বালুকা, বনস্পতি

বালুকা, বনস্পতি -- গৌতম বসু

গৌতম বসু

কবি ও সম্পাদক মহাশয় একটি বিচিত্র প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ অতর্কিতে আমার উপর নিক্ষেপ করেছেন। বিশেষ কোনো প্রসঙ্গে বিচার করে একটি গ্রহণযোগ্য মীমাংসা সূত্রে পৌঁছনো যে সম্ভব, এ-মনোবল আমার এক সময় ছিল, আজ আর নেই। অন্য কাউকে কিছু বোঝাতে যাওয়ার প্রচেষ্টার করুণ পরিণতি দেখতে পাই সর্বত্র, চলার পথে, কর্মস্থলে, গৃহে, দূরদর্শনে সম্প্রচারিত বিভিন্ন বিবাদানুষ্ঠানে। এখন মনে হয়, অন্তত নিজের কাছে স্পষ্ট করে নেওয়ার জন্য ভাবনাসূত্রগুলি লিখে রাখাই একমাত্র সঠিক প্রণালী। আদালত অবশেষে বাবরি মসজিদ বিতর্কের একটি সমাধানসূত্র খুঁজে পেয়েছেন; সমাধানসূত্রটি রয়েছে নিজের জায়গায়, একটি ভিন্ন ক্ষেত্রে সম্পাদক মহাশয়ের অনুভব জেগে উঠেছে। তিনি বলেছেন বনপথচারী রামচন্দ্র একদিকে, অন্যদিকে সম্রাট বাবর, এঁদের অস্তিত্বের ভিন্নতা এমনই যে আদালতের একটি রায়ে দুটি নাম একত্রে উচ্চারিত হওয়া খুবই অসঙ্গতিপূর্ণ। তিনি আরও একটি অভিমত প্রকাশ করেছেন: কল্পজগতের রামচন্দ্রকে বাস্তবজগতের বাবরের পাশে রেখে আমাদের ভাবনার জগতের উপর একটি বিষম আঘাত হানা হয়েছে! প্রসঙ্গটি নিয়ে ভাবার প্রয়োজন আছে এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই, যদিও মানতেই হয় যে এমন উদ্ভট একটা ভাবনা একজন কবির মাথায় যদি না আসে তাহ’লে আর কারই বা মাথায় খেলবে?

অস্তিত্বের ভিন্নতা বিষয়ে যে কথাটি উঠে এসেছে সেটি নিয়ে বিস্তারিত ভাবে চিন্তা করলে হয়তো প্রতীয়মান হবে যে, প্রকৃতপক্ষে, অস্তিত্বের কোনো ভিন্নতাই নেই। বাবর পবিত্র কোরান-এর নির্দেশাবলীর পালনকর্তা মাত্র, তার বাইরে অন্তত এ- প্রসঙ্গে তাঁর কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। ধ্বংসপ্রাপ্ত ধর্মস্থানটি যাঁর গুণকীর্তনে নিয়োজিত, তিনি অন্য:

‘ভূলোকের সমস্ত আর দ্যুলোকের সমস্ত, সমস্তই আল্লাহ-র/তোমাদের অন্তরে যা রয়েছে তা তোমরা প্রকাশ করো অথবা গোপন রাখো, তিনি তাঁর হিসাব গ্রহণ করবেন এবং তারপর তাঁর অভিলাষ মতো কাউকে তিনি মার্জনা করবেন, কাউকে প্রদান করবেন শাস্তি, আল্লাহ সমুদয় কর্মে সক্ষম।’

(পবিত্র কোরান/ সূরা ২/ পারা ৩/২৮৪)

পবিত্র কোরানের সূরাগুলির প্রারম্ভে আরবী বর্ণমালার তিনটি অক্ষরের উল্লেখ পাওয়া যায়: আলীফ-লাম-মীম। ইসলাম ধর্মাবলম্বীগণ বিশ্বাস করেন এ-অক্ষরগুলি আল্লাহ-র দান এবং এগুলির মর্মার্থ একমাত্র তাঁরই বোধগম্য। ইসলামধর্ম বিমূর্ত ভাবনার যে স্তর স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছে তার তুলনা আমরা অন্যত্র দেখি না। ঈশ্বর ভাবনা এখানে একটি পরম উপলব্ধির উপর চিরপ্রতিষ্ঠিত: মানুষের অপূর্ণতা ও অক্ষমতা। ভাবনায়, ভাষায় এবং লিপিতে মানুষের অক্ষমতার কথা, এবং সমস্ত কর্মকাণ্ডের অপূর্ণতার কথা এমন অক্লান্তভাবে, এমন সুস্পষ্টভাবে, এমন বিনম্র শিল্পসুষমায় মণ্ডিত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে:

