কৌশিক দত্ত
চিকিৎসকদের ওপর সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্নরকম নির্যাতন বহুদিন ধরেই চলছিল। গত দুই বছরে এই রাজ্যে ২৬১টি বড় মাপের চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে। তা নিয়ে প্রশাসন, বিদ্বজ্জন বা সাধারণ মানুষ (অর্থাৎ স্বাস্থ্যপরিষেবার আম উপভোক্তা), কারও কোনও হেলদোল ছিল না। বিষয়টি জনমানসে “এরকম তো কতই হয়” পর্যায়ে নেমে এসেছিল, যাকে পরিভাষায় বলে ‘normalised’ হয়ে যাওয়া। এভাবেই চলছে চলবে বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। সেবাধর্মের নামে চিকিৎসক সম্প্রদায় সামন্ত পরিবারের গৃহবধূর মতো “taken for granted” হয়ে গিয়েছিলেন। সম্প্রতি এই আরামে বিঘ্ন ঘটেছে। ২০১৯-এর জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে চিকিৎসক নিগ্রহ হঠাৎই একটি সামাজিক অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে। না, চিকিৎসকের মাথা গুঁড়িয়ে হত্যার চেষ্টা হয়েছে বলে ততটা নয় (যদিও সংবেদনশীল কিছু মানুষ ঘটনার বীভৎসতায় আহত হয়েছেন), মূলত চিকিৎসকেরা এবার বড় মাপের আন্দোলন শুরু করেছেন বলে। আন্দোলনে সারা পশ্চিমবঙ্গের এবং পরবর্তীকালে সারা ভারতের চিকিৎসা পরিষেবা অংশত থমকে যাওয়ায় চিকিৎসকদের চাবকে পরিষেবা আদায় করে নেবার চিরন্তন আত্মপ্রত্যয় ধাক্কা খেয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলির পাশে বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরাও এসে দাঁড়িয়ে নিজেদের আউটডোর ও প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ করায় ফোর্টিস, আমরি, অ্যাপোলো, বেলভ্যুগামী শিক্ষিত উচ্চ-মধ্যবিত্ত জনতাও চিন্তায় পড়েছেন। ফলে সকলেই এতদিনে ইস্যুটিকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হয়েছেন, তা তিনি আন্দোলনের পক্ষে বা বিপক্ষে যে অবস্থানই নিন না কেন।
চিকিৎসক নিগ্রহ নিয়ে এই পত্রিকায় আগেও লিখেছি। একাধিক ঘটনার প্রেক্ষিতে এই অশান্তির শিকড়, রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কের ক্রমাবনতি, স্বাস্থ্যপরিষেবা ধ্বংস করার কুটিল পরিকল্পনা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতে হয়েছে। আগ্রহী পাঠক সেগুলো পড়ে দেখতে পারেন। বর্তমান সরকার স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যেখানে যেটুকু ভালো কাজের চেষ্টা দেখিয়েছেন, তার উল্লেখ করে প্রশংসা করেছি এতদিন (হয়ত প্রাপ্যের চেয়ে বেশি)। আজ আবার সেই বিষয়টি নিয়ে লিখতে বাধ্য হচ্ছি। একজন ব্যক্তি একই বিষয়ে দুই বছর ধরে ঘ্যানঘ্যান করলে কি ভালো লাগে কোনও পাঠকের? ভেবে দেখুন, কেন বারবার লিখতে হয়? কেন দুই বছরের ওপর ক্রমাগত ঘ্যানঘ্যানানির পরেও কিছুই বদলায় না? বাজারে এত উন্নত শ্রবণযন্ত্র কিনতে পাওয়া গেলেও প্রশাসন কেন নিজের চিকিৎসা না করিয়ে চিরবধির থাকার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন?
এর আগে যখন বিভিন্ন হাসপাতালে ভাঙচুর, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে এবং শাসকদলের সমর্থকদের সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গেছে, তখন একাধিকবার বলেছিলাম যে এরা এ জাতীয় অপরাধ করে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা নষ্ট করে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নকেই ধ্বংস করছেন। আজ নিজের লেখা সেসব কথা ফিরে দেখলে মনে হচ্ছে, নিতান্ত মূর্খের মতো আমি বা আমরা ব্যক্তি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সদিচ্ছায় আস্থা রেখেছিলাম তাঁর দলের যাবতীয় অনাচার সত্ত্বেও। হাসপাতালে ঢোকার মুখে বানিয়ে তোলা বিশাল ফটকগুলোর চটক দেখে আমাদেরও চোখ ধাঁধিয়েছিল নাকি? তা নয়, রাজ্যবাসী হিসেবে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষিত প্রকল্প এবং ফেরি করা স্বপ্নগুলোতে আস্থা রাখা উচিত মনে করেছিলাম। মাননীয়া সেই নাগরিক সদিচ্ছার মূল্য দিলেন না।
পড়ুন — এ বড় সুখের সময় নয়
এই মুহূর্তে পরিস্থিতি এতটাই জটিল এবং অগ্নিগর্ভ যে সেই বিষয়ে শান্তভাবে গুছিয়ে প্রবন্ধ লেখা প্রায় অসম্ভব। কতগুলো জরুরি কথা সংক্ষেপে অগোছালোভাবে বলার চেষ্টা করছি৷ প্রথমেই একটা কথা বলি, সমস্যাটা শুধুমাত্র চিকিৎসকদের নয়। অনেক বুদ্ধিজীবী নির্দিষ্ট অভিসন্ধিবশত একে ডাক্তার বনাম রোগী লড়াইয়ের চেহারা দিতে চেষ্টা করছেন। তাঁদের চিনুন। তাঁদের রাজনৈতিক পরিকল্পনা বুঝতে চেষ্টা করুন। যা চলছে, তা গৃহযুদ্ধ। সাধারণ মানুষ (ডাক্তারেরা যার অংশ) বনাম রাজনৈতিক মদতপুষ্ট সংগঠিত সশস্ত্র গুণ্ডাবাহিনীর লড়াই, যেখানে একপক্ষ নিজেরা বিভাজিত হয়ে মার খাচ্ছে, অপরপক্ষ মনের সুখে মেরে যাচ্ছে। ওদিকে কিছু তৃতীয় ও চতুর্থ পক্ষ এরই মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ফায়দা তোলার অপেক্ষায় আছে।
