তৃতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় যাত্রা — বামপন্থা ও ভবিষ্যতের ভারত

স্টেশন মাস্টার

 

...যদি প্রশ্ন জাগে, এমন নিষ্ঠুর হৃদয়বিদারক উপমা কি বামেদের প্রাপ্য ছিল? ঝটিতি উত্তর আসে, এ প্রাপ্য নির্ধারণ করিয়াছেন তাঁহারা নিজেরাই। যদি প্রশ্ন জাগে, এমত পশ্চাদ্‌গমনের আশু সমাধান কী, তাহারও উত্তর, সমাধান তাঁহাদেরই হস্তে। সে পথ কেমন বন্ধুর, কতদূর সমস্যাদীর্ণ, কেমন তার উচ্চাবচ সম্মুখগমন, ভবিষ্যৎই তাহা বলিতে পারে। জুন সংখ্যার বিষয়মুখ নির্বাচন করিতে বসিয়া চারনম্বর প্ল্যাটফর্মের সম্পাদকমণ্ডলীর প্রত্যয় হইয়াছে, রাত্রির নিবিড়তম অন্ধকারের মুহূর্ত হইতেই যেমত পরবর্তী ঊষাকালটির নির্মাণ শুরু হয়, ভারতবর্ষে বামপন্থী রাজনীতির ভবিষ্যৎ পথরেখাটির অভিমুখ নির্ধারণের সূচনাকল্পেও তেমনই ইহাই সঠিক সময়বিন্দু। এই হতমান, হৃতগর্ব সময়ের গর্ভেই হয়তো বা পথের সঠিক সন্ধান মিলিতে পারে— এমন ভাবনাক্রম হইতেই এই সংখ্যার মূল বিষয়ভাবনা ‘বামপন্থা ও ভবিষ্যতের ভারত’-এর পরিকল্পনা।...

 

জনপ্রিয় ‘সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম’-এ দিনকতক একটি বিচিত্র ছবি ঘোরাফেরা করিতে দেখা গেল। ছবির বিষয় গুরুতর কিছু নহে – বিক্রেতা (তাঁহাকে যদিচ দেখা যাইতেছে না) ঝাঁকাভর্তি লিচু বাজারে আনিয়াছিলেন বিক্রয়ের জন্য, দিনাবসানে তাহার সামান্য গুটিকয় অবিক্রীত রহিয়া গিয়াছে – রৌদ্রপীড়নে ও অবিক্রয়জনিত হতাশার লাঞ্ছনে তাহাদিগের অধিকাংশই করুণ, বিবর্ণ ও ফিকা। আলোকচিত্রের নিম্নে গোটা-গোটা অক্ষরে লিখা, “শীঘ্র খরিদ করুন, মাত্র সাড়ে সাত শতাংশ অবশিষ্ট… সস্তায় পাইবেন” ইত্যাদি। ছবির নিম্নে ‘লাইক’, নানাবিধ রসবতী মন্তব্য ও তদুপযোগী ‘ইমোটিকন’-এর বন্যা দেখিয়া বুঝিতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না যে, কটাক্ষবাণের আশু লক্ষ্য রাজ্যে বামেদের ক্রমহ্রসমান জনসমর্থন ও প্রাপ্ত ভোটের হার; এবং বামেদের এ হেন অধঃপতন যে নিছক ব্যঙ্গ ও পরিহাসের অধিক কোনও মনোযোগ দাবি করে না, আলোচনার অভিমুখ ও বিষয়বস্তু হইতে তাহাও যৎপরোনাস্তি প্রতীয়মান হয়।কৌতুকের মাত্রা বর্ধিত হয় যখন নজরে আইসে যে, তথাকথিত বামমনস্ক বলিয়া সাধারণ্যে পরিচিত ব্যক্তিদিগেরও কেহ কেহ আপনাপন সময়রেখায় সেই চিত্র ‘শেয়ার’ করিতেছেন, তাহা লইয়া উপভোক্তাগণের সম্মিলিত হাস্যরসে সামিল হইতেছেন, এমনকী বামবিরোধী বলিয়া পরিচিতদের বক্রোক্তিতে সম্মতিসূচক মন্তব্যও করিতে ছাড়িতেছেন না।

