পাহাড়ি আত্মার হ্রদ

আইভান আনতোনোভিচ ইয়েফ্রেমভ

 

আইভান আনতোনোভিচ ইয়েফ্রেমভ (১৯০৮-১৯৭২) প্রখ্যাত পুরাতত্ত্ববিদ। জীববিজ্ঞান এ ডক্টরেট। ট্রান্সককেশিয়া, মধ্য এশিয়া, ইয়াকুতিয়া, পূর্ব সাইবেরিয়া এবং আরো পূর্বদিকে প্রত্নতত্ত্ব অভিযানে প্রধান হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর প্রথম ছোট গল্পগুলি 1942 সালে প্রকাশিত হয়। 'পাহাড়ি আত্মার হ্রদ' তার মধ্যের একটি গল্প। রুশ কল্পবিজ্ঞানে এটি এক উজ্জ্বল রচনা।

তর্জমা : লীলা সরকার

লীলা সরকারের জন্ম ১৯৩৫-এ, জলপাইগুড়িতে। কেন্দ্রীয় সরকারের অবসরপ্রাপ্ত গেজেটেড অফিসার। ১৯৬৫ সালে কলকাতার Indo Soviet Cultural Society (ISCUS) থেকে রুশভাষায়  ডিপ্লোমা পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার। ১৯৬৬ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত ISCUS-এর বিভিন্ন কেন্দ্রে এবং অন‍্যান‍্য রুশভাষা শিক্ষাকেন্দ্রে  শিক্ষকতা। মূল রুশভাষা থেকে বাংলায় গল্প অনুবাদের শুরু ISCUS-এ শিক্ষকতাকালীন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। পরবর্তীকালে কর্মজীবন থেকে অবসরলাভের পর এই কাজে পরিপূর্ণভাবে আত্মমগ্ন। সেরিব্রাল অ্যাটাকে স্বাধীন চলাফেরা ব‍্যাহত হলেও তাঁর অদম‍্য মানসিক উৎসাহকে সেই অসুস্থতা দমিয়ে রাখতে পারেনি। বিছানায় বসে বসেই হাতের কাছে খাতা বই অভিধান সাজিয়ে নিয়ে অনুবাদের ধারা বয়েই চলেছে।

 

কয়েক বছর আগে, আমি এক ভ্রাম্যমাণ গবেষকের সঙ্গে, কাতুন নদীর বামতীরে লিস্তবিয়াগাব পর্বতশ্রেণির অন্তর্গত আলতাই পাহাড়ে গিয়েছিলাম। মনে আমার তখন কত সোনালি স্বপ্ন! তাই মূল্যবান সম্পদ খুঁজে না পেলেও আলতাই-এর সুন্দর আবহাওয়া আমার মনকে আনন্দে ভরিয়ে তুলেছিল।

আমার কাজের জায়গায় সেরকম কোনও উল্লেখযোগ্য দ্রষ্টব্য কিছু ছিল না। লিস্তবিয়াগা তুলনামূলকভাবে নিচু পর্বতমালা – -সেখানে হিমবাহ, পার্বত্য হ্রদ বা অগম্য পর্বতচূড়া কিছুই ছিল না। কিন্তু ছিল এমন এক পাহাড়ি সৌন্দর্য, যা আপনাকে আশ্চর্য করবে। মস গাছে ছাওয়া তাইগার ওপর এবং সমুদ্রের ঢেউয়ের মত বোল্ডারের নিচে জড়ো হওয়া এই পাহাড়, জলাভূমিপূর্ণ নদী-উপত্যকার নীরস কর্মক্ষেত্রে ছিল আমার একমাত্র আনন্দস্থল।

