উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়
সদ্যোসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল দেখে আপাত দৃষ্টিতে মনেহতে পারে, বামপন্থা হয়তো বা শেষ। কিন্তু, প্রকৃত বিচারে, বামপন্থা তো পার্টি-নির্ভর নয়। জীবন-নির্ভর। একটি বিশেষ মতামতের উপর তা দাঁড়িয়ে থাকে। সেই মতামতটি হল, পৃথিবীতে একটি দ্বন্দ্বই মৌলিক এবং তা হল পুঁজির সঙ্গে শ্রেণির দ্বন্দ্ব। এই মত কার্ল মার্ক্স সমবেত করেছিলেন সত্য, কিন্তু তিনিই এর স্রষ্টা এমন কথা বলা যায় না। মার্ক্সের আগে সমাজতন্ত্র নিয়ে যাঁরা ভেবেছেন তাঁরাও মূলত শ্রেণিদ্বন্দ্বকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলেন। এঁদের মধ্যে সাঁ সিমো উল্লেখযোগ্য। সিমো সরাসরি পুজিবাদকে অস্বীকার করে সমাজতন্ত্রে ঝাঁপ দেওয়ার কথা বলেছিলেন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ সঙ্কট কি তীব্র হতে পারে, তার প্রথম ইঙ্গিত দিয়েছিলেন সাঁ সিমো এবং সেই অর্থে কাল্পনিক সমাজতান্ত্রিকেরা। কিন্তু মার্ক্সই প্রথম বললেন যে পুঁজিবাদ অবশ্যই একটি ব্যবস্থা যার মধ্যে শ্রেণিদ্বন্দ্বগুলি প্রথম প্রকট হয়ে দেখা দেয়। এখানে শ্রেণি বলতে মার্ক্স একটি বিমূর্তায়নের কথা বলেছেন যা খুব আক্ষরিক অর্থে প্রযোজ্য নয়। মার্ক্স হলেন সেই সমাজবিজ্ঞানী যিনি মনে করতেন যে, সমাজকে যেহেতু টেস্ট টিউবে ঢুকিয়ে পরীক্ষা করা যাবে না তাই তাকে বোঝার একটি মানদণ্ড প্রয়োজন। এই মানদণ্ডটি হল শ্রেণি। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, শ্রেণিকাঠামো কিছুটা স্পষ্ট হয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যেখানে পুরনো সামাজিক সম্পর্কগুলি ভেঙে পড়ে। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রেণির বাস্তবতা থাকলেও তা অতটা স্পষ্ট হয় না, কারণ ধর্ম বা সামাজিক অন্য মোহ বেশি ক্রিয়াশীল থাকে। মার্ক্সের এই বক্তব্যটি ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপের প্রেক্ষাপটে রচিত।
পৃথিবী তার পর অনেক পালটে গিয়েছে। উপনিবেশবাদ পরিণত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদে। সেই সাম্রাজ্যবাদের দাপটে যেমন বিশ্বযুদ্ধ আমরা দেখেছি, তেমনই দেখেছি দ্বিমেরু প্রবণতা, ঠান্ডা লড়াই ইত্যাদির মাধ্যমে প্রসারিত এক বিশেষ জাতীয়তাবাদ যা মার্ক্স দেখে যেতে পারেননি। সোভিয়েত তৈরি হল এক রাষ্ট্রে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় তা এক বিশেষ সামরিক রাষ্ট্রে পরিণত হল যার মূল লক্ষ্য রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বকে রক্ষা করা। তা কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি বিশেষ মডেল হয়ে উঠতে পারল না। পূর্ব-ইউরোপের রাষ্ট্রগুলিও সোভিয়েতের পদাঙ্ক অনুসরণ করার ফলস্বরূপ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশ হল না। চেকোস্লোভাকিয়ায় সোভিয়েতের অনুপ্রবেশ অবশ্যই মার্ক্সবাদ সম্মত