আত্মহত্যার তথ্যহত্যা : গণনার পদ্ধতির সঙ্গে পালটে যায় পরিসংখ্যান

কৃষক আত্মহত্যা | প্রথম বর্ষ, তৃতীয় যাত্রা | জুলাই, ২০১৭

পড়গুম্মি সাইনাথ

 

১৯৯৫ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশে কৃষকদের আত্মহত্যার ঘটনা তিন লক্ষ ছাড়িয়েছে। কিন্তু এই কথা বলে রাখা ভালো – ২০১৪ সালের পরিসংখ্যানের সঙ্গে আগের উনিশ বছরের পরিসংখ্যানের তুলনা করা প্রায় অসম্ভব। এর কারণ তথ্য জোগাড় ও পরিবেশনার ক্ষেত্রে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (NCRB) পদ্ধতিগত বড়সড় পরিবর্তন।

নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করার ফলে দেখা যাচ্ছে – ২০১৪ সালে কৃষকদের আত্মহত্যার সংখ্যা কমে গিয়ে হয়েছে ৫,৬৫০। এই অঙ্ক ২০১৩ সালের ১১,৭৭২টি আত্মহত্যার সংখ্যার অর্ধেকেরও কম। এই হ্রাসের কারণ আর কিছুই নয়, কৃষকদের আত্মহত্যার সংখ্যাকে অন্যান্য নতুন বা পরিবর্তিত বিভাগের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। এওটু নজর করলেই দেখা যাবে – কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা হ্রাসের সঙ্গে কিভাবে বেড়ে গেছে ‘অন্যান্য’ ধরণের আত্মহত্যার সংখ্যা। ২০১৪ সালে কর্ণাটকে (কৃষক আত্মহত্যার দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্য) ৩২১ জন কৃষক আত্মহত্যা করেন। সংখ্যাটা তার আগের বছর, অর্থাৎ ২০১৩-র ১,৪০৩টি আত্মহত্যার ঘটনার সংখ্যার থেকে অনেকটাই কম সন্দেহ নেই। কিন্তু এই বছরেই, অর্থাৎ ২০১৪-তে, দেখা যাচ্ছে ‘অন্যান্য’ কলমভুক্ত আত্মহত্যার সংখ্যা ২০১৩ সালের সংখ্যার থেকে প্রায় ২৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১,৪৮২ থেকে এক লাফে বেড়ে ৫,১২০টি আত্মহত্যার ঘটনা। গড়পড়তা হিসাবে দেখা যাচ্ছে, কৃষক আত্মহত্যার জন্য সবথেকে কুখ্যাত পাঁচটি রাজ্যে এই ‘অন্যান্য’ খাতে আত্মহত্যার সংখ্যা ২০১৩-র তুলনায় বেড়েছে ১২৮ শতাংশ।

NCRB আত্মহত্যা পরিসংখ্যান, সারণী ২.৬ এবং ২.৭

NCRB-র পরিসংখ্যানে ভাগচাষীদের আত্মহত্যার একটা বড়ো সংখ্যাকে ‘কৃষিশ্রমিক’-এর আত্মহত্যার আওতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যার ফলে কৃষকদের আত্মহত্যার সংখ্যার বিপুল ভারের অনেকটাই লাঘব করা সম্ভব হয়েছে। NCRB-র নিজের কথাতেই – এই নতুন পরিসংখ্যানের কোনো অডিট হয় নি। পুলিশথানাগুলি – এই পরিসংখ্যান জোগাড় ও যোগানের প্রাথমিক দায়িত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত – তাদেরও এ-বাবদ যথোচিত ট্রেনিং দেওয়া হয় নি।

শুধু এই-ই নয়। ২০১৪ সালে বারোটি রাজ্য ও ছ’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে কৃষক-আত্মহত্যামুক্ত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এ-ও এক রেকর্ড। এর মধ্যে আছে তিনটি বড়ো কৃষিপ্রধান রাজ্য – পশ্চিমবঙ্গ, রাজস্থান ও বিহার। আশ্চর্যের বিষয় এই – ২০১০ সালে একটি রাজ্যকেও কৃষক-আত্মহত্যামুক্ত বলে ঘোষণা করা হয় নি, এবং মাত্র তিনটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এই শিরোপা পায়। এই বারোটি রাজ্য, অথচ, এখন সগর্ব ঘোষণা করছে যে, ২০১৪ সালে একটিও কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা এই রাজ্যগুলিতে ঘটে নি। তা সে যে কারণেই হোক।

