রাজদীপ্ত রায়
একটা মাঠ। মাঝে একটা খুব নিচু এবং পলকা দেওয়াল, অথবা বলা ভালো, একটা বেড়া চলে গেছে। তার একদিকে থাকে কেঁচোরা। অন্যদিকে কৃমি। সম্পর্ক ভালো নয়। এতদিন কেঁচোরা মাঠের ওপর দিকটায় ছিলো। ওইদিকে একটা দীঘি আছে। এই গোটা প্রান্তরের একমাত্র জলের উৎস। দীঘির গা ঘেঁষে চলে গেছে নিচু বেড়াটা। কিন্তু এখন কেঁচোরা ওপরদিকে আর থাকেনা। খুব ঝগড়া হল। কেঁচোরা হেরে গেলো। দীঘির দিকের দখল নিল কৃমির দল। তারা এখন ওপর দিকে থাকে। কেঁচোরা দেওয়ালের এপারে, মাঠের নিচের দিকে। বড় কষ্টে দিন কাটে। তেষ্টায়। জল চাইতে পারেনা কৃমিদের কাছে। লজ্জায়, অভিমানে, রাগে। হাজার হোক শত্রুপক্ষ। কৃমিদের মহা উল্লাস। অনেক, অনেকদিন বাদে মাঠের ওপরের অংশ, দীঘি – সব তাদের দখলে। আনন্দে জল নিয়ে কি করবে ভেবে উঠতে পারছে না। এই হুটোপুটি করে নাইতে যায় তো ওই অকারণে উল্লাসে জল খেয়ে খেয়ে গা হাত পা ব্যথা করে ফেলে! আদেখলার ঘটি হলে যা হয় আরকি!
এদিকে কেঁচোদের রাজ্যপাট শুকিয়ে কাঠ। জলের ভীষণ প্রয়োজন। কিন্তু যে দেশে আজীবন আছে, তাকেই ভালো করে চেনে না। কোনোদিন মুখ তুলে দেখেইনি। কাজেই জল খাওয়ার আর কোনও পথ বা উপায় আছে কিনা ভেবে ভেবেও কিনারা হয় না সহসা।
দেশের নাম অঙ্গুরীমাল প্রদেশ। এখানকার নব্বই শতাংশ অধিবাসী এই অঙ্গুরীমাল সম্প্রদায়ের। কেঁচো এবং কৃমি উভয়েই অংগুরীমাল প্রাণী। মেধা, মনন, দেহ বা উদ্দেশ্য এবং জীবন যাপনের গতে বিস্তর মিল থাকলেও এই দুই গোষ্ঠীর বর্ণভেদ আছে। এদের গায়ের রং আলাদা। এমনিতে দুজনেই মাটির কাছাকাছি বাস করে, একজন মাটির ওপর ঘাসে ঘাসে, অন্যজন মাটির ভেতর। একেবারে মাটির মানুষ দুইই। তবে এত মাটিময় জীবনে কারোরই আর মুখ তুলে আকাশ দেখার ইচ্ছে বা সৌভাগ্য কোনটাই হয়নি। অনভ্যাসে উচ্চতাও বাড়েনি।
অনভ্যাসে নাকি কিছুই বাড়েনা। ডারউইনের কথা। কাজেই এদের না বেড়েছে মস্তিষ্ক, না বেড়েছে লিঙ্গ। ফলে দুটি জাতেরই বোধবুদ্ধি সীমিত, আর দ্বিতীয় অঙ্গটির ক্ষীণবৃদ্ধিতে পরকালও ঝরঝরে। যাও বা আকচাআকচি করে নিজেরা আপাতত আছে লিঙ্গ-ক্ষীনতার নির্জীব সহবাসে ভবিষ্যৎ একেবারেই ঢুঁ ঢুঁ জগন্নাথ। বর্ণহীন। সাদামাটা। বংশে বাতি দেওয়ারও খুব একটা কেউ নেই।
কিন্তু তা সে ভবিষ্যতে যাই হোক না কেন, আপাতত ভীষণই খিটকেল অবস্থা। তেষ্টায় ছাতি ফাটছে। উচ্চতা হীন হওয়ার জন্য বেড়ার ওপারে না পারছে দেখতে, না পারছে বেড়া বেয়ে উঠতে। কোনো উপায়ই বেড়োচ্ছে না ঘিলু থেকে। গোদের ওপর বীষফোঁড়ার মত ওপার থেকে ভেসে আসছে কৃমিদের জলকেলির উল্লাস। গায়ে ধরছে আরোও জ্বালা।
