শুভেন্দু দেবনাথ
সম্প্রতি সারা দেশে শেষ হয়েছে লোকসভা নির্বাচন। কিছুটা প্রত্যাশিত এবং খানিকটা অপ্রত্যাশিত ফলাফলই পাওয়া গিয়েছে এই নির্বাচনে্র। প্রত্যাশিত কারণ সারা ভারতের নিরিখে দেখতে গেলে পুলওয়ামা আত্মঘাতী হামলায় ভোটের আগেই সাধারণ মানুষের জন্য সাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল বিস্ফোরক, আর তারপর সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের নাটক তাতে কাজ করেছিল ট্রিগারের। আর অপ্রত্যাশিত কারণ গোটা বাংলা তথা ভারতের শহরাঞ্চলে শিক্ষিত মানুষ ভাবছিলেন তাদের বিজেপি ঘৃণা বোধহয় ভোটের ফলাফল নির্ধারিত করবে। আসলে তারা ভুলে গিয়েছিলেন সারা ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের একটা বড় অংশ গ্রামাঞ্চল এবং সেখানে প্রান্তিক মানুষদের বাস। সেই সংখ্যাটাকে তারা প্রায় ধর্তব্যের মধ্যেই আনেননি। ফলে তাদের কাছে এই ফলাফল কিছুটা অপ্রত্যাশিত তো বটেই। অন্যদিকে কংগ্রেসের বংশ পারম্পারিক রাজতন্ত্রের গ্রহণযোগ্যতা বছর তিনেক আগেই অস্ত গিয়েছে সোনিয়া গান্ধির অসুস্থতায়। ফলে বিজেপির এই রমরমা হওয়ারই ছিল। মানুষ সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছে বেগুসরাইতে কানহাইয়ার হারে। কারণ বামপন্থার নতুন মসিহা হয়ে দেখা দিয়েছিলেন এই তরুণ নেতা। অসাধারণ বাগ্মিতা, মেধাবী এবং তীক্ষ্ণবুদ্ধির অধিকারী কানহাইয়াকে নিয়ে প্রায় খানিকটা স্বপ্নই দেখতে শুরু করেছিল ভারতবর্ষের বামপন্থা। তবু কেন এই ভরাডুবি? তার কারণ শরীরে নতুন রক্তের যোগান হলেও পুরনো রক্তকে শুদ্ধিকরণ করা হয়নি। ২০১৬য় কানহাইয়া কুমারের জেলযাত্রার পর আমি যখন বেগুসরাইয়ের হাইওয়ের ধারের এক ছোট টোলা বিহটের মসনদপুর গ্রামে কানহাইয়া কুমারের বাড়িতে থাকছি, আমার সেই এক পক্ষকাল থাকার সুবাদে বেশ কিছু ছবি আমার চোখে ধরা পড়েছিল। একটা গোটা জেলা কানহাইয়ার সমর্থনে দলমত নির্বিশেষে, কিন্তু বামপন্থাদের প্রাচীনপন্থীদের উপর তাদের ভরসা প্রায় তলানিতে। আর আমার এই ১৫ দিন ধরে থাকাকালীন বেগুসরাই এবং বিহট জেলার বেশ কিছু তাবড় তাবড় সিপিআই নেতার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি করে মনে পড়ছে দুজনের কথা এই ভোটের ফলাফল দেখার পর। একজন সিপিআইয়ের তাবড় নেতা তথা কানহাইয়ার রাজনৈতিক গুরু বলবন্ত সিং, অন্যজন বেগুসরাইয়ের সিপিআই পার্টি অফিসের এক কর্মী সমর্থক ফাগো তাঁতি। হঠাৎ করেই কয়েকদিন আগে এক বন্ধুর ফেসবুক পোস্ট থেকে জানতে পারি বিজেপির ভোট কারচুপি রুখে দেওয়ায় খুন হতে হয়েছে ফাগোকে। একদিন ঘণ্টাখানেক কেটেছিল এই ফাগোর সঙ্গে। ফলে পোস্টটা পড়ার পরই কেমন একটা গায়ে কাঁটা দিয়ে গিয়েছিল। বারবার মনে পড়ছিল ফাগোর কথাগুলো। সেসব কথা বলার আগে জেনে নেওয়া যাক বেগুসরাইকে।