NCRB অবশ্য বলেছেন – তথ্যের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিকতা দেখলে সংশ্লিষ্ট রাজ্য / কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের কাছে কৈফিয়ত দাবী করা ‘হতে পারে’ (‘হতে পারে’-র ওপরে জোর আছে) ।

NCRB কোন পদ্ধতি অনুসরণ করে ‘ভারতে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু ও আত্মহত্যা’ (Accidental Deaths & Suicides in India) –সংক্রান্ত তথ্যাবলী সংগ্রহ করেছেন তা নিয়ে বিশেষ স্পষ্টতা নেই। আবার, আত্মহত্যার কারণের প্রশ্নে দেখা যাচ্ছে সব সময়ে রাজ্য সরকারের দেওয়া কারণ – অর্থাৎ অবসাদ ইত্যাদি – কেই কারণ হিসাবে দেখানো হচ্ছে। যাই হোক না কেন, ১৯৯৫ থেকে আজ পর্যন্ত কৃষকদের আত্মহত্যার ঘটনা ৩,০২,১১৬ ছুঁয়েছে। যদিও নানান বদলের ফলে ২০১৩-র তথ্যের সঙ্গে সোজাসুজি ্তুলনা করা প্রায় অসম্ভব, তবুও দেখা যাচ্ছে যে ২০১৪ সালে সমস্ত কৃষি-সংক্রান্ত আত্মহত্যার সংখ্যা (১২,৩৩৬) ২০১৩-র থেকে সামান্য হলেও বেশী।

কৃষকদের আত্মহত্যার ঘটনার নিরিখে উল্লেখযোগ্য পাঁচটি রাজ্য হল – মহারাষ্ট্র, অন্ধ্র প্রদেশ (তেলেঙ্গানা-সহ), কর্ণাটক, মধ্য প্রদেশ এবং ছত্তিশগড়। পুরো গত দশক জুড়ে সারা দেশের কৃষক-আত্মহত্যার ঘটনার অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ এই রাজ্যগুলিতে ঘটেছে। নতুন হিসাবে ২০১৪ সালে এই পাঁচটি রাজ্য নব্বই শতাংশ মৃত্যুর ভাগীদার হয়েছে। মহারাষ্ট্র – যার কুড়ি বছরের কৃষক-আত্মহত্যার যোগফল ৬৩,৩১৮, সে ২০১৪ সালে সারা দেশের ৪৫ শতাংশ কৃষক-আত্মহত্যার ভাগীদার হয়েছে। তবুও, তথ্য পরিবেশনে ২০১৪ সালের এই অদলবদলের কারণগুলো অজানা, আর তাদের ঘিরে গজিয়ে ওঠা প্রশ্নগুলো অনুত্তরিত।

তথ্য সংগ্রহ করবার মতন প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো NCRB-র নেই। বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা তথ্যাবলী সাজিয়ে পেশ করাই NCRB-র কাজ। সেই অর্থে এই সংস্থার তথ্যসংক্রান্ত কোনো কায়েমী স্বার্থ নেইবলেই ধারণ আকরা যেতে পারে। কিন্তু এইভাবে তথ্য পরিবেশনের ছক বদল হলে তথ্যবিকৃতির ক্ষেত্রে রাজ্যগুলিকে উৎসাহিত করা হবে। রাজ্যের রাজধানীতে বসে থাকা সরকারী কর্মীর কাছে পিঠ বাঁচানোর উপায় সহজতর হবে।

চোখে পড়বার মতন তথ্যবিকৃতির শুরু ২০১১ সালে, ছত্তিশগড়ের ক্ষেত্রে। ২০০৬ থেকে ২০১০ পর্যন্ত এই রাজ্যে প্রতি বছরে আত্মহত্যা করেছেন গড়ে ১,৫৫৫ জন কৃষক। ২০১১ সালে এই সংখ্যাটা কমে দাঁড়ালো শূন্যতে। ছত্তিশগড়ের কথায় – সে রাজ্যে ২০১১ সালে আত্মহননের সংখ্যা শূন্য, ২০১২-তে চার, এবং ২০১৩-তে আবারও শূন্য। ২০১২ থেকে পশ্চিমবঙ্গও একই পথের পথিক হল। ধীরে ধীরে পিছিয়ে থাকল না অন্যেরাও। এখন নতুন বিভাগ তৈরী করে এদের কাজটা আরও সহজ করে দেওয়ার ব্যবস্থা হল। নতুন (উপ) বিভাগ বলতে – যে কৃষক নিজের জমিতে চাষ করেন, ভাগচাষী, কৃষিশ্রমিক ইত্যাদি।