উত্তরের জলবায়ুকে আমি ভালোবাসি তার নির্বাক বিষণ্ণতা, আদিম একাকিত্ব এবং বন্যতার জন্য। জোর করে মন জয় করবে এমন চিত্রল উজ্জ্বল দক্ষিণের জলবায়ুর সঙ্গে তাকে কোনওভাবেই পরিবর্তন করতে চাই না। যখন বড় শহরে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল — যা কিনা প্রত্যেক গবেষকেরই হয় — ধূসর পাহাড়, সীসা রঙের সমুদ্র, লুপ্তপ্রায় বিরাট বিরাট লার্চ গাছ আর স্যাঁতসেতে ফার গাছের জঙ্গলের গভীরতা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।

তাই আমার এই নদীবক্ষের কাজটা আমি আনন্দের সঙ্গেই সম্পন্ন করেছিলাম। যাই হোক, আমার তখনও একটা কর্তব্য বাকি ছিল, কাতুন নদীর মাঝখানে বড় গ্রাম চেমালের কাছে। আলতাইতে সবচেয়ে উঁচু কাতুনের পাহাড়শৈলীর পাশ দিয়ে সংক্ষিপ্ত পথে সেখানে যেতে হবে। উইসন গ্রাম পর্যন্ত গিয়ে তেরেকতিনের তুষারমণ্ডিত উচ্চপর্বতশ্রেণী অতিক্রম করতে হবে। আর অগনুদাই-এর পরে আবার কাতুন নদীর উপত্যকায় নামতে হবে। দীর্ঘ এই ভ্রমণে আমি আলতাইয়ের চিত্তাকর্ষক আবহাওয়া উপভোগ করছিলাম। আমি যখন আমার ছোট ক্যারাভান নিয়ে, লার্চ, সিডার ও রুপোলি ফার গাছের গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে কাতুন নদীর উপত্যকায় অবতরণ করলাম, সেই মুহূর্তটা আমার খুব ভালোভাবে মনে আছে। নদীতে ঘোড়াগুলো বুক পর্যন্ত জলে ডুবে গেল। দশ মিটার যেতেই প্রচুর পরিশ্রম হল। কিন্তু আমি রাত্রির জন্য ক্যারাভান থামালাম না, সেদিনই কাতুন নদীর ডানতীরে যাওয়া স্থির করলাম।

পাহাড়ের উপরে চাঁদ উঠল, মনে হল আর যেতে কষ্ট হবে না। খরস্রোতা কাতুন কলকল ধ্বনিতে আমাদের অভ্যর্থনা করল। আমাদের পথপ্রদর্শক তার ঘোড়াসহ কলকল প্রবাহিনীতে প্রবেশ করল, তাকে অনুসরণ করল অন্যরা। জল হাঁটুর উপরে মনে হল না । আমরা সহজেই নদী অতিক্রম করে অপর তীরে পৌঁছলাম। বড় বড় নুড়িপাথরপূর্ণ বন্য অঞ্চল পেরিয়ে আমরা আবার সাইবেরিয়ার জলাভূমিতে পড়লাম। মসের নরম কার্পেটের উপর কিছু ফার গাছ ছড়িয়ে ছিল। চারিদিকে উঁচু টিলার উপরে শন গাছেরা বাতাসে মর্মর শব্দ করছে। আমরা এগিয়ে যাওয়া স্থির করলাম।

প্রথমে আশা হল যে শুকনো জায়গা পেয়ে যাব। পাইন গাছের বিষণ্ণ অন্ধকারে পথ ঘুরে গেল, ঘোড়াদের পা মস গাছের নরম কার্পেটে ঢুকে গেল। সেখানে আমরা প্রায় দেড়ঘণ্টা এগোলাম যতক্ষণ না পাইন আর সিডার গাছ দেখা গেল এবং মস প্রায় অদৃশ্য হল। কিন্তু এগিয়ে যাওয়া থামল না। বরং আরও খাড়াই পথ অতিক্রম করতে হবে। আমরা বাইরে খুব হাসিখুশি দেখাচ্ছিলাম বটে কিন্তু সমস্ত দিনের শেষে নরম মাটিতে আরও দুঘণ্টার আরোহন বড়ই কষ্টকর হল। সেইজন্য সকলে আনন্দিত হল যখন ঘোড়ার পা পাথরের উপরে স্ফুলিঙ্গ তুলে খটখট করে চলতে লাগল এবং পাহাড়ের প্রায় সমতল চূড়া দেখা গেল। মুহূর্তের মধ্যে ঘোড়াগুলোকে ভারমুক্ত করা হল। বড় বড় সিডার গাছের নিচে তাঁবু খাটিয়ে দৈনন্দিন নিয়মে এক কাপ চা খেয়ে ধূমপান করে গভীর নিদ্রায় মগ্ন হলাম।