প্রসঙ্গটি প্রণিধানযোগ্য কেবল এই কারণেই নহে যে, আলোচ্য চিত্রটি রসিকতার ছলে একটি রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করে। ইহার তাৎপর্য এইখানেও যে, গোটা বিষয়টির মধ্যে একটি প্রকাশ্য চটুলতা নজরে আইসে— রাজ্যে বামশক্তির ক্রমাবক্ষয় ও তজ্জনিত প্রাসঙ্গিকতাহ্রাস যে আদপে কোনও গুরুতর আলোচনার বিষয়ই নহে, তেমন একটি তাচ্ছিল্যের বার্তাও সেখানে প্রতিভাত হয়। সোশ্যাল মিডিয়া স্বভাবত ফাজিল, এমন ধরিয়া লইলে ল্যাঠা হয়তো বা চুকিয়া যায়, কিন্তু বহিরঙ্গের রসিকতার নির্মোক খসাইয়া সত্যই যদি কেহ এই তাচ্ছিল্যের নিহিতার্থ বুঝিতে চাহেন? যদি পূর্বাপর অনুধাবন করিতে চাহেন, গত কয় বৎসরে কী এমন ঘটিল যে, বামেরা এই রাজ্যের প্রধানতম নির্ণায়ক শক্তির সিংহাসন খোয়াইয়া ক্রমান্বয়ে দ্বিতীয়, তৃতীয় স্থানে নামিয়া আসিলই শুধু নহে; অধিকন্তু রাজ্য-রাজনীতির এমন এক প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত হইল, যাহাতে ভোটের পূর্বে কংগ্রেস আগাইয়া আসিয়া জোটের হাত বাড়াইয়া দিল না কেন বলিয়া আলিমুদ্দিনকে ক্রন্দন করিতে হয়, এবং ভোটের পরে বামভোটের সিংহভাগ বিজেপি-তে চলিয়া গেলে বিনাইয়া-বিনাইয়া “নেতৃত্ব ভোটারদিগকে এমন নির্দেশ কদাচ দেয় নাই, কিন্তু সমর্থকরা তৃণমূলের আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষা করিবার নিমিত্ত বিজেপি-র ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিলে দল কী করিবে” জাতীয় আত্মপ্রতারণার আশ্রয় লইতে হয়। এই মুহূর্তে ভারতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তৃণমূল ও বিজেপি-র মধ্যে বৃহত্তর রাজনৈতিক শত্রুটি কে ও কেন— সদ্যোসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে তাহা স্থির করিয়া উঠিতে না-পারার মাশুল দিতে গিয়া রাজ্যে বামশক্তি প্রায় নিশ্চিহ্ন হইবার মুখে ইহা অতএব অর্ধসত্য; তদপেক্ষা মৌলিকতর সত্যটি হইল এই যে, ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি করিতে ব্যস্ত কমিউনিস্টরা এমনকী রাজনৈতিক বিরোধী নির্বাচনের আবহমানকালীন পদ্ধতিটিও ভুলিয়া বসিয়া আছেন।

