বিষাণ বসু
যতদূর জানতে পেরেছি, ঘটনাটা এরকম। পঁচাশি বছরের বৃদ্ধ গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হন। পরদিন তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। পরিজনের বক্তব্য, অবনতির সময়ে ডাক্তারকে ডেকে পাওয়া যায়নি, যে অভিযোগ ডাক্তাররা অস্বীকার করেছেন। চিকিৎসকরা বলেছেন, রোগীপরিজন তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন, পরিজনের দাবী ঠিক উল্টো। পরিজনেরা জানিয়েছেন, ডিউটিরত জুনিয়র ডাক্তাররা তাঁদের মারধর করেন। জুনিয়র ডাক্তারদের অবশ্য পরিজনের বিরুদ্ধে আলাদা করে অভিযোগ প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই। পরিজনের মারে দুজন জুনিয়র ডাক্তার গুরুতর আহত। তার মধ্যে একজনের খুলির হাড় ভেঙে মস্তিষ্কের বাইরের পরতটিকে ছিঁড়ে ফেলেছে। তিনি বরাতজোরে প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন। দুটো ম্যাটাডোর ভাড়া করে মাত্র শদুয়েক “শোকাহত” পরিজন হাসপাতালে হেস্তনেস্ত করতে এসেছিলেন। এইখানে দুটি বিষয় লক্ষ্যণীয়:
- চিকিৎসাই একমাত্র ক্ষেত্র, যেখানে একটিই ঘটনায় একই অভিযোগে একই সঙ্গে আপনি চারটি জায়গায় বিচার চাইতে পারেন। আদালত, ক্রেতা সুরক্ষা আদালত, মেডিকেল কাউন্সিল, রাজ্য সরকারের মেডিকেল কমিশন। এতদসত্ত্বেও পরিজন হাত-থাকতে-মুখে-কেন ভাবনায় ভরসা রাখছেন, যা রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার হালটি স্পষ্ট করে দেয়। তাছাড়া, ডাক্তার-পেটানো যথেষ্ট নিরাপদও, কেননা গত দুবছরে আড়াইশোটি চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনায় মাত্র পাঁচটি কেসে পুলিশ অপরাধীদের গ্রেফতার করেছেন। কাজেই, নেহাত কপাল খারাপ না হলে আপনি হাতের সুখ করে নির্বিঘ্নে বাড়িতে ঘুমোতে পারেন— কেউই আপনাকে ধরতে আসবে না।
- সরকারি হাসপাতাল প্রায় অভয়ারণ্য গোছের কিছু একটা, যেখানে ম্যাটাডোর বোঝাই সশস্ত্র মানুষ রাতবিরেতে বিনা বাধায় প্রবেশ করতে পারেন— সংশ্লিষ্ট পুলিশ বা নিরাপত্তারক্ষী, এক্ষেত্রে, আপনাকে খামোখা ব্যতিব্যস্ত করবে না।
প্রসঙ্গে ফিরি। প্রতিবাদে জুনিয়র ডাক্তাররা কর্মবিরতি শুরু করেন। অকুস্থল এনআরএস দিয়ে শুরু— ছড়িয়ে পড়ে রাজ্যের প্রায় সবকটি মেডিকেল কলেজে।
এদিকে, ঘোলা জলে মাছ ধরার আশায় আইটি সেলের কিছু সুযোগসন্ধানী কর্মী মৃত ব্যক্তি ও আক্রমণকারীর ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে প্রচার শুরু করেন। কিন্তু, খুব স্বাভাবিকভাবেই, সমস্ত চিকিৎসক একবাক্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে থাকেন। এইটি বিশেষভাবে প্রশংসনীয়, কেননা এমত ভাবনায় হাওয়া দিলে চটজলদি সমর্থন পাওয়া যেত— সেই আপাতসহজ পথটি চিকিৎসকেরা বাছেননি। চিকিৎসকের পেশাটা একটু অন্যরকম। একজন মানুষ ব্যক্তিজীবনে গোঁড়া, এমনকি কঠোর সাম্প্রদায়িক হয়েও, চিকিৎসকের জামাটি গায়ে চড়ানো মাত্র ওসব ধর্মটর্ম তাঁর মাথায় থাকে না।
