গল্পাণুদের আখ্যান: অলোকপর্ণার “দাস্তানগো”

অভিষেক ঝা

 

“তারপর?” এবং “তারপর…”; আবার “তারপর?”… এভাবেই অফুরান জানতে চাওয়া আর বিরামহীনভাবে আবার শুরু করার মাঝখানে কোথাও একটা আমাদের দেখা হয়। দেখা হলেই যে বুঝতে পারব যে দেখা হল তা কিন্তু নয়। বরং অনেক পরে অন্য কোথাও অন্যভাবে দেখা হওয়ার সময় মনের ভিতর কেমন এক আবছায়া খেলে যাবে এবং আধমনে থাকা স্বপ্নের মত মনে হতে থাকবে এর সঙ্গে কি আগে দেখা হয়েছে? এই বিকালটা কি আমার সঙ্গে এইভাবে দেখা করবে কোনওদিন? এত চেনা ঠেকছে কেন একদম অচেনা এই জায়গাটিকে? একটা সময়ে এসে খুব অসহায়ভাবে বুঝতে পারি ‘আমার গল্প’ বলে কিচ্ছু হয় না, গল্প নিজ ইচ্ছামতো আমি, তুমি, আমরা, তারা খুঁজে নেয়। তারা, আমরা, তুমি, আমি তারপর গল্প খুঁজতে থাকে তারপরের গল্পের খোঁজে। এই খোঁজ তাই যেকোনও অসহায় সাহিত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ‘অসহায়’ শব্দটি খুব সচেতনভাবেই ব্যবহার করলাম কারণ অসহায় অবস্থাতেই আমরা বুঝতে পারি আমরা আসলে বিশাল এক ফ্রেমের কোলাজের আধটুকরো কাগজ, বা আধপোড়া দেশলাইকাঠি যেগুলো একসময় হয়তো সচেতন কোনও অহমিকা ছিল যা অসহায়ভাবে এখন তুচ্ছ। তুচ্ছতাকে আঁকড়ে থাকে অসহায় সাহিত্য, তার না আছে ‘মহান’ হওয়ার ক্ষমতা, না আছে নিজেকে ‘ব্যতিক্রমী’ দেখানোর অতিসচেতন প্রয়াস। আমার সময়ের এমনই একটি আখ্যান অলোকপর্ণার “দাস্তানগো”। বইটির নাম থেকেই বোঝা যায় এটি পারস্যের কিসসা রীতিকে উদযাপন করতে চাইছে নিজস্ব ভঙ্গিমায়। অলোকপর্ণার এই বই ঘোষিতভাবে ‘মনোলগ’। তাই গল্পের চেয়ে এখানে আখ্যান ও আখ্যানরীতিই যে গুরুত্ববহ হবে তা প্রত্যাশিতই।

যে আখ্যান থেকে আরেক আখ্যান হয়ে আরেক আরেক আখ্যানের ভিতর ঢোকা যায় না সেটা কি আদৌ আখ্যান? তাই আখ্যান বলে কিছুই হয় না, আখ্যান সবসময়ই আখ্যানেরা। আমি ভাত আর টাকি মাছের ভর্তা খাওয়াকালীন আখ্যান যদি সেই মাছ যে ফিনফিন ঘাসেদের ভিতর তার চোখে জলের উপরিতলে ছায়া ফেলে সেই ওপাশের বনের ভিতরে নাই ঢুকাতে পারল তবে সে আখ্যানে আমি আগ্রহ হারাই। আর সেটা যে আখ্যান পারে তাকে বেশ একটা হেলানো বটগাছ ঠেকে আমার। সকাল থেকে রাত অবধি এক কথক ঠাকুর বসে আছে যার তলে। যার যা গপ্প লাগবে তার কাছে এসে শুনে চলে যাচ্ছে। দিন শেষে তার নিজেরই মনে থাকছে না কার গল্পে কে ঢুকে বসে আছে। সব ফাঁকা হয়ে গেলে পাতারা জিগায়: “তারপর?”… সে শুরু করে “বুয়লেন…”। অলোকপর্ণা ‘দাস্তানগো’তে এমনই একটা হেলানো বটের তল বানিয়ে ফেলেছেন।