সাম্প্রতিক ঘটনা পরম্পরার দিকে সংক্ষেপে তাকানো যাক একবার। তার আগে আরও সংক্ষেপে প্রেক্ষাপটটুকু।
চিকিৎসক নিগ্রহ বহুদিন ধরেই চলছিল ছোট বড় মাপে। সঙ্গে চলছিল প্রায় তিন দশক ধরে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে লোক খ্যাপানোর কাজ। এই লোক খ্যাপানো, স্বাস্থ্যসেবা থেকে সরকারের হাত তুলে নেওয়া, বেসরকারি হাসপাতালের শ্রীবৃদ্ধি… এসব যে হাত ধরাধরি করে চলেছে এবং চিকিৎসার দায়িত্ব সরকারের কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলা তথা এর নিয়ন্ত্রণ চিকিৎসকের হাত থেকে উচ্চবিত্ত ব্যবসায়ীর হাতে স্থানান্তরিত করার জন্যই যে এই সুদীর্ঘ রাজনৈতিক প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছিল, তা আগে বিস্তারিতভাবে লিখেছি। সরকারি চিকিৎসার পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং জনস্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয় বৃদ্ধির দাবিতে যেহেতু চিকিৎসককুল বহুকাল ধরে সোচ্চার, তাই সরকারের সঙ্গে চিকিৎসকদের সংঘাত পুরনো। যেহেতু চিকিৎসকদের সঙ্গে রোগীদের একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার চল ছিল এবং চিকিৎসকেরা রোগীর পক্ষে দাঁড়ানোর ফলে সাধারণ রোগীদের বোকা বানিয়ে অবহেলা করতে সরকারের অসুবিধে হচ্ছিল, তাই জনমানসে চিকিৎসকদের ভিলেন বানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এক প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রশান্ত শূরের সময় থেকে চিকিৎসকদের গণশত্রু হিসেবে দেগে দেবার প্রকল্পটি স্পষ্ট হতে থাকে। তবু পূর্বতন সরকারের আমলে এই বিষয়ে কিছু রাখঢাক ছিল এবং সরকার পক্ষের সব লোক স্বাস্থ্যব্যবস্থাটিকে সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ করার ব্যাপারে একমত ছিলেন না। ফলে জোড়াতালি দিয়ে পরিষেবাটি চলছিল এবং চিকিৎসকদের সঙ্গে সরকারের টানাপোড়েন চললেও তা সর্বদা প্রকাশ্যে আসত না, বড় সমস্যাগুলো মিটিয়ে নেবার চেষ্টা হত।
বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এই তৈরি জমিটাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। তিনি জানতেন যে বেহাল স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে জনগণের মনে ক্ষোভ আছে। অতএব সব দোষ ডাক্তারের ওপর চাপিয়ে দিতে পারলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। মানুষ পরিষেবা না পেয়ে সরকারকে দুষবে না এবং চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কামান দাগলে তাঁর জনহিতৈষী ইমেজ তৈরি হবে। এই কারণে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিজের ইমেজ তৈরির অভিযান শুরু করেন অকারণে বাঙুর ইন্সটিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেসের তৎকালীন প্রধান অধ্যাপক শ্যামাপদ গড়াইকে তাড়িয়ে। আজ যাঁরা ধর্মঘটের ফলে মানুষের সমস্যা নিয়ে চিন্তিত, তাঁরা অবশ্যই সঠিক চিন্তা করছেন। সেই তাঁরা একবার খোঁজ নিয়ে দেখুন অধ্যাপক গড়াইয়ের মতো দক্ষ সার্জনের বিতাড়নের ফলে কত জটিল অস্ত্রোপচার আটকে গিয়েছিল, কত রোগীকে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে। যেদিন মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে আচমকা ডেকে পাঠান, সেদিন তাঁর আটটি অপারেশন ছিল। আটখানা নিউরোসার্জারি একদিনে। তাও সরকারি হাসপাতালে একজন চিকিৎসক করছেন। ভাবুন। তাহলেই বুঝতে পারবেন ডাক্তারেরা কতটা ফাঁকি দেয়।
পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তন হল, যখন ২০১৭র মার্চে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী চিকিৎসক ও হাসপাতালগুলির বিষয়ে তাঁর ঐতিহাসিক বৈঠকটি করলেন। টেলিভিশনে ডাক্তারদের বেজায় ধমক দিয়ে তিনি জনগণের চোখে মেসিহা হতে চাইলেন। তাঁর ধারণা হল স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রকৃত উন্নতি করতে যে পরিকল্পনা, পরিশ্রম ও খরচ প্রয়োজন, তা এড়িয়ে ডাক্তারদের ধমকে তিনি বহুসংখ্যক ভোটারকে নিজের দিকে টেনে নিতে পারবেন। এই সহজ পদ্ধতিটা অন্যান্য শাসকেরাও অবলম্বন করেছেন, কিন্তু তাঁরা সোনার ডিম পাড়া হাঁসটিকে বাঁচিয়ে রেখে রোজ একটি করে ডিম