাদ করে, তাহলে সেই জেহাদকে বিদ্রোহ বলে ঘোষণা করা আইনসঙ্গত হবে। আর বিদ্রোহ শরিয়তে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।’ বিদ্রোহ হলে মুসলমান প্রজাদের কর্তব্য হবে তাদের দমন করতে শাসককে সাহায্য করার নির্দেশ দেওয়া হয় ওই ফতোয়ায়। এ নিয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য ডবলু ডবলু হান্টার রচিত ‘দ্য ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ (১৮৭১ খ্রি.) গ্রন্থে পাওয়া যাবে।
সব ধর্মে যেমন হয়, ইসলামেও প্রয়োজনমতো ধর্মীয় নিদান নিজেদের সুবিধামতো বদলে নেওয়া যায়। আল কায়দা বা আইএসের মতো জঙ্গি সংগঠনগুলোও প্রতিটি কাজ শরিয়ত মোতাবেক করছে বলে কেবল দাবিই করে না, তারা তার পক্ষে কোরান হাদিস এবং ইসলামি অন্যান্য শাস্ত্রগ্রন্থ থেকে তার ন্যায্যতারও প্রমাণ দেয়। ধর্ম সবই সয়, ধর্মে সবই হয়— তবেই সে ধর্ম লক্ষ কোটি মানুষের মধ্যে টিকে থাকতে পারে এবং বিকশিত হয়।
আরও একটা জেহাদের কথা শোনা যাচ্ছে ইদানীং— যৌন জেহাদ। তিউনিসিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লতিফ বেন জেদদৌ বলেছেন, তাঁর দেশ থেকে বহু নারী সিরিয়ায় পাড়ি জমিয়ে সেখানকার সরকার বিরোধী ইসলামপন্থীদের ‘জিহাদে’ যোগ দিয়েছেন। তবে ওই নারীরা অস্ত্র নিয়ে লড়াই চালাচ্ছেন না। ‘জিহাদ-আল নিকাহ’ হিসেবে পরিচিত যুদ্ধকালীন সাময়িকভাবে বিয়ে করে তাঁরা মুজাহিদদের ‘উদ্দীপ্ত’ করে পরোক্ষভাবে ‘জিহাদ’ করছেন। ‘হাফিংটন পোস্ট’-এর এক প্রতিবেদন এ খবর জানা গেছে। সুন্নি সালাফিপন্থী কিছু আলেমের মতে, যুদ্ধকালীন সাময়িক বিবাহ বা ‘জিহাদ আল নিকাহ’ বৈধ। এই ধরনের ‘জিহাদি বিবাহ’তে কোনও মুসলিম নারী কোনও মুজাহিদকে বিয়ে করে তাঁর যৌনসঙ্গী হতে পারেন। আবার দ্রুতই তাঁরা বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন। এই ধরনের সাময়িক বিয়ের মাধ্যমে একজন নারী এক দিনে একাধিক পুরুষের শয্যাসঙ্গী হতে পারেন।
ইদানীং সংবাদমাধ্যম এবং সঙ্ঘ পরিবারের প্রচারের কল্যাণে ‘লাভ জেহাদ’ নামে একটি জেহাদের কথাও প্রায়শ শোনা যাচ্ছে। ২০০৮ সালের আগে ‘লাভ জেহাদ’ (শুরুতে ছিল ‘রোমিয়ো জেহাদ’) শব্দবন্ধটির এত পরিচিতি ছিল না। ২০০৯ সালে প্রথম কেরল ক্যাথলিক বিশপ কাউন্সিল দাবি করে, লাভ জোহাদের লক্ষ্য সাড়ে চার হাজার মেয়ে। ওই অভিযোগ উঠতেই হিন্দু জনজাগৃতি সমিতি দাবি করে, কর্নাটকের ৩০ হাজার মেয়েকে ইতিমধ্যেই ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। কেরল হাইকোর্টের এক বিচারপতি পুলিশকে গোটা বিষয়টি তদন্ত করার নির্দেশ দিলে নতুন এই শব্দবন্ধ এক ধরনের বিচারবিভাগীয় মান্যতা পেয়ে যায়। অথচ দুই রাজ্যেরই তদন্তকারী সংস্থা তদন্তের শেষে অভিযোগের সারবত্তা খুঁজে পায়নি। প্রতি ক্ষেত্রেই মুসলিম ছেলের প্রেমে পড়ায় পরিবারের চাপে মেয়েটিকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। অভিযোগ ভুল প্রমাণিত হলেও গোটা বিতর্কটা হিন্দু মৌলবাদীদের হাতে রসদ তুলে দেয়। এই ‘লাভ জেহাদ’ বিতর্কে সব থেকে বড় ক্ষতি হচ্ছে মেয়েদেরই। সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে মেয়েদের স্বাধীন মতামতের গুরুত্বই সেখানে অর্থহীন। প্রথাবিরুদ্ধ পাত্র নির্বাচনের মাশুল হিসেবে, হয় সে সমাজ থেকে বহিষ্কৃত হয়, নয়তো কখনও ধর্ষিতার তকমা দিয়ে কখনও বা জোর করে ধর্মান্তরকরণের তত্ত্ব খাড়া করে, তার স্বাধীন-সত্তার অস্তিত্বটাকেই অস্বীকার করা হয়। লাভ জোহাদ নিয়ে মূলত ক্যাথলিক এবং হিন্দুত্ববাদীরাদের প্রচার প্রতিবেশী মুসলমানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে ভয়ের পরিবেশ তৈরির জন্য। সে কাজে তারা অনেকটাই সফল।