কিন্তু বৃহত্তর বিচারে এই বাস্তবতাও অন্তিম সত্য নহে। ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ এই রচনার উদ্দেশ্য নহে, তথাচ স্মরণে রাখা প্রয়োজন, একমাত্র বামশক্তির নিকটই প্রত্যাশা ছিল দেশজোড়া জাতীয়তাবাদী হাওয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া সামাজিক উন্নয়ন বিষয়ে একটি বিকল্প ভাষ্য রচনার— বিজেপি-র ক্ষুরধার জাতীয়তাবাদ, কংগ্রেসের নরম হিন্দুত্ব ও রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের সুবিধাবাদী তোষণের রাজনীতির ত্রিধারার বাহিরে গিয়া একটি চতুর্থ মাত্রার প্রবর্তনা, যেখানে ভোটের প্রকৃত ইস্যুগুলি ধারাবাহিকভাবে আলোচনায় উঠিয়া আসে। মাত্রই কয়েকমাস আগে মহারাষ্ট্রে একের পর এক কৃষক আন্দোলন, দলিত, সামাজিক অনগ্রসর শ্রেণি ও অরণ্যবাসী প্রান্তিক মানুষের মনে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ সেই ভাষ্যরচনার পরিপ্রেক্ষিৎ রচনা করিয়া রাখিয়াছিল। তদুপরি কর্মসংস্থানে ঘোরতর সংকোচন, অর্থনীতির দোলাচল ও শ্লথগতি, কৃষিক্ষেত্রে চূড়ান্ত অস্থিরতা, নির্মাণশিল্পে বৃদ্ধি হ্রাস, ক্ষুদ্রশিল্পের মুখ থুবড়াইয়া পড়াইত্যাদির কারণে শহর ও মফস্বলের মধ্যবিত্ত মানুষও যৎপরোনাস্তি হতাশাগ্রস্ত ছিলেন। অথচ দেখা গেল, ভোটের ভাষ্য রচিত হইল জাতীয়তাবাদী লাঙুল-আস্ফালনকে কেন্দ্র করিয়া। কেন্দ্রের শাসক দল যখন রামনবমীতে সশস্ত্র মিছিল বাহির করিলেন, রাজ্যের শাসকদল তখন হনুমানজয়ন্তী পালনের রাস্তা নিলেন। কংগ্রেস বহুতর আশা জাগাইয়া ‘ন্যায়’ভাষ্য প্রকাশ করিলেও কার্যক্ষেত্রে দলের কর্ণধার চৌকিদারকে চোর এবং নিজেকে খাঁটি হিন্দু তথা নিষ্ঠ ব্রাহ্মণ প্রমাণ করিতে সমধিক ব্যস্ত রহিলেন। ভারতবর্ষের প্রান্তিক মানুষের হইয়া কথা বলিবার জন্য অতঃপর বাকি ছিল কেবল বামেরা। তাহারাও যখন ভোটের পূর্বে রাজ্যে কয়টি আসনে লড়িবে তাহা লইয়া কংগ্রেসের সহিত বাক্যবিনিময়ে অর্থহীন কালক্ষেপ করিয়া চলিল ও অনন্তর সহসা মুখ্যমন্ত্রীর উচ্চারণদোষ লইয়া অধিকতর উদ্বিগ্ন হইয়া পড়িল, তখনই বুঝা গিয়াছিল সঙ্কট সমাগতপ্রায়। ভোটের ফলাফল সময়কালে সেই সঙ্কটকে সংখ্যায় অনুবাদ করিল মাত্র।

গত অর্ধশতাব্দকালে এ দেশে বামেদের প্রধানতম সাফল্য বলিতে যাঁহারা পশ্চিমবঙ্গে ভূমিসংস্কারের উল্লেখ করেন, তাঁহারা সম্পূর্ণ সত্য বলেন না। তাহা ঐতিহাসিক অবশ্যই, কিন্তু তদপেক্ষা মৌলিক সাফল্য শ্রেণিসংগ্রামের আলোকে ভারতীয় সমাজের অগ্রগতি ও বিবর্তনকে ব্যাখ্যা করা ও ভারতীয় রাজনীতির মূলস্রোতে শ্রমিক ও কৃষকের কণ্ঠস্বরকে প্রতিষ্ঠিত করার ধারাবাহিক প্রয়াস। খেদজনক যে, কেবলমাত্র কানহাইয়া কুমার বা জিজ্ঞেশ মেবানির ন্যায় গুটিকয় ব্যতিক্রম ব্যতীত এবারের লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে সে বিষয়গুলি তুলিয়া ধরিবার আপ্রাণ উদ্যোগ তেমন চক্ষেই পড়িল না।