এদিকে একটা নতুন আশঙ্কা দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে কয়েক গুণ। মোড়ল কেঁচো অভিজ্ঞ জীব। মেঘে মেঘে বেলা গড়িয়েছে অনেকটাই। দেখে শুনে সে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছে। বিলক্ষণ বুঝতে পারছে যে এই তেষ্টা পীড়ন আরোও কিছুদিন চললে কেঁচোগোষ্ঠীতে একটা অন্তর্কলহ অবশ্যম্ভাবী। সকলেই তো আর এক ছাঁচের কেঁচো নয়তো রে বাবা। এই হক কথা বুঝতে পাশ দিতে হয়না। মোড়লী দিয়েও এসব ধরতাই বোঝা যায়। আমরা না হয় মাটির প্রাণী, লম্বা নই, বেড়া ডিঙোতে পারি না। কিন্তু এই না পারাটা তো ফস করে বলে বসা যায় না। দুম করে হাটের মাঝে কেউ বলে যে, আমি রাতে বাইরে বেরোতে ভয় পাই, বা আমার মাথায় চুল নেই আসলে পরচুলো! সমাজের একটা রীতিনীতি আছে তো নাকি? অক্ষমতা কখনো ঢাকঢোল পিটিয়ে জানাতে নেই। এতে বাজারদর কমে, ছেলে ছোকরারা মান্যিগন্যি করে কম। টাক পড়লে পরচুলোতে ঢেকে রাখাটাই দস্তুর।
অতএব ফরমান জারি হল যে বেড়ার কাছাকাছি যাওয়া যাবেনা। তেষ্টায় ছাতি ফাটে ফাটুক, তবুও জল চাওয়া নৈব নৈব চ।
যেসব কেঁচো খানিক দুর্বল বা মতিগতি অস্থির তাদের জন্য আনা হল একহাঁড়ি আরক। নাম, আদর্শ নৈতিক আরক। খাওয়ালেই কেল্লা ফতে। তখন মরে গেলেও জল খেতে চাইবে না জীবনে। মোড়ল জানে যে সমস্যা অনেক। একে তার নিস্তেজ ডারউইন; শিলাজিৎ, জাপানী তেলেও সে রোগ সারার নয়। আছে বেড়া, তা সে যত নিচুই হোক না কেন, না ডিঙোতে পারার নাছোড়বান্দা হেরে যাওয়া পাপবোধ। সঙ্গে আবার আরেক যন্ত্রনা।
এমন নয় যে কেঁচোদের কাছে জল খুঁজে পাওয়ার ম্যাপ ছিলোনা। ছিলো। অনেক পুরোনো কালে। সে এক কাল ছিলো বটে, আহা, কেঁচোদের কি দাপট ছিলো সে বলার নয়, দেখার মতো। তখন বেড়াটা ছিলো না। কেঁচো, কৃমি সব পাশাপাশি। আর দীঘিটা দখল করেছিলো সারসেরা। বিভীষিকা। অকাতরে তখন কেঁচো কৃমি ভোজন চলছে। সারসের বাড়বাড়ন্তে বাঁচাই দায়। তখন এক দৈবীপুরুষ, উফফ, ভাবলে মোড়লের এখনো কাঁটা দেয় গায়ে, দয়া পরবশ হয়ে দিনরাত খেটে বানালেন ম্যাপ। মাঠের মধ্যে চললো অন্য কোনো জলের উৎস সন্ধান। দিন মান এক করে তখন খাটাখাটি, মাটি ওলটপালট – সে এক কর্মযজ্ঞ বটে। গর্ত খোঁড়া, বাঁধ বানানো — হুলুস্থুলু ব্যাপার। জল এল। প্রাণ জুড়োল। সে তো জল নয়, যেন সাক্ষাৎ জীবন। তেষ্টা মিটিয়ে সবাই এককাট্টা হয়ে, সব শক্তি এক করে সারসের সংগে ধাঁ ধমাধম লড়াই। দীঘির দখল হাতে এলো। আহ্লাদ হলো। কৃমিদের সাথে প্রথমে আমোদ হলো। তারপর ঝগড়া হলো। বেড়া হলো। কুলকুল করে হালকা হাওয়ায় গা ভাসিয়ে অনেক দিন, মাস, বছর কাটিয়ে দেওয়া হলো।
মাঝখান থেকে গোলমালে ম্যাপটার কথা কেউ মনে রাখলো না। সেটা গেলো হারিয়ে। কালে কালে কুয়োটাও বুজে গেলো। ঘাস লম্বা হলো। কৃমিদের দৌরাত্ম্য বাড়লো। তারপর ঝাড়পিট। হার হলো। কৃমিরা এলো দীঘির পাড়ে। কেঁচোরা মাঠের ঢালু দিকটায় চলে যেতে বাধ্য হলো। মাঝখানে বেড়া। নিচু। কিন্তু কেঁচোর সাধ্য কি তাকে ডিঙোয়। এই আদিগন্ত ঘাস জমির নিচের দিকের অধিবাসী কেঁচোদের এখন ম্যাপ বিহীন কুয়ো খুঁজে বের করা মুশকিল হি নেহি, না মুমকিন হ্যায়।
