রেজাউল করীম
প্রচারের ঢক্কানিনাদে কান পাতা দায়। সে প্রচারের মূল কথা হল— বামপন্থা শেষ, তারা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। মনে পড়ল মুজতবা আলি সাহেবের একটি চুটকুলা— নিউ ইয়র্কের রাস্তায় কাগজওয়ালা চেঁচিয়ে বলছে,”রাশিয়ানরা চাঁদে পৌঁছে গেছে, রাশিয়ানরা চাঁদে পৌঁছে গেছে।” দলে দলে আমেরিকান বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করতে লাগল— “সবাই, সবাই?”
বামপন্থীহীন পৃথিবীর স্বপ্ন অনেকে দেখেছেন, হিটলার, মুসোলিনি, রোনাল্ড রেগান। তাঁদের সবার আশায় ছাই দিয়ে বামপন্থা বিস্তৃত হয়েছে, সারা পৃথিবী জুড়ে। ল্যাটিন আমেরিকা থেকে এশিয়া ছাড়িয়ে ইউরোপে ডানা মেলেছে। বামপন্থার স্বপ্ন সমানাধিকার, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, ক্ষুধাহীন পৃথিবী। যতদিন পৃথিবীতে অসাম্য, অবিচার ও ক্ষুধা থাকবে ততদিন বামপন্থাও থাকবে।
আমি বামপন্থাকে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে চাই না, বিশেষত সারা পৃথিবী জুড়ে সমাজতান্ত্রিক দেশ, বিশেষত সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের ফলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে বামপন্থীদের নতুন নতুন বন্ধু জোগাড় করতে হবে, আরও সৃজনশীল, স্বচ্ছ ও সংস্কারহীন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগোতে হবে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, গণতান্ত্রিক সমাজবাদ বামপন্থীদের আশু দৃষ্টিভঙ্গি হওয়া উচিত। এখনকার চ্যালেঞ্জ হল ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ। এ দেশের বামপন্থীদের দুটি ধারা আছে— একটি ধারা সরাসরি সশস্ত্র বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে। আরেকটি ধারা হল সংসদীয় গণতন্ত্রের পথ ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করতে চায়। এদেশের সংবিধানের যে চরিত্র তাও গণসমাজতন্ত্রী। নেহেরুজি নিজেও গণসমাজতন্ত্রী ছিলেন বলে আমার বিশ্বাস। হীরেন মুখার্জি লিখেছেন— It needs to be stressed that whatever his inhibitions and hestitancies in sphere of practice, there was nothing evasive in his concepts of socialism.” সংসদীয় বামেদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে নেহেরুজির যে পার্থক্য হীরেন মুখার্জি বলেছেন তার কারণ নিহিত আছে কংগ্রেসের শ্রেণিগত অবস্থানে। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকে কংগ্রেসের মুখ্য পরিচালক দেশীয় পুঁজির মালিক। একজন ব্যক্তিবিশেষের দৃষ্টিভঙ্গি যে সেই পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে কোনও স্থায়ী পদক্ষেপ নিতে পারবে না তা বলাই বাহুল্য। তবু, ঘোষিতভাবে কংগ্রেস দল ধর্মনিরপেক্ষ, যা ফরাসি বিপ্লবের সময় বামপন্থার অন্যতম দর্শন হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। যাই হোক, বামপন্থী চেতনার বহিঃপ্রকাশ আর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় তাদের যে হিস্যা তা সমানুপাতিক নয়। এদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নেই। নির্বাচনে জয়লাভের যেসব কার্যপ্রণালী আছে— যেমন, প্রচার, নানারকম প্রতিশ্রুতি (হোক না তা ভুয়ো), ভোট করানোর সংগঠন এবং এসব করার জন্য বিপুল অর্থ— এসবই দরিদ্র মানুষের প্রতিভূর নাগালের বাইরে। তাই, নির্বাচনে জয়-পরাজয় দিয়ে বামপন্থীদের অস্তিত্ব যাচাই করলে ভুল হবার শঙ্কা থাকে।
এই সেদিন মহারাষ্ট্রের শাসকদলকে কাঁপিয়ে হাজার হাজার কৃষকের দৃপ্ত মিছিল এল মুম্বইয়ে। বাংলার বুকেও হাজার হাজার কৃষকের মিছিল হয়েছে। শত শত বামপন্থী কর্মী সেদিনের কেরলের বন্যায় সর্বস্ব পণ করে ঝাঁপিয়েছিল। বামপন্থী ছাত্র-যুবরা ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে জেএনইউ-তে, যাদবপুরে, প্রেসিডেন্সিতে, মেডিকেল কলেজে। যতদিন মানুষের উপর অন্যায় জুলুম হবে, ততদিন বামপন্থা থাকবে। যতদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবীরা থাকবে ততদিন বামশক্তি থাকবে।
