অচিরাংশু আচার্য
খবরে প্রকাশ, সম্প্রতি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক তফশিলি উপজাতি-ভুক্ত অধ্যাপিকাকে তাঁর জাতপাত তুলে অপমান ও হেনস্থা করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি কতিপয় ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষায় কম নম্বর দেওয়ার ফলে তারা অকৃতকার্য হয়েছে। তারা অধ্যাপিকার কাছে নম্বর বাড়ানোর দাবি তোলে। অধ্যাপিকা তাদের দাবি মেনে না নেওয়ায় তারা তাঁর জাত নিয়ে কটূক্তি করে এবং তাঁর বাড়ি পর্যন্ত কটূক্তি করতে করতে ধাওয়া করে। স্বাভাবিকভাবে সেই অধ্যাপিকা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং একরকম বাধ্য হয়েই ছাত্র-ছাত্রীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানায়। এই খবর জানাজানি হতেই, চার বিভাগীয় প্রধান এবং দুটি স্টাডি সেন্টরের ডিরেক্টরেরা ইস্তফা দেন। এরপর শিক্ষামন্ত্রীর হস্তক্ষেপে ও দোষী ছাত্র-ছাত্রীদের অভিযোগ প্রমাণ সাপেক্ষে কড়া আইনানুগ ব্যবস্থা নেবার আশ্বাস দেওয়ায়, বিষয়টির কিছুটা নিষ্পত্তি হয়। কিন্তু সত্যি-ই নিষ্পত্তি হল কি? আর কোনওদিন-ও কি সেই অধ্যাপিকাকে কটূক্তি করা হবে না? অভিযোগ প্রমাণিত হলে সত্যিই কি কোনও শাস্তি হবে?
জাতপাত তুলে অপমান করার অভ্যাস তো আমদের বহুদিনের। মুচি, মেথরদের তো আমরা নাম জিজ্ঞেস করি না। কারণ জানি সে নিম্নজাতের। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে যে জাতপাত নিয়ে নোংরামো হবে, তাও একজন মহিলা অধ্যাপিকা যিনি তাঁর নিজের চেষ্টায় সংগ্রাম করে চাকরি পেয়েছেন তাঁর বিরুদ্ধে, এটা মেনে নেওয়া যায় না।
সমাজে অবশ্য একটা ধারণা আছে যে সংরক্ষণ মানেই অকেজো বা অযোগ্য লোকের চাকরি। এই ধারণা ঠিক নয়, যদিও এর ব্যাতিক্রম হয়তো আছে। সংরক্ষিত পদে চাকরি পেলে প্রমাণ করতে হয় যে সে সেই পদের যোগ্য। নইলে তাঁর পক্ষে সেখানে টিকে থাকা মুশকিল। চাকরি হয়তো সে পেল, কিন্তু তারপর তাঁর দায়িত্ব নিজের কাজ দেখিয়ে তাঁর যোগ্যতা প্রমাণ করার। আলোচিত অধ্যাপিকা সেই যোগ্যতা দেখিয়েছেন। তিনি চাপের কাছে মাথা নত না করে নম্বর অকারণে বাড়াতে রাজি হননি। তাই তাঁর হয়রানি। জাতপাত নিয়ে তাঁকে খোঁটা। তাঁর কাছে তো অনেক সহজ ছিল বেশি নম্বর দিয়ে পাশ করিয়ে দেওয়া। সেটাই তো ছাত্র-ছাত্রীদের খুশি করত, ছাত্র-সংগঠনকে খুশি করত, সবাই খুশি থাকত। তাই না? আমরা তো এভাবেই সব কিছু মেনে নিয়েছি। তাই টিভির পর্দায় নেতা মন্ত্রীদের ঘুষ নিতে দেখলে, কিংবা মাধ্যামিক বা উচ্চ-মাধ্যামিকে এত ছাত্র-ছাত্রী ভুরি ভুরি নম্বর পাচ্ছে দেখলে আমরা প্রশ্ন করি না।