উজ্জ্বল আলোয় ঘুম ভেঙে তাঁবু থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম। তাঁবুতে ঢোকার মুখেই দুটো সিডার গাছের ফাঁক দিয়ে গোলাপি আলোয় মাখা চারটি ধারাল পর্বতশৃঙ্গ দেখা যাচ্ছিল। বায়ুমণ্ডল আশ্চর্যরকমের স্বচ্ছ। কল্পনাসাধ্য যত রকমের লাল রং হয় তারই একটি মিশ্রণ বরফাচ্ছাদিত পাহাড়ের ঢালু অংশ দিয়ে যেন নিচে গড়িয়ে পড়ছিল। একটু নিচে নীল হিমবাহের উপরে ছায়ার একটি বিরাট তির্যক নীল রেখা দেখা যাচ্ছিল। এই নীল ভিত্তি পাহাড়ের স্তূপের বায়ুমণ্ডলের হালকাভাব আরও বাড়িয়ে দিল।

কয়েক মিনিট কেটে গেল। সূর্য মাথার উপরে উঠল। সোনালি থেকে বেগুনি নীল রঙের হল। শৃঙ্গ থেকে গোলাপি রং পরিবর্তিত হয়ে পরিষ্কার নীল রং হল, আর হিমবাহ ধূসর রঙের মনে হল। ঘণ্টা বাজল, গাছের নিচে পরস্পরের সঙ্গে চিৎকার করে কথা বলতে বলতে সবাই ঘোড়াগুলিকে জড়ো করল। বোঝাগুলিকে ভাঁজ করে বাঁধল। এই পার্থিব জাদুর জয় আমার খুবই ভালো লাগল। তুন্দ্রা অঞ্চলের বোল্ডারের উপর দিয়ে দীর্ঘ কষ্টকর কঠিন ভ্রমণের পরে, স্বচ্ছ আলোর বিকিরণ আর হাল্কা পরিবর্তনশীল খেলার এটা একটা নতুন জগৎ ছিল।

যেমনটি হয় তেমনই , আলতাইয়ের হিমবাহের উঁচু চূড়ার প্রতি আমার আকর্ষণ প্রবল হয়ে উঠল। এই ভালোবাসার জন্য আমাকে কখনও হতাশ হতে হয়নি। পাহাড়ি হ্রদের নীল অথবা পান্নার মতো অকল্পনীয় স্বচ্ছ জলের সৌন্দর্য অবর্ণনীয়। আমার মনে হচ্ছিল বরফাচ্ছাদিত পাহাড়ের দৃশ্য প্রকৃতির সৌন্দর্য সম্বন্ধে আমার এক তীক্ষ্ণ বোধ জাগ্রত করেছে। এই সংগীতময় পৃথিবীর ছায়া বিশ্বকে যেন সুরেলা আশীর্বাদ জানাচ্ছে। আর আমি, পৃথিবীর সামান্য এক মানুষ, প্রকৃতি সম্পর্কে আমার নতুন অনুভূতির জন্য এই মহান সমন্বয়ের কাছে বাধিত।

উচ্চ পার্বত্য অংশ অতিক্রম করে আমি আবার কাতুন নদীর অববাহিকায় স্তেপভূমিতে অবতরণ করলাম ঘোড়াকে খাওয়ানোর জন্য। দূরের তেরেভতিনস্কি তুষারমণ্ডিত পর্বত আমাকে আকৃষ্ট করতে পারল না। অনগুলাই পর্যন্ত গিয়ে পথপ্রদর্শককে আমার সংগ্রহ ও পোশাক দিয়ে বিস্ক-এ পাঠিয়ে দিলাম। চেমানের অ্যাসবেসটস পর্যবেক্ষণ করার পর নতুন ঘোড়ায় চড়ে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য কায়াশ্চ গ্রামে থামলাম।