১৮৭০, বিহারে মুঙ্গের জেলার সাব ডিভিসন হিসেবে স্থাপিত হল বেগুসরাই। তার ঠিক ১০০ বছর পর অর্থাৎ ১৯৭০ সালে বেগুসরাইকে দেওয়া হল এক পূর্ণাঙ্গ জেলার মর্যাদা। কী এই নামের অর্থ? বেগম থেকে বেগু অর্থাৎ রানি আর সরাই অর্থে অতিথিনিবাস। আসলে এই নামটির উৎপত্তি একটি ইতিহাস থেকে। ভাগলপুরের বেগম বিহারের একটি পুণ্যস্থান সিমারিয়া ঘাট দর্শন করতে এসেছিলেন। তার থাকার জন্য এই বেগুসরাইতেই স্থাপিত হয়েছিল একটি সরাইখানা। সেখান থেকে নাম হয় বেগুসরাই। বেগুসরাই মূলত বিখ্যাত থার্মাল পাওয়ারের জন্য। এছাড়াও এই জেলার গড়হাড়া অঞ্চলে এশিয়ার সবচেয়ে বড় এক্সচেঞ্জ ইয়ার্ড। এই জেলার পূর্ব দিকে রয়েছে আইওসিএল রিফাইনারি, দক্ষিণে হিন্দুস্তান ফার্টিলাইজ কর্পোরেশন এবং বারাউনি থার্মাল পাওয়ার স্টেশন। ভারতীয় রাজনীতিতে বিশেষ করে বাম রাজনীতিতে বেগুসরাই একটু গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। স্বাধীনতা সংগ্রামেও এর অবদান কম নয়। ১৯৮২ সালে এই জেলার বীর উচিৎ সিং বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থাকায় প্রাণ হারিয়েছেন ইংরেজদের গুলিতে। বিহারের প্রথম কেবিনেট মন্ত্রী এবং কংগ্রেস নেতা রমচরিত্র সিং যিনি ছিলেন বিহারের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিংহের মন্ত্রীসভার সেচ ও বিদ্যুৎ মন্ত্রী, তিনিও এই জেলারই মানুষ। এই জেলা থেকেই উঠে এসেছেন কিংবদন্তী সমস্ত বাম নেতা। সিপিআই নেতা তথা রামচরিত্র সিংয়ের ছেলে চন্দ্রশেখর সিং, বাজপেয়ি সরকারের আমলে ইউনিয়ন হোম সেক্রেটারি ও সিকিমের প্রাক্তন রাজ্যপাল বাল্মীকি প্রসাদ সিং, প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রামশরণ শর্মা, এবং রাষ্ট্রকবি রামধরী সিং দিনকর এদের সকলেরই জন্ম এবং কর্মক্ষেত্র এই বেগুসরাই। আর এই বেগুসরাইয়ের বিহট গ্রাম থেকেই উঠে এসেছেন কানহাইয়া কুমার। বিহট আর বেগুসরাই মূলত দুর্ভেদ্য লাল দুর্গ। ভারতীয় রাজনীতিতে সিপিআইয়ের দুর্ভেদ্য দুর্গ হিসেবেই যাকে ধরা হয়। এতটাই যে বিহটকে বলা হয় বিহারের বারদৌলি। বাম নেতা চন্দ্রশেখরের নেতৃত্বেই বিহট এবং বেগুসরাই হয়ে উঠেছিল বাম রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র। এই জেলা এবং এই গ্রাম এতটাই বাম দুর্গ ছিল যে বেগুসরাইয়ের আরেক নাম লেনিনগ্রাদ আর বিহটকে বলা হয় মিনি মস্কো।
