সিসিফাস
মন আটকায়ে বেপরয়া দি নাল/ উস দিন দুনি দে শাহ নে দাল
(My soul is entangled with the indifferent one/ Lord of all things visible and invisible)
শাহ হুসেন। ষোড়শ শতকের ‘কাফি’ ঘরানার পাঞ্জাবি কবিতার পথিকৃৎ। লাহোরের কাছে শালিমার বাগান, আর কাছেই বাঘবানপুরা, দ্য শ্রাইন অফ শাহ হুসেন। হুসেনের সমাধির পাশেরটিই মধুলালের। কে এই মধুলাল? একদিন রাভি নদীর ধার ঘেঁষে ঘোড়ায় করে আসছিলেন হিন্দু বালক মধু। হুসেন দেখেই ভালোবেসে ফেললেন। বাকি জীবনটা সেই বালকের প্রেমে মশগুল ছিলেন। নিজের নাম নিলেন মধুলাল হুসেন। এখনও শাহ হুসেনের অনুগামীরা দুজনকে এক নামে ডাকেন। মধুর সমাধি বাঘবানপুরায় হুসেনের ঠিক পাশেই। আকবরের জমানার শেষ দিকে হুসেনের প্রতিপত্তি। লেখায় মিলন, বিশ্বজনীনতার ডাক। গোঁড়া ইসলামি সাম্রাজ্যেরর মাথায় অশনি সঙ্কেত। জাহাঙ্গির। তখন প্রিন্স সেলিম। রাজসভার এক বিশ্বস্ত অনুচরকে দিয়ে হুসেন প্রতিদিন যা বলছেন, এক ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করতে বললেন। কেন? ভক্তি? হুসেনের কবিতার প্রতি, লেখার প্রতি তীব্র আনুগত্য? হতে পারে। অথবা অন্য দিক আছে। নজরদারি। রাজবিরোধী, গোঁড়া ইসলাম-বিরোধী হুসেনের প্রতিটি লেখা কট্টর ইসলাম মতে এবং রাজমতে প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়াচ্ছিল। ভয় পাচ্ছিল ধর্ম, শাসক।
সেই শাহ হুসেন। বাঘবানপুরায় তাঁর উরস অর্থাৎ মৃত্যুবার্ষিকীতে চলা তিনদিন ব্যাপী উৎসব। একটা সময় পর্যন্ত শালিমার বাগানে চলত হিন্দু মেলা, উরস বাঘবানপুরায়। তীব্র হুসেন অনুরাগী মহারাজা রঞ্জিত সিং-এর উদ্যোগে বাঘবানপুরাতেই উরস ও মেলা এক হয়ে হয়ে আসছে ‘মেলা চিরাঘান’। ফেস্টিভাল অফ লাইট।
ফায়ারওয়াল। অগ্নিকূপ। মোম, তেল, কাঠ, তুলো— এবং তাঁর পরিণতি এক আলোর রোশনাই। এই উৎসবের প্রতীক বলা চলে। যেই আসেন কিছুটা আগুন আরও ধরিয়ে দেন এই কূপে। রঙের খেলা চলতে থাকে।
কাফি পাঞ্জাবি ঘরানার কথা বলছিলাম। মনে পড়ছে নুসরত ফতে আলি খানের নাম, আবিদা পারভিন, হামিদ আলি বেলা, জুনুন বা নুরজাহানের নাম। মেলা চিরাঘান এই কাফি ঘরনার সাধকদের এক ‘জয়দেব কেন্দুলি’। সুফি সাধনার রঁদেভু। দেখা হয় তাঁদের। ঠিক মার্চের শেষে।
একজন গরীব মুসলিম তাঁতির ছেলে। কবির নিজের কথায়— ‘কহে হুসেন ফকির নামানহা, দিওয়া খাক দিওয়ারে দি’। অর্থ? ‘সেইজ হুসেইন দ্য ওয়ার্থলেস ফকির, আই অ্যাম দ্য ডাস্ট অন ইওর ডোরস্টেপ’। ছোটবেলায় মা’কে হারানো। এক হিন্দু পুরুষ এবং এক মুসলিম বালকের অসমবয়সী ভালোবাসাকে নিয়ে রূপকের মতো গড়ে ওঠা এই উৎসব আসলে তো সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে। দুই ধর্মের মিলনক্ষেত্র। প্রথাগত ভালোবাসার বাইরে সাহসী এক সম্পর্কের দ্যোতক। আসলে পাঞ্জাবি ইসলামি ঘরানার সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার বাকি পৃথিবীর সাংস্কৃতিক মিলনেরই পরাকাষ্ঠা এই গল্প, এই উরস। ভাবতেই শিহরণ হয়। আর তাকে ঘিরে পাঞ্জাবের উৎসবগুলির মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম লোকসমাগম।
সারারাত জেগে কাওয়ালি, সুফি, কাফি গানের মাদল। নেশায় ভরপুর লাহোর। ঈশ্বরের সঙ্গে ব্যক্তিগত কথোপকথন। দুই ধর্ম। তখন কোথায় যুদ্ধ? কোথায় সীমান্ত? ভ্যানিশ। লেনন মনে পড়ে। ‘ইমাজিন দেয়ার্স নো কান্ট্রি’।
পৃথিবীকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া বাঘবানপুরা। লাহোর। শাহ হুসেনের সমাধি। মধুলালের নিষ্পাপ মুখ। ভালোবাসা। সঙ্গীত। মানবতা। এই উৎসব যেন চিরন্তন হয়।
তথ্যঋণ – আলি রেজা এবং ‘Dawn’ সংবাদপত্র
ছবি কৃতজ্ঞতা – নাসির রহমান