অবিন সেন
পূর্ব প্রকাশিতের পর
আট
বেশ কয়েকদিন হয়ে গিয়েছে রেখা দাশের কোনও খোঁজ নেই। পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটা কেস শুরু করেছে। এই খবরটা তো মিডিয়া লুফে নিয়েছে। প্রথমে টেলি জগতের এক উঠতি অভিনেত্রী হারিয়ে গেলেন। সেই অভিনেত্রীর কোনও সন্ধান পাওয়া গেল না, তার আগেই উধাও হয়ে গেলেন সেই অভিনেত্রীর মেকআপ আর্টিস্ট। রোজ খবরের কাগজে এই নিয়ে পুলিশের মুণ্ডুপাত করে চলেছে মিডিয়া। ও দিকে পুলিশের হালে পানি না পাওয়া অবস্থা।
টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়ার ঘনিষ্ঠ এক মন্ত্রী পুলিশের কাজ নিয়ে খুব ক্রিটিসাইজ করলেন সন্ধ্যাবেলা এক টিভি চ্যানেলে বসে।
পরদিন এই নিয়ে এক পপুলার টিভি চ্যানেলে ঘণ্টা খানেক টক শো-এ পুলিশের বাপ-বাপান্ত চলছিল।
অর্ক খুব বিরক্ত হয়ে টিভিটা বন্ধ করে দিয়ে রিমোটটা দূরে সোফায় ছুঁড়ে ফেলে দিলে প্রবাল উষ্মা প্রকাশ করে বলল,
আমার টিভি রিমোটের উপর রাগ দেখিয়ে কী হবে?
অর্ক ভেবেছিল এই কেসে সে মাথা ঘামাবে না। কিন্তু উপরমহলের চাপ তাকে ঠিক ঘাড় ধরে প্রবালের বাড়িতে এনে হাজির করল।
প্রবাল একটা ডাইরিতে কিছু লিখে রাখছিল। তন্ময় সামন্ত এখনও এসে পৌঁছায়নি। তনুকা কফি বানাচ্ছিল। কিচেন থেকে টক শো-এর চোখা চোখা গা জ্বলানো কথাগুলো সে শুনতে পাচ্ছিল। পুলিশের সমালোচনায় সে যেন মনে মনে আমোদ পেয়েছে এমনভাবে অর্ককে একবার খোঁচা দিয়েছে। টিভিটা বন্ধ হয়ে যেতে কিচেন থেকে সে অর্ককে আবার খোঁচা দিল,
কী অর্কদা, টিভি বন্ধ হয়ে গেল কেন ? কী সুন্দর তোমাদের প্রশংসা শুনছিলাম!
এমনিতেই অর্কর মাথায় আগুন জ্বলছিল। তনুকার উপরে সে যেন রাগ দেখাতে না পেরে আরও খেপে গেল। প্রবালকে সে খিঁচিয়ে উঠল,
প্রবাল, কাটা গায়ে নুনের ছিটে দিতে বারণ কর।
প্রবাল হাসছিল। সেটা দেখে তার আরও গা জ্বলে গেল।
তনুকা একটা ট্রেতে করে কফি, ঘরে বানানো শিঙাড়া নিয়ে এসে সেন্টার টেবিলে রাখতে রাখতে বলল,
আর রাগ করতে হবে না। এত কষ্ট করে শিঙাড়া বানিয়েছি, টেস্ট করে দেখো কেমন হয়েছে।
শিঙাড়া অর্কর খুব প্রিয়। অর্কর রাগ জল হয়ে যায়। সে তনুকাকে বোন বলে ডাকে। একটা শিঙাড়ায় কামড় বসিয়ে সে বলল,
আরে তোর উপরে রাগ করছি নাকি! শিঙাড়াটা কিন্তু একেবারে লেটার মার্কস পেয়েছে।