এই বটতলে পারস্যের কিসসাধারার আখ্যানরীতি সুনিপুণভাবে বুনেছেন লেখক। ফলে পড়তে পড়তে আমরা দেখতে পাই একটি নকশিকাঁথা বোনা চলছে। সেখানে আমাকে ফোন করা আমি, শীতলার ভোগের খিচুড়িতে পড়ে যাওয়া কুকুরের প্রভাবে ডগি স্টাইলে মেতে একবছর কারও পেট না হওয়া পাড়া, জ্যোৎস্না খেয়ে কেরলের বনে হারিয়ে যাওয়া কেউ, এক অন্ধবুড়ির ছেলেকে ট্রেন থেকে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে এক হরবোলার সেই ছেলে হয়ে যাওয়া, পুকুরে ডুবে যাওয়া না-দেখা দিদির জল কেটে বুদবুদ হয়ে উঠে আসার গল্প ও তলিয়ে যাওয়ার গন্ধ এবং আরও আরও আখ্যান মোজাইক হয়ে আছে। ৩২ পাতার এই অপার বিস্তারে মনে রাখার মত কত যে শব্দব্রহ্মাণ্ড: “গাছ পুষি। ছোট্ট বনসাই। নাম দিই। কথা বলি। ডাকলে বৃক্ষ সাড়া দেয়।” খেয়াল করুন কী অসহায় এই বাক্যের গঠন: পোষা গাছ থেকে শুরু, শেষ হচ্ছে বৃক্ষের সাড়া দেওয়ায়। গাছ থেকে বনসাইটি যেভাবে বৃক্ষ হয়ে উঠছে তার বিস্তৃত যাত্রা চারটি মিনিমালিস্টিক বাক্যে আঁকলেন লেখক। মোটিফ হিসাবে ব্যবহার করলেন বনসাই যা কিনা একইসঙ্গে বৃক্ষের অপারতাকে টবের ভিতর ধরতে চায় জেনেই যে ধরা সম্ভব না। এখানে লেখক ‘বনসাই’-এর বহুল প্রচলিত ‘বামন’ প্রতীকটিকে বিনির্মাণ করলেন। এবং এখানেই লেখক সেই অসহায় স্থানাঙ্ক তৈরি করছেন যা প্রতিটি সীমাবদ্ধ মানুষ নিজের সীমাবদ্ধতা জেনেও এক অপার পৃথিবীর সন্ধান করেই চলে। আরও কয়েকটি বাক্য দেখলে বোঝা যাবে এই বিনির্মাণ: “পৃথিবীর প্রতিটা গাছ অপার অভিমানে সবুজ হয়ে আছে। তাই গাছের কোনও ডাক নেই। গাছেরা কেউ কাউকে ডাকে না,” “লিখতে বসার আগে মাস্টারবেট করে নেওয়া জরুরি— শারীরিক ও মানসিক,” “এগোতে এগোতে একদিন বুঝতে পারলাম, বুড়ো আঙুল তৈরি হয়েছে একা মানুষের মুঠো ভরাবার জন্য।– এরপর অন্য কাউকে ছুঁতে কেমন লাগবে?— সহসা হাত আটকে যাবে। ছুঁতে পারব না।” যে পরিমাণ বিপরীতমুখী শক্তি প্রতিটা বাক্যকে চালিত করছে সেইখান থেকেই ছিটকে আসে প্রিজমিক এক আখ্যান। আমরা জানতে ইচ্ছুক হয়ে উঠি কেরলের বনে হারিয়ে যাওয়া তার সঙ্গে কি মরে যাওয়া দিদির দেখা হল? নাকি নিজের শহুরে চারপাশে বসে একটি বনসাই দিয়েই ভেবে চলেছে কথক সবকিছু? আর আমরা দেখছি আখ্যান গড়িয়ে চলেছে নিজ মনে।

গড়ানো এই আখ্যানের ফ্লুইডিটি চমকে দেয়। কথকের ‘আমি’, লৌকিক উপাচার, মিথ সবকিছুকে কী অনায়াসে  মেশানো যায় সেটা এই আখ্যান দেখায়। একটা উদাহরণ: “আমি চিরকাল পুকুরের সবজেটে কালো জলকে ভয় করে এসেছি। সেই কারণে সাঁতার শিখতে আমার সাতাশ বছর লেগে গেছে। ওই অন্ধকার অনেক কিছু বলতে চাওয়া অন্ধকার। অনেক কিছু দেখাতে চাওয়া অন্ধকার। আমি কল্পনা করি পুকুরের পেটে শুয়ে আছে মা মাসিদের হারানো কানপাশা। শকুন্তলার অঙ্গুরীয়র মতো তা পেটে নিয়ে ঘুরছে গভীর গোপন মহাশোল মাছ। এই একই অন্ধকার আমি আমার প্রেয়সীর ভিতর দেখেছি। ঘন নীল পদ্ম ফুটে থাকা অন্ধকার।” এখানে হাজার বছরের বহমানতাকে কী অবলীয়ায় একটা ডুবে ধরা গেল। প্রি-ইদিপাসীয় উদ্বেগ থেকে আঁদ্রে রিচীয় নির্ভরতার এই বয়ে যাওয়াকে বাংলা ও ভারতীয় কনটেক্সটে শুধু আনেননি লেখক, ‘মহাশোল’-এর মত অকুলীন মাছকে ক্যারিয়ার করে একটা সাঙ্ঘাতিক সাবাতোজ করেছেন, অথচ এগুলি না জানা পাঠকও ডুব দিতে পারবেন অনায়াসে। এখানেই একটি লেখার মানবিকভাবে অসহায় হয়ে ওঠা। আর এর জন্যই বইটি জুড়ে কথা বলে যাচ্ছে অসংখ্য স্বর কেউ সচেতনভাবে, কেউ অবচেতন থেকে। কথককে তাই কাউন্সেলিং-এর প্যাটার্নে শুরুতেই নিয়ে যাওয়া আখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়িয়ে দেয়। আমরা কখনওই তাই নিশিচত হতে পারব না আমরা যা জানছি পড়তে পড়তে তা কথক জানাচ্ছে নাকি গড়ছে? যে স্বর গোটা বই জুড়ে তা কি একার, নাকি অন্যের, নাকি নির্মাণ করা অন্যের? তাই পাঠ শেষে রয়ে যায় সেই চিরায়ত “তারপর?”, “তারপর…”।

তাই এই বই কোনওভাবেই ‘মনোলগ’ নয়। এটি পলিলগ, বড় অসহায়ভাবে পলিলগ। পড়লে সেই আনন্দ পাবেন যে আনন্দ একটি ঘাম গড়ানো ফুটপাথে হেঁটে পান, ধানক্ষেতে দাঁড়িয়ে পেকে ওঠা ধানের গন্ধ নিতে নিতে পান। এইটুকুই এই বইয়ের সম্পর্কে বলার।

দাস্তানগো
অলোকপর্ণা
প্রকাশক: আঙ্গিক
মূল্য: ৫০ ভারতীয় টাকা

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...