সংগ্রহ করতেন। শ্রীমতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের তাড়া ছিল। তিনি হাঁসটিকে মেরে একবারে সবকটা ডিম বের করে নিতে চাইলেন। টিভিতে যাঁরা তাঁর হম্বিতম্বি দেখে মুগ্ধ হয়ে আবার ভোট দেবেন বলে ঠিক করলেন, তাঁরা ভাবলেন জননেত্রী চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দিচ্ছেন। তাঁরা দলে দলে বেরোলেন ডাক্তারদের শায়েস্তা করতে। অগুন্তি ভয় দেখানো বা গালিগালাজের হিসাব ধরছি না, গত দুই বছরে এই রাজ্যে আড়াইশ’র বেশি শারীরিক নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বিরুদ্ধে, সাথে হাসপাতাল ভাঙচুর। আইনের চোখে এসবই জামিন-অযোগ্য অপরাধ, অন্তত তিন বছর কারাদণ্ড বাঁধা, কিন্তু আজ অব্দি মাত্র পাঁচজন সামান্য শাস্তি পেয়েছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রেপ্তার এড়াতে পেরেছেন অপরাধীরা। সরকার তাঁদের ভরসা জুগিয়েছে মনের আনন্দে ডাক্তার পেটালেও কোনও শাস্তি হবে না। চিকিৎসকদের সংগঠন বারবার ডেপুটেশন দিয়েছে। একবার মুখ্যমন্ত্রী বৈঠক করলেন, বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি দিলেন এবং কোনও কথাই রাখলেন না। এভাবেই ভোটার সংখ্যা বাড়িয়ে ফেলার ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত ছিলেন। এই পর্বে উল্লেখ করা যাক, সেদিন তাঁর গর্জন শুনে যাঁরা ডাক্তার পেটানোর উৎসাহ পেয়েছিলেন, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে তাঁদের অনেকেই নীল সাইকেলে চেপে গেরুয়া পদ্মে ছাপ মেরে বাড়ি ফিরেছেন। ফলাফল তেমনই ইঙ্গিত দেয়। সোনার ডিম দেওয়া হাঁসটা মরে গেছে।
সরকারের তরফে চিকিৎসকদের ওপর অত্যাচার, যা আগেও ছিল, তা এই ক’বছরে অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। পুরনো সব ঘটনা ভুলে ‘এনআরএস কাণ্ডে’র ঠিক আগের একটিমাত্র ঘটনার উল্লেখ করি। সরকারের অত্যাচারে সদ্য মারা গেলেন এক শিক্ষক চিকিৎসক। তিনি গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় আকুলভাবে বাড়ির কাছাকাছি বদলি অথবা ভলান্টারি রিটায়ারমেন্ট চাইছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য দপ্তর তাঁকে ল্যাজে খেলানোর সিদ্ধান্ত নেয়। হেনস্থা চলতে থাকে। আটকে রাখা টাকা-পয়সা না পেলে পরিবার খাবে কী, এই চিন্তায় তিনি অনেক দূরে এসে ডিউটি করতে থাকেন এবং বারবার পড়ে যেতে থাকেন। এইভাবে পড়তে পড়তে, ধুঁকতে ধুঁকতে তিনি যখন কোমায় আচ্ছন্ন, কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র তাঁর জীবনের নিয়ন্ত্রক, তখন স্বাস্থ্য দপ্তর তাঁর মেডিক্যাল পরীক্ষা করিয়ে তাঁকে আনফিট ঘোষণা করেন। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তিনি চাকরি, পরিবার সবকিছু ছেড়ে আমলা-মন্ত্রীদের নাগালের বাইরে চলে যান। এই ঘটনাটুকু থেকে বোঝা যায় সরকার চিকিৎসকদের প্রতি কেমন আচরণ করে এবং সরকারের প্রতি চিকিৎসকদের মনোভাব কেমন হতে পারে। এছাড়াও কারণে অকারণে মেডিকেল কাউন্সিল বা নবগঠিত মেডিকেল কমিশনে চিকিৎসকদের ডেকে সারাদিন বসিয়ে রাখা, ধমকানো, নানাভাবে হেনস্থা করে এবং ভয় দেখিয়ে রাজনৈতিক আনুগত্য আদায়ের চেষ্টা, রাজনৈতিক চাপের কাছে মাথা নত না করলে বেআইনিভাবে একাধিক চিকিৎসকের রেজিস্ট্রেশন কেড়ে নেওয়া (যার জন্য মাননীয় উচ্চ ন্যায়ালয় রাজ্য সরকারকে ভর্ৎসনা করেছেন), মানুষের চিকিৎসা রুখে কুকুরের ডায়ালাইসিস (যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে সরকারের কোপে পড়েন ডাক্তারেরা), মেডিকেল কাউন্সিলের নির্বাচন লুঠ করার চেষ্টা, জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় তৈরি সরকারি হাসপাতাল ধনকুবের ব্যবসায়ীর হাতে তুলে দেবার চেষ্টা (যা চিকিৎসক-সরকার সংঘাতের আরেক কারণ)… এরকম নানাবিধ অন্যায় অত্যাচার নিয়মিত চলছিল।
পড়ুন — ধায় রাত্রি
এমত পরিস্থিতিতে ১০ই জুন নীলরতন সরকার হাসপাতালে এক পঁচাশি বছর বয়সী গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তির মৃত্যু হল। সব মৃত্যুই দুঃখের, তা সে একশ বছরের ক্যান্সার রোগীর হলেও, কিন্তু কঠিন সত্য এই যে, সব মৃত্যু প্রতিরোধ করা যায় না৷ বৃদ্ধের মৃত্যুর পর শুরু হল তাঁর পরিচিতদের হৈচৈ, গালিগালাজ, ঠেলাঠেলি। এই পর্যন্ত ব্যাপারটা এত নিয়মিত হয়ে গেছে যে চিকিৎসকেরা আজকাল নালিশও করেন না। এরপরে যা ঘটল, তা ভয়াবহ। দুটো লরি বোঝাই করে শ’দুয়েক সশস্ত্র গুণ্ডা হাসপাতালে এসে তাণ্ডব শুরু করল। প্রহরারত পুলিশ বা আধ মিনিট দূরত্বের এন্টালি থানা কাউকে বাধা