নির্মাল্য সেনগুপ্ত
১)
সম্রাট আর তিস্তা পাশাপাশি বসেছিল চুপ হয়ে। সম্রাট পকেট থেকে একটা চকোলেট বার বের করে তিস্তার দিকে বাড়িয়ে অস্ফুটে অফার করল। তিস্তা মাথা নেড়ে না বলল। সম্রাট আর অনুরোধ না করে সেটা র্যাপার ছিঁড়ে খাওয়া শুরু করল৷ আরও কতক্ষণ এভাবে বসে থাকতে হবে কে জানে৷
এদের দুজনের সঙ্গে আরেকজন উপস্থিত ছিল সেখানে, যার অস্বস্তির পরিমাণ তিস্তা বা সম্রাটের থেকে অনেক বেশি। তাকে এমন একটা কারণে কোনওদিন জড়িয়ে পড়তে হবে, সে ভাবতেও পারেনি। রাজা মুখ নীচু করে দাঁত নিয়ে নখ কাটতে কাটতে একবার তিস্তাকে একবার সম্রাটকে দেখছিল আড়চোখে৷ রাজা সম্রাটের ছোটবেলার বন্ধু। ওরা দুজন আলাদা হয়ে যাওয়ার পর থেকে সবথেকে বেশি সমস্যায় পড়েছিল রাজাই। রাজাকে পাড়ার সব বন্ধুরা বলেছে যে এই পরিবার থেকে দূরে সরে আসতে। এখানের সমস্যা অনেক গভীরে। অত সহজে কিচ্ছু বদলাবে না৷ রাজা আসেনি সরে, তার পক্ষে সম্ভব ছিল না৷
একটু পরে এক হাবিলদার এসে ডাক দিল, “সাক্ষী রাজর্ষি সামন্ত হাজির হও।”
রাজা তড়িঘড়ি উঠে একবার বাকি দুজনের দিকে চাইল৷ তারপর ঢুকে গেল ঘরের ভিতরে।
বহু সিনেমাতে আদালত দেখেছে রাজা। একটা বিশাল হলঘর, তার একপ্রান্তে জজসাহেব বসে থাকেন। দু পাশে দুই কাঠগড়া, সেখানে দাঁড়িয়ে গীতায় হাত রেখে শপথ গ্রহণ করতে হয়, “যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য বিনা মিথ্যা বলিব না…” সেও এমনই কিছু ভেবেছিল৷ কিন্তু তেমন নয়, একটা মাঝারি মাপের ঘর, সেখানে একটা লম্বা টেবিলে ৬, ৭ জন লোক বসে আছে। সে রঞ্জনকাকু আর তপতীকাকিমাকে দেখল। তপতীকাকিমার ডান চোখের নীচ থেকে ঠোঁট অবধি লম্বা নখের আঁচড়, যা দেখে রাজা চোখ নামিয়ে ফেলল অস্বস্তিতে৷
রাজাকে দেখে তপতী ডুকরে উঠে বলল, “রাজা, বল বাবা, তুই তো দেখেছিস সবকিছু৷ জজসাহেবকে জানা সত্যিটা৷”
একদম টেবিলের অপর প্রান্তে থাকা কালো কোট পরিধারী ভদ্রলোক বলে উঠলেন, “অর্ডার৷ আপনি নয়, আপনার উকিলকে বলতে দিন ম্যাডাম।”
তপতীকাকিমার উকিল, মিস্টার ঘোষাল বলে উঠলেন, “রাজা সেদিন কী হয়েছিল জানাও।”
রাজা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তার মুখ থেকে কোনও কথা বেরোল না৷
মিস্টার ঘোষাল আবার ডাকলেন, “রাজা, মাননীয় ধর্মাবতারকে সত্যিটা জানাও যা তুমি দেখেছিলে…”
রাজা তাকিয়ে রইল৷
আবার তপতীকাকিমা কেঁদে উঠলেন, “রাজা…”
জজসাহেব বললেন, “অর্ডার, অর্ডার…”
রাজা ঢোক গিলে, শুকনো গলায় বলল, “হ্যাঁ বলছি…”
২)
তিস্তা পেটের উপর দিয়ে রাজার হাতটা সরিয়ে দিয়ে অন্য পাশ ফিরে শুল৷ তার রাগ হয়েছে।
রাজা জোর করে তিস্তাকে কাছে টেনে নিয়ে, তার গলায় একটা চুমু খেয়ে বলল, “মাত্র তিনমাসের জন্য তো, ফেরার পর তো বাকি তিরিশ বছর লিজ নিচ্ছিস আমার।”
তিস্তা মনে মনে কোনও হিসেব কষে বলল, “তিরিশ কেন? ষাট বছরে মরে যাবি নাকি তুই?”