কিন্তু তা সে যাই হোক, সে সব অক্ষমতার, অপারগতার গল্প তো আর বাইরে করা যায়না। বারণ বারণ বারণ। অতএব আদর্শ নৈতিক আরকের বিক্রি। আর তাছাড়াও বাজারে এখন সবাই কিছু না কিছু বেচে চলে, বেচেই চলে সর্বক্ষণ। কেঁচোরা না হয় খানিকটা আরকই বেচলো। ওই চামড়ার খুঁত, ছোটখাটো গর্ত ঢাকার জন্য যেমন ক্রিম বা লোশন, সেরকম আর কি। এতে মনের ভেতরের বেচাল ভাবনার ছুটকো ছাটকা ফাটা বা হাঁ-মুখ গুলো ঢাকাও পড়ে, আবার এক ধরনের একটা শহীদ শহীদ ভাবও আসে চেহারায়। বেশ খোলতাই লাগে। কাঁহাতক আর বেড়ার পাশে হা-ঘর, হাভাতের মত বসে থাকা যায় বলো!
ওই মাঠের কেঁচো-কৃমির গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত। তবে ছোট্ট একটা কথা না বললে পুরোটা বলা হয়না। ওই মাঠে, বেড়ার ধারে, উদাসীন জিরাফও ছিলো গোটাকয়। তারা অনেক দিনের বাসিন্দা। ওই অনেক আগে, সারসদের সঙ্গে যুদ্ধের সময়ে যে দৈবী-পুরুষের গল্প প্রসঙ্গ ধরে এসেছিলো, সেই গল্প এই জিরাফগুলোও শুনেছে। মেনেছে। নিজেদের মত করে মনে রেখেছে। ওরা অনেক লম্বা। তাই ঘাসের আড়ালে এবং ওপরেও দেখতে পায়। ওরা জানে কুয়ো কোথায় আছে। কিন্তু ওদের সঙ্গে কেঁচো বা কৃমি কেউই খুব একটা সম্পর্ক রাখেনা। কেঁচো কৃমিরা সংখ্যায় বেশী। তাই গুমোরও বেশী।
জিরাফগুলো ভাবতে ভালোবাসে। কেঁচোদের সাথে পৃথিবী দেখেছে দীর্ঘদিন। আবার কৃমিদেরও দেখছে। দুটিকেই অবশ্য বড্ডবেশী ঘাড় ঝুঁকিয়ে, কষ্ট করে দেখতে হয়। একে ছোট, তায় মাটির কাছাকাছি। ওরা কুয়োর কথা বলেছিল। ভাষা না জানায় কেঁচোগুলো বুঝতে পারেনি। তবে কেঁচোদের দু:খে জিরাফগুলোও দু:খী। আর কিছু নয়, কিন্তু হাজার হোক জল না পাওয়ার তেষ্টা তো। বড় বাজে বুকে। সেজন্য জিরাফগুলো, নিতান্তই সমব্যথায়, জল খায়না। তেষ্টা হজম করে। আর তাছাড়া ওই কৃমি ভরে নোংরা দীঘির জল এখন আর খাওয়াও যায়না। এতে আবার কৃমিদের ভারি অভিমান। অন্যদিকে, কেঁচোগুলো মনে মনে খুব খুশি। যেন, যাহোক একহাত নেওয়া গেলো কৃমিদের ওপর। ভাবখানা এমন যেন, জিরাফগুলো ওদের ওই আদর্শ নৈতিক আরকের চাপেই জল খাচ্ছে না। আসলে কেঁচোগুলো বুঝতেই পারেনি যে ওরা মাটির ওপর শুয়ে চলা জীব, বেড়া ডিঙিয়ে খেতে পারেনা। কিন্তু জিরাফগুলো বেড়া সহজেই ডিঙোতে পারে, তবুও খায়না, এটা জিরাফদের ইচ্ছে। একধরনের পছন্দও বলা যায়। যোজন যোজন ফারাক রয়েছে এই পারা বা না পারার মধ্যে।
কিন্তু এসব কথা তো কেঁচো বা কৃমি কাউকেই বুঝিয়ে বিশেষ লাভ নেই। তাই বাধ্য হয়ে একদিন উদাসী জিরাফগুলো ভাবলো, অন্য কোনও নিরুদ্দেশের দিকে রওনা দিলে কেমন হয়। কেঁচো বা কৃমি কারুর কাছেই ওরা কিছু আশা করেনা। ওদের ভাষাও এরা বোঝে না। এখানে, মানে এই অঙ্গুরীমাল প্রদেশে জিরাফদের থাকা বা না থাকায় এইসব কেঁচো কৃমিদের কিছু যায় বা আসে না খুব একটা। কিন্তু ইদানিং এই আপাত বৈরাগ্যে অল্পবিস্তর বাদ সেধেছে অন্য একটি উপদ্রব।