NCRB-র কথায় – এগুলি কোনো নতুন বর্গীকরণ নয়, উনিশ বছর ধরে প্রকাশ হতে থাকা পুরোনো শ্রেণীর (কৃষিতে যুক্ত স্বনিয়োজিত মানুষ, বা ‘Self-employed persons in Agriculture/Farming’) নতুন বিন্যাস মাত্র। দেখার বিষয় এই যে, পুরোনো বছরগুলোর সারণীতে – তা NCRB-র হোক বা অন্য কারো – কখনই কৃষিশ্রমিকদের ‘স্বনিয়োজিত’ বলে দেখানো হয় নি। কৃষিশ্রমিকেরা কখনই স্বনিয়োজিত নন। হতে পারেন না। কাজের সন্ধানে তাঁরা দেশের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে ঘুরে বেড়ান।

আরও আছে।

কোনো একটি জেলার কোনো একটি থানার কনস্টেবল ঠিক করেন আত্মহনন বেছে নেওয়া মানুষটি কৃষক ছিলেন, না কি ভাগচাষী বা জমির মালিক, বা সাধারণ শ্রমিক। এই নির্ধারণের কাজটা একজন পোড় খাওয়া ফিল্ড সার্ভেয়রের পক্ষেও খুব সহজ নয়। NCRB বলেন – তাঁর তথ্য থানার সরকারী তথ্যের ওপর নির্ভর করে গোছানো। কিন্তু, অস্বাভাবিক মৃত্যুর তথ্য প্রথমে জমা পড়ে জেলার ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোতে। তারপর যায় রাজ্য ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোতে। তাঁরা সেই তথ্যকে উপযুক্তভাবে সাজিয়ে পেশ করেন NCRB-র কাছে।

NCRB-র বক্তব্য, তাঁরা এই তথ্য সংগ্রহকে উন্নততর করবার লক্ষ্যে কিছু ট্রেনার তৈরী করেছেন, এবং তাঁদের প্রত্যেককে গত বছর এক মাসের নিবিড় ট্রেনিং প্রদান করেছেন। বলা বাহুল্য, এই সব ট্রেনারেরা থাকেন রাজ্যের রাজধানীতে। স্থানীয় থানায় নয়। NCRB-র বক্তব্য, রাজ্য ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর শিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মচারীদের অনুরোধ করা হয় একই শিক্ষণ জেলাস্তরে বিতরণ করবার জন্য, আর জেলাস্তরের কর্মচারীদের বলা হয় থানাভিত্তিক এই ট্রেনিং-কে ছড়িয়ে দেবার জন্য। এই ছড়িয়ে পড়ার কাজটুকু কতটা হয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে।

কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা বেশী, যেমন মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ বা কর্ণাটকের মান্ড্য, এমন অঞ্চলে থানায় যোগাযোগ করতে গিয়ে দেখা গেল তাঁরা গোটা ব্যাপারটা নিয়ে যথেষ্ট ধোঁয়ায়। প্রথম পাঁচ রাজ্যের উপরতলার পুলিশ সাহেবদের অবস্থাও দেখা গেল তথৈবচ। অন্ধ্র প্রদেশের এক উচ্চপদের অফিসার বলেই বসলেন – এমনভাবে তথ্য সংগ্রহের কথা বলে কোনো সার্কুলারের কথা তাঁর জানা নেই।