দিল না। গুণ্ডারা উন্মত্তের মতো ডাক্তার ও ছাত্রদের মারতে লাগল। ছেলেমেয়েরা আচমকা আক্রান্ত হয়ে প্রাণে বাঁচার জন্য প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলেও অতজন প্রশিক্ষিত ক্রিমিনালের সঙ্গে পেরে ওঠা সম্ভব ছিল না। দুজন জুনিয়র চিকিৎসককে গুরুতর আহত করে, অন্যদের বিধ্বস্ত করে অপরাধীরা বিদায় নেয়। হত্যার উদ্দেশ্যে পরিবহ মুখোপাধ্যায় নামে এক তরুণ চিকিৎসকের মাথার খুলি ভারি অস্ত্র দিয়ে ভেঙে গর্ত করে হাড়ের টুকরো ঘিলুর মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এতটা তোড়জোড় করে মারার পরেও অভিজ্ঞ নিউরোসার্জন অস্ত্রোপচার করে তাঁকে বাঁচিয়ে ফেলবেন, তা আততায়ীরা কল্পনা করতে পারেনি। মৃত্যু নিশ্চিত ধরে নিয়ে তারা হৃষ্টচিত্তে ফিরে যায়। স্বাভাবিক নিয়মে চললে আক্রমণকারীরা ফিরে গিয়ে নিশ্চিন্তে গল্পগাছা করতে পারত কে কজন ডাক্তার পেটাল, কিন্তু এবার একটু বড় মাপের আন্দোলন শুরু হল। তার ফলে চাপে পড়ে পুলিশকে কিছু করতেই হত। দু’শ গুণ্ডার মধ্যে জনা পাঁচেককে গ্রেপ্তার করা হল। শোনা যাচ্ছে মূল চক্রীদের না ধরে সঙ্গে আসা দুজনকে ধরা হয়েছে। কিছু সংবাদে প্রকাশ পাচ্ছে, আক্রমণটি পূর্বপরিকল্পিত এবং এর পিছনে গভীর উদ্দেশ্য ছিল। তা নিয়ে পুলিশ তদন্ত করার অনুমতি পাবে কিনা, তা সময়ই বলবে।
এই ঘটনাটি ঘটে যাবার ফলেই কি এতবড় আন্দোলন হল? তা নয়। আন্দোলন বড় হল সরকারের অসহনীয় নেতিবাচক মনোভাবের ফলে। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী যদি ঘটনাটি সম্বন্ধে প্রতিক্রিয়া দিতেন, আক্রমণের নিন্দা করতেন, আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেবার কথা অন্তত মুখে বলতেন, সন্তানতুল্য আহত ও মৃতপ্রায় ছেলেটিকে একবারও দেখতে যেতেন, তাহলে সকাল হবার আগেই কর্মবিরতি উঠে যেত। কিন্তু তিনি তা করলেন না। বদলে এমন কিছু কাজ করলেন, যা অবিশ্বাস্য এবং নিষ্ঠুরতায় অতুলনীয়। এগুলো খেয়াল না করলে আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হবার কারণ বোঝা যাবে না।
মুখ্যমন্ত্রী (যিনি একইসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) প্রথমে নির্বিকার থেকে সকলের ধৈর্যের পরীক্ষা নিলেন। পরে মুখ খুলে ভয়াবহ কিছু কথা বললেন। তিনি চিকিৎসা পরিষেবার মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টি করার চেষ্টা করলেন, যা অকল্পনীয়। আক্রমণকারীদের পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে বিজেপি রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু চিকিৎসকেরা সমবেতভাবে তা প্রতিরোধ করেছেন। এটা জানার পরেও একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এতবড় গর্হিত কাজ করতে পারেন, তা প্রত্যক্ষ দেখে এবং শুনেও বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। এছাড়া তিনি চিকিৎসক ও ছাত্রদের বহিরাগত বললেন, তাঁদের সম্বন্ধে একের পর এক অপমানজনক কথা বললেন, হস্টেল থেকে বের করে দেবেন ইত্যাদি বলে হুমকি দিলেন। যে প্রতিশ্রুতিগুলো চাওয়া হচ্ছিল, সেগুলো দিতে অস্বীকার করলেন। হাসপাতাল সিকিউরিটি দিতে পারবে না, চিকিৎসা করতে এলে কাশ্মির সীমান্তের সেনা জওয়ানের মতো গুলি খেয়ে মরতে হবে এবং সহকর্মীর মৃত্যু বিনা প্রতিবাদে মেনে নিতে হবে বলে জানালেন। স্পষ্টতই তিনি চিকিৎসক ও রোগীদের দুই যুযুধান শত্রুপক্ষে পরিণত করার উদ্দেশ্য নিয়েই বক্তৃতাটি দিলেন। চিৎকৃত ভাষণের মধ্যে শুধুই চিকিৎসকদের প্রতি বিষোদগার এবং ভীতিপ্রদর্শন। আক্রমণকারীদের প্রতি দরাজ গলায় কোনও হুমকি শোনা গেল না, অর্থাৎ তিনি গুণ্ডাদের আবারও নৈতিক সমর্থন দিলেন। যেহেতু দুই বছর আগে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে তাঁর বহুল প্রচারিত রণহুঙ্কারের পরেই গুণ্ডামি মাত্রা ছাড়িয়েছে, সেহেতু তাঁর নৈতিক কর্তব্য ছিল বিপরীত হুঙ্কার দিয়ে তাতে রাশ টানা। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে তাঁর কাছে সেই ভুল শোধরানোর সুবর্ণ সুযোগ ছিল। একবার জোর গলায় বলতে হত, “এসব বরদাস্ত করব না। নার্স ডাক্তারের গায়ে হাত তুললে সবাইকে জেলে ভরব।” তাতে গুণ্ডামির সংখ্যা বা বীভৎসতা কিছু কমার সম্ভাবনা থাকত। অন্তত আন্দোলনটি প্রত্যাহার করে চিকিৎসা পরিষেবা পুনরায় চালু করার একটা সুযোগ পাওয়া যেত। মুখ্যমন্ত্রী সেই পথে গেলেন না। অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় তিনি বিষয়টিকে আরও জটিল করে দিয়ে গেলেন, যাতে চিকিৎসকেরা চাইলেও আন্দোলন তুলে নিতে না পারেন।