সমস্যার সূত্রপাত সেই ঘাসে ঘাসে, পাতায় পাতায়। তবে এ বেলা তার হাড়হীম আশঙ্কা কেঁচো কৃমির মিলিত ভয়ের চাইতেও বেশী। সম্প্রতি অঙ্গুরীমাল প্রদেশে আরোও এক কিসিমের প্রাণীদের বেমক্কা বাড়বাড়ন্ত দেখা দিয়েছে। এরা নব্য অতিথি। নাম, জোঁক। সম্প্রদায় একই, তবে উদ্দেশ্য এবং বিধেয়, দুইয়েই ফারাক আছে আশমান জমিন।
এরা দেখতে শুনতে অতটা দোহারা না হলেও ধকে বলিহারি। সদ্য আবির্ভাব, মানে, সদ্য গজিয়েছে, তাও নয়। ছিলো আগেও, কেরামতিও দেখিয়েছে অনেক, কিন্তু অঙ্গুরীমাল প্রদেশে হালে পানি পায়নি আজ ইস্তক। থেকেছে। কেঁদে কঁকিয়ে, ঝোপে, ঝাড়ে, বাদায়, পাঁকে। কিন্তু সে থাকায় এত গত্তি কোনোদিন লাগেনি, যা লেগেছে এই বছর কয়েকে। আসলে কৃমিরা যখন পুকুরের দখল নিলো, আর কেঁচোগুলোও হয়ে গেলো দিশেহারা আউলিয়া, তখন থেকেই জোঁকেদের আড়মোড়া ভাঙা শুরু।
বেশ তেল চুকচুকে চমকাই নিয়ে, হরকা বানে গা এলিয়ে পুকুরের ধারে আসা। খোলতাই গল্পগাছা। মষ্করা। খুনসুটি। দেয়ালা মুখে নিয়ে প্রথম প্রথম কৃমিদের সংগে আহ্লাদি আশনাই। কিন্তু সে হলে কি হবে বলো, খাদ্য বা ক্ষিদের ধরন যে এদের একেবারেই আলাদা। শুরুর দিকে সলতে অতটা পাকেনি, যতটা পাকিয়েছে ইদানিং। ফলে যা হওয়ার তাই হলো। বেচাল বাড়তে বাড়তে এখন অহি নকুলে গড়াগড়ি খেলা যাকে বলে।
কৃমিদের ততটা ঢাক গুড়গুড়ে সেরেস্তা-কীত্তন নেই। যা পাই তাই খাই গোছের একটা মাগুরমাছের মন আর পেট নিয়ে তাদের কারবার। কেঁচোগুলোও খেত কমবেশী, তবে কৃমিদের ওই হাস্যকর হাঁকাড়-পনাটা ছিলোনা। কেঁচোরা খেত মাথা খাটিয়ে, ধীরে সুস্থে, নজর বাঁচিয়ে, আলগোছে। এতে দুদিকেই লাভ। খাবারের সাপ্লাইয়ে সহসা টানও পড়তোনা, আবার মুখে অসাবধানী আমূল গুঁড়ো লেগে ধরা পড়ার ভয়টাও যেত কমে।
কিন্তু, এই নব্য উৎপাতের আবার অন্য ধরণ, অন্য কেতা। এরা যা খায়, এবং যেভাবে খায়, তার নাম আলটপকা সবার মাঝে বলতে নেই। ফিসিফিসিয়ে কানে ঠোঁট রেখে বলতে হয়, রক্ত! হ্যাঁ, জোঁকগুলো রক্ত খায়। আগে কেঁচোদের অথবা এখন কৃমিদের খাবারের যোগান ওই পুকুরে থাকলেও, জোঁকেদের জাত আলাদা, খাবার আলাদা, সুতরাং লক্ষ্যও আলাদা। তারা জিরাফগুলোকে তাক করে এগোচ্ছে পুকুর বরাবর।
সামনে লড়াইটা কৃমিদের সংগে। ওরাই বা ছাড়বে কেন বলো। অত সাধের রাজ্যপাট তো এক বৈশাখের বাওয়াল ঝড়ে ছেড়ে দিতে নেই। সে তুমি আম আঁটি বা ভেঁপু যাই বাজাও না কেন, শোভন অশোভনের ধাক্কায় হকের কই জলে ভাসিয়ে দেব নাকি? এসবেরই একটা নিয়ম, ছিরি, ছাঁদ আছে। হুট বলতে কেউ সন্ন্যাস নেয় না।
তো, তা সে যাই হোক, কৃমিরা আছে, তাই কেঁচোগুলোও দুঃখু দুঃখু ভাব করে তবু লড়াই অভিমান চিঠি চাপাটি খেলছে। দুটিই মাটির ওপর থাকে বলে একে অন্যেকে চেনেও বেশ, আবার সময়মত মান মর্য্যাদাও দেয়। মোটের ওপর ঠোকাঠুকি, চোখঠারা সব নিয়ে পাশাপাশি তবু চলে যাচ্ছিল দিনমান। কেঁচোগুলোর খাবারে এখন টানাটানি, জল পায়না। মনে দুঃখু। আবার কৃমিগুলো জল নিয়ে নিজেরাই মারামারি করে, দিন গেলে কাজ না থাকলে যা হয় আর কি!
