অতীতের সঙ্গে আলাপচারিতা: একটি প্রদর্শনী

শতাব্দী দাশ

 

‘উবাচ’। আসলে একটি ক্রিয়াপদ।

ব্রূ বা বচ্ ধাতু থেকে উৎপন্ন। ‘উবাচ’ শব্দের অর্থ— ‘বলেছিলেন’। একটি প্রদর্শনীর নাম ‘উবাচ’। তাতে আছে, বিশেষ কিছু নয়, শুধু দুই শতকের আটত্রিশ জন নারীর কিছু বাছাই করা উক্তি বা ‘কোট’। নিরাভরণ বাহুল্যহীন এক প্রদর্শনী। নানারঙের সুতির শাড়ির উপর আটত্রিশ জন মহিলার কোট, তাঁদের ছবিসহ৷ প্রত্যেকটি একেকটি পোস্টারের আকারে। এই হল প্রদর্শনীর থিম। এরকম এক প্রদর্শনী কি ‘বিশেষ’ হয়ে উঠতে পারে?

তা বিশেষ হয়ে উঠতে পারে বৈকি! যদি উক্তিগুলি বাছা হয় এমন সব মানুষের, যাঁরা সেভাবে ‘ক্যানন’ বা মূলধারায় কখনও স্থান পাননি— হয়ত লিঙ্গগত প্রান্তিকতার জন্য, হয়ত জাতি বা শ্রেণিগত প্রান্তিকতার জন্য৷ এক্ষেত্রে, বোঝাই যাচ্ছে, লিঙ্গগত প্রান্তিকদের জায়গা মিলেছিল এই প্রদর্শনীতে। রাখা হয়েছিল ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মহিলাদের উক্তি।

বললাম বটে, ‘ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ’। কিন্তু সাবিত্রী ফুলে বা কল্পনা দত্তকে আপনি প্রাসঙ্গিক স্কুল-পাঠ্য ইতিহাস বই-এর পাতায় আদৌ পাবেন না। উচ্চতর শিক্ষার বেশ কয়েকটা ধাপ অতিক্রম করলে এবং লিঙ্গরাজনীতি নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহ থাকলে, তবেই এঁদের হদিশ পাবেন। অথচ প্রদর্শনীতে এঁদের উক্তিসকল এমন সব মানুষদের সামনে তুলে ধরা হল, যাঁরা অনেকে এসেছেন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে, যাঁরা স্কুল-কলেজে পড়ছে, যাঁরা সংগ্রামী মহিলা হয়েও জানতেন না পূর্বজাদের কথা। অতীত আর বর্তমান যেন মিলেমিশে গেল। কারণ আটত্রিশ জনের যে উপলব্ধিগুলি বাছা হয়েছে, সেগুলি ব্যক্তিগত, আবার রাজনৈতিকও বটে৷

পোস্টার প্রদর্শনীটি ‘এবং আলাপ’ সংস্থার উদ্যোগে গোর্কি সদনে আয়োজিত হয়েছিল। পয়লা জুন থেকে পাঁচ জুন পর্যন্ত চলেছিল এই প্রদর্শনী। ব্যতিক্রমী নারীদের উদ্ধৃতি নিয়ে ‘উবাচ’ সিরিজটি এঁদের ‘এবং আলাপ’ ব্লগ-এও নিয়মিত প্রকাশিত হয়। এবার সেগুলিই পোস্টার আকারে এল। এল পোস্টকার্ড আকারেও।

বিংশ আর একবিংশ শতকের ভারতীয় নারী। পরাধীন ভারত আর স্বাধীন ভারতের নারী। সেই যখন উনিশ শতকের ভারতে নবজাগরণের ঢেউ, সেই যখন ইংরেজ তাড়ানোর লড়াই, সেই যখন চোরাগোপ্তা কমিউনিস্ট আন্দোলন— সেই সময় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত, কোন খাতে এঁদের ভাবনা বয়েছে? ঐতিহ্য নিয়ে, সমাজ নিয়ে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে? নিজের শর্তে নিজের জীবন বাঁচার চেষ্টা করতে গিয়ে কী কী বাধা পেরোতে হয়েছে এঁদের? নারী হিসেবে রাজনীতিতে অংশগহণ করতে গিয়ে কী অভিজ্ঞতা এঁদের? কিংবা নারী সাহিত্যিক হিসেবে? বা সমাজকর্মী হিসেবে? বা খেলোয়াড় হিসেবে? এঁদের বৈষম্যের কাহিনীর সঙ্গে একাত্ম বোধ করল প্রদর্শনীতে আসা বর্তমান। এঁদের লড়াই-এর আগুনে হাত সেঁকে নিল বিবেকানন্দ মহিলা কলেজের ছাত্রীটি বা লস্করপুর স্কুলের মেয়েটি। এখানেই প্রদর্শনীর সার্থকতা।