“বালাই ষাট। মরব কেন?” রাজা জামা পরতে পরতে বলল, “ষাট বছরে আরেকটা বিয়ে করব। আমার খুব শখ।”
তিস্তা কোনও উত্তর না দিয়ে সেও টপটা খোঁজা শুরু করল।
“এই দ্যাখো, সবেতে রাগ। ইয়ার্কি মারাই যাবে না তোর সঙ্গে আর দেখছি।”
“না রাজা, এই ইয়ার্কিগুলো মারিস না৷ আমি সেপারেশন নিতে পারি না৷ আমি মাকে দেখে বুঝে গেছি, যে যতই সাবলম্বী হও, এই পেট্রিয়ার্কাল সোসাইটিতে ডিভোর্সি মহিলারা ধ্বংস হয়ে যায়। তোর অন্য কাউকে পছন্দ থাকলে এখনই বলে দে৷”
রাজা এত সব জটিলতা বোঝে না৷ সে জানে তিস্তা সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটে বিভিন্ন ফেমিনিস্ট গ্রুপের সঙ্গে নিত্য আলোচনা, নানান মুভমেন্ট ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত থাকে৷ তিস্তার বক্তব্য “আমরা সবাই কম বেশি পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন। লুকোনো থাকে। সময়ে বের হয় নখের মতন।” তার এগুলো বোগাস মনে হয়। পুরুষ এবং নারীর সমান অধিকার রয়েছে এবং তারা সেটা নিয়ে জন্মায়৷ ভারতের আইনও মেয়েদের পক্ষেই৷ এছাড়া সে বহু সময়ই দেখেছে এই সব ফেমিনিস্ট গ্রুপের মেয়েরা একই কাজ করে যা একজন পুরুষ করলে তারা বিরোধিতা করত। ভীষণ হিপোক্রিট লাগে তার৷ স্বামীস্ত্রীর সম্পর্কে শাসন এবং অধিকারের মধ্যে সবাই গুলিয়ে ফেলে৷ মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিংকে মিসোজিনি বলে৷ বিরক্তিকর যত। সে আর কিছু না বলে, তিস্তার কপালে একটা চুমু খেয়ে জল খেতে গেছিল। এরপরই পাশের ঘরে আওয়াজ পেয়ে সে ঘটনাটা দেখে ফেলে৷
৩)
সম্রাটদের পাড়ার একদম দক্ষিণ দিকে একটা পরিত্যক্ত বাড়ি রয়েছে। এর মালিক কে কেউ জানে না৷ একদিন অবহেলায় ফেলে চলে গিয়েছিল৷ তারপরই বিভিন্ন উদ্ভিদ, রংবেরঙের পাখি, কুকুর মেকুর এমনকি শিয়াল বা ভামও আপন করে নিয়েছে বাড়িটাকে৷ প্রত্যেক বছরই কোনও প্রোমোটার কেড়ে নেবে এমন আশঙ্কা করা হলেও এত বছরেও তেমনটা ঘটেনি৷
সম্রাট আর রাজা ছোটবেলা থেকেই খেলার পর এখানে আসত আড্ডা মারতে। তাদের প্রথম সিগারেট খাওয়া, নগ্ন মেয়ের ছবি দেখা, সুরাপান সবই এখানে লুকিয়ে৷ তাদের নামের সাদৃশ্যের জন্যই প্রথম আলাপ। তারপর বন্ধুত্ব গড়াতে গড়াতে যে সম্পর্কে চলে আসবে তারাও ভাবেনি। তিস্তা আর রাজা ছোটবেলায় কোনওদিন এইসব মাথায় আনেনি। রাজা সম্রাটদের বাড়িতে যাতায়াত শুরু করলে, সারল্য থেকেই বন্ধুত্ব হয় তিস্তা আর রাজার৷ তিস্তা কলেজ পাশ করলে রাজার মা-ই প্রথম রাজার কাছে প্রস্তাবটা রাখেন৷ প্রথমে অবাক হয়ে লজ্জা পেলেও রাজা ভেবে দেখে যে তারও তিস্তাকে বেশ পছন্দই৷ সে তিস্তাকে প্রোপোজ করে৷ তিস্তা রাজি হয়ে যায় এবং লাজুকভাবে জানায় যে তারও একই ইচ্ছা। রাজা এর অনেকদিন পরে তিস্তাকে বলেছিল তার মায়ের প্রস্তাবের কথা৷ এরজন্য তাদের সম্পর্কটা লাভ নাকি অ্যারেঞ্জ এই নিয়ে বেশ কনফিউশন রয়েছে৷