কিন্তু, এইবারে বাদ সাধলো ওই জোঁকগুলো। ওদের মতিগতি, ভাব, ভঙ্গি ঠিক কৃমি বা কেঁচোদের মত নয়। কেমন যেন ঘোর লাগা চোখ, দোল খাওয়া চলন বলন। যখন টানে, তখন একেবারে সবসুদ্ধু শিকড় বাকর নিয়ে কারবার। রক্ত বলে কথা। তার ওপর এ রাজ্যে চুষে রক্ত খাওয়ার মত জীব বলতে ওই তো গোটা কয় জিরাফ। আছে বলে যাহোক অন্তত নিয়ম রক্ষা। কেউ তো বড়। লম্বা। দূর পর্যন্ত ঠাহর করতে পারে গলা বাড়ালে। কেঁচো, কৃমি বা জোঁকেরও সে ক্ষমতা নেই। চোখে দেখে কম, বলে যা সব কান পাতলেও শোনা দায়, আবার এপাশ ওপাশ যেতেও বছর পাতলা।
তবে, জোঁকগুলো অতটা ভ্যাবলা নয়। চটপটে। তিড়িং লাফ মেরে, ক্ষুর পা লেজ বেয়ে, ডিঙি মেরে মেরে, পেট শরীর মাথা পর্যন্ত যা হোক করে পৌঁছে যায়। ভার হালকা। আলগা। টের পাওয়া দুষ্কর। কাজেই রক্ত চোষার কাজটা হয়ে পড়ে সহজ। তার ওপর ওদের আছে এক মোক্ষম অস্ত্র। কামড়ানোর সময় ওরা একধরনের লালা ঢেলে নেয় ক্ষতের ওপর, তাতে ব্যথা তো লাগেই না, আর রক্তটাও বেরোয় বেশ ধারা দিয়ে। সাড় থাকেনা বলে কেউ বুঝতেও পারেনা যে, জোঁক তার কাজ শুরু করে দিয়েছে চুপেচাপে চেপেচুপে। ওদের পাঁয়তাড়াই হলো, খাপে খাপ, রক্তে চাপ। হাসিল করা সহজ, আবার সাড় না থাকায় প্রতিবাদ প্রতিরোধেরও বালাই থাকেনা। বেশ গুছিয়ে হজম করা যাকে বলে আর কি।
জোঁক গুলো পাড় ধরে এগোচ্ছে। পুকুরের দখল চাইছে ঠিকই, কিন্তু ওরাও জানে যে কেঁচো তো নয়ই, এমনকি কৃমিগুলোও ওদের এই চুপিসাড়ে গুঁড়িমারা আটকাতে পারবে না। দেখতেই পাবেনা ঘাড় তুলে। সেই ঘাড় নামের ও অঙ্গ তো নেইই। কাজেই পাতা বা ঘাসের আড়ালে নির্ভেজাল চলছে চলবে তাদের গুটিগুটি ডিঙ্গি মেরে এগোনো।
হ্যাঁ, সমস্যা একটা আছে। সে ওই জিরাফগুলো। ওদের লম্বা গলায় অনেক দূর থেকেই ওরা দেখে ফেলেছিলো জোঁকেদের এগিয়ে আসা। কান ভালো। আছে বলেই ভালো। কেঁচো বা কৃমিদের তো সে বালাই নেই। মর্মটাও বোঝে নি। কাজেই জিরাফগুলো বারে বারে দুটি ঝগড়ুটে কে বলেছিলো, বলতে চেয়েছিলো জোঁকেদের সারিবদ্ধ এগিয়ে আসার কথা। ওরা শোনেনি। আর এদিকে জোঁক গুলোও জানে যে ওই জিরাফগুলোই সব কিছু গোল পাকাতে পারে। তার ওপর ওদের গায়ে আছে রক্ত। খাদ্য বটে। স্বাভাবিক ভাবেই ওদের সব নজর কিন্তু জিরাফগুলোর দিকে।
