অনির্বাণ ভট্টাচার্য
ওপারে পোস্ট অফিস আছে? ডাকপিওন? চিঠি দেয় কেউ? মেল? নেটওয়ার্ক? টেক্সট? হোয়াটসঅ্যাপ? কৃত্তিকা, এসবই কথার কথা। প্লাস্টিকের আবরণ। আর তার এদিকে, ওদিকে শূন্যতা। অবিতর হাওয়ার অভাব। অ্যাসফিক্সিয়া। সেই শূন্যতা, কৃত্তিকা, ঝামরে পড়ল আজ। শহর জানল, একটা অবান্তর বিকেলে একটা মেয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরল না। জাস্ট ফিরল না।
বই পড়তিস, কৃত্তিকা? কোর্সের বাইরে? নম্বর পাওয়ার বাইরে, যে সব বই, পড়তিস? বারুইপুরের ঠাম্মা, দাদু, মহাভারত? পড়িসনি? বয়সের চেয়ে অনেক এগোনো একটা মেয়ে, একটা অসুখের ভেতর হলুদ লাইন জড়ো করা, কোনদিকে ঝাঁপাবে? সিলভিয়া প্লাথ। এক নারীর ভেতর ঘর করা অবসাদ। পড়েছিস? ‘ডাইং ইজ অ্যান আর্ট, লাইক এভরিথিং এলস, আই ডু ইট এক্সেপশনালি ওয়েল’। গ্যাসের ওভেন। পাশের ঘরে ছেলেমেয়ে। সিলভিয়ার ওভেন। আর তোর প্লাস্টিক। এত কঠিন, এত ভয়ঙ্কর মৃত্যু? তোর ইংরেজি স্কুলের কোর্সের ইভিএস, প্লাস্টিক, সাগরের তলায় কচ্ছপের চোকিং, বিট প্লাস্টিক …। কৃত্তিকা, আসলে কিতুই সাগরের ভেতর? কেউ বা কারা ওপর থেকে প্লাস্টিকের ছিপ নামিয়েছে, তুই হিপনোটাইজড, গলায় প্লাস্টিক, তাই না?
জীবন। নাচ। বিরিয়ানি। তাইকোন্ডা। এর কোনওটা ভাসাতে পারল না, তাই না? অ্যানা পাভলোভা। তুই পাভলোভাকে চিনতিস কৃত্তিকা? গুগল করিসনি? ‘এ ড্যান্সার ড্যান্সেস বিকজ হিজ ব্লাড ড্যান্সেস ইন হিজ ভেইন্স…’। ও আরও বলেছিল জানিস? একদিন নাচতে না পারলে মরে যাওয়ার কথা ভাবতেন পাভলোভা। তুই? পড়াশুনো। চাপ। ক্লাসে ফার্স্ট। আই.এ.এস। কী দিল? কী দেবে? তোকে, তোদের? মা, বাবা, তুই, একটা ভিসিয়াস ট্রায়াঙ্গল। চিল্ডনেস। কেউ কারওকে চেনে না। তিন মাস ঘুমোতে না পারা। কালি ছিল না চোখে? খাবার টেবিলে কথা হত? চোখে চোখ রাখতিস, রাখত, গর্ভধারিণী, জাতক, তুই, তোরা? এত দূরত্ব? তারা হয়ে জন্মালে বেশ করতিস? নীচ থেকে খসে পড়ার শব্দ পেত কলকাতা। পুলিশ আসত না। মর্গ আসত না। খবর আসত না। প্লাস্টিক আসত না।