যাক সে কথা। পরের দিন, বুধবার, সিনিয়র ডাক্তারদের সংগঠনগুলি একযোগে বারো ঘণ্টা প্রাইভেট ক্লিনিক-আউটডোর বন্ধের ডাক দেন। রাজ্যজুড়ে এই ডাকে যে সাড়া পাওয়া যায়, তা, এককথায়, অভূতপূর্ব। জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতির সঙ্গে সিনিয়র ডাক্তারদের এই সহমর্মিতায় রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। শুধু ওপিডি বন্ধের ডাক থাকা সত্ত্বেও, অনেক মেডিকেল কলেজের এমার্জেন্সিও বন্ধ হয়ে যায়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি আবার মুখ্যমন্ত্রীও বটেন, তিনি স্বাভাবিক ব্যস্ততার কারণে এসব তুচ্ছ বিষয়ে মাথা ঘামানোর সময় পান না। সকালে কৃতী ছাত্রছাত্রীদের সম্বর্ধনা— যেখানে পরবর্তী প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের অনুপ্রাণিত করার গুরুদায়িত্ব, যাতে তারা রাজ্যের বেহাল স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বলির পাঁঠা হয়ে নিয়মিত মারধর খেতে পারে— আর সন্ধের দিকে অত্যুচ্চ পাঁচতারা হোটেলের শুভ উদ্বোধন।
পরের দিন, বৃহস্পতিবার, সিনিয়র চিকিৎসক সংগঠনগুলির ডাকা কর্মবিরতি অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও জুনিয়রদের কর্মবিরতি জারি থাকে। হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসা পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। সাধারণ মানুষের হয়রানি চরমে ওঠে।
পাশাপাশি, চিকিৎসক আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই প্রথমবার, সারা রাজ্য তো বটেই, আন্দোলনের সমর্থনে দাঁড়ায় দেশের বিভিন্ন অংশের চিকিৎসকেরা। শুক্রবার বিভিন্ন এইমস, পিজিআই চণ্ডীগড়-সহ চিকিৎসাশিক্ষার ক্ষেত্রে দেশের শীর্ষপ্রতিষ্ঠানগুলির জুনিয়র ডাক্তারেরা কর্মবিরতি পালন করেন। দেশের বাইরেও, বিভিন্ন দেশের ডাক্তারদের অ্যাসোসিয়েশন এই রাজ্যে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। যেমন, ব্রিটিশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন, ওয়ার্ল্ড মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন।
এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী এসএসকেএম হাসপাতালে যান। সমস্যার কেন্দ্রটি এনআরএস হওয়া সত্ত্বেও তিনি এসএসকেএম কেন গেলেন, তার হদিশ পাওয়া তুচ্ছ মনুষ্যের বিচারের অতীত। হতে পারে এসএসকেএম-এর কৌলিন্য, হতে পারে কালীঘাটের থেকে এসএসকেএম-এর নৈকট্য। কারণ যা-ই হোক, এসএসকেএম হাসপাতালে দাঁড়িয়ে মাননীয়া যেকটি কথা বলেন, গুরুত্ব ও প্রভাবে প্রতিটিই অসামান্য। সেই মণিমুক্তার ভাণ্ডার থেকে বাছাই করা মুশকিল। তবুও, দুখানি বিশেষভাবে স্মর্তব্য—
- ডাক্তারবাবুরা রোগীদের পদবী দেখে চিকিৎসা করেন। অস্যার্থ, চিকিৎসকেরা চিকিৎসার মুহূর্তে রোগীর জাতপাত বা ধর্মপরিচয় নিয়ে মাথা ঘামান। চিকিৎসকদের সম্পর্কে অর্থপিশাচ-কমিশনখোর-দাম্ভিক-উন্নাসিক-দুর্ব্যবহারী- কর্তব্যে অবহেলা-দায়বদ্ধতার অভাব ইত্যকার হাজারো সত্যিমিথ্যে অভিযোগ থাকলেও, এমন অভিযোগ কল্পনায় আনতে পারা ব্যতিক্রমী সৃজনশীলতার পরিচায়ক।
- সংঘর্ষে পুলিশ মারা গেলে বা পুলওয়ামায় জঙ্গিহানায় সেনা মারা গেলে, কই, সেনা বা পুলিশ, কেউই তো কর্মবিরতির কথা বলেন না!! ঘটনাচক্রে, মনে রাখা যেতে পারে, চিকিৎসা একটি দ্বিপাক্ষিক প্রক্রিয়া। চিকিৎসক ও রোগীপরিজন, উভয়ের সহযোগিতা ভিন্ন চিকিৎসা সম্ভব নয়। দুই সহযোগীর সম্পর্কে অপ্রত্যাশিত সশস্ত্র আঘাতের সঙ্গে সেনা-জঙ্গির স্বভাবশত্রুতার সম্পর্ক ও তজ্জনিত আক্রমণের তুলনায় কাণ্ডজ্ঞানের অভাবটিই সামনে এসে পড়ে।