তেলেঙ্গানার একজন উপরতলার অফিসারের কথায় – “এইসব ক্লাসিফিকেশন করা কনস্টেবলের কাজ নয়। তহশীলদারের কাজ। কে চাষী আর নয়, সেটা দেখা রাজস্ব দফতরের কাজ। এফ আই আরের কপি তহশীলদারের কাছে যায়। অকুস্থলে যে পুলিশকর্মী থাকেন, তাঁর কাজ আত্মহত্যার কারণটুকু নোট করে নেওয়া।” এর অর্থ, মৃতের শ্রেণীবিভাগ হবে রাজস্ব দফতর অথবা রাজ্য ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর অফিসে। কোথাও কোনো সংশয় থাকলে ঘটনার স্থান হবে ‘অন্যান্য’ বা Others বিভাগে। এই শেষোক্ত ঘটনাটি হাজার-হাজার ক্ষেত্রে ঘটে চলেছে।

অবস্থা সবথেকে খারাপ যেখানে, সেই মহারাষ্ট্রে পুলিশমহলে যোগাযোগ করতে গিয়ে জানা গেল – তাঁরা কৃষি সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে ইস্যু করা রাজ্য সরকারের একটি ২০০৬ সালের সার্কুলার সম্বন্ধেই কেবল ওয়াকিবহাল। এক অফিসার জানালেন – “সেই সার্কুলার অনুযায়ী আমাদের কাজ হল এইরকম কোনো আত্মহত্যার ঘটনা ঘটলে জেলাশাসকের দফতরে জানানো।” উনি সেই আদ্যিকালের সার্কুলারের একটি কপিও আমাদের দিলেন।

কর্ণাটকের একজন পুলিশ অফিসার জানালেন, তাঁরা এই নতুন ডেটা ক্ল্যাসিফিকেশন নিয়মের রহস্যে একেবারে বিহ্বল। সুতরাং, স্থানীয় থানার কাছেও এই মর্মে কোনো নির্দেশ পৌঁছয় নি। মধ্য প্রদেশের পুলিশকর্তারা বলছেন, তাঁদের জ্ঞাতানুসারে ঘটনাস্থলে উপস্থিত কনস্টেবলের কাজ হল এই তথ্য জোগাড় করা।

এই যে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা-জনিত ধন্দ, এর সুর যেন NCRB-র রিপোর্টেও ধরা পড়ে। কৃষক আত্মহত্যার প্রসঙ্গে লিখিত নোটের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে খুব সঠিকভাবে লেখা হচ্ছে – “কৃষকের অর্থ – যাঁরা জমির মালিক এবং নিজের জমিতে চাষ করেন, এবং তাঁরাও যাঁরা নিজের জমিতে চাষের জন্য ভাড়ায় লোক লাগান। কৃষিশ্রমিকেরা কৃষক নন।” তাই যদি হবে, তবে ওই ‘স্বনিয়োজিত’-দের সারণীতে কৃষিশ্রমিকেরা স্থান পান কি করে?

ভাগচাষীরা, যাঁরা অন্যের জমি চাষ করেন এবং বিনিময়ে কিছু নগদ অর্থ বা ফলনের অংশ মালিককে দেন, তাঁদের কথা ধরা যাক। ভাগচাষীদের সঙ্গে জমির মালিকের চুক্তি অধিকাংশ সময়েই অলিখিত। সেই কারণে ব্যাঙ্কের থেকে অর্থসাহায্য পেতে ভাগচাষীদের অসুবিধা হয়। তার ফলে স্থানীয় সুদের কারবারিদের কাছে তাঁদের হাত পাততে হয়। ধারে-কর্জে ডুবে অনেক সময়েই তাঁরা আত্মহননের রাস্তা বেছে নেন। এঁদের কোনো সরকারী পঞ্জীকরণ হয় না বলে এঁদের আত্মহত্যার ঘটনাও সরকারের খাতায় জায়গা পায় না।

এখনকার অবস্থায়, এই নতুন নিয়মে এঁদের মৃত্যুর ঘটনাগুলো অপঞ্জীকৃত অবস্থায় থেকে যাওয়া আরও অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। NCRB-র নতুন উপবিভাগে হয়ত খুব সামান্যসংখ্যক ঘটনাই স্থান পাবে। বেশীর ভাগই গণ্য হবেন কৃষিশ্রমিক হিসাবে। ২০১৪ সালের রিপোর্টে ঠিক এই ব্যাপারটাই ঘটেছে। ২০১৪ সালে যে সমস্ত কৃষিশ্রমিকেরা আত্মহত্যা করেছেন, তাঁদের সংখ্যা ৬,১৭০। এই সংখ্যা কৃষকদের তুলনায় এক হাজারের মতন বেশী। অন্ধ্রপ্রদেশে ২০১৪ সালে মাত্র ১৬০ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন, কিন্তু কৃষিশ্রমিকদের আত্মহত্যার সংখ্যা এই বছরেই প্রায় তিন গুণ বেশী।