মৌনমিছিল। তোর আন্টিদের। আঙ্কলদের। একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ। বাবা মা। কোর্স, টিউশন, পড়া, কম্পিটিশন, ঈর্ষা, সবুজ চোখ, ম্যাকবেথ, থ্রি উইচেস, ডেথউইশ। কোনওদিন নাটক দেখতে যাওয়ার কথা হয়েছে? আউটডোর? কলকাতার কাছেই কোনও পুরনো বাগানবাড়ি, মফস্বল? ছেলেমেয়েদের নিয়ে? একটা দিন পড়াশুনোর বাইরে, দিদিমণিদের বাইরে, একটা ফেটাল বিষাক্ত প্রতিযোগিতার বাইরে একটা দিন। তুমুল ভালোবাসা, মেয়েবেলা, কিশোরীবেলা, ছেলেমেয়ে, বাবামা, বই, সিনেমা, শাহরুখ, শচীন, ফার্স্ট ক্রাশ – একটা দিন। পারতেন না কাটাতে? এখন মৌনমিছিল? কেন? সিকিওরিটি বাড়বে। সিসিটিভি বসবে। তারপর? শার্পনারটা সরিয়েছেন? একাবোধটা? কষ্টটা? এক লক্ষটা সিসিটিভি বসলেও মেয়ে জায়গা খুঁজে নেবে। সিলিং-এ। হলুদ লাইনের ওধারে। পার্লারে। রাতে ‘বাই ডার্লিং’-এর পর আলো বন্ধ মেলানকোলিক ঘরে। সিরিয়াস মম। ড্যাড। মিলিয়ে নেবেন …
ক-য় কৃত্তিকা, কিরণ …। কিরণ বাউরি। চিনিস? ক্লাস টুয়েলভ। পুরুলিয়া। তোর বড় হওয়া, বাবা-মার খেয়ালি টুরের পুরুলিয়ার কিরণ। আদিবাসী কিরণ। আরও পাঁচ লাখ বন্ধু। একটা সাড়ে কিলোমিটারের হিউম্যান চেইন। চাইল্ড ম্যারেজের এগেন্সটে। বেঁচে থাকার কথা। আনোয়ারা খাতুন। বছর আঠেরো। সন্দেশখালি। নারী পাচার জানিস? শুধু জীবনের এপারে ওপারে না, বেঁচে থেকেও না থাকার এদিক ওদিক। বীভৎসতা। ছোট্ট আনোয়ার পাচার হয়ে গেছিল। বেঁচে ফিরেছে। ফিরে কখনও রিভার্স মোশনে যাওয়ার কথা ভাবেনি। এখন ইউ.এন.-এর চাইল্ড রাইটস ক্রুসেডর। এরা মেট্রো দেখেনি। হলুদ লাইন জানত না। অবসাদ বোঝার আগেই শরীরে হাত, নারীত্বে হাত, ইচ্ছেশক্তিতে হাত। কৃত্তিকা, আরেকবার বেঁচে উঠবি? যাবি, পুরুলিয়া, সুন্দরবন?
কোথায় সমস্যা? পড়াশুনো? স্কুল, ও স্কুল! তোমাদের ব্রসিউওরে একজন করে মনোবিদ রাখো না কেন? একটা মানুষ, বন্ধু, হাত, ছেলেমেয়েগুলোর মাথায় থাকবে। বোঝাবে পড়াশুনোটা নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই। বাবা-মা’র সঙ্গে না, বন্ধুদের সঙ্গে না, নিজেকে ওপরে ওঠানোর লড়াই, মেয়ে হলে বাকি পৃথিবীর পৌরুষ দমনের লড়াই, পড়াশুনোটা তখন অস্ত্র, লেথ্যাল উইপন …। মথুরাপুরের সুব্রীতার কথা বলতে পারতেন। সুব্রীতা ভাণ্ডারী। মাসে চার হাজার টাকা রোজগার করা অঙ্গনওয়ারী মা-এর মেয়ে। মাধ্যমিকে সাতশ’য় ছ চুয়াল্লিশ পেল। না, ছশ নিরানব্বই আশা করেনি। লাইব্রেরিতে কাটাত। বাড়িতে