তনুকা হাসতে হাসতে বলল,
থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ।
তখনই দরজার বাইরে ভারি পায়ের শব্দ।
প্রবাল বলল,
তন্ময় সামন্ত।
তখনই ডোরবেল বাজল।
সামন্ত ঘরে ঢুকতে ঢুকতে স্মিত মুখে বলল,
সারা ঘরটা শিঙাড়ার গন্ধে ভরে গেছে।
ঘরের সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
তনুকা আর এক প্লেট শিঙাড়া নিয়ে এসে সামন্তর সামনে টেবিলে রাখল। একটা কফির মগ হাতে নিয়ে সে প্রবালের পাশে বসল। তদন্তের গল্পে তার দারুণ ইন্টারেস্ট।
অর্ক তদন্তের ব্যাপারে কিছু বলতে গেলে সামন্ত তাকে রিকোয়েস্ট করল,
শিঙাড়াগুলো আগে শেষ করি স্যার। এ যেন একবারে অমৃত হয়েছে।
শিঙাড়া শেষ করে একটা কফির মগ তুলে নিয়ে সামন্ত বলল,
রুবি পালের বাড়ি আজ সকালে গিয়েছিলাম। কিন্তু সে বিশেষ কিছু জানে বলে মনে হল না। কথা শুনে মনে হল, রেখা দাশের সঙ্গে তার খুব একটা ভালো রিলেশন ছিল না। মানে বন্ধুত্ব ছিল না স্যার।
প্রবাল বলল,
রেখা দাশের ঘর সার্চ করে কিছু পাওয়া গেল?
না স্যার, ব্রেক থ্রু পাবার মতো কিছু পাইনি।
তার এই সহজ আর দায়সারা গোছের উত্তরে যেন কিছুটা বিরক্ত হয় প্রবাল,
সামন্তবাবু, জিনিসগুলোকে এত সহজ ভাবে দেখলে চলবে না। কোনও নিখোঁজ মানুষের তদন্ত গতানুগতিক পদ্ধতিতে করলে চলে না। এই ধরনের তদন্তে চার দিকটাই খোলা থাকে, মানে উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম যে কোনও ডাইরেকশানে আমাদের ডেসটিনেশন থাকতে পারে। এখন আমাদের ঠিক করে নিতে হবে আমরা কোনদিকে যাব। এই কোনদিকে যাব, সেটা যদি না সঠিকভাবে বুঝতে পরি তবে আমাদের গোলকধাঁধার মতো ঘুরে বেড়াতে হবে। সেক্ষেত্রে সেফেস্ট পদ্ধতি হচ্ছে যিনি নিখোঁজ হয়েছেন তাঁর হিস্টরিটা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুধাবন করা। এখানে ইতিহাস হবে আমাদের রিয়ারভিউ মিরর।
প্রবাল একটু থামল। বোতল থেকে এক ঘোট জল গালায় ঢেলে সে আবার শুরু করে,
এ ক্ষেত্রে আমি যতটুকু বুঝতে পেরেছি তাতে করে মনে হয়েছে, বিশাখা দত্ত আর রেখা দাশের নিখোঁজ হওয়াটা এক সূত্রে বাঁধা। ইফ আই অ্যাম নট রং, রাহুল বৈদ্যর হত্যাও এর সঙ্গে জড়িত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই সবকটা অপরাধের পিছনে কী কারণ থাকতে পারে? অপরাধের মোটিভটা কী? আপনারা কেউ কিছু ভেবেছেন?