NCRB-র বক্তব্য – “ধরে নেওয়া হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট পুলিশ থানা তাঁদের তদন্তের ভিত্তিতে মৃতদের কৃষক বা কৃষিশ্রমিকে শ্রেণীবিভাগ করেছেন।” যদিও NCRB বলে রেখেছেন, কোথাও কোনো বেচাল দেখলে তাঁরা সংশ্লিষ্ট রাজ্যের কৈফিয়ত তলব করবেন।

সমস্যা যে আছে, সেটা NCRB বিলক্ষণ জানেন। আরে জানেন বলেই অফিসারেরা স্বীকার করেন, কেবলমাত্র সেই ভাগচাষীদের মৃত্যুই রেকর্ড করা হয়েছে যাঁর চুক্তির কাগজেপত্রে কোনো অস্তিত্ব আছে। তবে NCRB এই কথাও বলেন – “NCRB এই মুহূর্তে ভাগচাষীদের অধিকার বা সমস্যা – যা এক রাজ্যভেদে আলাদা আলাদা আকার নেয় – এ-সংক্রান্ত কোনো বিশদ অধ্যয়নে যেতে চায় না।” এই হল দেখার মত বিষয়। ভাগচাষীদের মৃত্যুর নথিভুক্তিকরণ বা তার অভাবের কারণে ২০১৪ সালের তথ্য তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। সারা ভারত কিষাণ সভার উপাধ্যক্ষ মল্ল রেড্ডি বলছেন – “NCRB বহু ভাগচাষীকেই কৃষিশ্রমিক বলে ভুল করছেন।”

কিষান সভার চাপে পড়ে ২০১১ সালে অন্ধ্র প্রদেশের সরকার একটি লাইসেনসড কাল্টিভেটরস অ্যাক্ট প্রবর্তন করেন, যাতে করে ভাগচাষীদের আলাদা করে চিহ্নিতকরণ সম্ভব হয়। ব্যাঙ্কের লোন পাবার সুবিধা করে দেবার জন্য ভাগচাষীদের দেওয়া হয় ‘লোন এলিজিবিলিটি কার্ড’। কিন্তু, মল্ল রেড্ডির কথায়, অন্ধ্রের ৩২ লক্ষ ভাগচাষীর মধ্যে নব্বই শতাংশই না কি সেই কার্ড পান নি। ফলে তাঁদের ভাগচাষী-মর্মে কোনো পরিচয়পত্র জোটে নি। প্রসঙ্গত, অন্ধ্রের কৃষকদের এক-তৃতীয়াংশ ভাগচাষী। কিষান সভার মতে, ২০১৪ সালের NCRB-র তথ্যে যত কৃষক আত্মহত্যা অন্ধ্রের ক্ষেত্রে দেখানো হয়েছে, তার বেশী ঘটনা ঘটেছে বছরের প্রথম সাত মাসের ভেতরেই।

(ভাগচাষীদের নিয়ে সমস্যা ভারতীয় ব্যাঙ্ক সংঘেরও। তাঁদের মতে, ভাগচাষীদের পৃথক পরিচয়পত্র না থাকার কারণে ব্যাঙ্কিং-এর ক্ষেত্রেও অনেক অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে।)

ভাগচাষী-সংক্রান্ত সমস্যা ছাড়াও NCRB-বিরচিত কৃষকের আত্মহত্যার সংখ্যা নানাবিধ সমস্যায় কলুষিত। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হল একতা বড়ো অংশকে ‘অন্যান্য’ বিভাগে ঠেলে দেওয়া নিয়ে। আত্মহত্যায় প্রথম পাঁচ রাজ্যে ২০১৪ সালে ‘অন্যান্য’ বিভাগে পঞ্জীকরণের সংখ্যা ২০১৩-র তুলনায় দ্বিগুণ। কর্ণাটকের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা বেড়েছে এক বছরে ২৪৫ শতাংশ। অন্ধ্র প্রদেশের ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধির হার ১৩৮ শতাংশ। মহারাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ৯৪ শতাংশ। মধ্য প্রদেশ ও ছত্তিশগড়ের ক্ষেত্রে যথাক্রমে ৮৯ এবং ৩০ শতাংশ।