রবীন্দ্রনাথ জাতপাত-মুক্ত একটা পরিবেশ চেয়েছিলেন। আপন করেছিলেন শান্তিনিকেতন, যেখানে মুক্ত চিন্তা ভিন্ন অন্য কোনও কিছু গুরুত্ব পাবে না।
এই প্রসঙ্গে আদি ব্রাহ্মসমাজকে উপলক্ষ করে রবীন্দ্রনাথ যা বলেছেন তা সামগ্রিকভাবে সমাজ সম্পর্কে তাঁর সুগভীর ও সর্বার্থে মানবিক চিন্তনকে তুলে ধরে। এখন আধুনিক সমাজতাত্ত্বিকরা এবং নিম্নবর্গের ইতিহাসের রূপকাররা ‘Us’ আর ‘Them’ এই দুটি ধারণার কথা বারবার বলছেন। সব সময়ই রাষ্ট্রে, সমাজে, পরিবারে-প্রতিষ্ঠানে এই ‘অপর’ এর ভেদচিহ্ন আমাদের বিযুক্ত করছে। রবীন্দ্রনাথ একশো বছরেরও পূর্বে কী বলেছিলেন একটু দেখা যাক,
ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে যে মঙ্গলের ধারা প্রবাহিত হইতেছে তাহাকে পদে পদে “আমরা” ও “তোমরা” বাঁধের দ্বারা বিভক্ত করিয়া ধর্ম্মকে ও সাম্প্রদায়িক জয়পরাজয়ের আস্ফালনের সামগ্রী করিয়া অকারণে যাঁহারা কল্যাণকে বাধাগ্রস্ত করিয়া তোলেন তাঁহারা কেবলমাত্র ব্রাহ্ম নামটাকে গ্রহণ করিয়া উপবীতধারী অথবা অন্য কাহারও চেয়ে আপনাকে শ্রেষ্ঠ কল্পনা করিবার অধিকারী নহেন। তাঁহাদের ব্রাহ্ম নামই উপবীতের অপেক্ষা অনেক প্রবল ভেদচিহ্ন, এবং তাহার অহঙ্কারও বড় সামান্য নহে। অহঙ্কারের দ্বারা অহঙ্কারকে মথিত করিয়া তোলা হয়, সেই অহঙ্কারের বাধাই সকলের চেয়ে বড় বাধা এই কথা মনে নিশ্চয় জানিয়া সর্ব্বপ্রকার সাম্প্রদায়িক চাপল্যের মাঝখানে অবিচলিত থাকিয়া আমরা যেন এই প্রার্থনাকেই চিত্তের মধ্যে বিনম্রভাবে ধরিয়া রাখিতে পারি যে–
স নো বুদ্ধ্যা শুভয়া সংযুনক্তুঃ।
মনে পড়ে যাচ্ছে বাবাসাহেব আম্বেদকরের কথা। ইতিহাসবিদ ও অর্থনীতিবিদ ভীমরাও রামজি আম্বেদকর (১৮৯১–১৯৫৬) বাবাসাহেব হিসেবেই ভারতের দলিত সম্প্রদায়ের কাছে সুপরিচিত। ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসন–শোষণে নিপীড়িত নিম্নশ্রেণির মানুষের সামনে তিনি আলোর মশাল নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। জাতপাত থেকে দলিত সম্প্রদায়কে চিরতরে মুক্তি দিতে তিনি বৌদ্ধধর্মের পুনর্জাগরণে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাকে ভারতীয় সংবিধানের পিতা হিসেবেও অভিহিত করা হয়। স্বাধীন ভারতের প্রথম আইনমন্ত্রীও ছিলেন তিনি।
সংস্কারবাদী হিন্দু সংগঠন জাত–পাত–তোদক মণ্ডলের (অস্পৃশ্যতা বিলোপ ফোরাম) ১৯৩৬ সালের বার্ষিক অধিবেশন আয়োজন করা হয়েছিল লাহোরে। এতে বক্তৃতা করতে ড. ভীমরাও (বি আর) আম্বেদকরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বক্তৃতার কপি দেখে আয়োজকদের মনে হল লেখাটা ‘অসহ্য’। আমন্ত্রণ প্রত্যাহার করে নেওয়া হল। আম্বেদকর তখন তার নিজের পয়সায় বক্তৃতাটির পনেরোশ’ কপি ছাপালেন। নাম দিলেন ‘অ্যানাইহিলেশন অব কাস্ট — Annihilation of Caste’ (জাতপাতের সম্পূর্ণ বিলোপ)। অল্প সময়ের মধ্যে সেটি কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হল। লেখাটি দলিত সম্প্রদায়ের কাছে ধর্মীয় গ্রন্থের মতো সমাদৃত হয়। কিন্তু যে উচ্চবর্ণের লোকদের জন্য এটি লেখা হয়েছিল, তাদের মধ্যে প্রায় অপঠিতই থেকে যায়।