অর্ক হাত তুলে দিল। বলল,
আমি বস এই নিয়ে কিছু ভাবার সময় পাইনি। তবে একটা জিনিস আমাদের মাথায় স্ট্রাইক করেছে। সেটা হচ্ছে রাহুল বৈদ্যর মার্ডার উইপন। আমরা যে ধরনের অস্ত্র চোরাচালানের তদন্তে কাজ করছি ওই পিস্তলটা একেবারে সেই গোত্রের। ওটা একটা চাইনিজ মেড 7mm পিস্তল। এই ধরনের পিস্তল ভারতে সচরাচর পাওয়া যায় না। লাস্ট পাওয়া গিয়েছে কাশ্মিরে। কিছু দেশি মেড পাওয়া যায় মোটামুটি সেম ক্যালিবারের। তবে বিদেশ থেকে যেগুলো পাচার হয়ে আসছে সেগুলো দারুণ হ্যান্ডি আর ডেডলি। এখন রাহুল বৈদ্যর খুনের সঙ্গে এই অস্ত্রের যোগসূত্র আমাদের ভাবাচ্ছে। রাহুলের সঙ্গে অস্ত্র চোরাচালানের কোনও যোগসূত্র ছিল কিনা সেটা নিয়ে আমরা তদন্ত চালাচ্ছি। যদিও আমরা এখনও কোনও ক্লু পাইনি।
প্রবাল বলল,
ধরে নেওয়া যায় রাহুল এই ধরনের অস্ত্রকারবারিদের সঙ্গে যুক্ত ছিল, তাহলে বিশাখা দত্ত কোথায় গেল। তার নিখোঁজ হবার কারণ কী? সে খুন হতে পারত! কিডন্যাপ করার মতো রিস্কি কাজ কেন করা হল? শুধু তাই নয়, তার পরে নিখোঁজ হল রেখা দাশ। না ভাই অস্ত্র চোরাচালান ছাড়াও গভীর কোনও রহস্য আছে। সামন্তবাবু আপনার কি মনে হচ্ছে?
সামন্ত গলা খাঁকারি দিয়ে একটু গলাটা পরিষ্কার করে নেয়, বলে,
আমার মনে হয়েছে, রুবি পাল কিছু জানে। তার পেটে কিছু কথা আছে। গত কয়েক মাসে তার রোজগার বেশ বেড়ে গিয়েছে, আমরা তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট চেক করেছি। তার পিছনে আমি চর লাগিয়েছি। আর ও ‘আবাদ’ নামে একটা NGO সংস্থার সঙ্গে কাজ করে।
‘আবাদ’ নামটা শুনে অর্ক সোজা হয়ে বসে। তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে,
তাতে কী?
সামন্ত তার স্বভাবসুলভ হেসে নিয়ে বলে,
কোথায় কে কী ছিপ ফেলে বসে আছে তা কী সহজে বোঝা যায় স্যার! সংস্থাটা নতুন। তার বিষয়ে কেউ বিশেষ কিছু জানে না। তারা কালীঘাটের রেড-লাইটেড এলাকায়, টালিগঞ্জের সিনেমা পাড়ায় খুব ঘুর ঘুর করছে আজকাল। রুবি পাল হচ্ছে তাদের রেড লাইটেড এলাকার লিঙ্ক।
অর্ক এই নিয়ে আর কথা বলে না। সে মনে মনে ঠিক করে, তাকে রুচিরার বিষয়ে জানতে হবে।
প্রবাল বলল,
সামন্তবাবু আমি রেখা দাশ যে বাড়িতে ভাড়া থাকত সেখানে যাব। আর রুবি পালের সঙ্গেও কথা বলব। আপনি ব্যবস্থা করুন। আর বিশাখা দত্ত আর রেখা দাশ এদের দু-জনের পুরো হিস্ট্রি আমার চাই।
অর্ক বলল,
রেখা দাশ যে দিন নিখোঁজ হয়, সেই দিন তার মোবাইলের টাওয়ার লোকেশনের একটা ম্যাপ বানিয়ে ফেলুন সামন্তবাবু।
সে নিজেই যে এমন একটা ম্যাপ বানাতে বলেছে সেটা সে বেমালুম চেপে গেল।
প্রবাল বলল,
ঠিক বলেছিস অর্ক। তার গতিবিধিটা আমাদের জানা দরকার। সামন্তবাবু আপনি কী ভাবছেন?