এর পাশাপাশি সরকারি মদতপুষ্ট গুণ্ডা ও ক্যাডারেরা যা করছে এই কদিন ধরে, তা অভূতপূর্ব। একাধিকবার পাথর, হকিস্টিক নিয়ে এনআরএস আক্রমণ করার চেষ্টা হল। চিত্তরঞ্জন হাসপাতালেও ঢিল মেরে চিকিৎসকের মাথা ফাটানো হল। মালদা মেডিকেল কলেজের অবস্থানরত চিকিৎসক ছাত্রদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী। অবাধে চলল বেধড়ক মারধর। মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদেও হয়েছে সংগঠিত আক্রমণ।
বর্ধমান মেডিকেল কলেজে আউটডোর বন্ধ রেখে ইমার্জেন্সি চালু রাখার চেষ্টা হচ্ছিল। সেই চেষ্টা ব্যর্থ করতে আউটডোরের সব রোগীকে ইমার্জেন্সিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হল কৌশলে। ওইটুকু জায়গায় হাজারের ওপর মানুষ ঢুকে পড়লে পদপিষ্ট হয়েই অনেকে মারা যাবেন, গুরুতর অসুস্থ রোগীকে খুঁজে পাওয়াই হবে অসম্ভব, চিকিৎসা তো পরের কথা। অগত্যা বলা হল যে শুধু গুরুতর অসুস্থ রোগীদেরই ঢুকতে দেওয়া হবে। অদ্ভুতভাবে কিছু সংবাদ চ্যানেল প্রচার করা শুরু করল যে ইমার্জেন্সি প্রায় বন্ধ, কারণ গুরুতর অসুস্থ রোগী ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না! অথচ ইমার্জেন্সি মানে তো আপতকালীন বা জরুরি পরিষেবা। সেখানে তো শুধুমাত্র খারাপ রোগীদেরই চিকিৎসা হবার কথা। এই সহজ প্রশ্নটা সাংবাদিক বা দর্শক কাউকে বিব্রত করল না। ওদিকে এই গোলমালের সুযোগে শুরু হল ভয়াবহ আক্রমণ। কর্তব্যরত চিকিৎসকদের লক্ষ্য করে অবিরাম ইট বৃষ্টি, যাতে সকলে ইমার্জেন্সি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। পাথর মেরে এক ছাত্রের মাথা ফাটানোর পর লাঠি, পিস্তল, অ্যাসিডের বোতল হাতে হাসপাতালের দখল নিল গুণ্ডাবাহিনী। মেয়েদের হস্টেলের জানালা ভেঙে প্যান্ট খুলে শিশ্ন উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রইল বীরপুঙ্গব। অবিশ্রান্ত গালিগালাজের সঙ্গে লাগাতার হুমকি, নাগালের মধ্যে পেলেই ধর্ষণ করে দেওয়া হবে। যাতে এই মহিলা চিকিৎসকেরা কোনওমতেই হস্টেল ছেড়ে বেরিয়ে কাজে যোগ দিয়ে জরুরি পরিষেবা চালু করতে না পারেন, সেটা নিশ্চিত করার জন্যই এই বর্বরোচিত আক্রমণ। সিনিয়রদের তরফ থেকে আমরা বারবার সবাইকে বলছিলাম ইমার্জেন্সি চালু রাখতে, কিন্তু এসব ঘটনার পর আর জুনিয়র চিকিৎসকদের সেকথা জোর দিয়ে বারবার বলার মুখ আমাদের রইল না এবং সত্যিই বেশ কিছু হাসপাতালে জরুরি পরিষেবা অন্যান্য দিনের চেয়ে ঢিমে হয়ে পড়ল।
বর্ধমান ডেন্টাল কলেজের এক ছাত্র যাচ্ছিল এটিএম থেকে টাকা তুলতে। তাকে প্রশ্ন করা হল ডাক্তার কিনা। সে “হ্যাঁ” বলতেই তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে মেরে মুখ ফাটিয়ে দেবার পাশাপাশি চোখ গেলে দেওয়া হল। তার একটি চোখ চিরতরে নষ্ট হয়ে গেছে। মুখ্যমন্ত্রী হস্টেল খালি করে দেবার হুমকি দেবার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে গেল সেই হুমকিকে কাজে পরিণত করার প্রচেষ্টা। সেই চেষ্টা অতি নৃশংস। ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের লিন্টন হস্টেলের ছাত্রেরা যখন ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন মাঝরাতে তাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল যাতে সকলে পুড়ে মরে। সেদিন বৃষ্টি হবার ফলে ছাত্রেরা প্রাণে বেঁচে গেল, কিন্তু পুড়ে গেল তাদের জামাকাপড়, বইপত্র, সার্টিফিকেট ইত্যাদি সবকিছু।
ঘটনার বিবরণ দীর্ঘ করছি না। বুঝতেই পারছেন যে শুধুমাত্র এনআরএসের প্রথম আক্রমণটির কারণে আন্দোলন এতদূর গড়াচ্ছে না। রাজ্য সরকার এবং ক্ষমতাসীন দল চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে রীতিমতো হিংস্র যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, যার ফলে আন্দোলন তুলে নিয়ে পিছিয়ে যাওয়া এখন সকলের কাছে নিশ্চিত মৃত্যুকে মেনে নেবার সমতুল্য হয়ে গেছে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে বর্ষীয়ান শিক্ষক চিকিৎসকেরা পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলি থেকে দলে দলে পদত্যাগ করা শুরু করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের আক্রান্ত চিকিৎসকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন সারা ভারতের চিকিৎসকেরা। সারা ভারত জুড়ে পালিত হয়েছে প্রতিবাদ দিবস এবং একদিনের কর্মবিরতি। দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেসেও পালিত হয়েছে একদিনের কর্মবিরতি। সেখানকার চিকিৎসকেরা এখন মাথায় ব্যান্ডেজ় বেঁধে কাজ করছেন এবং পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে আন্দোলনরত চিকিৎসকদের দাবি না মানলে তাঁরা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করবেন। বিদ্বজ্জন এবং শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সাধারণ মানুষও এবার চিকিৎসকদের দাবিগুলির সমর্থনে গলা মিলিয়েছেন, পথে নেমেছেন। ১৪ই জুন শুক্রবার বিকেলে কোলকাতার রাস্তায় বেরিয়েছিল চিকিৎসক রোগীর সম্মিলিত মহামিছিল। হাজার দশেক মানুষ উদাত্ত কণ্ঠে স্লোগান দিতে দিতে হেঁটেছেন সাত মাইল পথ। রাস্তার দুপাশে ভিড় করে নগরবাসী সসম্ভ্রমে দেখেছেন সেই পদযাত্রা।