কাল থেকেই বারবার মন চলে যাচ্ছে বেগুসরাই আর বেহট গ্রামে। বন্ধুর ফেসবুক পোস্ট… ফাগো তাঁতি। কানহাইয়া কুমারের হয়ে প্রচার করা আর বিহারের নির্বাচনে বিজেপির ভোট লুঠ একা হাতে রুখে দেওয়া ফাগো তাঁতি খুন হয়ে গেছেন। ফাগো তাঁতি… বছর ৬২র এক তরুণ কমরেড।
সম্ভবত সময়টা ২০১৬ সালের এপ্রিল মাস। মসনদপুর গ্রামের এক বিষণ্ণ বিকেলে বসে আছি কানহাইয়া কুমারের বাড়ির উঠোনে। সেই মুহূর্তে কানহাইয়ার বাড়িতে পুরুষ বলতে প্যারালাইসিস আক্রান্ত কানহাইয়ার বাবা জয়শঙ্কর সিং, দাদা মনিকান্ত। ভাই প্রিন্স আর জ্যাঠা রাজিন্দর সিং আর কৈশোরের রাজনৈতিক গুরু বলবন্ত সিং গিয়েছেন বিজেপি যুবনেতা কুলদীপ ভার্সনৈ আর উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চল সেনা দলের নেতা আদর্শ শর্মার নামে মামলার শুনানিতে। কুলদীপ হুমকি দিয়েছিলেন যে কানহাইয়ার জিভ কেটে আনতে পারবে তাকে তিনি পাঁচ লাখ টাকা দেবেন। আর আদর্শ দিল্লিতে পোস্টার মেরেছিলেন যে, যে কানহাইয়ার মুন্ডু কেটে আনতে পারবে তাকে তিনি ১১ লাখ টাকা দেবেন। খাটিয়ায় বসে গুড়ের চা খেতে খেতে কানহাইয়ার মা মীনা দেবী আর দাদার সঙ্গে কথা বলছি। চারদিকে গুমোট, এমন সময় এলেন প্রিন্স, রাজিন্দর আর বলবন্ত সিং। আরেক প্রস্থ চলল আলোচনা। তারপর বলবন্ত বলে উঠলেন চলো তোমাকে বিহারের লেনিনগ্রাদ আর মিনি মস্কো ঘুরিয়ে আনি। অগত্যা নতুন কিছুর আশায় উঠে বসলাম প্রিন্সের বাইকের পেছনে, আরেকটা বাইকে বলবন্ত আর রাজিন্দর।
কিলোমিটার তিনেক আসার পর মেন রাস্তা ছেড়ে ডানদিকের একটা গলিতে ঢুকে একটা স্কুলের মাঠে বাইক দাঁড় করায় প্রিন্স। সামনেই বড় স্কুল, তারপর খোলা ঘাসহীন মাঠ, আর এক কোণে একটা পোড়ো পুরনো দিনের বাড়ি, প্রায় ভেঙে পড়েছে। এটাই এই এলাকার সিপিআইয়ের পার্টি অফিস। বলবন্তজি আর প্রিন্স নিয়ে গেলেন সেখানেই। আলাপ করিয়ে দিলেন আইপিআই অঞ্চল প্রধান এবং এক সময় এমএলএ প্রার্থী রামরতন সিংয়ের সঙ্গে। রামরতনের পাশেই বসেছিলেন একজন নোংরা জামাকাপড় পরা বছর ৬০-এর বৃদ্ধ। শুনলাম তার নাম ফাগো তাঁতি। পার্টির ফুল টাইমার। রামরতনবাবুকে একটু বাজিয়ে দেখতে বর্তমানে সেখানকার বাম ভবিষ্যতের হালহকিকত জানতেই সাংবাদিক সুলভ একটা তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করি প্রথমেই। কানহাইয়ার মত এমন ডাকাবুকো ছেলের পাশে কেন দাঁড়াচ্ছে না বেগুসরাইয়ের সিপিআই? কানহাইয়া এপিসোডে এখনও পর্যন্ত কেন খোলাখুলি কোনও বিবৃতি পাওয়া যায়নি বিহারের লেনিনগ্রাদ আর মিনি মস্কোর সিপিআইয়ের তরফে? নাকি কানহাইয়া বিহটে থাকতে সিপিআইতে যোগ দিতে অস্বীকার