সামন্ত বলল,
বিশাখা দত্তর ফোনে লাস্ট কলটা গিয়েছিল রেখা দাশের ফোন থেকে।
অর্ক আর প্রবাল পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়।
নয়
তার মাথার ভিতরে উইপোকা বাস করে। তারা কট কট করে মাঝে মাঝে তার মাথার ভিতরটাকে কামড়াতে থাকে। তিষ্ঠোতে পারে না সাধুচরণ। মাথা গরম আগুনের মতো হয়ে যায়। সে উঠে নীচতলার লম্বা বারান্দায় পায়চারি করে, দৌড়ায়। কিছুতেই তার যেন শান্তি হয় না।
সেদিন গঙ্গার পারে মেয়েমানুষের মড়া দেখে তার মাথার ভিতরে সেইসব উইপোকার কামড় যেন হাজার গুণ বেড়ে গিয়েছে। মেয়েমানুষের সেই আধো হাঁ করা মুখ। গড়িয়ে পড়া রক্তের গন্ধ পেয়ে দু একটা মাছি উড়ে বেড়াচ্ছিল। সাধুচরণের চোখের সামনে সেই সব সারাদিন ভেসে ভেসে বেড়ায়। কোনও কাজে তার সারাদিন মন বসে না। খাওয়ায় অরুচি। শুধু তার মনে হয়, মাথার ভিতরে সহস্র উইপোকা কট কট করে তার করোটি চিবিয়ে চলেছে।
আজ যেন তার মাথাটা বড্ড বেশি উচাটন করছে। সে কিছুতেই তার বিছানায় স্থির হয়ে শুয়ে থাকতে পারছে না। সে দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসে। আকাশে মেঘ নেই। চারপাশে কেমন ঘোলাটে জ্যোৎস্না, হালকা মশারির মতো ভেসে ভেসে আছে। চরাচরে এর থেকে বেশি আর আলো নেই কোথাও! সাধুচরণ ভাবল। কেমন থম থম করছে চারদিক। সাধুচরণের গা টা সির সির করে ওঠে। একটা দমকা হাওয়া এসে তার গায়ে কাঁটা ধরিয়ে দেয়।
কোথাও একটা কুকুর কেঁদে ওঠে। সাধুচরণ ভাবে এ নিশ্চয়ই তার প্রিয় ন্যাওটা লড়বড়ি। কুকুরটা সারাদিন প্রায় এ বাড়িটার আশে পাশে ঘুর ঘুর করে। সাধুচরণ তাকে তিন বেলা খেতে দেয়। তার চেহারাটা খাসা। হালকা লালচে রং। ডাকটা দারুণ গম্ভীর। বাড়ির পিছনে বাগানের শেষ প্রান্তে যে ভাঙা ছাউনি দেওয়া ঘরটা আছে, লড়বড়ি রাত্রে সেখানে শুয়ে থাকে। সাধুচরণ কতবার তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তাকে বারান্দার এক পাশে শুতে বলেছে। কিন্তু রাত হলেই লড়বড়ি আর এ বাড়িতে থাকে না। সে তার সেই ভাঙা ঘরটাতে চলে যায়। সাধুচরণ সেই ঘরটার দিকে বিশেষ যায় না। তার বাপ তাকে বারণ করে গিয়েছিল ওই দিকে যেতে, ‘সাধু ওদিকে যাসনি কখনও, ওদিকে এককালে কত লাশ পুঁতে রাখা আছে, সেই সব মরা মানুষের লাশ রাতের বেলা কাঁদে। ওদিকে কখনও যাসনি সাধু।’
সাধুচরণ তার বাপের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে এসেছে। সেদিকে তাকালেও তার বুকটা দুরু দুরু করে ওঠে।
সাধুচরণের মনে হল, লড়বড়ি যেন ডাকছে না, কাঁদছে। একবার। দু বার। তিনবার। শেষে তার ডাকটা গোঙানির মতো হয়ে গিয়েছে। এবং তার পরে একেবারে চুপচাপ।
