এই মৃত্যু উপত্যকাই কি আমার দেশ?

সুশোভন ধর

 

কোনও এক সর্বগ্রাসী দুর্ভিক্ষের সুদৃশ্য সুতোর টানে উত্তরবঙ্গের চা-বাগানগুলির শ্রমিকরা এক মৃত্যুমিছিলে নাম লিখিয়েছেন। অবশ্য এই চা বাগানের শ্রমিকরা এইভাবে অনাহারে, বিনা চিকিৎসায় না মারা গেলে তাদের অস্তিত্বের কথা আমরা কজনই বা জানার চেষ্টা করতাম?

নিন্দুকেরা অবশ্য বলছেন যে চা-শ্রমিকদের এই চরম সংকট কোনও কোনও সময়ে পঞ্চাশের মন্বন্তরের স্মৃতি উস্কে দিচ্ছে। সেই দুর্ভিক্ষ যেখানে পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ মারা গেছিলেন চরম দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায়। অবশ্য সেদিনের ঐ অবস্থার কারণ খুঁজে বের করতে বা দোষীদের সনাক্ত করতে কোনও পণ্ডিতি লাগে না। সকলে একবাক্যে স্বীকার করেন যে তখনকার পরাধীন ব্যবস্থাই আমাদের বিপর্যস্ত করেছিল। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর ভারতবর্ষে, যেখানে এমনকি খাদ্য নিরাপত্তা আইন তৈরি হয়েছে, সেখানেও কেন ভয়ঙ্করভাবে প্রাসঙ্গিক চা শ্রমিকদের এই মৃত্যু মিছিল বা অর্ধাহারে বেঁচে থাকা?

শিল্প না প্রহসন?

অথচ এই পশ্চিমবঙ্গের চা শিল্প নিয়ে আমাদের গর্বের অন্ত নেই। পৃথিবীর চা উৎপাদনের ২৬% উৎপন্ন করার ফলে চিনের পরেই দ্বিতীয় প্রধান উৎপাদকের স্থান ভারতের। আবার এই দেশে চায়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎপাদক পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য। শুধু তাই নয় চা, এই রাজ্যের বড় শিল্পের মধ্যে অন্যতমও বটে। দার্জিলিং-এর পাহাড় ও উত্তরবঙ্গের সমতল ডুয়ার্স ও তরাই মিলে কমপক্ষে ৫ লক্ষ মানুষ এই শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষভাবে নিযুক্ত। এদের পরিবার ও চা বাগান সংশ্লিষ্ট জীবিকা বা পেশাগুলি ধরলে এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা ২৫ থেকে ৩০ লক্ষ। রাজ্যে ৪৫০ মতন চা বাগান আছে এবং কার্যত উত্তরবঙ্গের এক বড় অংশের অর্থনীতি এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের রাজ্যে বড় বড় কোম্পানি মালিকানাধীন বাগানের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও টাটা টি, উইলিয়ামসন ম্যাগর, গুডরিক, ডানকানস, ইত্যাদির ভালই উপস্থিতি আছে।

স্বল্প ইতিহাস

বাণিজ্যিক বাগিচার প্রথম হদিস পাওয়া যায় রোমান আমলে। একে বলা হত লাতিফুন্দিয়া যেখানে মদ তৈরির জন্য আঙ্গুর ও তেলের জন্য অলিভ চাষ করা হত। আধুনিক বাগিচা শিল্পের জন্ম হয় ইউরোপীয়রা কলোনি তৈরির উদ্দেশ্যে ‘নতুন বিশ্ব’ মানে আমেরিকায় পদার্পণের সাথে সাথে। এক জার্মান অর্থনীতিবিদ ও সমাজতত্ত্ববিদ, ওয়ার্নার সমবার্ট-এর মতে এই বাগিচাশিল্প বা প্ল্যান্টেশন হল মানব ইতিহাসে প্রথম বৃহৎ পুঁজিবাদী শিল্পসংস্থা। তিনি একথাও বলেন যে ‘নতুন বিশ্বের’ এই বাগিচাশিল্প ইউরোপীয় পুঁজিবাদকে চালিকাশক্তি যুগিয়েছিল।