প্রশ্ন হল, বামপন্থীরা শেষ হয়ে গেছে এই প্রচারের কারণ কী? সাম্প্রতিক নির্বাচনে বামফ্রন্টের পরাজয়কেই সাধারণভাবে বামপন্থার পরাজয় বলে বর্ণনা করা হচ্ছে। বামফ্রন্ট সংসদীয় বামপন্থীদের একটি জোট যা অতি অবশ্যই শক্তিশালী বামপন্থী ধারা কিন্তু বামফ্রন্টই একমাত্র বামশক্তি একথা ভাবা ঠিক হবে না। অনেক বামপন্থী দল আছেন যারা সংসদীয় রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন অথচ বামফ্রন্টে নেই। বাম আন্দোলনের একটি ধারা আছে যারা সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন না। তাই, বামফ্রন্টের পরাজয়কে বামপন্থার পরাজয় ভাবা ভুল। অনেকে বলছেন, যে বামপন্থীরা ভারতের রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক ও তাদের আর ফিরে আসার কোনও সম্ভাবনা নেই। সংসদীয় গণতন্ত্রে পতন উত্থান থাকবেই। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা কখনওই মানুষের মূল সমস্যা সমাধান করতে পারবে না। তাই, যে দলই ক্ষমতায় যাক না কেন তারা কিছুদিনের মধ্যেই জনপ্রিয়তা হারাবে। বামফ্রন্টও কালের নিয়মে আবার ফিরে আসবে, তা যত সুদূরই হোক না কেন।
এই প্রসঙ্গে আমার মনে হয় নির্বাচনে বামশক্তির কেন ভরাডুবি হল সে বিষয়ে কাটাছেঁড়া করা উচিত, সমালোচনা করার জন্য নয়, প্রতিটি ভুলই অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতায় আলোকিত হয়ে ভবিষ্যতের রূপরেখা নির্মাণ করা প্রয়োজন।
প্রথমেই আমি যে প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে চাই তা হল বামফ্রন্ট কেন হারল? এর একটা সহজ উত্তর যা চটজলদি দেওয়া যায় যে এই পরাজয় উগ্র জাতীয়তাবাদ ও তার হাইভোল্টেজ প্রচারের কাছে পরাজয়, ব্যক্তির হিম্যান ইমেজের কাছে পরাজয়। আমি মনে করি সেটা চটুল, তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে, টিভিতে টক শোর উপপাদ্য হতে পারে। উত্তরটি অত সহজ নয়।
সিপিআইএম দল যে স্বাধীনতার পর এই প্রথম বাংলা থেকে লোকসভায় কোনও প্রতিনিধি পাঠাতে ব্যর্থ হল, বাংলায় তার ভোটের হার কমতে কমতে সাত শতাংশ হয়ে দাঁড়াল এটা কোনও আকস্মিক ব্যাপার নয়। সাত বছর ধরেই তাদের ভোট ক্রমশ কমে আসছিল। এই নির্বাচনে সেই বিপর্যয় আরও একটু স্পষ্ট হয়েছে মাত্র। নির্বাচনের আগে থেকেই কর্পোরেট সংবাদমাধ্যমগুলি এই বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তবে পরাজয়ের এই ভয়াবহ ছবি সবার কাছে এত অবিশ্বাস্য ঠেকেছিল যে কর্পোরেট মিডিয়ার কল্পকাহিনী ভেবে সবাই ধরে নিয়েছিলেন। সিপিআইএম-এর মত ক্যাডার-সর্বস্ব দল তার আঁচ করতে পারেনি, সেটা শুধু বিস্ময়কর, তাই নয়, এই অপারগম্যতার মধ্যেই নিহিত আছে, এই পরাজয়ের আসল কারণ। এটা ঠিক, কর্পোরেট মিডিয়া নরেন্দ্র মোদির জাঁকজমকপূর্ণ প্রচারকেই সুদৃশ্য মোড়কে পরিবেশন করেই ক্ষান্ত থাকেনি, আরেক ধাপ এগিয়ে তারা মোদিকেই একটি আকর্ষণীয় পণ্য হিসেবে মানুষের কাছে তুলে ধরেছে। মোদিহীন ভারতের যে ভয়াবহ চিত্র রচনা হয়েছে, তার ফলে যে অজানা আশঙ্কা মানুষের মনে দানা বেঁধেছে, তাকেই বাস্তব বর্ণনা খুব সফল নাটকের মঞ্চায়ন। যদিও এটি নাজি জমানার পুরনো ক্লিশে হওয়া চিত্রনাট্য, গোয়েবলসের হাতে যার সৃষ্টি, কিন্তু তা ঠেকানোর মত সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতা কোনওটাই বিরোধীদের ছিল না। কিন্তু কেবলমাত্র মিডিয়ার প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে মানুষ বামদলকে প্রত্যাখান করেছে, এই বিশ্লেষণ মেনে নিলে, সাময়িক মানসিক স্বস্তি তো পাওয়া যায় কিন্তু এটাই আসল কারণ বললে তা অতিসরলীকরণ হবে বলে মনে হয়। নিরপেক্ষভাবে এই বিশ্লেষণ করতে গেলেও অবশ্য বিতর্ক খুঁচিয়ে তোলার অবকাশ আছে। তবু মনে হয় এই বিতর্কের প্রয়োজন আছে।