আন্দোলনকারীদের দাবিগুলো কী? খুবই সামান্য দাবি। হাসপাতালে নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করতে হবে এবং রোগীদের জন্য চিকিৎসার পরিকাঠামো উন্নয়নে মন দিতে হবে। দুটো দাবিই এতটা সহজ, যৌক্তিক এবং মানবিক যে তা মেনে নিতে আটচল্লিশ ঘণ্টা কেন, আটচল্লিশ মিনিটও লাগার কথা নয়। তবু মুখ্যমন্ত্রী নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। তিনি বিভিন্ন জায়গায় সভা করবেন, ডাক্তারদের বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যমে বক্তব্য রাখবেন, কিন্তু কিছুতেই এনআরএসে যাবেন না, সরাসরি জুনিয়র চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলবেন না, কিছুতেই তাঁদের নিরাপত্তার আশ্বাস দেবেন না এবং পরিকাঠামো উন্নয়নে রাজি হবেন না। এই প্রতিজ্ঞার কারণ কী? অনেকেই মুখ্যমন্ত্রীকে মানসিকভাবে অসুস্থ বলছেন দেখলাম। এটা নিয়ে কিছু আপত্তি নথিভুক্ত করি। প্রথমত, কোনও মানুষকেই পাগল বলে গালি দেবার বিরুদ্ধে আমার নৈতিক আপত্তি আছে। এতে মানসিক রোগীদের অপমান করা হয়, অথচ তাঁরা সমাজের কোনও ক্ষতি করেন না। দ্বিতীয়ত, মুখ্যমন্ত্রীর কুকাজের সমালোচনা অবশ্যই করব, কিন্তু তাঁকে কুৎসিত গালিগালাজ করব না, এটা আমাদের নীতি। ব্যক্তি মানুষটি যেমনই হন, সাংবিধানিক পদটির মর্যাদা রক্ষা করা কর্তব্য। যেহেতু মুখ্যমন্ত্রী নিজে সেই পদটির মর্যাদাহানি করছেন, তাই আমাদেরই দায়িত্ব নিয়ে সেই মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। তৃতীয়ত, মুখ্যমন্ত্রী আদৌ অসুস্থ নন। তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। অবশ্যই অতিরিক্ত দম্ভ আর ক্রোধ তাঁর দুটি অজেয় রিপু, যা কালক্রমে তাঁর বিনাশের কারণ হবে এবং এই ঘটনাপরম্পরায় তাদের ভূমিকা প্রকট। তবে এছাড়াও অত্যন্ত কুটিল রাজনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছেন। ফাঁদ পেতে শিকারের অপেক্ষায় আছেন। একটু পরে এর ব্যাখ্যা দিচ্ছি। তার আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া যাক, যা এই আন্দোলনের বিরোধী এবং আপাত সমর্থক অনেকেই তুলছেন।
পড়ুন — ব্রাহ্মমুহূর্ত
১) প্রশ্ন: চিকিৎসকেরা কি সব ধোয়া তুলসীপাতা?
উত্তর: না, একদমই না। তবে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অন্তত চার জায়গায় নালিশ জানানোর সুযোগ আছে। কোনও পেশায় সকলে সৎ বা সকলে অসৎ হন না। সকলে ধোয়া তুলসীপাতা নয় বলে কোনও চিকিৎসকের নিরাপদে কাজ করার অধিকার থাকবে না, এই দাবিটি গণতান্ত্রিক নয়।
২) প্রশ্ন: একটা মারামারির ঘটনার জেরে এত প্রতিবাদের কী আছে?
উত্তর: একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পূর্ববর্তী ঘটনাগুলোর পরিসংখ্যান আগেই দেওয়া আছে। এবারেও দীর্ঘ আন্দোলন যে সরকারি অত্যাচারের ফলে, তারও ব্যাখ্যা দিয়েছি।
৩) প্রশ্ন: প্রথমেই কর্মবিরতি কেন? অন্য পথ ছিল না?
উত্তর: প্রথমেই কর্মবিরতি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে বহুবার মার খেয়ে নানাভাবে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। রোগীদের চিকিৎসা ঠিকমতো দিতে না পারার বেদনাতেও নানাভাবে প্রতিবাদ হয়েছে। ফল হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী আগে কিছু আশ্বাস দিয়েছিলেন, কিন্তু কথা রাখেননি। এসব কথা আপনারা জানেন না, কারণ চিকিৎসকদের সমস্যাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেননি বলে খোঁজ রাখেননি। সংবাদপত্রগুলিও যথাসম্ভব চেষ্টা করেছে ঘটনাগুলোকে ধামাচাপা দিতে। যদি অন্যরকম হত? যদি মুখ্যমন্ত্রী কথা রাখতেন অথবা আপনারা আগেই চিকিৎসকদের পাশে দাঁড়াতেন, তাহলে এতদিনে আপনাদের চিকিৎসার মানও উন্নত হত আর এরকম আন্দোলনও হত না।
৪) প্রশ্ন: সেনা জওয়ান বা পুলিশ আহত হলে তো তাঁরা ধর্মঘট করেন না। তাহলে ডাক্তারেরা মার খেয়ে কান্নাকাটি করবে কেন?