আর ওদিকে, খেয়ে না খেয়ে কে জানে কেন, জিরাফগুলো কিঞ্চিত ভূয়োদর্শী মডেলের জীব। ওরা ঠাহর করে জোঁকগুলির বেভুল ইচ্ছেটা ভালোই বুঝেছে। যা হোক বলো বহুদিন ধরে পৃথিবীটাকে দেখছে তো রে বাবা। ওই যে দেখো ঘাস পাতা কাঁটা ঝোপ খায়, তাতে করে তো আর জীবন চলে না। ওরা যতটা মুখে তোলে, চিবোয় তার চাইতে ভাবে ঢের বেশী। চোখ আধবোজা, চিবোনো মুখ আর থম মেরে আকাশ বাতাস পাতাল ভেবে যাওয়া, এটাই না জিরাফগুলোর চেনা চিত্র। তা সে ভেবে ভেবে জিরাফেরা বুঝতে পেরেছে যে জোঁকেদের সপাট চালে ভাঁজ আছে গিলে করা পাঞ্জাবীর হাতার মত প্রায়। আড়ালে প্রেমপত্রও হারিয়ে যাবে গোপনে বিন্দাস। জোঁকগুলো রক্ত খায় তাই জিরাফের দল তাদের টার্গেট। কিন্তু আসল খেলাটা অন্য।
এই যে কেঁচো বা কৃমিগুলো খাচ্ছে, কেচ্ছা কেলেঙ্কারি করছে, হেসে খেলে নধর কেলিয়ে কুটিপাটি কেত্তন, তা সে ক্ষমতায় আছে না নেই বড়কথা নয়, এদের সবকটার বেঁচেবত্তে থাকায় একটা বড় ফাঁকি আছে। জোঁকগুলো সে ফাঁকিতে তাল দিয়েই সাধ্যমত সেঁধোচ্ছে একেবারে মূলাধারচক্র পর্যন্ত। আর তারপর, দে দমাদম টান। একেবারে শিকড় উপড়ে থেবড়ে পড়ে, পপাত চ। আছাড় খেয়ে ঝিম মেরে যাবি, তবু বুঝতে পারবি না ঢ্যামনা মেরেছে কে? খুলেই নাহয় বলা যাক খানিক। জিরাফগুলোর ভাবা-রোগে কিছু ভালো দিক আছে, সে কথা সবাই জানে এবং মানে। কেঁচো বা কৃমিদের সে বালাই নেই, নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত, কাজেই কোনোদিন ভাবাটাই অভ্যেস করেনি। ফলত বোঝেও নি কিছু। বোঝেনি যে ওদের সংখ্যা বাড়ে আরোও কেঁচো বা কৃমি জন্মালে, অর্থাৎ বংশবৃদ্ধিতে। কেঁচো থেকে কেঁচো, কৃমি থেকে কৃমি। অবিকল একই রকম দেখতে, একই খাদ্যাভ্যাস, ক্ষমতা দখলের ধরন ধারন, কালযাপন সবই মোটামুটি এক। জাত এক। শুধু প্রাণী হিসেবে পার্থক্য। এরা কেঁচো, ওরা কৃমি। কিন্তু জোঁকগুলো? সে খেলা একদম আলাদা। ধরতে গেলে যায় না ধরা, তন্ত্র বাবার জাঙ্গিয়া পরা।
আর এই ধরে ফেলাতেই যত বিপত্তি। জোঁক গুলো রক্ত খায়। রক্ত সুস্বাদু, আর শক্তিও বেশী দেয়। যোগান, যদি অন্য একটা যাহোক জীবকেও লালা মাখিয়ে চুষে নিতে পারো, তবে অফুরান। কেঁচো বা কৃমির নিতান্ত নিরামিষ ভক্ষণে না আছে সে পুষ্টি, না আছে শক্তি, না আছে স্বাদ বা যোগান। মাঝখান থেকে জল না পেলে তেষ্টায় ছাতিফেটে আলোয়ান হালকা! কিন্তু রক্তে সেসব উদখুলামো নেই। খাবারের খাবার, তেষ্টার তেষ্টা। দেখলে হবে? খচ্চা আছে, সংগে জি এস টি। অর্থাৎ, তুমি যদি একবার চেখে নিতে পারো কায়দা করে, তাহলেই কেল্লাফতে। সারা জন্মে আর অন্যদিকে মুখ তুলে চাইবে না খাবারের জন্য। একেই বলে রক্তের স্বাদ! মজাটা হলো বংশ বা সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে। জোঁকগুলোর সে ব্যাপারে কোনো মাথা ব্যথাই নেই। ওরা জানে যে একবার গোপনে ফিসফিসিয়ে যদি কেঁচো বা কৃমি যাকেই হোক, কায়দা মতো সে স্বাদ দেওয়া যায়, গোপনে মদ ধরান টাইপের, তাহলেই মার দিয়া কেল্লা। হুজ্জতে বাংলা, হিকমতে চীন।