সংসদীয় রাজনীতিতে বামদলগুলির এই বিপর্যয়ের কারণ বুঝতে, আমার মনে হয়, একটু অতীতে ফিরে যেতে হবে। ১৯৭৭ সালে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল ইন্দিরা কংগ্রেস দলকে হারিয়ে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে। সিপিআইএম দলের কর্মসূচিতে এই ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্যের ব্যাখা দেওয়া আছে। জনগণের আশু সমস্যার সমাধান করবে এই প্রত্যাশা নিয়ে বামফ্রন্ট যাত্রা শুরু করে। স্বৈরশাসনে পিষ্ট মানুষের কাছে সেই আশা নির্মল সুবাতাসের বার্তা নিয়ে এসেছিল। সমাজের এক ব্যাপক অংশের মানুষের শুভেচ্ছা নিয়ে এই সরকার কাজ শুরু করল।
বামদলগুলি রাজ্যে ক্ষমতা আসার অব্যবহিত পরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়, যা কর্মসূচি বর্ণিত আশু সমস্যা সমাধানের পক্ষে অনেকটা সহায়ক হয়েছিল। বিশেষত পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও ভূমিসংস্কার উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। সারা রাজ্যে প্রায় ১১ লক্ষ একর জমি ১৪ লক্ষ বর্গাদারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এছাড়া ৭৮-৮২ সালের মাধ্যে ৮ লক্ষ একর জমি ১৫ লক্ষ ভূমিহীন মানুষের হাতে তুলে দেন। গ্রামীণ বিদ্যুতায়ন, সড়ক নির্মাণ ও অন্যান্য পরিকাঠামো নির্মাণ মানুষের জীবন সংগ্রাম অনেকটা সহনীয় করতে পেরেছিল ও দলগুলির গণভিত্তি বৃদ্ধি করেছিল। বিশেষত, গরিব মানুষের আত্মমর্যাদাবোধ বৃদ্ধি পেয়েছিল, তারা নিজেরা গ্রাম উন্নয়নে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে বামফ্রন্টের গণভিত্তি আরও শক্তিশালী করেছিল। কৃষি উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছিল। রাজ্য মৎস্য চাষে স্বনির্ভর হয়। ক্ষুদ্র শিল্পেও যথেষ্ট উন্নতি করতে থাকে।
প্রথম বামফ্রন্টের সময় দেশের মোট জিডিপির শতকরা ৭.২% আসত পশ্চিমবঙ্গ থেকে। কৃষি উৎপাদনের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ও ক্ষুদ্র শিল্পের উন্নতি এই বৃদ্ধির মূল কারণ। কিন্তু বামফ্রন্ট এই বৃদ্ধি ধরে রাখতে পারেনি। পরবর্তী একদশকে কমে ৬.১৫ হয়ে যায়। ১৯৮২র পর বামফ্রন্ট ভূমিসংস্কারের কাজে ঢিলেমি শুরু করে ফলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির হার কমে যায়। আরেকটি কারণ হল চাষের কাজে পুঁজি বিনিয়োগের অভাব। সমবায় আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। সরকারি কৃষি খামারগুলিও তেমন কিছু করে উঠতে পারেনি। তার সঙ্গে যুক্ত হল, বৃহৎ শিল্পের ক্রমাবনতি।
বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার সময় শিল্পের মোট উৎপাদনের ৯.৮% ছিল বাংলার। ১৯৯৭ সালে তা কমে দাঁড়ায় পাঁচ শতাংশে। কেন্দ্রের মাসুল সমীকরণ নীতির ফলে অনেক কারখানা অলাভজনক হয়ে যায়। বস্তুত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এই কারণটি চিহ্নিত করেছিলেন। তবে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনও তার দায়িত্ব এড়াতে পারে না। কারখানার আধুনিকীকরণ, অটোমেশন, নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার, কম্পিউটার ব্যবহার ইত্যাদি নতুন যুগের চাহিদাগুলি আত্মস্থ করতে না পারার জন্য কারখানাগুলি শুকিয়ে যাচ্ছিল। ট্রেড ইউনিয়নগুলি কর্মসঙ্কোচনের আশঙ্কায় নতুন প্রযুক্তি ঠেকানোর চেষ্টা করেছে। অপরদিকে জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ভয়ে মালিকপক্ষ নতুন পুঁজি বিনিয়োগে উৎসাহী ছিলেন না। নতুন অর্থনৈতিক নীতি ফলে উৎপাদিত পণ্যের বৈচিত্র ও গুণমান নিয়ে ক্রেতাদের উচ্চাশা তৈরি হয়। কিন্তু বিশ্বায়িত পৃথিবীর সে চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের সেই বৈচিত্র আনা সম্ভব হয়নি, উপযুক্ত কারিগরী বিদ্যারও অভাব ছিল। প্লাস্টিকের অবাধ ব্যবহারে পাটজাত দ্রব্যের চাহিদা কম হওয়ায় চটকলগুলি আস্তে আস্তে বন্ধ হচ্ছিল। নতুন পুঁজি বিনিয়োগেও মালিকপক্ষ তৈরি ছিল না। পাট থেকে শুধু চটের বস্তা তৈরি না করে পাটজাত আর কী করা যায়, তা নিয়ে গবেষণা হয়নি, কেউ সেটা নিয়ে ভাবনাচিন্তাও করেননি, এটা খুবই আশ্চর্যের! অনেক জায়গায় কারখানা চালাতে অনিচ্ছুক মালিকের সঙ্গে ট্রেড ইউনিয়নের যোগসাজশের অভিযোগ আসে। শিল্পপতিদের বিনিয়োগে কমার একটা কারণ অবশ্যই ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন। কেবল