ভারতে চা শিল্পের পত্তন ঘটে ১৭৭৪ সালে বড়লাট হিসাবে ওয়ারেন হেস্টিংসের রাজত্বকালে। কিন্তু চিন থেকে আনা চা গাছ এখানে বিশেষ সফল হয়নি। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় রবার্ট ব্রুস, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক কর্মচারি আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার উপরের দিকে দেশীয় প্রজাতির চা গাছের সন্ধান পান। আরেকটা মতামত অনুসারে মণিরাম দেওয়ান নামের জনৈক অসমীয়া জমিদার ব্রুসকে ১৮২৩ সালে চা গাছ চেনান। দেওয়ানের চা বাগিচা ছিল। ইংরেজরা এই ব্যবসায় নিজেদের একচেটিয়া কর্তৃত্ব কায়েম করতে চাইলে মণিরামের সাথে তাদের সংঘাত বাঁধে। ১৮৫৭ সালে সেপাই বিদ্রোহের সময় ইংরেজদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে মণিরামকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর ইংরেজরা চা শিল্পের কর্তৃত্ব সম্পূর্ণভাবে নিজেদের হাতে তুলে নেয়। ইতিমধ্যে ভারতে চা উৎপাদন শুরু হয়ে গেছে ও ১৮৩৮ সালে ভারতীয় চা লন্ডনের নিলামে বিক্রি হয়।

ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় চা উৎপাদনে সফল হওয়ার পর আসামের অন্যান্য জায়গায় যেমন কাছাড় অঞ্চলে এর প্রসার ঘটে। ১৮৫০ দার্জিলিং-এ চা বাগিচার পত্তন ঘটে। মজার ব্যাপার হল যে চৈনিক প্রজাতির চা গাছ দার্জিলিং-এর আড়াই হাজার থেকে ছ হাজার ফিট উচ্চতায় দিব্যি বেঁচে যায়। বিদেশের বাজারে চায়ের চাহিদা বাড়ার ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হিমালয়ের পাদদেশে তরাই ও ডুয়ার্স অঞ্চলে চা বাগিচার প্রসারণ ঘটায়। একই সময় মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির নীলগিরি পাহাড়ে চা শিল্প গড়ে তোলা হয়।

পৃথিবীর আন্যান্য জায়গার বাগিচা শিল্পের মতন আমাদের দেশের চা শিল্পেও এক ধরনের বৈপরীত্য বিরাজ করে। চা বাগানের পরিচালকরা একদিকে আধুনিক আমলাতন্ত্র ও অন্যদিকে দাস মালিকের ভূমিকা একইসাথে পালন করেন। এই বাগানে কাজ করা শ্রমিকরা মজুরীতে নিযুক্ত শ্রমিক হলেও তাদের নিয়োগ, পরিচালনা, বাগানে ধরে রাখা, ইত্যাদি করা হয় জোরজবরদস্তির মাধ্যমে। পরাধীনতার যুগে মালিকদের হাতে শ্রমিকদের শাসন করার অধিকার ছিল। এমনকি অত্যধিক কাজের চাপ ও বসবাসের নারকীয় ব্যবস্থার ফলে শ্রমিকরা বাগান ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাদের ধরে এনে জনসমক্ষে বেত্রাঘাত করার অধিকার মালিকদের ছিল। যা তারা হামেশাই প্রয়োগ করতেন। সময়ের সাথে সাথে শাসন করার এহেন ‘সুসভ্য’ অধিকারগুলি থেকে মালিকরা বঞ্চিত হলেও শ্রমিক খাটানোর রীতিনীতি একই থেকে গেছে। অর্থাৎ শ্রমিকদের ভয়াবহ অসহয়তার সুযোগ নিয়ে তাদের এক ধরনের বাধ্য করা হচ্ছে কম পয়সায় হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে।