তিস্তার মা তপতীকাকিমা এবং বাবা রঞ্জনকাকুর মধ্যে কবে থেকে সমস্যা শুরু হল তা রাজা বোঝেনি৷ সম্রাট এবং তিস্তাও বোঝেনি হয়ত। হঠাৎই একদিন তারা ডিসিশন নেন আলাদা হওয়ার। নিমেষেই উকিল ডেকে, সম্পত্তি, উত্তরাধিকার সব ঠিক হয়ে যায়৷ সম্রাট থাকবে বাবার সঙ্গে, তিস্তা মায়ের কাছে। রঞ্জনকাকুর দুটো বাড়ি। তাতে তিনি সম্রাটকে নিয়ে চলে যান৷ মিউচুয়ালিই ডিভোর্স ঠিক হয়। তপতীকাকিমা ব্যাঙ্কে চাকরি করেন, মাইনেও প্রাইভেট সফটওয়্যার ফার্মে চাকরি করা রঞ্জনকাকুর থেকে একটু বেশি। ফলে খোরপোষের কোনও দাবী রাখেননি৷ মাস ছয়েকের মধ্যেই সমস্ত ফরম্যালিটি মেনে ডিভোর্সের নিয়ম পূর্ণ হবে। রাজা আগামী মাসে ব্যাঙ্গালোর যাচ্ছে ট্রেনিং-এ, ফিরে এসে কোলকাতাতেই তার পোস্টিং৷ যাওয়ার আগে তার আর তিস্তার রেজিস্ট্রি হয়ে যাবে। আলাদা হয়ে গেলেও রঞ্জনকাকু মাঝেমধ্যেই এই বাড়ি আসেন৷ রাজাও নিমন্ত্রিত থাকে। আগের মতই হাসিখুশি পারিবারিক আড্ডা হয়। দু একবার রাজার বাবামাও এসেছেন বাড়িতে৷ সমস্ত সমস্যা মিটেই গেছিল৷ হঠাৎই ঘটনাটা ঘটল।
সম্রাট আর রাজা সিগারেট খাচ্ছিল ভাঙা বাড়িটার বারান্দায় দাঁড়িয়ে। সম্রাট এক মণ্ড ধোঁয়া ছেড়ে রাজাকে বলল, “দেখ কোনও ভনিতা না করেই বলছি৷ তুই সাক্ষী দিস না৷ বলিস আমি দেখতে পাইনি কিছু৷ ব্যস।”
রাজা অবাক হয়ে বলল, “শি ইজ ইয়োর মাদার সম্রাট!”
“অ্যান্ড হি ইজ মাই ড্যাড, উইথ হুম আই লিভ।”
একটু থেমে সম্রাট বলল, “ইউ গট আ জব রাজা। তোর বিয়ে পরের সপ্তাহে৷ শান্তিপূর্ণ জীবন। বাবামা, বউ, শাশুড়ি, একান্নবর্তী পরিবার৷ আমার বাপ ছাড়া কেউ নেই৷ আমি চাকরি পাইনি৷ বাবার উপরই ইকোনমিকালি নির্ভরশীল হয়ে আছি৷ বাবার জেল হয়ে গেলে আমার কী হবে! খাব কী?”
“কাকিমা তোকে হেল্প করবেন।”
“আমি চাই না মায়ের হেল্প। যে এক কথায় আমালে ছেড়ে দিতে রাজি হয়ে যায়, তার থেকে আমি এক পয়সা নেব না৷ তুই প্লিজ বলিস না কিছু কাল৷ দু মাস পর ওদের ডিভোর্স হয়ে যাবে। সব কেচ্ছা শেষ।”
রাজা মাথা নেড়ে বলল, “এটা রেপ কেস সম্রাট৷ তুই মিথ্যে বলতে বলছিস?”
সম্রাট এবার বিরক্তিতে চেঁচিয়ে উঠে বলল, “নিজের বউকে আবার রেপ কী রে?”