নয়। পুরোটাই হয়ে উঠল সোভিয়েতের স্বার্থরক্ষার খেলা। জনমানসে যে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে, সেটা চিন্তাই করা হল না। যুগোস্লাভিয়া আগে বেরিয়ে গেল সোভিয়েত ব্লক থেকে, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের হাত ধরে। কিন্তু গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা মানুষের মনে ক্রমেই বাড়তে লাগল। এরই প্রভাবে ১৯৮৯-এ বার্লিন ওয়ালের পতন এবং সামগ্রিকভাবে পূর্ব-ইউরোপ জুড়ে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিনাশ। এ নিয়ে অবশ্য হাহুতাশ করার কিছু নেই। সোভিয়েতের গ্লাসনস্ত এবং পেরেস্ত্রইকা দুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। ১৯৯০-এর দশকে নতুন করে ভাবনাচিন্তা শুরু হল বামপন্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে। এতদিন যে একদেশীয় সমাজতন্ত্র নির্মাণের ব্যবস্থা ছিল, তা কিছুটা পরাজিত হওয়ার ফলে নতুন করে ভাবনাচিন্তার ঢেউ উঠল।
পুঁজিবাদ তার সর্বোচ্চ শিখর স্পর্শ করেছে। এমতাবস্থায় প্রয়োজন ছিল চিন্তার জগতে নতুন মন্থনের। কিন্তু প্রথাগত বামপন্থায় তার অভাব রয়েছে। সেই পুরনো চিন্তার ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হল না। সেই একই পার্টি-কাঠামো, সেই একই স্লোগানের পুনরাবৃত্তি বামপন্থী ভাবনাকে আচ্ছন্ন করে রাখল। অবশ্যই তা মূলস্রোতের বামপন্থা। কিন্তু যে শোষণ ও বঞ্চনার আর্থসামাজিক প্রেক্ষিতে এই বাম ভাবনার শুরু, তার বাস্তব পরিবর্তনের তো কোনও সম্ভাবনা নেই। বরং তা আরও পল্লবিত হয়ে উঠল।
পুঁজিবাদের এই পর্বটি তার নখ দাঁত প্রকাশ করছে বিশ্বায়নের হাত ধরে। আমাদের অর্থনীতি, শিল্পনীতি শুধু নয়, সামগ্রিকভাবে পুরো সামাজিক পরিসরটাই দখল করে নিয়েছে নব্য পুঁজিবাদ। আমাদের ভাবনাচিন্তায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে পরিচিতি সত্তার দ্বন্দ্ব। এটি পুঁজিবাদী আগ্রাসনের একটি নয়া কৌশল। সাংস্কৃতিক ভুবনেও যে লড়াইটা ছিল, তা আজ প্রায় অস্তমিত। মানুষ তার স্বার্থের গণ্ডি অতিক্রম করতে দ্বিধান্বিত। শ্রমিকদের কষ্ট কমেনি, বরং বেড়েছে। নয়া পুঁজিবাদের সঙ্গে লড়াই চালানোর মতো কোনও বিকল্প পথ খোলা থাকছে না। মানুষ নানা সরকারি প্রকল্প এবং চমকে খুশি হচ্ছেন।
এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন। সরকারি প্রকল্পগুলি অবশ্যই দরকার। যখন সামগ্রিকভাবে কাজের সুযোগ কমে যাচ্ছে, সেখানে অন্তত কিছু রিলিফ পাওয়া জরুরি। সরকার বিভিন্ন ভাতা দেওয়ার মাধ্যমে এই কাজটি করেন। কিন্তু সামগ্রিক বিচারে এটা একটা ইলিউশন হয়ে দাঁড়ায়। যদি শিক্ষান্তে কাজের সুযোগ পাওয়া না যায়, সেক্ষেত্রে যে সরকারি সাহায্যের কথা বলা হচ্ছে তা একান্তই একটি বিফল প্রয়াস হয়ে দাঁড়ায়। সামাজিক ক্ষেত্রে সরকারের বিনিয়োগ যথেষ্ট বাড়লেও তার যথাযথ বিকাশ যদি মানবসত্তায় ছাপ ফেলতে না পারে, তবে সমস্তটাই একপ্রকার ভ্রান্তির বাতাবরণ তৈরি করতে পারে। শিল্পক্ষেত্রে শ্রমিকদের দাবিদাওয়া মেটানোর দায়িত্ব নিচ্ছে সরকার, কিন্তু তবু যথাযথ বিনিয়োগ সম্ভব হচ্ছে না। অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ হয়তো কিছু বাড়ছে, কিন্তু সেখানে শ্রমিকদের সমবেত হয়ে নিজেদের দাবিদাওয়া পেশের সুযোগ কম।