ধর্মঘট করে উৎপাদন কমিয়ে মালিককে শিক্ষা দেওয়া ও অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলনের বাইরে ভাবার মত সুশিক্ষিত ট্রেড ইউনিয়ন নেতার অভাব ছিল। নইলে অপ্রয়োজনীয় উৎপাদন করেও মালিককে শিক্ষা দেওয়া যেত, তাতে অন্তত শিল্পবিরোধী তকমা দেওয়া সম্ভব হত না। ট্রেড ইউনিয়নের আরেকটি বড় সমস্যা ছিল রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে আন্দোলনের জন্য যে রাজনৈতিক শিক্ষা দরকার তা যথেষ্ট ছিল না ও বামফ্রন্ট সরকারকে রক্ষা করার গুরুতর কাজের বাইরে অন্য লক্ষ্য নিয়ে কাজ করার মত রাজনৈতিক শিক্ষা ও দর্শনের অভাব ছিল। ফলে, নতুন শিল্প বিনিয়োগ কমতে থাকে। আসানসোল-দুর্গাপুর, ব্যারাকপুর ও হাওড়ার একদা সমৃদ্ধ শিল্পাঞ্চলে অন্ধকার নেমে আসে।
বামফ্রন্টের কাছে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল বেকার সমস্যার সমাধান, অর্থনৈতিক মন্দার বিরুদ্ধে বিকল্প সন্ধান ও নয়া অর্থনীতি যে সামাজিক অবক্ষয়ের সৃষ্টি করছিল তার বিরুদ্ধে একটি সজীব ও গ্রহণযোগ্য বিকল্প সংস্কৃতি হাজির করা। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের চাহিদা অনুযায়ী চাকুরির ব্যবস্থা সম্ভব ছিল না, চাকুরির ক্ষেত্রটি সঙ্কুচিত হচ্ছিল। অথচ, রাজ্য ও দেশের বাইরে কর্মসংস্থানের উপযুক্ত দক্ষতা বৃদ্ধির কোনও সুনির্দিষ্ট দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব ছিল। ইংরেজি তুলে দেওয়ার ফলে শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা বিরূপ হয়। অন্য রাজ্যের চাকুরিদাতাদের কাছেও বাঙালির চাহিদা কমতে থাকে। আবার, এই সরকারি সিদ্ধান্তের ফলে বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যায়, যা মধ্যবিত্তের আওতার বাইরে। অথচ, সেগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা দূরে থাকে নেতাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার দায়িত্ব নিয়ে সেগুলো ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে। শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকার শিক্ষকদের মাইনে বাড়িয়েছেন কিন্তু শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ও পঞ্চায়েত ও পুরসভা প্রশাসনে অংশগ্রহণ করেছেন। ফলে, বিদ্যালয় শিক্ষার যে উচ্চমান ছিল তা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। পাশ ফেল তুলে দেওয়ার ফলে, একদিকে মধ্যবিত্তরা বিমুখ হয়েছে, অন্যদিকে ভিনরাজ্যের কাছে বাঙালির শিক্ষার মান নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
একথা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যে সৃজনশীলতা দরকার ছিল বামফ্রন্ট তা দেখাতে সক্ষম হয়নি। সেই সৃজনশীলতার অভাব ছিল সর্বত্রগামী, কিন্তু শিক্ষা ও সংস্কৃতির জগতে তা সবচেয়ে প্রকট ছিল। বিশ্বায়নের ফলে যে ক্ষয়িষ্ণু ও অবক্ষয়ের সংস্কৃতি বাংলাকে গ্রাস করছিল তার বিকল্প বামপন্থীরা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছিল। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ছিল রাজনীতিতেও। বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার অব্যবহিত পরেই রাজ্যের দেওয়ালে দেওয়ালে যেমন জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের আহ্বান জানানো হত, তেমনি সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সপক্ষে লেখা হত। এক দশকের মধ্যে সেই লেখনী ধীরে ধীরে ফিকে হতে হতে অবশেষে বামপন্থীদের চেতনার জগতও মানুষের মন থেকে মুছে যেতে থাকে। সংস্কৃতি নিয়ে কেউ মাথা ঘামাতে রাজি ছিলেন না। জ্যোতিবাবু নিজেও বলেছিলেন, “আমি সংস্কৃতিটংস্কৃতি বুঝি না।” গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী যে সংস্কৃতির ধারা গ্রামজীবনের অঙ্গ ছিল এই সরকার তা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। বিশেষত নতুন অর্থনৈতিক নীতি দরিদ্রের রুটির সংগ্রাম যত কঠিন করে তুলতে থাকে ততই গ্রাম্য আবহমান সংস্কৃতি পিছু হঠতে থাকে। বিকল্প সংস্কৃতির জায়গা নিতে শুরু করে উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতি ও তার সঙ্গে পাল্লা দেয়া সস্তা বিনোদন। গ্রামগুলি আস্তে আস্তে ভিডিও পার্লারে ভরে যেতে থাকে। পল্লিগীতি আর ভাটিয়ালি চটুল হিন্দি গানের চড়া কণ্ঠে ঢাকা পরে যায়। যাত্রাপালা, পঞ্চরস, আলকাপ ইত্যাদি অনুষ্ঠানগুলি সরকারি দাক্ষিণ্যে বঞ্চিত হতে থাকে। তার বদলে হোপ ৮৬-এর অনুষ্ঠান সরকারের প্রত্যক্ষ মদত পেতে শুরু করে।