বই নেই। টাকা নেই। ও বড় হয়ে সুন্দরবনে শিক্ষা ছড়াবে। বাকিটুকু জানে না। কিংবা তেহট্টের মৌসুমি হালদার। ছশ একান্ন। মা কাজ করে খায়। ও নিজে নিজে পড়ে। খাবার টেবিল আছে কি? মাটিতেই হয়ত। খেতে খেতে কথা বলে বাবার সঙ্গে। মা যোগ দেয়। কখনও বলেন, কখনও চুপ। হাসেন। তৃপ্তির হাসি। একটা মনোবিদ, একজন টিচার। কেলারের যেমন সুলিভান। ছোট্ট মিশেল ম্যাকনালির যেমন দেবরাজ সহায়। হাতে হাত রাখা ভেজা গলার স্বরে প্রথম ‘ওয়াটার’। বেঁচে থাকার কথা। তীব্র শহুরে কম্পিটিটিভ ‘ব্ল্যাক’ পৃথিবীর বাইরে প্যারালাল সময়। শিশির ভেজা মাঠ। পিকনিক। গাংচিল। সুনীল গাঙ্গুলি। বেসুরো গলায় রবীন্দ্রনাথ। হালকা একটা দরবারি কানাড়া। রাতে তারাভরা বারান্দার ধারে মা বাবাকে নিয়ে কোথাও ঘুরে আসার গল্প। ভ্যাকেশন। বারুইপুরের ঠাম্মার হাত। বাগানের নারকোল। জানলা। টিয়া। হয়ত ভালবাসার কেউ। কেউ ছিল? কাউকে বলা যেতে পারত কৃত্তিকা? ওই ছেলেটা, ওই মেয়েটা, ওই মুখটা, কাউকে, অন্তত কাউকে?
কেউ নেই? কেউ বোঝে না? ওপারে? এখনও? দেখতে পাচ্ছিস তোর জানলা? তোর হেডস্যার দাদু, ঠাম্মা, কীর্তনখোলা শ্মশানের গন্ধ, ওদের ‘তিন্নি’-র মুখ, শুকিয়ে যাওয়া চোখে বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, পড়াশুনোর অন্য এক পুরনো পৃথিবীতে ওঁদের কিছু না বোঝা টাইম ট্রাভেল? সেই তিন্নি, যে বই পড়তে ভালবাসত। ‘অ্যানা ক্যারেনিনা’। টলস্টয়। প্রথম পাতা। ‘হ্যাপি ফ্যামিলিস আর অল অ্যালাইক। এভরি আনহ্যাপি ফ্যামিলি ইজ আনহ্যাপি ইন ইটস ওন ওয়ে …’। বৈষ্ণবঘাটা, রানিকুঠি। মৃত্যু সাপের মতো যায়। ওঁত পাতে। ক্লাস ওয়ান থেকে। মেট্রো স্টেশনে। স্কুলের বাথরুমে। বাঁ হাতের কব্জি, জীবন, গোটা জীবন অপরাধবোধ আর ঠিক কোথায় ভুল, কবে থেকে ভুল বুঝতে না পারা জনক-জননী আর ‘মন দিয়ে লেখাপড়া’ ইংরিজি মিডিয়াম স্কুলের মাঝে জমতে থাকা পেন্সিল শার্পনারের ব্লেড, প্লাস্টিকের সেফটি, মুখের ভেতর, সমাজের ভেতর, সিস্টেমের ভেতর। তারপর ছোট্ট একটা মৌনমিছিল। ফেসবুক টপিক। ব্যস্ত মনোবিদ। আত্মসমীক্ষা। মরশুমি ধান-গম-সব্জির ইয়েস্টারডে-টুডে-অ্যান্ড-টুমরো। বোকা হওয়ার, আর বোকা করে দেওয়ার একটা ডিস্টপিয়ান ইডিয়ট বক্স।
প্রিয় কৃত্তিকা, চল অন কর …