সেখানে মধু দিয়ে চা খুব সুস্বাদু হয়েছিল। আমরা ছোট বাগানে পরিষ্কার সাদা টেবিলের পাশে অনেকক্ষণ বসে ছিলাম। আমার গাইড এক রুক্ষ মৌন আলতাইয়ান – – তামা ও কাদা নির্মিত পাইপে ধূমপান করছিল। আমি গৃহকর্তাকে চেমান পর্যন্ত পথে দ্রষ্টব্য স্থানের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। গৃহকর্তা একজন নবীন শিক্ষক, তিনি সরল তামাটে মুখে সাগ্রহে আমার কৌতূহল নিরসন করলেন।

‘তা একটা জিনিস আছে বইকি, বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার’- সে বলল। ‘চেমান থেকে একটু দূরে একটা ছোট গ্রাম পাবেন। সেখানে চোরোসোভ নামে এক রাগী বৃদ্ধ শিল্পী বাস করেন। কিন্তু আপনি যদি কোনওভাবে তার মন জয় করতে পারেন, তাহলে তিনি আপনাকে অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি দেখাবেন।’

তোমস্ক আর বিস্ক-এ চোরোসোভের যে ছবিগুলি দেখেছি, বিশেষত ‘কাতুনের মুকুট’, আর ‘আলতাই’, সেগুলো মনে পড়ল। চোরোসভের অসংখ্য ছবি দেখতে পেলে, আর তারই সঙ্গে কোনও একটা স্কেচ জোগাড় করতে পারলে, আলতাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচিতি খুব একটা খারাপ হবে না।

পরের দিন মধ্যাহ্নে আমার শিক্ষক বন্ধুর নির্দেশিত পথে আমি বেশ নিশ্চিন্তভাবে ঘোড়ার পিঠে বসে চোরোসভের বাড়ির দিকে গেলাম। সেখানে একজন খিটখিটে বৃদ্ধকে দেখব ভেবেছিলাম, তার বদলে গাড়িবারান্দায় একজন চটপটে পরিচ্ছন্ন ভদ্রলোক দ্রুত পদক্ষেপে উপস্থিত হলেন। মঙ্গোলীয় হলুদ বর্ণের মুখ। খাড়াখাড়া ছাঁটা চুলে ও শক্ত গোঁফে রূপোলি রেখা লক্ষ্য করলাম। ঝুলে যাওয়া গালের হাড়ের নীচে, উঁচু কপালে আর বসা গালে গভীর কুঞ্চন। আমাকে খুব সহৃদয়ে গ্রহণ করলেন। আমি কিন্তু আন্তরিকভাবে নয় বরং একটু সন্দেহ নিয়েই তাঁকে অনুসরণ করলাম।

সম্ভবত আলতাই সম্বন্ধে আমার আন্তরিক প্রশংসা শুনে চোরোসভ আরও অমায়িক হলেন। আলতাইয়ের কতকগুলি বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থান সম্বন্ধে তাঁর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আমার মনে গেঁথে রইল — তাঁর পর্যবেক্ষণ এতই তীক্ষ্ণ ছিল।

তাঁর চিত্রশালা বিশাল একটি অসজ্জিত ঘর – বড় বড় জানালা নিয়ে বাড়ির অর্ধেক জুড়ে আছে। অনেক স্কেচের ও কিছু ছবির মধ্যে একটা ক্যানভাস এমন ছিল যা আমার দৃষ্টি তৎক্ষণাৎ আকর্ষণ করল। চোরোসভের কথা অনুযায়ী, এটি তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ ‘দিয়েনি দের’ (পাহাড়ী আত্মার হ্রদ) বিরাট ক্যানভাস যা সাইবেরিয়ার একটা জাদুঘরে আছে। এই ক্যানভাসটির এক বিরাট ভূমিকা আছে আমার এই কাহিনীতে।