সাংস্কৃতিক কর্মী, শিক্ষক থেকে শুরু করে সবার মনে এই চিন্তা বদ্ধমূল হয়, যে এই বামফ্রন্টকে চোখের মণির মত রক্ষা করতে হবে। অথচ, একটি রাজ্য সরকারের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ, নতুন আইন প্রণয়নের ক্ষমতা নেই বললেই চলে, কেন্দ্রের খিদমতগারী করার পর সঞ্চয়ের বিরাট সাশ্রয় হয় না, অথচ বিরাট বিপুল সংসারের বোঝা। ওভারভ্রাফট নিয়ে টেনেটুনে চালানো সংসার। ঋণের বোঝাও বাড়ে। সত্যকার যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় উন্নীত হওয়ার জন্য মানুষের যে রাজনৈতিক শিক্ষা ও আন্দোলন প্রয়োজন তাও প্রথামাফিক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো আমূল বদলের জন্য শ্লোগানটি উপযুক্ত ছিল কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষের যোগদান ছিল নিষ্ক্রিয়। সক্রিয় করার কোনও উদ্যোগ নিচুতলার কর্মীরা নেননি। বরং সরকারের উষ্ণতার স্বাদ নিতে তারা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। থানাগুলিতে আইসির চেয়ে এলসিএসের ক্ষমতা বাড়তে থাকে। রাজনৈতিক শিক্ষাহীন এইসব নেতাদের একাংশ মানুষের প্রতিটি কাজে নাক গলাতে শুরু করে। অথচ, যে সহমর্মিতা, শিক্ষা, সহিষ্ণুতা ও সংবেদনশীলতা প্রয়োজন ছিল তা তাদের ছিল না। তাই, তাসের ঘরে তাসের দেশের ইস্কাবনের টেক্কা রাজত্ব করছিল।
রাজনীতিতে ধর্মের অনুপ্রবেশ শুরু হতে থাকে নতুন সহস্রাব্দ থেকেই। সংখ্যালঘুদের সমস্যা মাথাচাড়া দেয়। সংখ্যালঘুদের মধ্যে যে একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ধব হচ্ছে তা বাম বা ডান কেউ স্বীকার করতে চাননি, খাতায়-কলমে যাই হোক না কেন। রাজনৈতিক দলে মুসলিমরা হয় বিভিন্ন দলের সশস্ত্র পদাতিক বাহিনী, আর না হলে শুধু ভোটার। এর বাইরে তাদের ব্যবহার করা হয়নি। চাষি, তাঁতি, দরিদ্র মুসলিম পরিবারের ছেলেটি আজ তার বাবার পেশায় যেতে চায় না। তার পড়াশোনার মান যাই হোক, সে শিক্ষিত বেকার। এদের কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার আগাগোড়া কিছুই বামনেতারা বুঝতে চাননি। লেখাপড়া জানা ছেলেটি চাকুরি না পেয়ে তখন মাদ্রাসা বানিয়েছে। সে পেশায় সামান্য আয় কিন্তু সামাজিক সম্মান মেলে। সরকারি কোনও ছাপও লাগে না। গ্রামেগঞ্জে সেই মাদ্রাসার নেই কোনও সিলেবাস। আরবি, উর্দু পড়ানো হয়। কিন্তু তার হাত ধরে আসে রক্ষণশীলতা, গোঁড়ামি। বাম নেতারা সব বুঝেও কিল খেয়ে কিল হজম করতে শুরু করলেন, কেননা শিক্ষিত বেকারকে চটাতে গেলে বিপদ আছে। রক্ষণশীলতার প্রভাবে বাঙালি মুসলমান পাল্টালে অন্য সম্প্রদায় কি অক্ষত থাকে? তাই ধীরে হলেও বিজেপির হিন্দুত্ববাদের জন্যে বাংলা হয়ে ওঠে আদর্শ ল্যাবরেটরি। খারেজি মাদ্রাসার অনিবার্য প্রভাব বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য স্বীকার করে তা পরিবর্তনের উদ্যোগ নিলেও তা ব্যর্থ হয়। সাচার কমিটির রিপোর্ট সামনে আসতেই সংখ্যালঘু অনুন্নয়ন শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বুদ্ধদেব বলেছিলেন— চাকুরিতে সংখ্যালঘু কম হওয়ায় কারণ মাদ্রাসা শিক্ষা। তিনি খারেজি মাদ্রাসার সঙ্গে সাধারণ বিদ্যালয়ে শিক্ষিত বেকার গুলিয়ে ফেলেছিলেন। এই গুলিয়ে যাওয়া আকস্মিক নয়; বস্তুত মুসলিমদের ভোট অবিরত পেতে থাকলেও তাদের সংস্কৃতি অনুধাবনের চেষ্টা নানা কারণে কেউ করেননি। মুসলিম সংস্কৃতির অনেকটা ধর্মভিত্তিক। ধর্ম থেকে শত হস্ত দূরে থাকতে হবে এই ফরমান ছিল বলে তারা খুব সম্ভবত এসব নিয়ে মাথা ঘামাননি। নাহলে, যে সাচার রিপোর্ট সরকার গ্রহণ করে সেই রিপোর্ট পড়লেই বোঝা যেত, যে চাকুরিগত সুযোগ কম হওয়ায় সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষার কোনও সম্বন্ধ নেই। রিপোর্ট অবশ্য দেখানোর জন্য যতটা পড়ার জন্য ততটা নয়। সে যাই হোক, মুসলিমরা যে দূরে সরে যাচ্ছে সেটা বামফ্রন্ট হয়তো বুঝতে পারছিলেন, কিন্তু ক্ষমতার আঁচে সেদ্ধ নরম নেতারা সেটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেননি।