কয়েক হাজার বছর ধরে দেশের বর্ণ ও জাতপাতভিত্তিক সমাজনীতি পত্তন ও শাসন করে আসছে ধর্ম। যদিও বিশুদ্ধ বেদান্তের প্রবক্তা স্বামী বিবেকানন্দ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন— জাতিভেদ ধর্মীয় বিষয় নয়, ওটা সামাজিক প্রথা। ক্ষমতাশালীরা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। প্রথাটির উপর অত্যন্ত বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ হয়েই তিনি কথাটি বলেছেন। কারণ, সনাতন বা বৈদিক ধর্মের অনুশাসনে এমন হওয়ার কথা ছিল না। কৃত্রিম ও কূটকৌশলে এই ভেদ গড়ে তোলা হয়েছে। নিরীশ্বরবাদী বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম সৃষ্টির আগে বর্ণপ্রথা ছিল। কিন্তু তাতে জাতপাতভেদ ও অস্পৃশ্য-দলিত শ্রেণির জন্ম দেওয়া হয়নি। প্রবল প্রকটভাবে সেই কাজ করা হয়েছে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলার পরে। প্রথম খ্রিস্টীয় শতকের মনু থেকে শুরু করে অষ্টম শতকের শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্টের প্রবল জবরদস্তির কাল পেরিয়ে ষোড়শ শতকের রঘুনন্দন পর্যন্ত হল এই জাতপাতভেদ ও অস্পৃশ্যতাভিত্তিক একচ্ছত্র, সামাজিক, ধর্মীয় শাসনের যুগ। জাতিকে বর্ণহিন্দু, দলিত, পতিত, অস্পৃশ্য ইত্যাদি অসংখ্য বিচিত্র নামে ভাগাভাগি চালানো হয়েছে। এর জন্ম মনুসংহিতায়, পঞ্চাশ রকমের ভাগাভাগির মাধ্যমে। সমাজকে ধর্মীয় গোঁড়ামির শাসনে বেঁধে ফেলা হল। জাতির অর্ধেক প্রাণশক্তি নারীকে শূদ্রের সমান স্তরে স্থান দেওয়া হল।
এই সূত্রে কিছুদিন আগে হওয়া কেরলের স্কুলের একটি ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। সেখানকার সরকারি স্কুলগুলিতে ভর্তির সময় ফর্মে নিজেদের জাত জানাল না এক লক্ষেরও বেশি ছাত্র-ছাত্রী, প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। কেরল বিধানসভায় রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী সি রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, স্কুলে ভর্তি ফর্মের কাস্ট-এর জায়গাটি এ বছর ১ লক্ষ ২৩ হাজার ৬৩০ জন ছাত্র-ছাত্রী ফাঁকা রেখেছে। ঘটনাচক্রে দ্বাদশ শ্রেণির বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীই জাত জানিয়েছে। দ্বাদশ শ্রেণির মাত্র ৫১৭ জন পড়ুয়া ফর্মে কাস্টের