এই ‘উবাচ’-র তালিকায় আছেন স্বাধীনতা সংগ্রামী নারী। আছেন গণ আন্দোলনের নারীমুখ। আছেন কমিউনিস্ট আন্দোলন, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের নেত্রীরা। আছেন নানা ভাষার নারী সাহিত্যিক। আছেন বহু-নিন্দিত নারী-শিল্পীরা, যাঁদের সাধনা শুধু সঙ্গীত বা অভিনয় বা নৃত্য ঘিরেই আবর্তিত হতে পারেনি, বরং লড়তে হয়েছে সমাজের ভ্রূকুঞ্চনের বিরুদ্ধেও। আছেন সমাজকর্মী, সমাজসংস্কারকরা। আছেন খেলাধূলার পুরুষালি জগতে ভাগ বসানো মেয়েরা। বীণা দাস, কমলা দাশগুপ্ত, শান্তিসুধা ঘোষ, মণিকুন্তলা সেন, গীতা মুখার্জী, বাণী দাশগুপ্ত, নিবেদিতা নাগ, বিমলা মাজী, কল্পনা দত্ত, পার্বতীবাঈ ভোর, সুহাসিনী দাস, জাহানারা ইমাম, সৈয়দ মানোয়ারা খাতুন, সাবিত্রীবাই ফুলে, পন্ডিতা রমাবাঈ, বেগম রোকেয়া, রাসসুন্দরী দাসী, জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, শান্তা দেবী, রেণুকা রায়, মহাদেবী ভার্মা, অমৃতা প্রীতম, ইসমত চুঘতাই, বিনোদিনী নীলকণ্ঠ, রাধারাণী দেবী, সাধনা বসু, রেবা মুহুরি, জোহরা সেহগল, কেতকী দত্ত, রেবতী, বামা, তসলিমা নাসরিন, বেবী হালদার, মেরি কম, মিতালী রাজ, হিমা দাস, পিঙ্কি প্রামাণিক। সময়, পেশা, সামাজিক অবস্থান— সব দিক থেকেই এক বিস্তীর্ণ রেঞ্জ ধরা পড়েছে ‘উবাচ’ নির্বাচনে। ফলে প্রদর্শনী হয়ে উঠেছে এক চলচ্ছবি যেন। দৃশ্যের পর দৃশ্য। গল্পের পর গল্প। দশক বদলে যায়। স্থান বদলে যায়। চরিত্র বদলে যায়। লড়াই থেকে যায়। আমরা দেখি ১৯০৭-০৮ সালে পণ্ডিতা রমাভাই যে সুরে ধর্মশাস্ত্রে নারীবিদ্বেষের নিন্দা করেছেন, ১৯৪০ সালে শান্তিসুধা ঘোষের উক্তিতেও ঠিক একই প্রতিধ্বনি। আমরা দেখি, সাহিত্যিক হিসেবে বেশ কয়েক দশকের দূরত্বে দাঁড়ানো রাধারাণী দেবী, ইসমত চুঘতাই ও তসলিমা নাসরিন একইরকম স্বীকৃতিহীনতার গল্প শোনাচ্ছেন।

অ-সরকারি সমাজসেবী প্রতিষ্ঠান ‘এবং আলাপ’ আসলে ষোলো বছরের পুরনো এক অক্লান্ত সংস্থা। কলকাতা থেকে শুরু করে সুন্দরবন পর্যন্ত তাঁদের অনায়াস যাতায়াত। গৃহহিংসা, নারীশিক্ষা, লিঙ্গসচেতনতা প্রসার-নানা স্তরে তাঁদের কাজকর্ম৷ সেই সঙ্গে আছে একটি নিয়মিত ব্লগ। সেখানে লিঙ্গরাজনৈতিক আলোচনা হয় মূলত সহজবোধ্য বাংলা ভাষায়। সেখানে ‘শব্দজব্দ’-র মাধ্যমে কিছু পরিচিত, লিঙ্গ-রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক ইংরাজি শব্দের বাংলা মানে ও ব্যাখ্যা দেওয়া হয় (যেমন হোমোফোবিয়া, হেটেরোনরম্যাটিভিটি), কিংবা ‘আসল কথা’-তে ভাঙা হয় প্রচলিত মিথ, ‘স্কুলে জেন্ডার’ বিভাগে অংশগ্রহণ করেন শিক্ষকরা, ‘নজরে বিজ্ঞাপন’ অংশে বিজ্ঞাপনের লিঙ্গরাজনৈতিক কাটাছেঁড়া হয়, এবং ‘উবাচ’ সিরিজও প্রকাশিত হয়৷