বামফ্রন্টের সঙ্গে তথাকথিত অতিবামদের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা দরকার। সংসদীয় রাজনীতির ছায়া না মাড়ালেও এরা মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রাখেন ও সমাজের তাদের প্রভাব সুবিদিত। একথা অনস্বীকার্য যে, সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাহীন বামশক্তিগুলির আত্মবলিদান ও তাদের রাজনৈতিক সংগ্রাম ইন্দিরা কংগ্রেসকে আরও কোণঠাসা করেছিল। জরুরি অবস্থার সময় যে শ্বেতসন্ত্রাস ও স্বৈরতন্ত্র দেখা গিয়েছিল, তা কংগ্রেসের প্রতি মানুষের বিরাগ বৃদ্ধি করেছিল। সল্টলেক ও বরানগরে গণহত্যা, রুণু গুহনিয়োগীর নেতৃত্বে নকশালপন্থীদের ওপর নারকীয় অত্যাচার মানুষের বিরাগকে ঘৃণায় পরিণত করেছিল। প্রকৃতপক্ষে, নকশাল আন্দোলনের বিপ্লবী চেতনা বাঙালি যুবকদের রোমান্টিসিজমকে উস্কে দিয়েছিল ও অনেকটা স্বাধীনতা আন্দোলনের মত আবেগ সৃষ্টি করেছিল। সে আন্দোলনের অবশ্য গণভিত্তি ছিল না। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বামদলগুলি এতে যোগদান করলে কী হত বলা মুশকিল। তাদের সক্রিয় বিরোধিতা ও তৎকালীন সরকারের দমননীতির ফলে সে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে এলেও ৭৭-এর নির্বাচনে কংগ্রেসের পরাজয়ের এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে অবশ্যই চিহ্নিত হওয়া উচিত।
বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এসে নকশাল আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত ও বন্দিদের পুনর্বাসন ও মুক্তি তরান্বিত করার চেষ্টা করলেও তা যথেষ্ট ছিল না বলে অনেকে ভাবেন। অনেক উজ্জ্বল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জেলের ঘানি টানতে থাকে। রুনু গুহনিয়োগীর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নেওয়া ও তার প্রমোশন বিদ্বজ্জনের কাছে খুব দুঃখবহ ছিল। বরানগর গণহত্যার বিচার ছিল আরেকটি দাবী। বামপন্থার প্রতি সহানভূতিশীল সাধারণ মানুষ, নকশাল আন্দোলনের প্রত্যক্ষ সহযোগী ও তাত্ত্বিক বামেরা তাই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থানে তারাও সক্রিয় সহযোগিতা করে। সিঙ্গুর আন্দোলন ও বিশেষত নন্দীগ্রামে গুলি চালনার ঘটনায় এই শক্তিগুলি আরও সক্রিয় হয়।
বামফ্রন্ট সরকারকে চোখের মণির মত রক্ষা করতে গিয়ে বাম কর্মীরা বুঝতে পারেননি, যে তারা মানুষের সহানুভূতি থেকে বঞ্চিত। বামপন্থী কর্মীরা কোনও না কোনওভাবে প্রশাসনিক কাজে জড়িয়ে পড়ার ফলে, কোনও কোনও ব্যক্তি ক্ষমতা দখলের উদগ্র কামনায় মানুষের দৈনন্দিন সুখ-অসুখে তাদের পাশে থাকার বদলে তাদের ভোট ব্যাঙ্ক হিসেবে দেখতে থাকেন । বিপ্লবী চেতনার এই অন্তর্জলী যাত্রা নিয়ে পার্টি মিটিং-এ যাই হোক, সাধারণ মানুষের মনে সংশয় সৃষ্টি হয়। ভোটসর্বস্ব রাজনীতি যে সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি করে, তারাই আবার উচ্চতর নেতৃত্বে অলঙ্কৃত করতে থাকেন। সবদিক থেকে অবক্ষয়ের বৃত্তটি সম্পূর্ণ হতে থাকে। সরকার ও পার্টির সীমারেখা বিলুপ্ত হয়ে যায়। সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে পাইয়ে দেওয়া শুরু হয়। সে দেওয়াও ভোটের বাক্সে প্রতিফলনের সমানুপাতে হতে থাকে। পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের মোহ বৃদ্ধি করতে সাহায্য করলেও, অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক লক্ষপূরণের সহায়ক হয়নি। বিপ্লবী চেতনা যেন কাগজকলমে সীমাবদ্ধ থাকল। নয়া অর্থনৈতিক নীতি ও বিশ্বায়ন দেশের মানুষের কাছে বিশ্বের দরজা খুলে দিয়েছিল। উন্নত বিশ্বের চমকদার জীবনের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বাড়ছিল। বিদেশি স্বপ্নিল পৃথিবীর রঙচঙে খবর শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে ভারতের প্রান্তসীমা ভেদ করে গ্রামীণ জীবনেও ছাপ ফেলতে শুরু করেছিল। বামফ্রন্ট কিন্তু বিশ্বায়িত পৃথিবীর এই ঝকমকে জগতের বিকল্প হাজির করতে পারেননি। যে সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে এই পরিস্থিতির সুফল ঘরে তোলা যায় তা নিয়ে তেমন কার্যকরী পদক্ষেপ অন্তত আমজনতার চোখে পড়েনি।