অনাহারের মজুরী

আসলে উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স, তরাই ও দার্জিলিঙ্গের এই মনোরম চা বাগানের অন্তরালে যে নিষ্ঠুর শোষণ সর্বদা বিরাজমান তা খালি চোখে ঠাহর করা মুশকিল। এই শিল্পের সওয়ারী হয়ে মালিক থেকে শুরু করে, স্থানীয় দালাল এবং বিভিন্ন প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলির নেতারা লাখপতি-কোটিপতি হয়েছেন। কিন্তু যাদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের ফলে এই শিল্পের বিপুল উৎপাদন এবং বাড়বাড়ন্ত হয়েছে, সেই শ্রমিকরা কিন্তু যে তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেও নেই। তারা মানবজীবনের একেবারে তলার সারিতে কোনওরকমে টিকে আছেন। ভাবুন তো, এই মাগ্যিগণ্ডার বাজারেও বছর কয়েক আগেও তাঁদের মজুরী ছিল দৈনিক ৯০-৯৫ টাকা। এখন অবশ্য “অনেক” বেড়েটেড়ে সেটা হয়েছে দৈনিক ১৩২ টাকা ৫০ পয়সা। অবশ্য সব বাগান মালিকই যে এই পয়সা দেবেন তার কোনও গ্যারান্টি নেই। হাজারো সত্যি-মিথ্যা মেশানো গল্প বানিয়ে বহু বাগানেই মালিকরা মজুরী চুক্তির থেকে কম পয়সায় লোক খাটিয়ে নেন।

আসলে খাতায়-কলমে সংগঠিত শিল্প হলেও চা শিল্পের শ্রমিকদের অবস্থা অসংগঠিত শিল্পের শ্রমিকদের থেকেও খারাপ। না হলে যেখানে রাজ্যের অসংগঠিত শিল্পে সরকার ঘোষিত সর্বনিম্ন মজুরী ২০৬ টাকা সেখানে চা বাগানের শ্রমিকরা কী করে এত কম পয়সা পান? আরও মজার ব্যাপার হল যে দেশের দারিদ্রসীমার নীচের জনগণকে অনিপুণ বা অর্দ্ধনিপুণ কাজ দিয়ে তাদের ক্রয়ক্ষমতার উন্নতিসাধন করার লক্ষ্যে চালু এনআরইজিএ-এর আওতায় ১০০ দিনের কাজের মজুরীও দৈনিক ১৮০ টাকা, সেখানে বিদেশী মুদ্রা অর্জন করে এমন একটি শিল্পের শ্রমিকরা কী করে অর্ধাহারে-অনাহারে থাকার মতন কোনও একটা মজুরী পেয়ে যুগের পর যুগ গাধার খাটনি খাটতে বাধ্য হন? এই শিল্পের শ্রমিকদের তিন বছর অন্তর অন্তর মজুরী চুক্তি হয়।

চা শ্রমিকদের এই তিন বছর অন্তর মজুরী বৃদ্ধির চুক্তি এক ধরনের প্রহসন। বাইরে থেকে দেখলে প্রক্রিয়াটা বেশ গণতান্ত্রিক মনে হয়। মালিক ও শ্রমিক– দুইপক্ষই কি সুন্দর সরকারি উপস্থিতিতে যৌথ দরকষাকষির মাধ্যমে শ্রমিকদের দাবিদাওয়া মিটিয়ে নিচ্ছেন। আসলে শ্রমিকরা তিন বছর অন্তর অন্তর নিজেদের পাওনাগণ্ডা বুঝে নেন না, মালিকদের দাবিগুলোর আইনি মান্যতা দেন। এই মজুরী চুক্তিগুলো এখনও অবধি হয়ে এসেছে শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধির জন্য নয়। মজুরী চাপা দেওয়ার জন্য। না হলে ভাবা যায় যে এই পদ্ধতিতেই কখনও বারো আনা, কখনও দু’টাকা বা কখনও পাঁচ টাকা মজুরি বেড়েছে শ্রমিকদের। আখেরে যে মজুরি নির্ধারিত হয় সেটা প্রয়োজনের তুলনায় নগন্য এবং যেভাবে অতীতে চা শ্রমিকদের মূল ধারার সভ্যতা থেকে দূরে সরিয়ে এনে চা বাগানের গহীনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেভাবেই বিস্তর ফারাক রেখে দেওয়া হয় তাদের মজুরিতেও। অন্য শিল্পের শ্রমিকদের তুলনায় চা শ্রমিকদের মজুরি থেকেছে ধারাবাহিকভাবেই কম।

বিগত দু-তিন দশকের মজুরী বৃদ্ধি

 

