হিন্দোল ভট্টাচার্য
ব্যক্তিগত লেখা বলে আসলে কিছুই হয় না। কারণ কোনও লেখাই ব্যক্তিকে ছাপিয়ে হতেই পারে না। অবশ্য এর বাইরেও অনেক কিছু ভাবনা আছে। কিন্তু আমি ছাড়া আমার অভিজ্ঞতাগুলি নয়। আর অভিজ্ঞতা ছাড়া লেখা সম্ভবত সম্ভব হয় না। তা, সে যেরকম অভিজ্ঞতাই হোক না কেন। চারিদিকে এখন ভয়ানক অসহিষ্ণু বাতাবরণ। যা থেকে বাদ পড়ছে না কোনওকিছুই। মানুষ যেন তপ্ত লোহার উপর বসে আছে। কিছু না কিছু মন্তব্য করতেই হবে।
বহু আগে একটা ফিল্ম দেখেছিলাম। দ্য ট্রুম্যান শো। একজন মানুষ জীবনের প্রথম থেকেই, সেই বাচ্চা বয়স থেকেই বড় হচ্ছে একটা রিয়েলিটি শো-এর অংশ হয়ে। মানে, তার আজীবন একটা রিয়েলিটি শো। কী ভয়ঙ্কর! তার নিজস্ব কোনও ইচ্ছে নেই। তার জীবনে যা কিছু হচ্ছে সবকিছুই স্ক্রিপ্টেড। আমার বিশ্বাস, দ্য ট্রুম্যান শো এক গভীর রাজনৈতিক ছবি। তাদের সঙ্গে একমত নই, যাদের মতে ছবিতে কেবল একটি বিশেষ মতাদর্শের গন্ধ মাখা ডিসকোর্স সহ ছবিই হল রাজনৈতিক ছবি। রাজনীতির ক্ষেত্রে, বামপন্থী বা কমিউনিস্ট-পন্থীদের প্রতি এটিই আমার বড় একটা অভিযোগের জায়গা। তাঁরা সম্পূর্ণভাবেই হলেন অনুবাদ প্রজাতি। মানে, তাঁরা যখন ভাবেন, বা প্রকাশ করেন, তখন কিছু পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা ধারণাকেই পুঁথিগত জার্গনে প্রকাশ করতে ভালোবাসেন। আর এই বারবার এত জার্গনের ব্যবহারে, এত ছাঁচে ফেলা রাজনৈতিক কবিতা, উপন্যাস, রাজনীতি নিয়ে ধারণার প্রেক্ষাপটে, যা হারিয়ে যায়, তা হল ডায়ালগ। আজ যে হলিউড, স্পেন, দক্ষিণ আমেরিকা বা ইউরোপের ছবিগুলিতে আগামী পৃথিবীর ধ্বংসের ছবি, ডিসটোপিয়ার ছবি ফুটে উঠছে, সেই ছবিগুলি কেন রাজনৈতিক ছবি নয়? কেননা যদি এটা স্বীকার করে নিই, সামাজিকভাবে বেঁচে থাকার সমস্ত কিছুই রাজনৈতিক, তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, মানুষের একটা ভয়ঙ্কর সময়ের কল্পনা, সেটিও গভীরভাবে রাজনৈতিক। আর এই রাজনীতি এই সময়ের রাজনীতি-ই। এইবার কোনও তেমন ছবি আর মনে হয় না এই যুগে সম্ভব যা কেবল মার্ক্সীয় দর্শনকে মাথায় তুলে নাচবে। কারণ এখন আরও অনেক অনেক প্রশ্নের জন্ম হয়ে গেছে আমাদের মধ্যে, যে প্রশ্নগুলির উত্তর মার্ক্সবাদের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে না। মার্ক্সীয় দর্শনের কথা যদি আমরা ছেড়েও দিই, কমিউনিস্ট পার্টির এই অচলায়তন-সম কাঠামো নিয়েও অনেক প্রশ্ন উঠে গেছে। তাদের নির্মিত ইতিহাসের মধ্যে যে বহু ইতিহাস চাপা পড়ে আছে, সেগুলি নিয়েও অনেক প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই আছে। ইতিহাসকে যতই চাপা দিয়ে রাখুন না কেন, ইতিহাস তো চাপা পড়ে থাকবে না, থাকেওনি।