সাধুচরণের যেন ভাবনা হয়। সে কি একবার গিয়ে দেখে আসবে? কিন্তু আজ যেন গাটা তার বড্ড বেশি ছমছম করছে।
এমনটা তার হয় না খুব একটা, বহু বছর সে এই ভূতের বাড়িটাতে কাটিয়ে দিয়েছে। তার ভয় করেছে, গা ছমছম করেছে, কিন্তু আজকের মতো এমনটা তার তার কখনও মনে হয়নি। কোথা থেকে একটা হাওয়া যেন আসছে, এসে ফোঁস ফোঁস করে কিছু বলে যাচ্ছে, তার কোনও মানে নেই। মানে হয় না। বেশ কয়েক বছর আগে গঙ্গার পারে ওই বটগাছের নীচে এক সাধু এসে আস্তানা গেড়েছিল। সাধুচরণের সঙ্গে সেই সাধুবাবার দারুণ দোস্তি হয়েছিল তারপরে। সন্ধ্যার পরে দু জনে বসে ছিলিম টানত। সাধুচরণ সেই বাবাকে ভূত নামাতে দেখেছে। একদিন ঘোর অন্ধকার রাতে সাধুচরণের বাপের প্রেত নেমে এসেছিল। সাধুচরণ তার বাপের গলা স্পষ্ট শুনেছে। আস্তে আস্তে সেই গলার স্বর এক আবছা অবয়বের চেহারা নিয়েছিল। সাধুচরণ স্পষ্ট দেখেছে তার বাপের মুখ। সেদিন ঘরে ফিরে এসে সে বেহেড পাগল হয়ে গিয়েছিল। দু-তিনটে দিন সে এমনি ভণ্ডুল হয়ে ছিল। সুস্থ স্বাভাবিক হতে তার বেশ কয়েকদিন সময় লেগেছিল। সেই কটা দিন সর্বক্ষণ সে ভয়ে গোলপুটুলি পাকিয়ে থাকত। চারদিকে ছায়া ছায়া তার বাপের মুখ দেখতে পেত। বেঁচে থাকতে সে তার বাপকে কোনও দিন ভয় করেনি। কিন্তু মৃত বাপের ভয়ে সে কাঁটা হয়ে থাকত। ফলে কয়েকদিন সে ঘর থেকে বের হয়নি। সাধুবাবার কাছেও যেতে পারেনি সে। এই ভয়ের ঘোর কেটে যেতে সে সেই বটতলায় গিয়ে দেখেছিল সাধুবাবা নেই। সে শুনেছিল নেশার ঘোরে সাধুবাবা গঙ্গায় ভেসে গিয়েছিল। গোলাবাড়ি লঞ্চঘাটের কাছে সাধুবাবার লাশ ভেসে উঠেছিল পরদিন বিকেলে। তার চোখদুটো শকুনে খুবলে নিয়ে গিয়েছে। সব শুনে সাধুচরণের খুব মন খারাপ হয়। সাধুবাবার কলকেটা বটগাছের গুঁড়ির কাছে পড়েছিল। সাধুচরণ পকেটে করে সেটা ঘরে নিয়ে এসেছিল।
চারপাশে ফ্যাকাসে জ্যোৎস্নায় সাধুচরণের সেই আবার তার বাপের মুখখানা মনে পড়ে।
লড়বড়ির কান্না থেমে গিয়েছে। বাগানের ওপাশটা এখন ভীষণ শুনশান। কিন্তু ওদিকে গিয়ে দেখে আসার সাহস হচ্ছে না সাধুচরণের।
আজ সন্ধ্যাবেলা বদু এসেছিল। বদু আজকাল প্রায়ই আসে। সাধুচরণের সঙ্গে তার ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে। বদু ভারি অদ্ভুত, ছায়ার মতো রোগা চাবুক তার শরীর, চোখটা সবসময় কেমন ধক ধক করে জ্বলে। সে হাওয়ার মতো ঘুরে বেড়ায়, তার হাঁটাচলায় কোনও শব্দ হয় না। সাধুচরণ তেমনটা টের পেয়েছে। সে সকালে আসে, দুপুরে আসে, সন্ধ্যায় আসে, কয়েকদিন রাত্রেও এসে বসে থেকেছে। সাধুচরণের বাগানটার উপরে তার ভীষণ লোভ। মাঝে মাঝে সে বলে ‘সাধুদা তোমার বাগানটায় আমায় থাকতে দেবে?’