প্রশ্ন থাকতে পারে যে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বামপন্থী আন্দোলনের ধারা কি শুধুই নির্বাচনকেন্দ্রিক জয়-পরাজয়ের উপর নির্ভরশীল থাকবে? নাকি বৃহত্তর কোনও বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে? এখানেই ভাবতে হবে আমাদের দেশের সমাজবাদী ঐতিহ্যের কথা। এককালে জাতীয়তাবাদী ভাবনার একটা অংশে ছিল সমাজবাদী ভাবনার নির্যাস। সেটা ছিল জওহরলাল নেহরুর ভাবনা। কিন্তু পরবর্তীতে সমাজবাদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস একাকার হল। একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের এই প্রবণতার ফলে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ বা রাজন্যভাতা বিলোপের মতো কার্যক্রম যথেষ্ট আলোড়ন ফেললেও বামপন্থীদের মূল স্রোত তার সঙ্গে একাত্ম হতে পারেনি। জরুরি অবস্থার সময় গান বাঁধা হয়েছিল, “বাবু সমাজবাদ ধীরে ধীরে আয়ি/ লাঠি সে আয়ি, গোলি সে আয়ি”।
এই শতকে নরেন্দ্র মোদি নামক বিশাল ঘটনাটির সঠিক মূল্যায়ন করতে বামপন্থীরা ব্যর্থ হচ্ছেন। তিনি হিন্দুত্বের ধ্বজা নিয়ে যে ফ্যাসিবাদী সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তা অত্যন্ত বিপজ্জনক। মুখে গরিবদের প্রতি দরদ, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে অতিসক্রিয় রাষ্ট্রীয় শক্তির কার্যকলাপের প্রভাবে তা অস্তমিত। গোরক্ষার নামে তাণ্ডব, বিরুদ্ধ মতাদর্শ প্রচারকারীদের হত্যা আমাদের সমাজজীবনকে বিস্রস্ত করে রেখেছে। এর থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে হবে বামপন্থীদেরই, কারণ একমাত্র তাঁরাই আর্থসামাজিক ক্ষেত্রের সমালোচনা করতে পারেন, যতই সাংগঠনিক দিকটি এই মুহূর্তে দুর্বল মনে হোক। কিন্তু তার জন্য কেবল রাজনৈতিক দলনির্ভর আন্দোলন করলেই চলবে না, প্রয়োজন ব্যাপক সামাজিক আন্দোলনের। ভক্তি আন্দোলনের দেশ ভারতবর্ষ। সেখানে একচ্ছত্র একটি রাজনৈতিক সংলাপ প্রাধান্য পেতে পারে না। বহুত্বের সাধনা বিফল হতে পারে না। শোষণ-কাঠামো অব্যাহত রেখে রাজনৈতিক বোলচাল বেশিদিন সফল হতে পারে না। প্রয়োজন সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে যাওয়ার জন্য একটি নয়া বামপন্থা, যা কখনওই সর্বদা পার্টি দ্বারা চিহ্নিত হবে না। বামপন্থী ভাবনাই পুঁজিবাদ ও সামাজিক আগ্রাসনের এই সর্বগ্রাসী প্রভাবকে প্রতিহত করতে পারে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন নিরন্তর প্রয়াস, যা সামাজিক ক্ষেত্রগুলিতে আলোড়ন তুলবে। সে পথেই মুক্তি। বিরুদ্ধ যুক্তির স্পর্ধা এবং সাংগঠনিক প্রয়াস একদিন স্বপ্নের ভোর আনবেই।