তবে, প্রশ্নটা সেটা নয়। প্রশ্নটা হল, সমস্ত কিছুই রাজনৈতিক হলেও, সবকিছু হয়ত রাজনীতির বিষয় নয়। রাজনীতি বলে যে বিষয়টি চলছে তা কিছু অতি মিডিওকার লোকেদের কার্যধারা। তাদের শয়তানি, তাদের নির্বুদ্ধিতা, তাদের বিরোধিতা, তাদের বক্তব্য, তাদের মন্তব্য— এত অসহিষ্ণু, এত লাজলজ্জাহীন, এত মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিকে অপমান, যে মনে হয়, এরা কীভাবে আশা করে, যে মানুষ এদের শ্রদ্ধা করবে! সে আশা হয়ত এরা করেও না। মানুষে মানুষে শ্রদ্ধা বিষয়টি এমনিতেই সমাজ থেকে অন্তর্হিত। চিড়িয়াখানা উপন্যাসের সেই নিশানাথ সেনের কথা মনে পড়ে। যে জাতি নিজেদের শ্রদ্ধা করতে ভুলে গেছে, সে জাতি আর অপরকে শ্রদ্ধা কীভাবে করবে! কিন্তু এ সব হল কিছু সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের প্রশ্ন। এমন একটা সময় শরদিন্দু এই লেখাটি লিখেছিলেন, অন্তত সেই সময়েও মানুষের প্রতি মানুষের সামান্য হলেও শ্রদ্ধা ছিল। ৪৭-এর দাঙ্গা মাথায় রেখেই বলছি।
ধরুন আজ যদি আমি জিজ্ঞেস করি, আমি বা আপনি বা তুমি আসলে কী? আমাদের কবিতা লেখা বা কিছু অন্তত লেখা আসলে কী? এগুলির উদ্দেশ্য কি কেবল কিছু লেখা? তার পর তা থেকে বই প্রকাশ, কোথাও সেই কবিতা পড়া ইত্যাদি ইত্যাদি? প্রাণের আনন্দেই লেখা এ বিষয় তর্কের অতীত। কিন্তু এই যে লেখাটি লিখলাম, তা থেকে আমি কোথায় গেলাম? একজন কবি বা লেখক না থাকতে পেরে লেখাটি লিখছেন, কিন্তু লেখাটি যখন তিনি লিখছেন, তাঁর মনোজগত, তাঁর অস্তিত্বজগতের মধ্যে ঢুকে পড়ছে। একটি প্রেমের কবিতার মধ্যেও রয়েছে তাই সেই গভীর বিপন্ন দার্শনিক সঙ্কট। আর সেই সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে সেই প্রশ্ন— আমি কে? আমি কি একটি অসমাপ্ত গল্প? আমি একটি বিন্দুহীনতা থেকে আরেক বিন্দুহীনতার দিকে এগিয়ে চলেছি? কারণ আমি ছিলাম না কোথাও। এই যে বিপুল মহাবিশ্ব, তার মধ্যে আমি একটি অংশ, আমি ছাড়া এই বিপুল মহাবিশ্ব নেই। আবার আমি ছাড়াও সে আছে। কারণ আমি ছাড়াও সে ছিল। তাহলে কি আমার এখানে থাকাটি কেবল দুর্ঘটনা? না কি কোনও নির্দিষ্ট অভিসন্ধি আছে মহাজগতের? মহাবিশ্বের এই অসংজ্ঞাত অবস্থার সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দেওয়ার মধ্যে রাজনীতি কোথায়, তা আমি জানি না। আমি এর মধ্যে যেটি দেখতে পাই, তা হল এক অনিশ্চয়তার আবহমানতা। চিরকালীন প্রশ্নচিহ্ন। রাজা বা লোক কোনও নীতির সঙ্গেই এই সঙ্কটটা যাচ্ছে না, যা আমি আকাশের দিকে তাকালেই অনুভব করি, যা অনুভব করেছিলাম আমার বাবা যখন পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে পুড়ে যাচ্ছিলেন। এটা কি খুব বোকার মতো একটা বিস্ময়ের কথা হবে, যদি বলি, বুঝতে পারি না, এই রাজনৈতিক নেতারা কি মৃত্যুভয় পান না? না কি আদৌ ভাবেন না? মৃত্যু, নশ্বরতা, অনিশ্চয়তা, একটা অসমাপ্ত অসমীকরণের মতো। জীবনের সঙ্গে আদৌ ক্ষমতার সম্পর্ক কী, এ সম্পর্কে আমার ভাবনা কোনও তল পায় না। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারি, এই নশ্বরতার ক্ষমতাদখল এবং ক্ষমতাকায়েমের সঙ্গে এই প্রশ্নের সম্পর্ক ছিল না বলেই হয়ত গৌতম বুদ্ধ সবকিছু ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।