এককথায় সংসদীয় বাম যতটা সংসদীয় থাকার চেষ্টা করেছে, ততটাই বাম আন্দোলন ও বাম সংস্কৃতির অবনমন হয়েছে। যদিও এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, মানুষের জীবন-জীবিকার সমস্যাগুলি সংসদে তুলে ধরার জন্যে চেষ্টার কোনও ত্রুটি তারা রাখেননি। ইউপিএ সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়নে তাদের ভূমিকা খুব উজ্জ্বল, বিশেষত খাদ্যের অধিকার, তথ্যের অধিকার ও শিক্ষার অধিকার নিয়ে তাদের সংসদের ভেতরের লড়াই উজ্জ্বল ও প্রশংসনীয়। সংসদের ভেতরের লড়াই যে মানুষের লড়াই হয়ে ওঠেনি, এই গুরুত্বপূর্ণ দাবিগুলি কার অবিস্মরণীয় লড়াইয়ের কল্যাণে পাওয়া গেল সেই অধ্যায় যে মানুষের অগোচরে রয়ে গেল, সেটি নিয়েও তাদের প্রকাশ্য চিন্তার রেশ জনমানসে এল না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রাই সেই কৃতিত্ব কুড়িয়ে ভোটলক্ষীর আশীর্বাদধন্য হতে লাগলেন।
বামেদের সব চেয়ে বড় সমস্যা হল তারা সরকারে অংশগ্রহণ করতে চান না। এই দ্বন্দ্বের পেছনে যুক্তি হল— সংসদে তারা গরিষ্ঠ নন, তাই সরকারি নীতি প্রণয়নে প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন না। জ্যোতিবাবুকে সেই যুক্তিতে মসনদে বসতে না দিয়ে ঐতিহাসিক ভুল করেছিলেন। অথচ, বাইরে থেকে ইউপিএ সরকারকে সমর্থন করতে থাকলেন ও গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়নের ভাগীদার বলে জাহির করলেন। অথচ, সেই নীতি রূপায়নে সরকারের সঙ্গী কেন প্রত্যক্ষভাবে থাকবেন না তার গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিতে পারলেন না। মানুষ যাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেন, তারা সরকারে যাবেন না, এই দ্বন্দ্ব এই যুগের মানুষের কাছে আর গ্রহণযোগ্য নয়। জ্যোতিবাবুকে প্রধানমন্ত্রী না করার ঐতিহাসিক ভুলের সঙ্গে তুলনীয় আরেকটি ভুল হল, মানুষের কাছে কোনও ব্যাখ্যা না করেই ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন তুলে নেওয়া। ইউপিএর বিকল্প যে বিজেপি, তৃতীয় বিকল্প যে তখনও দানা বাঁধেনি, কেন যে তারা ভাবেননি, তা খুব বিস্ময়কর।
সারা পৃথিবী জুড়ে সংসদীয় বামেদের দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যারা এমনকি ক্ষমতা দখলও করছেন। প্রতিবেশী নেপাল থেকে শুরু করে লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে এটা দেখা গেছে। টার্কিতে বামপন্থীরা অনেক আসন পেয়েছে। তাই সংসদীয় গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে বামেরা কোনও ভুল করছেন মনে হয় না। তাই, বামপন্থী দলগুলির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা দরকার। এর জন্য বামশক্তির বিস্তার দরকার হিন্দি বলয়ে। নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করবার প্রয়োজন আগে। পুঁথিপত্র ঘেঁটে কাজটা কতটা মার্কসবাদসম্মত সেটা বিচার পরে হতেও পারে। তাছাড়া, কোনও ইজমের পুস্তক কোনও ধর্মগ্রন্থ নয়। সৃজনশীলতার মাধ্যমে নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করতে হবে। এই কাজ কেন করা যায়নি, তার উপযুক্ত ব্যাখা দরকার। নানারকম গালভরা কথার আড়াল খুঁজে যেন প্রকৃত সমস্যা থেকে মুখ ঘুরিয়ে না রাখা হয়। তেলেঙ্গানায় কেন বিপর্যয় হয়েছে, টিআরএসের মত দল যেখানে শক্তিশালী হতে পারল, সেখানে একদা শক্তিশালী বামেরা কেন নিশ্চিহ্ন তা খুঁজে বের করা দরকার। কেন তামিলনাড়ু কেবলমাত্র বামেদের সম্মান রক্ষা করল, তাও গভীরভাবে আলোচনা করা দরকার।
বামফ্রন্টের দলগুলি কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে?