করেছিলেন বা বলেছিলেন তিনি রাজনীতিতে আসতে চান না এখনই, সে কারণেই কি এখানকার সিপিআই নেতৃত্ব নিশ্চুপ? রামরতনের উত্তরের আগেই জ্বলে উঠেছিলেন ফাগো। বলেছিলেন— সাহাব পার্টি নেহি জয়েন কি পার, পার্টিকে সব কাম পে উয়ো রেহেতা থা। জব ভি পার্টিকে র্যালি নিকলতি থি তো সব সে বুলন্দ নাড়া উসকিই হোতি থি। ইহা আভি পার্টি থোড়ি কমজোর হ্যায়, ইসলিয়ে চুপ হ্যায় হাম, কিউ কি মসলা দিল্লিকা হ্যায়, হিঁয়া সে বৈঠকর হামারি বকচোদিসে কুছ না হোনেওয়ালা। আউর আপকো কিয়া বাতাউ আপ মিডিয়াওয়ালো কো সচ পাতা কাহা হ্যায়? প্রশ্ন করেছিলাম সত্যিটা কি? চা এসে গিয়েছিল। ঘন মোষের দুধে গুড়ের চায়ে চুমুক দিয়ে ফাগো বলেছিলেন, বললে লিখতে পারবেন? তাহলে শুনুন। এই দেশদ্রোহী জঙ্গি সমর্থক এসব আসলে বিজেপির ভাঁওতা। কানহাইয়ার সঙ্গে বিজেপির আসল লড়াই ইউজিসি নিয়ে। হিউম্যান রিসোর্স ডেভলপমেন্ট মিনিস্টার থাকাকালীন স্মৃতি ইরানি চেয়েছিলেন ইউজিসির অপসারণ। ইউজিসিকেই তুলে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৬ সালে হিউম্যান রিসোর্স মিনিস্ট্রির অধীনে ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্ট কমিশন অ্যাক্ট তৈরি হয় উচ্চশিক্ষার জন্য। এই আইনের আওতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থার মাপকাঠি বিচার করা হবে, বিশ্ববিদ্যলয়কে পরিচিতি দেওয়া হবে, সেই সঙ্গে দেওয়া হবে শিক্ষার পরিকাঠামোর জন্য অর্থ। বিশ্ববিদ্যালয়কে বেসরকারিকরণের উদ্দেশ্যে স্মৃতি চেয়েছিলেন এই আইন তুলে দিতে, যাতে বেশকিছু কর্পোরেট সংস্থার শিক্ষা সংস্থানগুলিকে মান্যতা দেওয়া যায়। তা ছাড়া সরকারের টাকায় জেএনইউর মত তথাকথিত প্রগতিশীল বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়াশুনা করা ছাত্রছাত্রীরা সরকারের গ্র্যান্ট নিয়ে শিক্ষিত হয়ে সরকারের কাজকর্মের বিরোধিতা করছে। ফ্যাসিস্ট বিজেপি সরকারের প্রতিনিধি স্মৃতি সেটাই বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। যার প্রথম বিরোধিতা করে কানহাইয়া।
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। একটা প্রায় ছিঁড়ে যাওয়া কালো প্যান্ট, নোংরা না কাঁচা একটা গোলগলা গেঞ্জি পরিহিত, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। প্রথম দর্শনেই এই লোকটাকে কোনও অশিক্ষিত দেহাতি বলেই মনে হবে। কিন্তু তার মুখ থেকে এত গুছিয়ে কথা একেবারে টু দি পয়েন্ট শুনে আর এত গভীর তথ্য দেয়া দেখে আচমকাই প্রশ্ন বেরিয়ে আসে মুখে, কতদূর পড়াশুনা করেছেন? এবার নরম হয়ে জবাব দেন