সরকারী NCRB পরিসংখ্যান-মোতাবেক ‘অন্যান্য’ বিভাগে আত্মহত্যার সংখ্যার নাটকীয় বৃদ্ধি

২০১১ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ছত্তিশগড় কৃষকদের আত্মহত্যার ঘটনার সংখ্যা শূন্য দেখিয়ে আসছে। যদিও ‘অন্যান্য’ বিভাগে গড় সংখ্যায় বৃদ্ধি হয়েছে ৮৩ শতাংশ (১,৪৭২)। কারা এই ‘অন্যান্য’ তা বলতে পারার জন্য কোনো পুরষ্কারের ব্যবস্থা নেই।

সমস্ত রাজ্যের যোগফল ধরলে ‘অন্যান্য’ বিভাগে ঘটনার সংখ্যা ২০১৩ সালের ২৪,৮০৯ থেকে ২০১৪ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১,২১৬-তে। অবাক হবার বিষয় এই যে, ‘অন্যান্য’ বিভাগ থেকে ১৫,৭৩৫টি মৃত্যুর ঘটনা ‘দিনমজুর’ নামে নতুন বিভাগ করে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবুও ‘অন্যান্য’ বিভাগের বৃদ্ধির হার এতটাই বেশী।

এই ‘অন্যান্য’ বিভাগে পঞ্জীকৃত আত্মহত্যার সংখ্যা সারা দেশের সমস্ত আত্মহত্যার (শুধু কৃষকের নয়) প্রায় এক-তৃতীয়াংশ – ৩১.৩ শতাংশ। শুধু পাঁচ প্রধান রাজ্যেই এই ‘অন্যান্যের’ সংখ্যা ১৬,২৩৪। ২০১৩-এ এই সংখ্যা ছিল ৭,১০৭।

NCRB-র রিপোর্টে ‘স্বনিয়োজিত ব্যক্তি (অন্যান্য)’ বলেও একটি বিভাগ আছে, যাতে উল্লেখিত সংখ্যায় ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। একটি বিভাগকে কেটে বিবিধ বিভাগে ভাগ করলে এ হওয়া স্বাভাবিক। যদিও, ছত্তিশগড়ের ক্ষেত্রে ‘স্বনিয়োজিত ব্যক্তি (অন্যান্য)’-এর তথ্যের সঙ্গে মূল কৃষক আত্মহত্যার তথ্যের একটা যোগসূত্র পাওয়া যাচ্ছে। ছত্তিশগড় ২০০৯ সালে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা ১,৮০২ বলে জানায়। সেই সময়ে ‘স্বনিয়োজিত ব্যক্তি (অন্যান্য)’-এ বলা হয় সংখ্যা ৮৬১। ২০১৩ সালে, যখন ছত্তিশগড় জানায় যে সেই রাজ্যে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা শূন্য, ‘স্বনিয়োজিত ব্যক্তি (অন্যান্য)’-র সংখ্যা দাঁড়ায় ২,০৭৭। ২০১১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ‘স্বনিয়োজিত ব্যক্তি (অন্যান্য)’-র পরিসংখ্যানকে যদি যোগ করা যায়, তবে দেখা যাবে যোগফল সেই রাজ্যের মোট আত্মহত্যার ঘটনার ৬০ শতাংশ।

 

‘অন্যান্যের’ অন্যান্য কথা…

এই ‘অন্যান্য’ স্তম্ভের এক ভয়াবহ ইতিহাস আছে। ২০০১ সালে অন্ধ্র প্রদেশের অনন্তপুর জেলায় ১৯৯৭ থেকে ২০০০ পর্যন্ত ১,০৬১টি আত্মহত্যার ঘটনায় কারণ হিসাবে ‘অসুস্থতা’ লিখে দেয় সেখানকার জেলা ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো। এর মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে লেখে ‘পেটে প্রচণ্ড যন্ত্রণা’। এই কথা লেখা হয় সেইসব মৃত কৃষকদের ক্ষেত্রে যাঁরা কীটনাশক খেয়েছেন আত্মহত্যার জন্য, এবং মৃত্যুর আগে পেটের যন্ত্রণায় কষ্ট পেয়েছেন। পুলিশের বদান্যতায় বিষয়টা সম্পূর্ণ উলটে যায়। এর ফলে, আত্মহত্যা করেছেন অনন্তপুরে এমন কৃষকদের সংখ্যা ৮২ শতাংশ ঠাঁই পায় ‘অন্যান্য’ এবং ‘রোগভোগে মৃত’ স্তম্ভের মধ্যে।