কিন্তু, একটু খতিয়ে দেখলে বুঝতে অসুবিধে হয় না, এই মন্তব্যের মধ্যে সূক্ষ্ম রাজনৈতিক চাল রয়েছে। যে আন্দোলন চিকিৎসক বনাম প্রশাসনের, সেই আন্দোলনকে ধর্মীয় বিভাজনের আন্দোলনের রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন প্রথমে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ— সফল হননি— মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং আরেকবার চেষ্টা করে দেখলেন। দ্বিতীয়ত, আন্দোলনটিকে চিকিৎসক বনাম রোগীর সংঘাতে পরিণত করার চেষ্টা করলেন।
সফল হলেন কি?
গত তিন-চারদিন যাবত, রাজ্যের স্বাস্থ্যপরিষেবা বেহাল। আমজনতার হয়রানি অকল্পনীয়। অন্তত দুটি মৃত্যুর ঘটনা তো সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় এসেছে। মুখ্যমন্ত্রীর সুচতুর রাজনীতি সফল হওয়ার জমি প্রস্তুতই ছিল। কিন্তু, প্রায় অভাবনীয়ভাবেই, সাধারণ মানুষ চিকিৎসকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। হাসপাতালের বাইরে অসহায় দিশাহীন মুখগুলো আশায়-অপেক্ষায় থাকলেও, বিক্ষোভ নেই সেই দৃষ্টিতে। বেশ কয়েকটি হাসপাতালে, মূলত শাসকদলের স্নেহচ্ছায়ায়, ইঁট-পাটকেল ছুঁড়ে উত্তেজনা-সৃষ্টির চেষ্টা হলেও, সাধারণ মানুষ, যাঁরা সত্যিসত্যিই হয়রানির শিকার হচ্ছেন, তাঁরা অংশ নেননি। শুক্রবারের মিছিল, সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে মহামিছিলে পরিণত হয়েছে। শীতঘুম কাটিয়ে সামিল হয়েছেন বেশ কয়েকজন বিদ্বজ্জনও। ডাক্তারদের নিরাপত্তার দাবীতে ন্যায্য আন্দোলনে সাধারণ মানুষের সমর্থন এভাবে পাওয়ার পিছনে চিকিৎসকদের চেয়ে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর এসএসকেএম হাসপাতাল থেকে দেওয়া সারমন-টির কৃতিত্বই, সম্ভবত, বেশি।
পাশাপাশি, মুখ্যমন্ত্রীর প্রকাশ্য হুমকির বিপরীতে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকদের মধ্যে প্রায় এক হাজারজন ইস্তফার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছেন। যদিও এই গণ-ইস্তফা মূলত প্রতীকী এবং জুনিয়রদের সঙ্গত দাবীর প্রতি সমর্থন জানানোই এর মূল লক্ষ্য, তবুও, এঁরা যদি শেষ পর্যন্ত ইস্তফার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন, তাহলে, রাজ্যের সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিপর্যস্ত হবে তো বটেই, মেডিকেল শিক্ষার পাট রাজ্য থেকে আপাতত উঠে যাওয়ার সামিল হবে।
স্বাস্থ্যপরিষেবার বেহাল দশায় মানুষের হয়রানি অনিবার্য— দুর্ভাগ্যজনক এবং সমর্থনের অযোগ্য। কিন্তু, ঠিক কোন প্রশ্নগুলো করলে সমস্যার গভীরে পৌঁছানো যায়, সেই গুরুত্বপূর্ণ ভাবনাটা শুরু হয়েছে। অন্যত্র ভর্তি করা যায়নি বলে যে শিশু মারা গিয়েছে, আশু দোষারোপের চেয়ে অনেক বেশি জরুরি প্রশ্ন, কেন একটি মেডিকেল কলেজে সেই শিশুটির চিকিৎসার পরিকাঠামো থাকবে না? ডাক্তাররা কর্মবিরতি করবে কেন, এর চাইতে গুরুত্ব পাক এই প্রশ্ন, ডাক্তারদের কর্মবিরতিতে যেতে হচ্ছে কেন?