৪)
তিস্তা আর রাজা শুয়েছিল পাশাপাশি৷ তাদের গত সপ্তাহে রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে৷ আজই শেষ রাত তাদের একসঙ্গে, আগামী তিন মাসের জন্য। পরের দিন দুপুরের ফ্লাইট তার। রাজারও আজ মন খারাপ লাগছে৷ শুধু প্রেম নয়, তিস্তা তার অভ্যেস৷ সে তিস্তাকে জড়িয়ে ধরল।
“এখনও রেজিস্ট্রির কাগজের ফাইলটা এভাবে রেখে দিয়েছ টেবিলে? এক সপ্তাহ হয়ে গেল, লকারে তুলতে পারলে না?”
তিস্তা অন্যমনস্কভাবে বলল, “তুলে রাখব। তুমি এমন একটা সময়ে চলে যাচ্ছ। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল আমার তোমাকে৷”
রাজা চুপ করে রইল। তাদের বিয়েতে রঞ্জনকাকু বা সম্রাট কেউই আসেনি৷ রাজার বাবামা ছিলেন৷ তারা সমস্ত বিষয়েই পাশে থাকবেন কথা দিয়েছেন, তিস্তা এবং তপতীকাকিমাকে। তবুও সম্রাটের জন্য মনখারাপ তিস্তা আর রাজার৷ একজনের দাদা, একজনের ছোটবেলার বন্ধু।
রাজার সাক্ষী দিয়েও অবশ্য লাভ হয়নি কোনও। ধর্ষণের মামলা টেকেনি৷ ডিভোর্স হতে এক মাস বাকি এখনও৷ ফলে ভারতীয় আইন অনুযায়ী বলপূর্বক সঙ্গম ধর্ষণ নয়। মাত্র দশ হাজার টাকা জরিমানায় কেস মিটে গেছে। তিস্তা তবু ছাড়তে রাজী নয়। হাইকোর্টে অ্যাপ্লাই করছে সে। ফেমিনিস্ট দলগুলো তার পাশে রয়েছে। পিটিশন সাইন চলছে। তপতীকাকিমা অবশ্য আর চান না কিছু। তিনি ক্লান্ত।
রাজা বলল, “বাবা আছে তো। বাবা তো বলেইছে সবকিছুতে হেল্প করবে। আর আমি তো অন্য গ্রহে যাচ্ছি না। ভারতেরই একটা রাজ্যে যাচ্ছি৷ তুমি চিন্তা কোরো না। কাছে এসো।” তিস্তাকে কাছে টেনে তার টপটা খোলার চেষ্টা করল রাজা। রেজিস্ট্রির পর থেকে তারা একে অপরকে তুমি ডাকার চেষ্টা করছে৷ যদিও পারছে না তেমন৷
তিস্তা “ধুত” বলে টপটা নামিয়ে সরে গিয়ে বলল, “ভালো একটা উকিল চাই৷ মায়ের এই উকিলটা বোগাস। তোমার এক উকিল বন্ধু আছে বলেছিলে না?”
“সে ইনকাম ট্যাক্সের। ক্রাইমের নয়…” আবার পুনর্প্রচেষ্টায় রত হল রাজা৷
“আরে কী করছিস… শোন আমার কথা। ইনকাম ট্যাক্সের হোক না, উকিল তো। সে চিনবে তো কাউকে, ভালো ক্রিমনাল ল-ইয়ার…”
রাজা এবার বিরক্ত হল৷ রোজ এই এক কথা। ভালো লাগছে না আর৷ কালই দুপুরে সে চলে যাবে। এখন এই এক বিষয় শুনতে আর ভাল লাগছে না। আদর পাচ্ছে তার ভীষণ। সে আর উত্তর না দিয়ে তিস্তার প্যান্টের বোতাম খোলা শুরু করল।
“আহ রাজা, কী হচ্ছেটা কী?” রাজাকে অবাক করে চিৎকার করে উঠল তিস্তা৷ সে উঠে বসেছে।
চট করে রাগে মাথাটা আগুন হয়ে গেল রাজার। এরপর অনৈচ্ছিক পেশির মত তার হাতটা অজান্তেই চলে গেছিল খাটের পাশের টেবিলে৷ যেখানে গত সাত দিন ধরে অবহেলায় তাদের রেজিস্ট্রির কাগজগুলো পড়ে আছে, একটা পরিত্যক্ত ভাঙা বাড়ির মতন…