ফাগো। আরে সাহাব হাম গরীব ভূমিহার কিষাণ, হামারে আউর কেয়া শিকসা! বচপনকে গয়ে থে কহি স্কুল পড়, পড়াই জায়দা চলা নেহি। বাস পাঁচবি কক্ষা তক হি পড়া হু। স্কুল তো ছুট গেয়ি পড়, পড়াই নেহি ছুটি। পার্টি অফিস মে জো কিতাব আতি হ্যায় পড় লেতে হ্যায় হিন্দি মে। ফাগো এরপর বলেন ২০১৪-১৫য় এই কানহাইয়া কুমারের নেতৃত্বেই দিল্লির আইটিও চত্বরে ধর্নায় বসে এসএফআই সহ প্রায় সমস্ত ইউনিভার্সিটি ছাত্র সংগঠনগুলি। সেই সময়ই স্মৃতির সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন কানহাইয়া। এরপর রোহিত ভেমুলার মৃত্যুর প্রতিবাদেও আরও একপ্রস্থ ঝামেলা। কানহাইয়ার কাছে হার মেনে স্মৃতিকে পেছু হটতে হয়। তখন থেকেই স্মৃতির চক্ষুশূল কানহাইয়া। তার উপর গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে যায় এবিভিপির মত শক্তিশালী ছাত্র সংগঠনকে হারিয়ে এআইএসফের নেতা হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়ে কানহাইয়ার জেএনইউর মত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের অধ্যক্ষ হয়ে যায়। ফলে দিনে দিনে কানহাইয়া বিজেপির কাছে বিপদ হয়ে উঠেছিলেন। কারণ কানহাইয়া যখন জেএনইউতে আসেন তখন ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও হাজার হাজার সমর্থক নিয়ে বিজেপি যা করতে পারেনি তা মাত্র পাঁচজন ছাত্র আর নিজের অসাধারণ বাগ্মিতার জোরে তাই করেছিলেন কানহাইয়া। জেএনইউ দখল। একজন সাধারণ দলিত সন্তানের এই স্পর্ধা মেনে নিতে পারেনি বিজেপি। ফাগোর কথার খুব একটা বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু ফাগো যে সত্যি বলছেন তার প্রমাণ পেয়েছিলাম পরে পাটনার রাজেন্দ্রনগরে গিয়ে শিক্ষক এবং সমাজকর্মী অক্ষয় কুমারের কাছে। এই মানুষটির বাড়িতেই কানহাইয়া থাকতেন পাটনা কলেজে পড়ার সময়। এবং কানহাইয়ার জীবনে তার গুরুত্ব অপরিসীম। ফাগোর কথারই পুনরাবৃত্তি শুনেছিলাম পাটনা বিধানসভার উল্টোদিকে জগজীবন রাম সামাজিক শিক্ষা সংস্থানের লনে জেএনইউর অধ্যাপক সুবোধনারায়ণ মালাকারের কাছে। যার তত্ত্ববধানেই জেএনইউতে আদিবাসীদের সমাজতত্ত্ব নিয়ে পিএইচডি করছিলেন কানহাইয়া। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ঠিক কী ঘটেছিল ২০১৬র ৯ ফেব্রুয়ারি? প্রফঃ মালাকার বলেন সম্পূর্ণ ঘটনাটি একটি পূর্বপরিকল্পিত ঘটনা। কারণ ৭০ শতাংশ ছাত্র এখানে দলিত পরিবার থেকে পড়তে আসে। এখানে পড়াশুনা করে তারা যে চিন্তাধারা নিয়ে বাইরে যায়, সেই চিন্তাভাবনার ধারাকে ভয় পায় শাসকদল। আর এটা নিয়েই যত ঝামেলার সূত্রপাত। সরকার