প্রশ্নগুলো উঠুক। উঠে আসুক। স্বাস্থ্য ক্রয়যোগ্য পণ্য কেন? সব নাগরিকের সামর্থ্যের মধ্যে কেন আসবে না স্বাস্থ্যচিকিৎসা? মেলাখেলা ছেড়ে সরকার কেন নজর দেবেন না স্বাস্থ্যপরিকাঠামোয়? কেন নিয়োগ হবেন না বেশি সংখ্যায় ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী? একটি ক্লাবকে অনুদানের টাকায় একজন স্বাস্থ্যকর্মীর সারাবছরের বেতন হতে পারে। একটি নীলসাদা গেটের টাকায় বেশ কয়েকজন ডাক্তারের বছরভরের মাইনের ব্যবস্থা হয়ে যায়। টাকা খরচ হচ্ছে অনেকদিকেই। কোনটি অগ্রাধিকার পাবে, পাওয়া উচিত, ঠিক করুন আপনারাও।
বিশ্বাস করুন, এই প্রশ্নগুলোর উত্তরের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে আপনার-চিকিৎসকের সম্পর্ক, চিকিৎসকদের কর্মস্থলে নিরাপত্তা, আপনার স্বাস্থ্যের আশ্বাস।
চিকিৎসা করাতে গিয়ে সরাসরি বা পরোক্ষে তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হননি, এমন মানুষ বিরল। এতদসত্ত্বেও, আজ আপনারা যাঁরা চিকিৎসকদের আন্দোলনকে সমর্থন করছেন, তাঁদের সেই সহমর্মিতা প্রশংসনীয়।
কিন্তু, আজ এই আন্দোলনকে যাঁরা সমর্থন করছেন না, তাঁদের উদ্দেশ্যেও বলি, প্রশ্নগুলো করুন। এই আন্দোলন শুধুমাত্র চিকিৎসকদের নয়। এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আপনার স্বাস্থ্যের অধিকার, আপনার চিকিৎসা পাওয়ার নিশ্চয়তা।
আন্দোলনকে সমর্থন করুন বা না করুন, প্রশ্নগুলো করুন। নিজের স্বার্থে। নিজেদের স্বার্থেও।
গুটকা খেয়ে যারা হসপিটালে নোংরা করে, তারাই আবার ডাক্তারি বিদ্যার উর্ধে গিয়ে ডাক্তার পেটায়। আর গদি লোভী সেই গুটকা খোরদের আরাল করছে , ডাক্তারদের হুমকি দিছে। পারলে ঐ গুটকা খোরদের আর ওদের ধর্ম গুরুদের (৮ পাস ও নয় ) শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। ঐ গুটকা খোর গুলো যে যে এলাকায় থাকে সেখানের ইতিহাস খুন, ধর্ষণ, ২নং ব্যবসা, ১০-১২ টা সন্তানের বাপ, ২-৪ টে বিয়ে, মহিলা নির্যাত … ভালো কিছু পাওয়া যাবে না।