উত্তর: সৈনিক বা পুলিশ যাদের হাতে আহত হন, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক শত্রুতার। সেনা জওয়ানকে আঘাত করতে গেলে তিনি আক্রমণকারীদের মেরে ফেলবেন। পুলিশকে আঘাত করলে তিনি আক্রমণকারীদের গ্রেফতার করবেন বা পেটাবেন অথবা ক্ষেত্রবিশেষে মেরেও ফেলতে পারেন। চিকিৎসকেরা যাঁদের হাতে নিয়মিত আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁদের সঙ্গে কখনওই এরকম কিছু করতে পারবেন না। চরম অভদ্র বা হিংসাশ্রয়ী রোগী বা রোগীর পরিজনও তাঁদের শত্রু নন। যিনি চিকিৎসককে মারার চেষ্টা করছেন, চিকিৎসক তাঁকেই বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। এ বড় বিচিত্র সম্পর্ক ও সমীকরণ। একে যুদ্ধের সঙ্গে মিলিয়ে ফেললে অনর্থ হবে।
৫) যুক্তি: চিকিৎসকদের পেটানো সমর্থন করি না, কিন্তু অমুক ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করাতে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতা ভালো নয়। তমুক ডাক্তারের ফি অনেক।
উত্তর: অভিজ্ঞতা খারাপ হয়ে থাকতেই পারে এবং তা দুঃখজনক। তার জন্য ক্ষমা চাই। কিন্তু একটা কথা বোঝা দরকার। কোনও ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে যদি কেউ অত্যাচারিতা মহিলার জামাকাপড় নিয়ে আলোচনা করতে বসেন, তবে তিনি রেপ অ্যাপোলজিস্ট হিসেবে চিহ্নিত হবেন। গুজরাট বা মুজফফরনগরের দাঙ্গার প্রেক্ষিতে যদি বলতে বসি যে আমার ঠাকুরদা ঢাকা শহরের ভিটে থেকে উৎখাত হয়েছিলেন হিন্দু হবার অপরাধে, তবে বোঝা যাবে আমি প্রচ্ছন্নভাবে সাম্প্রদায়িক। তেমনি আজকের পরিস্থিতিতে যাঁরা এই কথাগুলো বেশি করে বলছেন, তাঁরা প্রকারান্তরে চিকিৎসক নিগ্রহের পক্ষে যুক্তি সাজাচ্ছেন। এসব খারাপ অভিজ্ঞতা নিয়ে অবশ্যই আলোচনা হওয়া উচিত, কিন্তু অন্য সময়ে অন্যভাবে।
৬) প্রশ্ন: চিকিৎসকদের পক্ষে কি আদৌ কর্মবিরতিতে যাওয়া সঙ্গত? রোগীর প্রাণের কী হবে?
উত্তর: এই প্রশ্নটি অতি জটিল। বহু বছর ধরে এটা নিয়ে ভেবে চলেছি। গণতন্ত্র অথবা বামপন্থার কোনওটায় কোনওভাবে যাঁরা বিশ্বাস রাখেন, তাঁরা মানেন যেকোনও শ্রমিকের অধিকার আছে প্রতিবাদ আন্দোলনে নামার এবং প্রয়োজন হলে ধর্মঘট করার। চিকিৎসকেরাও শ্রমিক, এক্ষেত্রে সরকারি চাকুরে এবং ন্যায্যত মিল শ্রমিক, ব্যাঙ্ক কর্মচারী বা শিক্ষকের মতো এসব রাজনৈতিক অধিকারগুলো তাঁদেরও আছে। কিন্তু অধিকার থাকলেই কি তা প্রয়োগ করা যায়? স্বাস্থ্যের অধিকারের কী হবে? উল্লেখ্য, চিকিৎসকেরাই বহুদিন ধরে দাবি তুলছেন যে স্বাস্থ্যকে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করতে হবে, কিন্তু আজও সংবিধানে স্বাস্থ্য মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত নয়। ওদিকে বিচার কিন্তু সংবিধানসম্মত মৌলিক অধিকার। অথচ একটি মারপিটের ঘটনার প্রেক্ষিতে আইনজীবীরা মাসাধিককাল ধর্মঘট করে বিচারব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ অচল করে দিয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে বিশেষ সমালোচনা চোখে পড়েনি।
অর্থাৎ কর্মবিরতির নৈতিক অধিকার চিকিৎসকদের আছে। তবু আজও ধর্মঘট করার ব্যাপারে আমরা স্বচ্ছন্দ হতে পারিনি। তার কারণ আমরাই ভেতরে ভেতরে দুর্বল। রোগীরাই আমাদের দুর্বলতা। ধর্মঘট বা ধরনায় বসে আমাদের প্রথমেই মনে হয় রোগীদের কী হবে? বিনা চিকিৎসায় কারও প্রাণ যেন না যায়। কিছু নিয়ম মেনে চলা হয়। অন্যান্য পেশার মতো চিকিৎসকেরা সব কাজ বন্ধ করে দেন না বা সবাই মিলে একসঙ্গে ধর্মঘট করেন না। জরুরি বিভাগ চালু রাখা হয়, ভর্তি থাকা রোগীদের চিকিৎসা চলতে থাকে, শুধু বহির্বিভাগ বন্ধ থাকে। জুনিয়র চিকিৎসকেরা ধর্মঘট করলে সিনিয়র চিকিৎসকেরা যথাসাধ্য পরিষেবা চালু রাখেন। এবার পরিস্থিতি এমনই যে তাঁরাও একেবারে ইস্তফা দিতে শুরু করেছেন।
হিপোক্রেটিক ওথটি নেবার পর থেকে রোগীর স্বার্থকেই আমরা বড় করে দেখেছি। বেশিরভাগ সময়ে ভেবে এসেছি যে সহজে কর্মবিরতিতে যাব না। ঘোষিত আন্দোলনের সময়েও ইমার্জেন্সি বা ইন্ডোর বিভাগে রাত জেগে পরিষেবা দিয়েছি। মোটের ওপর স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ধর্মঘটের বিরোধী ছিলাম, কিন্তু এবার এই চিকিৎসকদের কর্মবিরতিকে সমর্থন করতে বাধ্য হচ্ছি, কারণ সরকার এই নির্যাতিত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। এবারেও জরুরি পরিষেবা চালু রাখার ব্যাপারে আমাদের চিকিৎসক সংগঠনের তরফ থেকে স্পষ্ট নির্দেশ আছে, ইমার্জেন্সি খোলা রাখার চেষ্টাও হচ্ছে, এমনকি তাড়াতাড়ি সব পরিষেবা স্বাভাবিক করার কথাও ভাবা হচ্ছে, কিন্তু বিভিন্নভাবে বাধা আসছে ক্ষমতাসীন দলের কাছ থেকেই। রোগীদের অসুবিধার কথা ভেবে অন্তরে কাতর চিকিৎসকেরা যাতে কোনওমতেই তাড়াতাড়ি কাজে ফিরতে না পারেন, তা নিশ্চিত করতে সরকার ও গুণ্ডাবাহিনী একের পর এক উস্কানিমূলক কাজ করে চলেছে।