ইউজিসির মাধ্যমে এখানকার সাবসিডি বন্ধ করে দিতে চায় যার বিরুদ্ধে লড়ছেন কানহাইয়া। তাতেই সরকারের রাগ গিয়ে পড়েছে কানহাইয়ার উপর। তাহলে ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন? মালাকারবাবুর কথায় সেদিন একদল স্টুডেন্ট একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল সেখানে। কানহাইয়া সেই অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিলেন না, সেই অনুষ্ঠানেও ছিলেন না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেই অনুষ্ঠান শুরুর দুঘণ্টা আগেই সেই অনুষ্ঠা্নের অনুমতি বাতিল করে দেন। কিন্তু ততক্ষণে সেখানে অনেকেই চলে এসেছিলেন। তারা অনুষ্ঠানটি করেন। এর খানিক পরেই মিছিল জেএনইউর অন্যদিকে গেলে তাদের নিজেদের মধ্যেই সংঘর্ষ বাধে। তখন কানহাইয়া সেখানে যান সংঘর্ষ থামাতে এবং পুলিশকে বলেন বহিরাগতদের বের করে দিতে। কানহাইয়া কোনও দেশবিরোধী স্লোগান দেননি। এরপর প্রশাসন যখন কানহাইয়াকে সাসপেন্ড করে দেয় তার দুদিন পরে ১১ তারিখ কানহাইয়া ভাষণ দেন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিঙে। সেখানেও কোথাও তিনি দেশবিরোধী রাষ্ট্রবিরোধী স্লোগান দেননি।
ফিরে আসি ফাগোর কথায়। জিজ্ঞাসা করেছিলাম বাম আন্দোলনের ভবিষ্যত কি তবে কানহাইয়া? নাকি আদৌ কোনও ভবিষ্যত আছে বামপন্থার? নাকি বামপন্থার পতন ঘটেছে? রামরতন সিংয়ের দিকে একবার আড়চোখে দেখে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ফাগো বলেন, ‘আপ তো বাঙ্গালকে হ্যায়, আপকো কিয়া লাগতা হ্যায়?’ উত্তর না পেয়ে ফাগো এরপর নিজেই বলে, ‘সাহাব খুন দেখা হ্যায়? তাজা খুন? জবতক নয়া খুন নিকল রাহা হোতা হ্যায় তব তক ওহ লাল রেহেতি হ্যায়, গাঢ়হা লাল, পর খুন নিকলনা বন্দ হো জায়ে তো ওহি খুন শুখকর কালা বন জাতা হ্যায়। ফিলহাল দেশ মে লেফট কা হালাত ওহি হ্যায়, শুখা খুন। আগার জিন্দা রেহেনা হ্যায় তো তাজা খুন চাহিয়ে।’ হা করে তাকিয়ে থাকি। কী বলছে লোকটা? চারজন শিক্ষিত দাপুটে কমিউনিস্ট নেতার সামনে দাঁড়িয়ে এক অশিক্ষিত ভূমিহার চাষির এই অমোঘ ভবিষ্যদ্বাণী সেদিন বুঝিনি। আজ বুঝি। ফাগো সেদিন বলেছিলেন, সাহেব যতদিন না দেশের বাম নেতৃত্ব বদলাবে, যতদিন না রীতিরেওয়াজ বদলাবে, যতদিন না বদলাবে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ততদিন শুকিয়ে যাওয়া কালো রক্তের দাগের মতই থেকে যাবে বামেদের ভবিষ্যত। খুব একটা ভুল কি সেদিন বলেছিলেন ফাগো? তাহলে কেন পশ্চিমবঙ্গে প্রচারে এলেন না কানহাইয়া? কেন শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে গেলেন তিনি, বাতিল করলেন মেদিনীপুরের সফর? আসলে তথাকথিত বাম নেতৃত্বের পুরনো ধ্যানধারণা অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল কানহাইয়ার নতুন দৃষ্টিভঙ্গির কাছে। পুরনো বাম নেতৃত্বের অনড় সেই অচলায়তন, এক প্রকার গা জোয়ারিই বাধ্য করেছিল কানহাইয়াকে দূরে সরে যেতে। মানুষ আর বামপন্থায় বিশ্বাস করলেও ভরসা করতে পারেনি।
বিহারের নির্বাচনে কানহাইয়ার পক্ষে প্রচার এবং নির্বাচনী এজেন্ট করা হয়েছিল ফাগো তাঁতিকে। সেদিনের সেই ষাটোর্ধ্ব তরুণ একার হাতে রুখে দিয়েছিলেন বিজেপির ভোট লুঠ। ফল পেয়েছিলেন হাতেনাতে। বিহারের ভোট শেষ হওয়ার পরপরই গত ১৬ই মে বৃহস্পতিবার বিকেলে অপহৃত হয়ে যান বেগুসরাইয়ের মটিহানী থানা এলাকার রামদিরি মহাজি গ্রামের বাসিন্দা ফাগো তাঁতি। পরদিন ১৭ই মে শুক্রবার তার লাশ পাওয়া যায় বেগুসরাইয়ের ভওনাপুর এলাকার রাস্তার ধারে। তার সারা শরীরের ছিল প্রচণ্ড মারধোরের চিহ্ন। তার ভাই রামচন্দ্র তাঁতির বক্তব্য ছল পচরুখি এলাকা থেকে ফেরার সময় অপহরণ করা হয় ফাগোকে। জানানো হয় স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে। কিন্তু পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী পঙ্কজকুমার জানান ১৭ তারিখ রাত দশটা নাগাদ ভওনাপুরের এক মন্দিরের কাছে ফাগোকে রক্তাক্ত অবস্থায় যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখা যায়। বারবার জল চাইছিলেন ফাগো। কিন্তু সেখানে তখন বহু মানুষ উপস্থিত থাকলেও একজনও এগিয়ে আসেননি ফাগোর মুখে জল দিতে বা তাকে সাহায্য করতে। পঙ্কজবাবু ফাগোর বাড়ির লোকজনকে খবর দেন, কিন্তু যতক্ষণে তারা পৌঁছোন ফাগো মারা গিয়েছেন। নিজের শেষ অবস্থাতেও ফাগো বামপন্থাকে ছাড়েননি। সবচেয়ে আশ্চর্য, পুলিশ ফাগোর মৃতদেহ যখন পায় তখন তার পরণে ছিল একটা লাল টি-শার্ট। যার উপর জ্বলজ্বল করছিল একটা লাইন ‘হাম লে কে রহেঙ্গে আজাদি’। কানহাইয়া কুমারের প্রিয় স্লোগান।
বন্ধু প্রশান্ত হালদারের ফেসবুক পোস্ট থেকে যখন ফাগোর মৃত্যুর খবর পেলাম, তখন খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম। বারবার কানে বাজছিল ফাগোর বলা কথাগুলো,
সাহাব খুন দেখা হ্যায়? তাজা খুন? জব তক নয়া খুন নিকল রাহা হোতা হ্যায় তব তক ওহ লাল রেহেতি হ্যায়, গাঢ়হা লাল, পর খুন নিকলনা বন্দ হো জায়ে তো ওহি খুন শুখকর কালা বন জাতা হ্যায়। ফিলহাল দেশ মে লেফট কা হালাত ওহি হ্যায়, শুখা খুন। আগার জিন্দা রেহেনা হ্যায় তো…
। ফাগো তাঁতি অমর রহে ।
অপূর্ব লেখনী। অসাধারণ বিশ্লেষণ। খুব ভাল লাগল।