আধ্যাত্মিকতা বলতেই তো আর ধর্মানুসারী নয়। আধ্যাত্মিকতা এক ধরনের সংযোগ। যা রাজনৈতিক নয়, বরং মহাজাগতিক। কিন্তু মহাজাগতিক বললেই যে মনে হয় অনেকের, ঈশ্বর ইত্যাদি। সেক্ষেত্রে? একটি রাস্তা তো একটি রাস্তা নয়। তার মধ্যে থাকে অনেকগুলি রাস্তা। হয়ত পাশাপাশিই থাকে। জীবনের, বেঁচে থাকার, অনুসন্ধানের এবং বিপন্ন বিস্ময়ের এই অনেকগুলি রাস্তার প্রতিটিই যে সত্য, তা স্বীকার করতে আমাদের অসুবিধে কোথায়? বরং আমি দেখি ভাবনার জগতে এক প্রবল মৌলবাদ। তা, সে মৌলবাদ যদি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকদের হয়, তবে তা যেমন মৌলবাদ, তেমন, তা যদি সাম্যবাদী বামপন্থীদের হয়, সেটিও মৌলবাদ। রাজনীতির কথা বলতে এলে, আমাদের হয়ত এখানে আসতে হবেই। অর্থাৎ, রাজনীতি যেভাবে আমাদের ডায়ালগকে নিয়ন্ত্রণ করে। যদি বলে কেউ, মহাজগতে সত্য একটিই, তবে তা যেমন এক ধরনের ফ্যাসিস্ট ভাবনা, তেমন যদি কেউ বলে, মার্কসবাদ সর্বশক্তিমান, কারণ ইহা সত্য, সেটিও হয়ে যায় ফ্যাসিস্ট ভাবনাই। ভাবনাকে এই নিজেদের ভাবনা দিয়ে নিজের মতো ছাঁচে ফেলার যে রাজনীতি, তা মনে হয় না নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে অপসারণ করা যাবে। আমি তো দেখি, আমাদের দেশের সমস্ত রাজনৈতিক পার্টিগুলিই এমনভাবেই ফ্যাসিস্ট। তবে, ফ্যাসিবাদী প্রবণতার মাত্রা এবং উদ্দেশ্যে তো পার্থক্য আছেই। তাই বিজেপির মতো দল হল প্রকৃতই ফ্যাসিস্ট যারা আমাদের দরজায় হানা দিচ্ছে, লালচক্ষু দেখাচ্ছে, ইতিহাসকে বিকৃত করছে অত্যন্ত নগ্নভাবে। কিন্তু তাদের বিরোধী শক্তিগুলিও তো ভাবনার একদেশদর্শিতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য ফ্যাসিবাদী প্রবণতার জন্ম দিয়েই দিয়েছে। ফ্যাসিবাদ তবে কি একপ্রকার সংক্রামক ব্যাপার?
মুশকিল হল, এখন আমার চারপাশকে দেখে মনে হয় না, মানুষ তার অস্তিত্ব নিয়ে খুব একটা ভাবিত। মানুষের মধ্যে বিস্ময়ের ভাবটাও খুব কমে যাচ্ছে। হয়ত কেউ এখন আকাশের দিকে এমন বিস্ময়ের চোখে তাকাচ্ছেন না এই ভেবে, যে এই বিপুল মহাবিশ্বে, তার অস্তিত্ব প্রকৃতপক্ষেই কারণহীন, আকস্মিক, দুর্ঘটনাপ্রবণ। কিন্তু এ সব ভাবলে মানুষ কীভাবে আস্তিক বা নাস্তিক হবে? কেননা আস্তিকতাও তো একপ্রকার কার্যকারণসূত্রের দর্শনকেই প্রতিফলিত করে। আমরা রয়েছি, এটাই আশ্চর্যের। এ প্রসঙ্গে একবার এক জেন সাধুকে তার শিষ্য জিজ্ঞেস করেছিলেন, জীবনের উদ্দেশ্য কী? সেই সাধু উত্তর দেননি। আবার জিজ্ঞেস করেছিলেন— আমরা এত অসহায়ভাবে জীবন কাটাই কেন? সেই সাধু তাও কোনও উত্তর দিলেন না। শিষ্য এমন প্রশ্ন করেই গেলেন। শেষপর্যন্ত সেই শিষ্য দেখলেন উত্তর পাওয়া যাবে না। তিনি ধ্যানে বসলেন। সেই সময় সাধু বলে উঠলেন— তুমি যে এই প্রশ্ন করেছ, এটাই হল উত্তর।
শিষ্য সেদিন জেন প্রাপ্ত হলেন।
আমরা এসব পড়ার পরেও হলাম না।
(ক্রমশ)