এখানেই প্রশ্ন, কেন এমন কাজ করা হচ্ছে। সহজ সমাধানযোগ্য সমস্যাকে অকারণে জটিল করা হচ্ছে কেন? উত্তর হল, পুরো সমস্যাটা সৃষ্টিই করা হয়েছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে। সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল প্রত্যাশা অনুযায়ী ভালো ফল করতে পারেনি। ভোটব্যাঙ্ক ভেঙেছে। শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর উত্থান হচ্ছে। এই অবস্থায় স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ব্যাপক সঙ্কট সৃষ্টি করে চিকিৎসকদের ভিলেন সাজিয়ে এবং ডাক্তার-বিজেপি যোগসাজশের গল্প ফেঁদে জনগণকে মারাত্মক খেপিয়ে তোলা, তাঁদের সংগঠিত করে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে একটি সত্যিকারের হিংসাত্মক অভ্যুত্থান ঘটানো এবং শেষে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে দারুণ কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে পরিস্থিতি সামলে জনমানসে শ্রদ্ধেয় হয়ে ওঠা এবং একইসঙ্গে ভাঙা ভোটব্যাঙ্ক গুছিয়ে নেওয়া… এই ছিল প্রাথমিক পরিকল্পনা। সেই উদ্দেশ্যে চিকিৎসকদের ক্রমাগত উস্কে কাজে ফিরতে না দেওয়া এবং সংবাদমাধ্যমে লাগাতার রোগীর অসুবিধা সংক্রান্ত প্রচার সমান্তরালভাবে চলতে থেকেছে। মুখ্যমন্ত্রীর উগ্র চিকিৎসকবিরোধী বক্তৃতাও আমজনতার মন জয় করার উদ্দেশ্যেই।
এই পরিকল্পনায় যা প্রত্যাশা করা হয়নি, তেমন কিছু ঘটনা ঘটে গেল এবার। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতা শুনে সাধারণ মানুষ এবার ততটা খুশি হলেন না। ট্রেনে-বাসে যেতে আমজনতার মুখে ওঁর নিন্দা শুনলাম এই কারণে। শিক্ষিত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ, শিল্পী, সাহিত্যিক, বিদ্বজ্জনেরা চিকিৎসকদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে সোচ্চার হলেন। সংবাদমাধ্যম যেমনই খবর করুক, অনেক সাংবাদিকও চিকিৎসকদের সমর্থন জানিয়েছেন। মিছিলের বিপুল কলেবর এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতি দেখে সরকার কিছুটা ভয় পেয়েছেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ধুরন্ধর মস্তিষ্ক নতুন পথ বের করে ফেলেছেন। সরকারের কয়েকজন বর্ষীয়ান চিকিৎসকদের মাধ্যমে জুনিয়র চিকিৎসকদের প্রভাবিত করে আন্দোলন বন্ধ করানোর চেষ্টা হল। তা যখন সফল হল না, তখন মাননীয়া টিভি চ্যানেলে সুর নরম করে এমন আচরণ করলেন, যাতে তাঁকে অত্যন্ত গণতন্ত্রপ্রিয় এবং তরুণ চিকিৎসকদের অতি অবাধ্য মনে হয়। মুখ্যমন্ত্রী অপেক্ষায় আছেন… আন্দোলন আরও চলতে থাকলে মানুষের সমস্যা বাড়বে, তাঁদের বিরক্তি বাড়বে, তাঁরা তখন চিকিৎসকদেরই চাপ দেবেন আন্দোলন তুলে নিতে এবং চিকিৎসকেরা তা করতে বাধ্য হবেন। তাতে সরকারের বিজয় ঘোষিত হবে এবং সরকার ও তাঁদের দল অতঃপর চিকিৎসকদের ওপর যথেচ্ছ নির্যাতন চালাতে পারবেন।
পড়ুন — জনস্বাস্থ্য — অধিকার ও প্রাপ্তি
এই পরিকল্পনা সফল হবে কিনা, তা নির্ভর করছে সাধারণ মানুষের ওপর। যদি এমন হয় যে বিক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ নিজেদের সঙ্কটের প্রকৃত কারণ বুঝলেন এবং দলে দলে জমা হলেন নবান্নের চারপাশে! সব রাস্তা ভরে গেল লক্ষ লক্ষ বিক্ষুব্ধ মানুষে! পুলিশের হুমকি ছাপিয়ে যদি লক্ষ মানুষের স্লোগান ওঠে, “আমরা চাই স্বাস্থ্য, আমরা চাই সুবিচার, আমরা চাই নিরাপদ ও উন্নত হাসপাতাল!” যদি এমন হয়?
জনগণই প্রকৃত শক্তি। যদি তাঁরা ঢাল হয়ে দাঁড়ান, চিকিৎসকেরা আপ্রাণ পরিষেবা দিতে শুরু করবেন। যেকোনও মুহূর্তে কাজে যোগ দেবার জন্য তাঁরা উন্মুখ।
“দুটো লরি বোঝাই করে শ’দুয়েক সশস্ত্র গুণ্ডা হাসপাতালে এসে তাণ্ডব শুরু করল।” – দুটো লরিতে শ’দুয়েক গুন্ডা ! শ’দুয়েক সশস্ত্র গুন্ডা এসে আঘাত করল আধলা ইট ছুড়ে। সত্যি, কী বিচিত্র এই সব গুন্ডারা, এতটাই রোগা পাতলা যে, একএকটা লরিতে ১০০ জন এঁটে যায়, অস্ত্র হাতে এসে আধলা ছুড়ে আঘাত করে।