ভারতবর্ষে এক অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। বেকারি গত অর্ধশতকে সবচেয়ে বেশি। হাজার হাজার কৃষক ঋণ শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। ডাঃ অশোক ধাওয়ালে দাবি করেছেন যে গত পনেরো বছরে সারা দেশে প্রায় তিন লক্ষ কৃষক আত্মহত্যা করেছে। এই রাজ্যেও ঋণগ্রস্ত আলুচাষির আত্মহত্যার খবর পাওয়া গেছে। সরকার এই সমস্যার সমাধানের বদলে সারা দেশে ধর্মীয় বিভাজনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়েছে। উগ্র জাতীয়তাবাদের কাছে মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা পরাজিত হয়েছে। স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষে এই অভূতপূর্ব রাজনৈতিক সঙ্কট বিংশ শতাব্দীর জার্মানির কথা মনে পড়িয়ে দেয়। দেশের যে কোনও সমস্যার জন্য সংখ্যালঘুদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো ও যুদ্ধের জিগির তোলা সেই ইতিহাসের যেন পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। সিপিআইএম সহ বামদলগুলির কাছে এই অবস্থা কিন্তু অভূতপূর্ব সুযোগও নিয়ে এসেছে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংহত বামশক্তির যুদ্ধ তো ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু এই দুরূহ কাজে ব্রতী হওয়ার জন্য সাংগঠনিক ও নীতিগত কিছু পরিবর্তন জরুরি।
যুবশক্তি, কৃষক, শ্রমিক ও নিপীড়িত মানুষকে সংগঠনের নেতৃত্বে আনা দরকার। রাজ্যের গ্রামের পর গ্রামে ঘুরে মনে হয়েছে যে নেতাকর্মীদের তারা বিপদের সময় পাশে পাননি। কর্মীরা তৃণমূলের কাছে নিগৃহীত ও নির্যাতিত হলেও অনেক নেতা গ্রামমুখী হননি। অনেক দুঃখ ও বহু বেদনায় মানুষ লাল পতাকার মোহ ত্যাগ করে অন্য পতাকা হাতে নিয়েছেন। বিজেপি বা তৃণমূলের বাক্সে ভোট দেবেন বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া মানুষের কাছে শুনেছি লাল পতাকা তাদের সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছিল। অনেক জায়গায় সাত বছর পর গ্রামে মিছিল দেখে নাচানাচি করেছেন, আবেগে কেঁদে ফেলেছেন, অশক্ত শরীর নিয়ে হেঁটেছেন। অথচ, ভোট বামশক্তি জিতবে না এই আশঙ্কায় তৃণমূলের বিপক্ষে যে যেখানে শক্তিশালী তাকে ভোট দিয়েছেন। বামপন্থীদের উপর আস্থাহীনতা মূল কারণ অতি অবশ্যই লড়াকু মনোভাবের অভাব। সাংগঠনিক শক্তি বাড়িয়ে, লড়াকু যুবশক্তি ক্ষমতায়ন করে মানুষের দৈনন্দিন সমস্যায় তাদের পাশে দাঁড়ানো তাই আশু কর্তব্য।
কেবলমাত্র আইন মেনে আন্দোলন করে কোনও স্বৈরশাসককে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে, এই ভুল ধারণা পরিবর্তন করা দরকার। তারা নতুন নতুন অস্ত্র প্রয়োগ করে জনগণের নায্য দাবিকে নস্যাৎ করবে। তাই, তাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতেও নতুন পন্থা নিতে হবে।
বামফ্রন্ট সরকার সংগ্রামের হাতিয়ার— একটি পরাবাস্তববাদী স্লোগান। সরকার শ্রেণিসমন্বয়ের হাতিয়ার। সেই সরকারকেই ব্যবহার করে শ্রেণিযুদ্ধ করা সম্ভব নয়। তাই, সরকার ও পার্টির সংগঠন তটরেখাটি স্পষ্ট করা দরকার। প্রশাসনিক ও সংসদীয় রাজনীতিতে যারা যুক্ত হবেন, তাদের পার্টির সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত করার ব্যাপারে সতর্ক হওয়া দরকার।
সুযোগ পেলে সরকারে যোগদান করা উচিত। সংসদে শুধু আইন পাশ করলে হবে না, সেই আইন যাতে সুষ্ঠুভাবে রূপায়ণ হয় তার দায়িত্ব নিতে হবে। নাহলে, মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য বিকল্প হওয়া কঠিন হবে।
সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে চিন্তাভাবনার আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা করার দায়ও বামকর্মীদের নিতে হবে। আবহমান কালের উৎসব অনুষ্ঠান থেকে দূরে থাকলে মানুষের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। তাছাড়া অনেক উৎসব আছে যার সঙ্গে ধর্মের প্রত্যক্ষ যোগ নেই— দোল, বসন্ত উৎসব, রাখিবন্ধন, নববর্ষবরণ— এইসব অনুষ্ঠানে বামকর্মীদের নেতৃত্ব দিতে হবে।
দেশীয় খেলাধূলাকে গুরুত্ব দিয়ে সর্বত্র তার সম্প্রসারণে ব্যবস্থা নিয়ে যুবকদের আকৃষ্ট করতে হবে। স্বাস্থ্য একটি অবহেলিত বিষয়। শক্তিশালী স্বাস্থ্য আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত আছে। তাকে ব্যবহার করতে হবে।
শিল্পনীতির ক্ষেত্রে উদারতা দেখাতে হবে। কৃষিক্ষেত্রে পুঁজি বিনিয়োগ ও আধুনিকীকরণে উদ্যোগ নিতে হবে। বামপন্থীদের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন আবার গড়ে তুলতে হবে রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে। অসংগঠিত শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির বাস্তবসম্মত দাবি নিয়ে লাগাতর আন্দোলন করতে হবে।
এই দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের চিন্তাভাবনা আরও বেশি করে মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ভগত সিং-এর আদর্শ এখনও মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য। সেই আদর্শের প্রচার ও পালন করেন প্রয়োজন। গণনাট্য ও বিজ্ঞান আন্দোলন আরও শক্তিশালী করতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, দেশের সামনে ফ্যাসিবাদের উদ্যত পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এই কঠিন সময়ে সব বামশক্তির একত্র সমাবেশ দরকার। দেশীয় বুর্জোয়াদের চরিত্র বিশ্লেষণ বা কে কত সংশোধনবাদী সেই চিন্তা না করে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সব ঘোষিত বামশক্তির এক ছাদের তলায় আসা দরকার। সেই বৃহত্তর বামশক্তিই কেবলমাত্র ফ্যাসিবাদের মহড়া নিতে পারে। আশা করা যেতে পারে, বাম দলগুলি নিজেদের হতাশা কাটিয়ে উঠে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করতে পারবে।