এঁরা প্রতি বছর অন্য কিছু কর্মসূচি সহযোগে ‘লিঙ্গসাম্য সম্মান’ও প্রদান করেন। সেই ‘লিঙ্গসাম্য সম্মান’ দ্বিতীয় বছরে পড়ল। প্রদর্শনীর শুরুর দিনে ‘এবং আলাপ’ সম্মানিত করল দু’জন ব্যক্তি ও দু’টি প্রতিষ্ঠানকে। মুর্শিদাবাদের লস্করপুর হাইস্কুল। এই বিদ্যালয় এক মুচলেকা বা অঙ্গীকারপত্র লিখিয়ে নেয় ছাত্রী ভর্তির সময়— ক্লাস ফাইভে ছাত্রী ভর্তি করলে কোনওমতেই ক্লাস টুয়েলভের আগে তার পড়াশোনা ছাড়ানো যাবে না। সামান্য উদ্যোগ। অথচ এর মাধ্যমে এলাকায় নাবালিকা বিবাহ রোধ করতে এক বিরাট ভূমিকা পালন করছে স্কুলটি। প্রসঙ্গত, মুর্শিদাবাদ জেলা মেয়ে-পাচার ও নাবালিকা বিবাহের জন্য কুখ্যাত। প্রধান শিক্ষক ও সহশিক্ষকদের এই সদর্থক ভূমিকা তাই নিঃসন্দেহে সম্মানের দাবি রাখে। অন্যদিকে, বেহালার বিবেকানন্দ কলেজ ফর উইমেন। ক্লাসে উপস্থিতির ব্যাপারে কড়াকড়ি নিয়ম করার পর অধ্যক্ষা টের পেয়েছিলেন, খিদে চেপে শেষের দিকের ক্লাসগুলি করতে পারে না মেয়েরা। তাই তিনি ব্যক্তিগত অর্থ বিনিয়োগ করে কলেজে চালু করেন মিড ডে মিল। পরে অন্য অধ্যাপকরাও সেই তহবিলে টাকা দিতে থাকেন৷ গড়ে ওঠে কলেজ মিড ডে মিল ফান্ড। এই কলেজের ছাত্রীরা আসে শিরাকোল, ফলতা, ডায়মন্ড হারবার থেকে৷ তাদের কেউ কেউ টিফিন কিনে খেতে পারত না যাতায়াতের পয়সা বাঁচিয়ে। মিড ডে মিল চালু করায় বেড়েছে উপস্থিতির হার। তাঁরাও এই সম্মানের যোগ্য প্রাপক।

জেন্ডার স্টিরিওটাইপ ভেঙে এই পুরস্কারের প্রাপক হলেন আরও দুজন। অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসে ভারতের পরিচিত মুখ লিপিকা বিশ্বাস, যিনি সম্প্রতি আবার সংবাদের শিরোনামে এসেছেন একা সাইকেলে ইউরোপ-এর সাতটি দেশ ভ্রমণ করার সুবাদে। মেয়েদের জন্য পথঘাট আজও সুরক্ষিত নয়। অথচ লিপিকা সাইকেলে বিশ্বজয় করলেন। তিনি অনুপ্রেরণা।

এবং বিলকিস বেগম। তিনি পেশায় গাড়িচালক। বিলকিস গৃহহিংসার শিকার। আজাদ ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় ড্রাইভিং শিখে এখন পেশাদার ড্রাইভার। ছকভাঙা পেশা নির্বাচন ও ঋজুতার নজির স্থাপন করে পেয়েছেন অনেক সম্মান। পেলেন ‘লিঙ্গসাম্য সম্মান’-ও।

সম্মান জ্ঞাপন করলেন নবনীতা দেব সেন, অনীতা অগ্নিহোত্রী, বেবি হালদার এবং পিঙ্কি প্রামাণিক। প্রত্যেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে পরিচিত৷

আজ যখন লিঙ্গবৈষম্যে সরাসরি শীলমোহর লাগায় কেন্দ্রে ও রাজ্যে অধিষ্ঠিত দুটি দক্ষিণপন্থী দলই, যখন ‘বেটি বচাও বেটি পড়াও’-এর টাকা খরচ হয়ে যায় তোরণ নির্মাণে আর ‘রূপশ্রী প্রকল্প’ মেয়েদের বিয়ের টাকা জোগায়, তখন শহরের এক কোণে এই প্রদর্শনীতে অতীতের নারীদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় আমাদের আক্ষরিক পশ্চাদপসরণকেই প্রকট করে তোলে।

প্রদর্শনীতে ছিল আটত্রিশটির মধ্যে থেকে বাছাই করা কয়েকটি পোস্টার ও পোস্টকার্ড বিক্রির ব্যবস্থাও। পোস্টারগুলি স্কুল, কলেজ, অফিস বা ড্রয়িংরুমে ছড়িয়ে পড়ুক তাদের গল্পগুলি নিয়ে। এখনও তাদের পাওয়া যাবে ‘এবং আলাপ’-এর ঠিকানায়।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...