সাধুচরণ তাকে হুস হুস করে তাড়িয়ে দেয়।
ভাগ ভাগ শালা। শ্যাল কুকুরের পো।
বদু চলে যায় না। সে দাঁত বার করে হাসে। কি ফরসা তার দাঁত। সাধুচরণ তার বিকশিত দাঁতের পানে চেয়ে থাকে।
দু একদিন এমনও হয়েছে বদু রাত্রে তার সঙ্গে তার বিছানায় শুয়ে পড়েছে। বদু দিশি মদ জোগাড় করে আনে। মুরগির ছাঁট নিয়ে আসে সন্ধ্যাবেলা। তারপরে দুজনে বসে খুব করে ঝাল দিয়ে রান্না করে। মাঝরাতে নেশার ঘোরেও সাধুচরণ বুঝতে পারে বদু তার পাশে বিছানায় নেই। বদু কোথায় যায় রাতদুপুরে? সাধুচরণ জানে না।
আজও সন্ধ্যাবেলা বদু এসেছিল। তার পায়ের কাছে ন্যাওটার মতো বসে লেজ নাড়াচ্ছিল লড়বড়ি। বদু তাকে একটা লেড়ো বিস্কুট ভেঙে দেয়। যেমন হাওয়ার মতো বদু এসেছিল তেমনি অন্ধকার ঘন হতে আবার হাওয়ার মতো সে অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়েছিল। সে কি চলে গিয়েছিল? সাধুচরণ ঠিক জানে না।
সাধুচরণ ভাবল আজ যদি বদু রাত্রে থকত তবে সে একবার লড়বড়ির ভাঙা ঘরটাতে গিয়ে দেখে আসত। কেন অন্ধকারে এক একা গুঙিয়ে গুঙিয়ে শেষে থেমে গিয়েছে সে।
অনেকটা ভাবনা নিয়ে ঘরে শুতে ফিরে যায় সাধুচরণ। এখন কত রাত কে জানে? তার ঘড়ির খুব একটা প্রয়োজন হয় না।
সাধুচরণ জেগে জেগে বিছানায় পাড়ে থাকে। কতক্ষণ কে জানে। বাইরে তার দরজায় কে ধাক্কা দেয়। সে ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসে। দরজা খুলতে সে অবাক হয়ে যায়। চাঁদের আলো যেন স্পষ্ট হয়েছে বাইরে। সেই আলোয় সে বদুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।
সাধুচরণ তাকে কিছু বলতে যায়। বদু ঠোটে আঙুল দিয়ে তাকে চুপ করার ইঙ্গিত করে। তারপরে সাধুচরণ তাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে। বদুর হাতে একটা সরু জোরালো টর্চ। তারা লড়বড়ির সেই ভাঙা ঘরটার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। বদু টর্চের আলো ফেলে। টর্চের আলো অনুসরণ করে সাধুচরণ দেখে লড়বড়ি উলটে পড়ে আছে। তার বুক থেকে পেটটা কে চিরে দিয়েছে। পেটের সমস্ত নাড়ি ভুঁড়ি বাইরে বেরিয়ে গিয়েছে। বদু আবার একটু এগিয়ে গীয়ে লড়বড়ির মুখের কাছে টর্চের আলো ফ্যালে। সাধুচরণ দ্যাখে লড়বড়ির কানদুটো নেই, চোখের জায়গায় একটা গভীর গর্ত।
সাধুচরণকে যেন আবার ভূতে পেয়ে গিয়েছে। ভূত আর অন্ধকারের ভিতরে তার মাথা যেন খারাপ হয়ে গিয়েছে। হাউমাউ করে সে বনবাদাড় ভেঙে, গাছপালা ভেঙে দৌড়ায়।
(ক্রমশ)