বিকেলের সূর্যের কিরণে ছবিটা ঝকঝক করছিল। ছবির মধ্য ভাগ জুড়ে হ্রদের নীল ধূসর স্বচ্ছ উপরিভাগ যেন শীতল ও নীরব অবসর বোঝাচ্ছিল। সামনের দিকের তীরে পাহাড়ের কাছে যেখানে মসের সবুজ আচ্ছাদন তুষারের বিন্দুর সঙ্গে মিশে আছে, সেখানে সিডার গাছের একটা গুঁড়ি আছে। তীরের দিকে যেখানে একটা গাছ পড়ে আছে তার ঠিক শিকড়ের পাশে একটা গভীর নীল রঙের তুষারস্রোত বয়ে যাচ্ছে। হ্রদের উপরিভাগে অগভীর তুষারস্রোত এবং বড় বড় ধূসর রঙের পাহাড়, কখনও সবুজ কখনও বা ধূসর-নীল রঙের ছায়া ফেলেছে। দুটো সিডার গাছ ঘন শাখা তুলে যেন আকাশের দিকে হাত প্রসারিত করে আছে। পিছনের দিকে পাহাড়ি বেগুনি এবং হালকা হলুদ রঙের ফুল সমেত খাঁজকাটা পাহাড়ের খাড়া ঢালু অংশ হ্রদে পড়েছে।
ছবির কেন্দ্রস্থলে হিমবাহের উপর থেকে তুষার কণা হ্রদে পড়ছে আর তার উপর খুব উঁচুতে বাঁদিকে একটা হিরের ত্রিকোণ পিরামিড উঠছে — তার বাঁদিকে যেন গোলাপি রঙের ‘স্কার্ফ’ জড়ো হয়ে আছে। উপত্যকার বাঁদিকে ঠিক শঙ্কুবৎ একটি পর্বত, যার সর্বাংশ বরফে আচ্ছাদিত। শুধু সামান্য বিবর্ণ হলুদের ডোরাকাটা দাগ পর্বতের খাড়া ধারাকে বোঝাচ্ছে। পর্বতটি বিরাট সিঁড়ির ধাপের উপর দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে বিরাট বিরাট সিঁড়ি দূরের হ্রদের দিকে নেমে গেছে। ছবিটি থেকে এক শীতল ও বিশুদ্ধ ঔজ্জ্বল্য প্রতিফলিত হচ্ছিল, যা কাতুনের পাহাড় যাবার পথে আমার মনকে জয় করেছিল। আলতাইয়ের হিমবাহের প্রকৃত মুখ, খুব ভালোভাবে দেখতে দেখতে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম আর আশ্চর্য হলাম সেইসব মানুষের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তিতে যারা হ্রদটির নাম দিয়েছিল – ‘দিয়েনি দের’-পাহাড়ি আত্মার হ্রদ। “কোথায় আপনি এরকম হ্রদ পেলেন?”- আমি জিজ্ঞাসা করলাম। “সত্যিই কি এটা আছে?”

“আছে। এবং খুব ভালোভাবেই সত্যি সত্যিই আছে। ঠিকভাবে বলতে গেলে এই মরুভূমিটি আমার মনে যে প্রভাব ফেলেছে হ্রদটি তার মূল উপাদান। এই উপাদানটিকে আবিষ্কার করতে আমাকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছিল।” -চোরোসভ উত্তর দিলেন। “আর এই হ্রদটা খুঁজে বের করা খুব সহজ ছিল না। তবে আপনি কী চাইছেন?