সময়কাল বৃদ্ধি (টাকা) মজুরী বৃদ্ধি (শতাংশ) এই সময়কালের মুল্যবৃদ্ধির হার (চক্রাকারে)
১৯৮৭-৯০ ২.৫৫ ১৩.৮০ ২২.৬৭ ২২.৯৬
১৯৯০–৯৩ ৫.৫০ ১৯.৩০ ৩৯.৮৬ ৪৭.৬৮
১৯৯৪-৯৭ ৭.০০ ২৬.৩০ ৩৬.২৭ ৩২.৩৭
১৯৯৭-২০০০ ৮.৫০ ৩৪.৮০ ৩২.৩২ ২৭.০৫
২০০০-০৩ ১১.১০ ৪৫.৯০ ৩১.৯০ ২১.৩১
২০০৫-০৮ ৮.০০ ৫৩.৯০ ১৭.৪৩ ১৭.৬৩
২০০৮-১১ ১৩.১০ ৬৭.০০ ২৪.৩০ ৩৪.৬৪
২০১১-১৪ ২৮.০০ ৯৫.০০ ৪১.৭৯ ৩২.৩২
২০১৪-১৭ ৩৭.৫০ ১৩২.৫০ ৩৯.৪৭

 

১৯৮৭ সাল থেকে চুক্তিগুলোর দিকে দেখলে পরিষ্কার যে চারবার মজুরী বৃদ্ধি সেই সময়কালের মূল্যবৃদ্ধি থেকেও কম থেকেছে। অর্থাৎ টাকার অঙ্কে মজুরী বৃদ্ধি ঘটলেও শ্রমিকদের ক্রয়ক্ষমতা আগের থেকেও কমেছে। সমাজের যে অংশের মানুষ কোনওক্রমে নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর মজুরী পান তাদের ক্ষেত্রে এই অবস্থা ভয়ঙ্কর। দুবার মজুরী বৃদ্ধি সেই সময়কালের মুল্যবৃদ্ধির ওপর কোনওভাবে ভেসে থেকেছে। ২০১১-১৪ সালের মূল্যবৃদ্ধি আগের থেকেও অনেক বেশি দেখতে লাগলেও এর ফলে সামগ্রিক অবস্থা বা গতিপ্রকৃতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। প্রথমত এই বৃদ্ধি হয়েছিল আদিবাসী চা শ্রমিকদের এক উত্তাল আন্দোলনের ফলে। এছাড়াও এই বৃদ্ধির হার খুবই নিম্ন আয়ের ওপর নির্ভর করে হয়েছে এবং পরবর্তীকালে এই বৃদ্ধির হার নেমে এসেছে।

তাহাদের কিবা রাত কিবা দিন

অথচ অবস্থাটা তো সত্যি এরকম হওয়ার কথা ছিল না। কর্মসংস্থানের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের এক নম্বর সংগঠিত শিল্পে চাকরি পাওয়া তো একসময় ভাগ্যের ব্যাপার বলে ধরা হত। অবশ্য শ্রমিকদের আর্তনাদ ও হাহকার চিরকালই ছিল, চা বাগানের নয়নাভিরাম দৃশ্যপটের তলায় চাপা। বর্তমানে, বিভিন্ন কারণে সেই কঙ্কালসার চেহারাগুলো মাটির তলা থেকে উঠে এসে জানান দিচ্ছেন যে তারা আছেন, ‘বেঁচে’ আছেন। চিন্তা করলে গা ঘিনঘিন করে যে সংগঠিত শিল্প বলা হলেও এ শিল্পের শ্রমিকদের অবস্থা অসংগঠিত শিল্পের থেকেও খারাপ। এ শিল্পে কোনও ন্যূনতম মজুরীর বালাই নেই। অবশ্য ধারাবাহিক আন্দোলন ও ঘরে বাইরের বিভিন্ন চাপের ফলে সরকার ন্যূনতম মজুরীর ঢোক গিলে এ বিষয় কিছু করার জন্য ২০১৫ সালে একটা কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু সেই লোকদেখানো কমিটি এখনও কোন সদর্থক ভূমিকা রেখেছেন বলে যায়নি। কমিটিতে শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা তো একসময় অভিযোগ জানান যে দুবছরে তাদের মাত্র তিনবার কমিটির সভায় ডাকা হয়েছে। বলা যেতে পারে যে এই কমিটিকে জন্ম থেকেই পঙ্গু করে রাখা হয়েছে। কারণ মালিকবাহাদুররা কোনও খিল্লি না করেই জানিয়ে দিয়েছেন যে কোনও অবস্থাতেই তাঁরা ন্যূনতম মজুরী দিতে ইচ্ছুক নন। অথচ আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে, ১৯৬৭ সালে Kamani Metals & Alloys Ltd. v. Their Workmen মামলায় সুপ্রিম কোর্ট পরিষ্কার রায় দিয়েছিল “there are certain principles enumerated by the Court on which wages are fixed, broadly speaking the first principle is that there is a minimum wage which, in any event must be paid irrespective of the extent of profits, the financial condition of the establishment or the availability of the workmen on lower wages. The minimum wage is independent of the kind of the industry and applies to all alike big or small.” সরকার বা মালিকপক্ষ যে বিষয়টা জানেন না তা কিন্তু একেবারেই নয়। অনেক পয়সা খরচ করে তাঁরা লোক পোষেন শ্রমিকদের পয়সা মারার মামলা সালটে দেওয়ার জন্য। তাদের আসলে বয়ে গেছে। তাঁরা জানেন যে তাঁরাই শেষ কথা কারণ প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলি ও তাদের নেতারা ফুটানি করেন তাঁদেরই পয়সায়।