একটা জিরাফ এসব জানতো। সে লিখে রেখে গেছে এসব গোপন আঁতাতের কারিকুরি। ব্যাস, আর দেখে কে। একে একে সব জিরাফ সে গুহ্যকথা টের পেয়ে গেলো। তুমি যদি একবার রক্ত খাওয়া শুরু করো, তাহলেই তুমি জোঁক। নাওয়া খাওয়া ভুলে তখন রক্তের জন্য ছোঁক ছোঁক করবে। আকার প্রকার প্রকৃতি সে তোমার যাইই হোক না কেন, কেঁচো বা কৃমি, রক্ত খেলে তুমি জোঁক। হুঁ হুঁ বাবা, আদিজিরাফের পঞ্চমুন্ডির পাঠ যে নেয়নি, যার কাছে মৃতদের সহিত কথোপকথন নেই, তারা এসব বুঝবে কেন। জিরাফগুলো বোঝে। বোঝে যে দেখতে শুনতে জোঁকের মত না হলেও আসলে কেঁচো কৃমিদের মাঝেও জোঁকসংখ্যা বেড়ে চলেছে কে কে করে। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘হু হু’ করে বাড়া।
পুকুরপাড়ের কৃমিগুলোর এসব ধকের কথা বুঝবার ক্ষমতাও নেই, আর কেঁচোগুলোর আবার আছে মাথার ব্যামো, তাই বোঝালেও বুঝবে না। ওদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখালেও দেখে না। দেখলেও মানে না। আদর্শ নৈতিক আরকের দিনরাত সেবনে ওরা এতটাই ঝিম মেরে থাকে যে, হক কথা বুঝতেও সময় লাগে বছর সত্তর। ততদিনে দুনিয়া কেঁপে টেঁপে আর দশদিন নয়, চমকে চৌত্রিশ আর পালটে পঞ্চান্ন।
কাজেই গোল বাঁধছে জিরাফগুলোকে নিয়ে। ওদের কাছে জোঁকেদের ঝাঁকে বাড়ার কেরামতি দিনের আলোর মত পরিষ্কার। তাই মৃতসঞ্জীবনী সুধার জন্য হাহাকারটাও বেশী। এসব শুনে কেঁচো বা কৃমিগুলো বিগড়ে গেলেই চিত্তির আর কি! ওই জিরাফগুলোই যে মহা শত্রু এবং যেকোনো দিন হল্লা করে পা ঝেড়ে নষ্ট করে দিতে পারে সব আঁকুড়ে উৎসব, সেকথা জোঁকেরা হাড়ে হাড়ে জানে। ওরা জিরাফগুলোকে বেছে বেছে নাম দিয়েছে, বদের বাসা। কুকর্মের হাঁড়ি। মুখে আকথা কুকথা বলছে কৃমি-কেঁচোদের। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য জিরাফ নাশন।
এর আগে অন্য একটা দেশে, তার নাম বলা বারণ, জিরাফগুলোকেই আগে কাত করেছে জোঁকেরা। সে না হলে ঘোর বিপদ। এই যে রক্ত খাওয়ার গোপন তথ্য, বা অসাড় করে টেনে নেওয়ার দুরভিসন্ধি, এসবই জিরাফগুলো ধরে ফেলেছে ঠিক। ওরা সাবধানীও বটে। কেঁচো এবং কৃমিদেরকে নিজেদের আকচা আকচি ছেড়ে আপাতত শান্তিকল্যান করে নিতে বলেছে তাও নয় নয় করে বার কয়েক। কিন্তু বললেই তো হলো না। শুনছে কে।