জায়গাটি ফাঁক রেখেছে। শিক্ষা দপ্তরের অনুমান, সম্ভবত কাস্ট সার্টিফিকেট আদায়ের জন্যই উঁচু শ্রেণিতে বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রী কাস্ট জানিয়েছে। নীচু শ্রেণিতে যেসব ছাত্র-ছাত্রীরা কাস্ট জানাতে চায়নি তাদের মা-বাবারা সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, শিক্ষা হওয়া উচিত স্কিল-ভিত্তিক। সংরক্ষণভিত্তিক নয়। যদি আমার সন্তান পড়াশোনা না করতে পারে, অন্য কোনও উপায়ে বাঁচবে।
১২৯২ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে লেখা একটি ব্যঙ্গকৌতুকময় রচনার কিছুটা উদ্ধার করছি। ‘ডেঞে পিঁপড়ের মন্তব্য’ লেখাটিতে শুধু জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতা নয়, ঔপনিবেশিকতার আসল চেহারাটিও যেন খুলে দেখাতে চাইছেন তরুণ লেখক।
… ওরা সব পিঁপড়ে, যাকে সংস্কৃত ভাষায় বলে পিপীলিকা। আমি হচ্ছি ডেঞে, সমুচ্চ ডাঁইবংশসম্ভূত, ঐ পিঁপড়েগুলোকে দেখলে আমার অত্যন্ত হাসি আসে। … পিঁপড়েদের দেখে আমার অত্যন্ত মায়া হয়, ওদের উপকার করবার প্রবৃত্তি আমার অত্যন্ত বলবতী হয়ে ওঠে। এমন কি আমার ইচ্ছা করে, সভ্য ডেঞে সমাজ কিছুদিনের জন্য ছেড়ে, দলকে-দল ডেঞে ভ্রাতৃবৃন্দকে নিয়ে পিঁপড়েদের বাসার মধ্যে বাস স্থাপন করি এবং পিঁপড়ে সংস্কারকার্যে ব্রতী হই— … তারা উন্নতি চায় না— তারা নিজের শর্করা নিজে খেতে এবং নিজের বিবরে নিজে বাস করতে চায়, তার কারণ তারা পিঁপড়ে, নিতান্তই পিঁপড়ে। কিন্তু আমরা যখন ডেঞে তখন আমরা তাদের উন্নতি দেবই, এবং তাদের শর্করা আমরা খাব ও তাদের বিবরে আমরা বাস করব— আমরা এবং আমাদের ভাইপো, ভাগ্নে, ভাইঝি ও শ্যালকবৃন্দ।
এই ছবিতে ইংরেজ ও ভারতবাসীর সম্পর্কের রূপক আছে এমনটা মনে হয়। সেই সঙ্গে এটাও ভুলতে পারি না যে চিরকাল ওপর থেকে করুণাকণা বর্ষণ করে ‘দরিদ্রনারায়ণের’ সেবার প্রতিবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর ‘লোকহিত’ কোমর বেঁধে অন্ত্যজ ও নিম্নবর্গের জন্য হিতসাধন নয়। পথটা একটু কঠিন তাই আমাদের তেমন পছন্দ হয় না, বারবার তিনি ভবিষ্যতে বলবেন আত্মশক্তির জাগরণের কথা।
এই আত্মশক্তি কি আমরা কোনওদিনও পাব না?
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে রোহিত ভেমুলার কথা। আত্মহত্যা করার আগে সে লিখেছিল তার জন্যে না কাঁদতে। লিখেছিল “জেনো আমি মৃত্যুতে অনেক খুশি থাকব বাঁচার থেকে।” আজকে রবীন্দ্রভারতীর ছাত্র-ছাত্রীরা যখন দলিত শিক্ষিকাকে জাতপাত তুলে অপমান করে কম নম্বব্র দেবার জন্য, তখন তারা রোহিত ভেমুলার প্রতি তাঁদের অশ্রদ্ধাই প্রকাশ করে।
ছবি: https://feminisminindia.com/2017/01/17/rohith-vemula-casteism-universities/