তাহারই সংক্ষিপ্ত ও মর্মান্তিক ফলাফল, প্রায়-নিঃশেষিত লিচুর ঝাঁকার প্রাগুক্ত চিত্রকল্প। যদি প্রশ্ন জাগে, এমন নিষ্ঠুর হৃদয়বিদারক উপমা কি বামেদের প্রাপ্য ছিল? ঝটিতি উত্তর আসে, এ প্রাপ্য নির্ধারণ করিয়াছেন তাঁহারা নিজেরাই। যদি প্রশ্ন জাগে, এমত পশ্চাদ্‌গমনের আশু সমাধান কী, তাহারও উত্তর, সমাধান তাঁহাদেরই হস্তে। সে পথ কেমন বন্ধুর, কতদূর সমস্যাদীর্ণ, কেমন তার উচ্চাবচ সম্মুখগমন, ভবিষ্যৎই তাহা বলিতে পারে। জুন সংখ্যার বিষয়মুখ নির্বাচন করিতে বসিয়া চারনম্বর প্ল্যাটফর্মের সম্পাদকমণ্ডলীর প্রত্যয় হইয়াছে, রাত্রির নিবিড়তম অন্ধকারের মুহূর্ত হইতেই যেমত পরবর্তী ঊষাকালটির নির্মাণ শুরু হয়, ভারতবর্ষে বামপন্থী রাজনীতির ভবিষ্যৎ পথরেখাটির অভিমুখ নির্ধারণের সূচনাকল্পেও তেমনই ইহাই সঠিক সময়বিন্দু। এই হতমান, হৃতগর্ব সময়ের গর্ভেই হয়তো বা পথের সঠিক সন্ধান মিলিতে পারে— এমন ভাবনাক্রম হইতেই এই সংখ্যার মূল বিষয়ভাবনা ‘বামপন্থা ও ভবিষ্যতের ভারত’-এর পরিকল্পনা। এই বিভাগে আমরা প্রাসঙ্গিকবোধে পুনর্মুদ্রণ করিয়াছি প্রখ্যাত মার্ক্সীয় চিন্তক প্রভাত পট্টনায়কের একটি ও বিজয় প্রসাদ ও সুধন্ব দেশপাণ্ডের অপর একটি নিবন্ধ। একইসঙ্গে, রহিয়াছে অধ্যাপক উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়, রেজাউল করীম, অনিকেত দাসশুভেন্দু দেবনাথ-এর চারটি অত্যন্ত জরুরি প্রবন্ধ। লেখাগুলি, আশা করি, আমাদিগকে পথ খুঁজিতে সাহায্য করিবে।

এই সংখ্যাতে স্মরণ করা হইল সদ্যোপ্রয়াত সাহিত্যিক অদ্রীশ বর্ধনকে। তাঁহাকে স্মরণ করিলেন যশোধরা রায়চৌধুরী এবং কৌশিক মজুমদার। বিশেষ নিবন্ধ হিসেবে প্রবন্ধ বিভাগে তর্জমাপূর্ব্বক মুদ্রিত হইল অরুন্ধতী রায়ের আর্থার মিলার ফ্রিডম টু রাইট লেকচারটি। কেবিন গ্রাফিত্তিতে রহিল অতনু দেব কৃত একটি গ্রাফিক নিবন্ধ ‘কার্ল মার্কস ২০০’। আর, এ সংখ্যা হইতেই শুরু হইল কবি ও প্রাবন্ধিক হিন্দোল ভট্টাচার্যের নতুন ধারাবাহিক আত্মকথা ‘অসঙ্গতির সঙ্গত’।

এতদ্ব্যতীত এই সংখ্যায় যথারীতি রহিল গল্প, অণুগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, অন্যগদ্য, সবুজ স্লিপার, ভালো খবর, হুইলার্স-সহ অন্যান্য সমস্ত নিয়মিত বিভাগ।

সকলে ভাল থাকুন। কাগজটি সম্পর্কে আপনাদের মূল্যবান মতামত আমাদিগকে জানান।

পুনশ্চ

সম্পাদকীয় নিবন্ধটি লেখা যখন প্রায় শেষের পথে, খবর পাইতেছি, পশ্চিমবঙ্গে শোচনীয় নির্বাচনী ফলাফলের সুরতহাল করিতে চৌঠা জুন আলোচনায় বসিতেছে মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির রাজ্যকমিটি। সেই মন্থনযজ্ঞ হইতে বাড়বাগ্নি উত্থিত হইবে, না কি হলাহল, না কি বহু-প্রতীক্ষিত অমৃত, সে কথা সময়ই বলিবে। আপাতত নেতৃবৃন্দের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ, ভোটে জিতিবার অঙ্কের বদলে সেই মনগুলিকে জিতুন যাহারা আপনাদের ভোট দিলে ভারতবর্ষ জিতিতে পারিত।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...