তবুও জোঁকেদের ভয় যায় না। কি জানি বাপু, দিনকাল ভালো নয়, ফস করে যদি জিরাফগুলোর মশহরা ওই কেঁচো কৃমিগুলো মেনেই নেয়, তাহলে তিন সেন্টিমিটার কোন ছাড়, তিনশ ফুটের আখাম্বা মূর্তিতেও বাড়া ভাতে ষাঁড়ের অপবিত্র মূত্র বা মল। আজকাল সাধকরে সামনে বসিয়েছে শপিং। বাড়া ভাতে, থুড়ি রক্তে, ছাই পড়তে আর ব্রহ্মপুত্র মেইল হবে না। সময়ের আগেই সজলকান্তি রোদ্দুর হয়ে যাবে। তাই জোঁকেদের সর্দারের দাঁতে দাঁত চাপা নির্দেশ, আগে জিরাফগুলোকে নিকেশ করো, তারপর পুকুরপাড়ে যাও, দখল নাও।
এ অবস্থায় জিরাফগুলোও বেসামাল। কাঁহাতক আর না-ঘর, না-ঘাট করে বসে থাকা যায় বলো। কেঁচো বা কৃমির সংসারে ওদের অনীহা। আবার জোঁকের বিপদটাও টের পায় বেশ ভালোই। কোথায় যায়, কি করে, ভাবতে ভাবতেই মাস পেরিয়ে বছর পোয়াতি। লেবার ওয়ার্ড পালটে হয়ে গেল মেটারনিটি।
এরপর এই কিসসার বাঁক বদলের নানা ইংগিত, নানা চাল। একটা ঝাড়পিট বা বোষ্টম কথকতা সবই ভাবা যেতে পারতো বা পারে। দেশটা অঙ্গুরীমাল প্রদেশ তো, কে বা কি যে কখন কোন দিকে বাঁক নেয় বা টাল খায় সেসব ভাঁজ পয়জার বোঝা অত সহজ নয়। এক্ষেত্রে আমরা একটা হতে পারে কিন্তু কেন হবে ধরনের ঘটনা ভেবে নিতে পারি। বিরক্তির একশেষ হয়ে, ভাবতে পারি, দূর থেকে উঁচুগলায় দিগন্তে মেঘ দেখে একদিন জিরাফদের যাত্রা শুরু হলো জলের দেশের দিকে… অন্য অন্য কোনও প্রান্তরে কোনও বেড়াহীন আগলহীন মুক্ত আকাশ, মুক্ত মনের নিবিড় ঘনঘটার দিকে। সেখানে পাঁক নেই, রক্ত চোষা নেই, নেই কোনো প্রথা মাফিক মগজে কার্ফ্যিউ। সেখানে ঘাস মাটি মাঠ জল বাতাস ফুল সবই থাকবে, আছে নিরব প্রতীক্ষায়। ভাষার প্রতীক্ষায়। যে ভাষা জিরাফেরা জানে। দৈবীপুরুষের কুয়ো খুঁড়ে জল তুলে আনবার ভাষা। তৃষ্ণা জুড়োনোর ভাষা। জলের ভাষা। ভাষা পেল আকাশ, ভাষা পেল মাটি, ভাষা পেল মাটির ওপর কান পেতে বেঁচে থাকবার এতদিনের ভেজা ভেজা বুকভার সাধ। অথবা ভাবা যেতে পারে কোনো নতুন বজ্র বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টি সম্ভাবনা। বসন্তে বা বর্ষায়। অথবা একটা আধুনিক কুরুক্ষেত্র।
এখানে, ভাষাহীন কেঁচো কৃমিদের নিত্য আকচাআকচি চলতেই থাকলো। নতুন আপদ জোঁকগুলোও দিব্য এগোতে থাকলো ডিঙি মেরে মেরে। কৃমি কেঁচো জিরাফ বা পুকুর সবকিছুরই অসাড় সব্বোনাশ করবে বলে। পাতায়, ঘাসে, বাদায়, বনে। অঙ্গুরীমাল প্রদেশের উষর প্রান্তরে। ক্লান্তিহীন। নিত্যদিন। খেলার ছলে ঘনিয়ে এলো বেলা গড়ানোর কাল। এসবই হলো। হতেই থাকলো। রক্তলোভী লোলুপ জোঁকের ঘোরলাগা মোহনায়, কালবেলায়, কেঁচো-কৃমির আকাট শোভার অশনি সংকেতে।
পুনশ্চ: অঙ্গুরীমাল প্রাণীদের, পর্ষদ অনুমোদিত পুরনো জীবনবিজ্ঞান বই অনুসারে, মস্তিষ্ক থাকে না। নতুন বই বলছে, থাকে, তবে একটু অন্যরকম হয়।