তথ্যের এই নতুন শ্রেণীবিন্যাস অনন্তপুরের গণনার স্বর্ণযুগকে ফিরিয়ে আনতে পারে।

এ-ছাড়া আর কোনো ছলাকলা নেই এমন নয়। মহিলা কৃষকের মৃত্যু নিয়মিতভাবে কম গোণা হয়। কারণ পরিবারগুলি বাড়ির মহিলাদের কৃষক হিসাবে দেখাতে চায় না। তা ছাড়াও, জমির পাট্টায় খুব কম ক্ষেত্রেই মহিলাদের নাম থাকে। ফলে, এই ধরণের আত্মহত্যার ঘটনা গিয়ে স্থান পায় ‘গৃহবধূ’ বিভাগে। কোনো কোনো রাজ্যের ক্ষেত্রে কখনও কখনও এই ‘গৃহবধূ’রা মোট মহিলা আত্মহত্যার প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত অধিকার করে থাকেন।

জাত নিয়ে সংস্কারও কে চাষী কে নয় নির্ধারণে ছাপ ফেলে। আদিবাসী বা দলিতদের খুব কম ক্ষেত্রেই ঠিকঠাক জমির দলিল বা পাট্টা থাকে। তাঁদের দেখানো হয় অনধিকার-প্রবেশকারী হিসাবে, এবং তাঁদের আত্মহত্যার ঘটনা কৃষকদের হিসাবে ্ষুব অল্পই স্থান পায়।

বিষয় হল এই যে, এই ধরণের নানান সংস্কার ইত্যাদির ফলে তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে যে ফাঁকটা ছিল, নতুন নিয়মে সেই ফাঁকটাকেই একটা বৈধতা দেবার চেষ্টা চলছে। যা ছিল স্খলন তা-ই হয়ে উঠছে নিয়ম। ছত্তিশগড় আর পশ্চিমবঙ্গকে দিয়ে ২০১১-১২ সালে যে তথ্যদুর্নীতির সূত্রপাত, সেই পথে বাকী রাজ্যগুলির এগিয়ে আসতে কোনো বাধা রইল না। এর ফলে রাজ্য রাজধানীতে আসীন সরকারী কর্মীর হাতে এলো অসীম ক্ষমতা। রাজনৈতিক সুবিধা-অসুবিধার কথা মাথায় রেখে তৈরী করা হবে পরিসংখ্যান যার সঙ্গে বাস্তবতার যোগ থাকবে না এতোটুকু। রাজ্য সরকারগুলি তাঁদের স্ব স্ব অভিপ্রায় অনুসারে নিজেদের মনের মতন করে আত্মহত্যার পরিসংখ্যানকে ঢেলে সাজাবেন।

তার শত দোষ স্বত্বেও NCRB-র তথ্য রাজ্য সরকারের দেওয়া তথ্যের থেকে কিছুটা আলাদা ছবি দেয়। ২০১৩ সালে মহারাষ্ট্র সরকার ১,২৯৬টি কৃষক আত্মহত্যার কথা জানান। NCRB বলে এই সংখ্যা ৩,১৪৬। ২০১১-১২-র ক্ষেত্রেও আমরা একই ঘটনা দেখতে পাই। ২০১৪ সালে NCRB-র ২,৬৫৮ রাজ্যের ১,৯৮১-র অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছে। এর পর থেকে হয়ত রাজ্যের তরফে পাঠানো তথ্যেই NCRB-র মোহর থাকবে। কে বলতে পারে?

 

উপসংহার

বিগত উনিশ বছর ধরে NCRB-র তথ্য একেবারে নির্ভুল না হলেও মোটের ওপর নির্ভরযোগ্য ছিল এই কারণে যে, এই তথ্যের থেকে প্রকৃত ছবির একটা হদিশ অন্তত পাওয়া যেত। সেই নির্ভরযোগ্যতা নষ্ট হয়ে গেছে।

কেন দরকার পড়ল আত্মহত্যা-সংক্রান্ত তথ্য পরিবেশনের পুনর্বিন্যাসের? এই সংখ্যাগুলি কি সরকারের কাছে অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়াচ্ছিল? সেই কারণেই কোনোমতে এই কথা প্রমাণ করা, যে আত্মহত্যার হিসাব আসলে হকিকতের থেকে একটু বেশীর দিকেই আছে?