“আশ্চর্য এই জায়গাটা শুধু দেখতে। এইরকম সৌন্দর্য যে দেখবে সে আর মৃত্যুকে ভয় পাবে না।”

শিল্পী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। “আর তাতেই আপনি বললেন যে মৃত্যুকে ভয় পাওয়া বন্ধ হবে? আপনি সম্ভবত জানেন না কী রকমের উপকথা এই হ্রদের সঙ্গে আলতাইয়ানদের মনে জমা আছে।”

“নিশ্চয়ই খুব চিত্তাকর্ষক, তারা যখন এত কাব্যিকভাবে হ্রদের নামকরণ করেছে।”

চোরোসভ ছবির দিকে তার দৃষ্টি ফেরালেন। “আপনি মনে হয় ছবিটিতে বিশেষ কিছু দেখেননি?”

“দেখেছি। ওই যে ওখানে বাঁ দিকের কোণে যেখানে পাহাড় শঙ্কু আকৃতির”- আমি বললাম- “ক্ষমা করবেন, ওখানে কোনও সৌন্দর্য আমি দেখতে পাইনি।”

“আরও একটু মনোযোগ দিয়ে দেখুন।”

আমি আবার খুব ভালো করে দেখতে লাগলাম; শিল্পীর কাজ এমন সূক্ষ্ম ছিল যে, যতই আমি দেখতে লাগলাম, ততই ছবিটির গভীরতা আরও বেশি করে আমার চোখে ধরা পড়তে লাগল। শঙ্কু-আকৃতির পাহাড়ের পাদদেশে সবুজ শুভ্র মেঘ মৃদু আলো বিকিরণ করছে। এই আলো পরস্পরকে অতিক্রম করার ফলে লাল রঙের কিছু একটা ডোরাকাটা ছায়ার সৃষ্টি হয়েছে। এই রকম আরও গভীর প্রায় রক্ত লাল দাগ পাহাড়ের সম্মুখ ভাগের খাড়া অংশের ফাটলে দেখা গেল। এই সব জায়গায় সূর্যকিরণ শৈলশ্রেণীর শুভ্র দেয়াল ভেদ করে তুষার আর পাথরের উপর পড়ে লম্বা লম্বা বিশালাকৃতি মানুষের চেহারা এবং নীল সবুজ ধোঁয়া তৈরি করেছে। আর এই সমস্তটাই এই প্রাকৃতিক অঞ্চলকে এক অশুভ কাল্পনিক ছায়ায় ঢেকে রেখেছে।

“বুঝতে পারছি না।”- নীল সবুজ সারির দিকে তাকিয়ে বললাম।

“চেষ্টাও করবেন না,” চোরোসভ হাসলেন- “আপনি খুব ভালোভাবেই প্রকৃতিকে জানেন এবং ভালবাসেন, কিন্তু তাকে বিশ্বাস করেন না।”

“কিন্তু আপনি নিজে কীভাবে পাহাড়ে এই লাল বর্ণের আগুন, নীল-সবুজ সারি এবং উজ্জ্বল মেঘ ব্যাখ্যা করবেন?”

“সোজা ব্যাখ্যা — পাহাড়ি আত্মা।”– শান্তভাবে শিল্পী উত্তর দিলেন।

আমি তাঁর দিকে ফিরলাম, কিন্তু তাঁর মুখে একটুও হাসি দেখলাম না।

একই স্বরে তিনি বলতে থাকলেন –“আমি একটুও ঠাট্টা করছি না। আপনি ভাবছেন, হ্রদের নামকরণ শুধু অতিপ্রাকৃত সৌন্দর্যের জন্যই করা হয়েছে? সৌন্দর্য তো ঠিকই, কিন্তু এর একটা দুর্নাম রয়েছে। এই ছবিটা আমি আঁকতে পেরেছি — কিন্তু মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে। প্রায় ত্রিশ দিন অসুস্থ ছিলাম।”

হ্রদ-সম্পর্কিত উপকথাটি বলতে আমি শিল্পীকে অনুরোধ করলাম। অমসৃণ হলদে-নীল রঙের মঙ্গোলিয়ান কার্পেট দ্বারা আচ্ছাদিত সোফায় বসেছিলাম। এখান থেকে ‘পাহাড়ী আত্মার হ্রদ’ ছবিটি দেখা যাচ্ছিল।

 

আগামী সংখ্যায় সমাপ্য

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...