সব পেয়েছির আসর

চা নিয়ে যে কোনও আলোচনায় একটা কথা মাথায় রাখতে হবে যে কৃষিনির্ভর এই শিল্প অত্যন্ত শ্রমনিবিড়। অর্থাৎ শ্রমিক বাদ দিয়ে কোনও কিছুই হবে না। সে আপনি যত আধুনিকতায় একে মুড়ে ফেলুন না কেন, মুল কাজ অর্থাৎ ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’ তোলার কাজে মেকানাইজেশন নৈব নৈব চ। শ্রমনিবিড় শিল্প হওয়ার ফলে এখানে লোক খাটিয়ে পয়সা। কিন্তু শ্রমিকদের পেছনে যে খরচা হয় তা টি এস্টেটের ৪০%-এর বেশি নয়। বাকিটা যায় অফিস, ম্যানেজার ও তার অধস্তনদের রক্ষণাবেক্ষণে, অফিস চালানোর খরচা ও মালিকদের পকেটে।

কোনও ধরনের সরকারী বিধিনিয়ম বা নিয়ন্ত্রণের অভাবে এই শিল্পে মজুরী ও সাধারণভাবে শ্রমিকদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। ন্যূনতম মজুরী চাইতে গেলেই মালিকরা রব তোলেন যে চা শিল্প সংকটে এবং তারা বাগান বন্ধ করতে বাধ্য হবেন। মোদ্দা কথা হল যে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় এই শিল্পের মালিকরা বেশ রসেবশেই আছেন। আসলে যারা সংকটে পিষ্ট তারা হলেন এই শিল্পের সাথে যুক্ত শ্রমিক ও তাদের পরিবার পরিজনেরা। দুটো বিষয়ের দিকে নজর দিলে এই শিল্পের শ্রমিকদের সামগ্রিক পরিস্থিতি দিনের আলোর মতন পরিষ্কার হয় যায়। ন্যূনতম মজুরীর কথা আগেই বলেছি। দ্বিতীয়, শ্রমিকরা যেহেতু বাগানে থাকেন, তাদের বাসস্থান ও অন্যান্য মৌলিক বিষয় সুরক্ষিত রাখাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় প্লান্টেশনস লেবার অ্যাক্ট ১৯৫১ অনুযায়ী। এই আইনের বলে শ্রমিকদের পাকা বাড়ি, স্বাস্থ্য পরিষেবা, ক্যান্টিন, ক্রেশ, শ্রমিকদের বাচ্চাদের শিক্ষার ব্যবস্থা, রেশন ও চা পাতা, শুকনো জ্বালানি কাঠ, পানীয় জল, মাতৃত্বকালীন সুযোগ সুবিধা, ইত্যাদি দেওয়ার কথা। কিন্তু, একে এই আইনের ফাঁকফোকর প্রচুর; এছাড়া মালিকরা এই আইনকে যথেচ্ছ বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যত্রতত্র শ্রমিক শোষণ চালাচ্ছেন। সরকারের তরফ থেকেও এই আইনের ঠিকঠাক প্রয়োগের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই।

একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই

আসলে এই মানুষগুলি কোনওরকমে বেঁচে আছে। তাদের নিত্যদিনের সাথী অনাহার-অপুষ্টি, চিকিৎসা ও ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার অভাব, ইত্যাদি। দাঁড়িয়ে থেকে ৮-১০ ঘণ্টার হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম যাদের দস্তুর তারা কম পারিশ্রমিকে নিরুপায় হয়ে চা বাগানে কাজ করতে বাধ্য। এদের থাকার অন্য কোনও বিকল্প বাসস্থান নেই। চা বাগানের ভেতরই তারা থাকে। সাহেবরা তাদের যেখান থেকে ধরে এনে, বা চুরি করে নিয়ে এসে তাদের দিয়ে ঘন জঙ্গল কাটিয়ে চা বাগানের পত্তন করেছিল, সেখানে ফেরার উপায় নেই। বাগানে কাজ না করলে তাদের সেখানে থাকতে দেওয়া হবে না, বের করে দেওয়া হবে। তাই একটু আশ্রয়ের জন্য হলেও তারা কম পারিশ্রমিকে কাজ করতে মজবুর। এর সুযোগ নিচ্ছে মালিকরা।

তাই চা বাগান ছেড়ে শ্রমিকরা দলবল নিয়ে অন্য কোথাও ভাগ্যন্বেষণে অন্য কোথাও পাড়ি দেবেন তারও পুরোপুরি উপায় নেই। চা বাগানের ‘কোয়ার্টারে’ থাকা এই মানুষগুলির ভিটেমাটি উচ্ছেদ হয়ে যাবে যদি সংসারের একজন বাগানে মালিকদের গোলামি না করেন। যেখান থেকে তাঁরা এসেছিলেন অর্থাৎ, সেই ছোটনাগপুর মালভূমিতে যে তাঁরা ফিরে যাবেন তারও উপায় নেই। ছলে-বলে-কৌশলে, ভুলিয়ে-ভালিয়ে বা চোখ রাঙ্গিয়ে-ভয় দেখিয়ে, গায়ের জোরে, নানাভাবে তাঁদের ধরে আনা হয়েছিল উত্তরবঙ্গ ও আসামের চা বাগানগুলিতে। এদের বেশিরভাগ জানেন না তাঁদের দেশ-গাঁ কোথায়। কোথায় ফিরবেন তাঁরা? কেই বা ডেকে নেবে তাঁদের?

অবশ্য এভাবে ভিটেমাটি উজাড় করে লোক চালান দেওয়া সারা পৃথিবীজুড়ে বাগিচাশিল্পেরই বৈশিষ্ট্য। তা সে চা, কফি, কোকো, তামাক বা চিনি, যাই হোক না কেন। সেই কারণেই আধুনিক ক্রীতদাসপ্রথা চালু হয় আমেরিকা মহাদেশে বাগিচাশিল্প পত্তনের হাত ধরে। বলা হয় যে বাগিচাশিল্প এই পৃথিবীর বুকে প্রথম বড়সড় পুঁজিবাদী উদ্যোগ। কিন্তু এখানকার মজুর খাটানোর ধরনধারণ বা শোষণের চেহারাটা কিন্তু ক্রীতদাসপ্রথাকেই অনেক বেশি অনুকরণ করে। সময়ের তালে হয়তো অনেকরকম আধুনিকতার মোড়কে সেজেছে এই শিল্প, কিন্তু মোটের ওপর ধাঁচাটা একই আছে।

আসলে যে কথাটা বলা হয়নি, তা হল চা বাগান এক মগের মুলুক। শিল্পপতি মালিকের পোশাকের আড়ালে বেচু-কিনু বানিয়াদের মৃগয়াভূমি। ‘শিল্পপতি’-র তকমা আঁটা এই ফড়েরা যাবতীয় সরকারি সুযোগ নিয়ে কার্যতঃ লুঠপাঠ চালাচ্ছে। লাগামছাড়া ফাঁকিবাজি আর ধান্দাবাজির শিকার শুধু হাজার-হাজার শ্রমিক-কর্মচারি-ই নয়, রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারও। সোনা ফলানো এই শ্রমনিবিড় শিল্পটিকে প্রায় লাটে উঠিয়ে দেবার দায় শুধু অলস শ্রমিক ও ইউনিয়নবাজির ওপর ঠেলে দিয়ে মালিক সংগঠনগুলো আজও পর্যন্ত হিসাবকিতাবহীন ফায়দা লুটে চলেছে সরকারি অজ্ঞতা, দায়বদ্ধহীনতা কিংবা উদাসীনতার কাঁধে চেপে।

 

 

(ছবি: ইন্টারনেট)

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

আপনার মতামত...