NCRB অবশ্য বলেন যে এই তথ্য পরিবেশনের পথগুলো মাঝেমধ্যেই বদল করা হয় কৃষিব্যবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বিভিন্ন সংস্থার প্রয়োজন বা অনুরোধ অনুযায়ী। সরকারী বা বেসরকারী কোনো তরফেই কোনোদিন এই ব্যবস্থার কোনো সংশোধন দাবী করা হয় নি, এই কথাও তাঁদের তরফে বলা হয়ে থাকে। যদিও, এই কথা মনে করবার যথেষ্ট কারণ আছে যে ২০১৩ সালে তৎকালীন কৃষিমন্ত্রীর ‘অনুরোধে’ NCRB কিছু ব্যবস্থা নেয়।

তর্কটা তাহলে এইখানে দাঁড়ায় যে – আগে সব পরিসংখ্যান এক জায়গায় জড়ো করে বলা হত। এখন ভেঙে ভেঙে বলা হচ্ছে যাতে বুঝতে সুবিধা হয়। এই তর্ক ধোপে টেঁকে না, কারণ – ২০১৩ সাল পর্যন্ত তথ্যে স্বনিয়োজিতদের কথা পরিষ্কারভাবে বলা আছে। কৃষিশ্রমিকেরা স্বনিয়োজিত নন। সংসদে প্রশ্নের উত্তরেও সরকার কৃষকমৃত্যুর ক্ষেত্রে NCRB-র তথ্য উল্লেখ করে কৃষকদের কথা বলেছেন। ভাগচাষী বা কৃষিশ্রমিকদের কথা বলেন নি।

দিন দিন গভীরতর হতে থাকা এই তীব্র সমস্যার – আত্মহত্যা যার একটা লক্ষণ মাত্র – প্রতিকারে সরকার তবে কি করছেন? সমস্যার মোকাবেলার বদলে তথ্য-পরিসংখ্যান নিয়ে খেলা দেখাচ্ছেন যাতে সকলের চোখে ধুলো দেওয়া যায়। ‘শূন্য’ ঘোষণার যে প্রবণতা শুরু হয়েছিল তা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। ২০১৪ সালের রিপোর্টে তথ্যের ইচ্ছাকৃত বিকৃতি সুনিপুণভাবে করা হয়েছে। তবুও আমরা আত্মবিভ্রমে মজে থাকি। সংখ্যা কত তা না জানলে কারোরই কিছু যাবে-আসবে না। আর গোণার পদ্ধতি বদলালেই, কে না জানে, গুনতিও বদলে যায়। গ্রামের অবস্থা যে তিমিরে সেই তিমিরেই থাকে।

 

 

(রচনার তারিখ ৫ই অগাস্ট ২০১৫ সাল। আমরা শ্রী সাইনাথকে অনুরোধ করি এই রচনায় সাম্প্রতিকতম তথ্য দিতে। উনি বলেন, নতুন পদ্ধতিতে যেভাবে তথ্য আসছে তাতে করে আগের সঙ্গে এখনকার তথ্যকে তুলনীয় রাখাটা একটা পরিশ্রমসাধ্য এবং কঠিন কাজ। হয়ত সময়ে আমরা ওঁর থেকে এখনকার অবস্থার এরকমই তথ্যনিষ্ঠ প্রতিবেদন পাব। আপাতত, দেশের বিভিন্ন জায়গায় কৃষক অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে তৈরী ওঁর এই ইউটিউব ভিডিওটি অনুসন্ধিৎসু পাঠিকা-পাঠকের কাজে আসবে। এই ভিডিওর আপলোডের তারিখ ১১ই জুন ২০১৭।

“কেন অসন্তুষ্ট আমাদের কৃষকেরা?” – https://www.youtube.com/watch?v=cyyvcP6MuoA)

 

মূল রচনাটি ইংরাজিতে পড়ার জন্য এইখানে দেখুন

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...