‘এবং সমুদয় বৃক্ষ যদি লেখনী হ’ত, এবং এই সমুদ্রের সঙ্গে আরও সাতটি সমুদ্র যুক্ত হয়ে যদি একযোগে কালি সরবরাহ করত, তথাপি আল্লাহ-র গুণগান থাকত অসমাপ্ত। আল্লাহ সর্বশক্তিসম্পন্ন, পরমপ্রজ্ঞাবান।’

(পবিত্র কোরান/ সূরা ৩১/ পারা ২১/২৭)

বস্তুত, চরম ব্যর্থতা বোধের কথাসকল বারংবার উচ্চারিত ক’রে, বারংবার আল্লাহ-র করুণার কথা স্মরণ ক’রে, ইসলামধর্ম এক অন্যতর সার্থকতার শিখর স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে হয়। আমি সর্বত ভাবে অক্ষম, আমি সঠিক পন্থা হ’তে বিচ্যুত হইনি, এইটি আমার যোগ্যতা; আমি আল্লাহ-র করুণাবর্ষণের ক্ষেত্র।

মধ্যপ্রাচ্যের নির্মম মরুপ্রান্তরজাত ভাবধারা থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে আমরা যদি ক্ষণকাল এসে দাঁড়াই ভারতীয় উপমহাদেশের নদনদীশোভিত বনভূমিতে, একটি সম্পূর্ণ বিপরীত উপলব্ধি ভেসে ওঠে:

‘ওঁ পূর্ণমদা পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে।

পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।।

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ’

(ঈশোপনিষৎ/ শান্তিপাঠ)

মানুষের এই চেতনাও প্রকৃতিরই দান; নির্জন বনভূমিতে গাছের তলায় ব’সে, পাখিদের কাকলি শুনতে শুনতে, হরিণ শাবকদের কোমল চলাফেরা দেখতে-দেখতে, পূর্ণতার বোধ ব্যতিরেকে আর কোন বোধই বা জাগ্রত হ’তে পারত? যা পূর্ণ, তার কি কোনো ক্ষয়প্রাপ্তি নেই? অবশ্যই আছে, কিন্তু প্রাচীনকালের ঋষিগণ প্রকৃতি থেকে এ-শিক্ষাই গ্রহণ করেছিলেন যে পূর্ণ থেকে যা-ই বিয়োগ করি না কেন, আমরা পূর্ণতেই ফিরে আসি, পূর্ণই অবশিষ্ট থাকে। ভারতীয় উপমহাদেশের এই বীজমন্ত্র দূরে সরিয়ে রেখে রামায়ণ-মহাভারতের মর্মোদ্ধার করা সম্ভব নয়। যুদ্ধ সমাপ্ত হয়েছে, রামচন্দ্র তার সহযোদ্ধাদের থেকে বিদায় নিচ্ছেন; মহর্ষি বাল্মীকি লিখেছেন:

‘একদা রাম সুগ্রীবকে কহিলেন, সৌম্য! তুমি এক্ষণে দেবগণেরও দুরাক্রমনীয় কিষ্কিন্ধা নগরীতে যাও এবং অমাত্যগণের সহিত নিষ্কণ্টকে রাজ্য ভোগ করো। তুমি পরম প্রীতির চক্ষে অঙ্গদকে দেখিও এবং হনুমান, মহাবল নল, সুষেণ, তার কুমুদ, দুর্ধর্ষ নীল, বীর শতবলি, মৈন্দ, দ্বিবিদ, গজ, গবাক্ষ, গবয়, শরভ, ঋক্ষরাজ জাম্ববান, গন্ধমাদন, ঋষভ, সুপাটল, কেসরী, শরভ, শুম্ভ, শঙ্খচূড় এবং আর আর যে-সমস্ত বানর আমার সাহায্যার্থে প্রাণপণ করিয়াছিলেন তুমি তাঁহাদিগকে প্রীতির চক্ষে দেখিও, কদাচ তাঁহাদিগের কোনো অপকার করিও না। রাম কপিরাজ সুগ্রীবকে এই কথা বলিয়া পুনঃ পুনঃ তাহাকে আলিঙ্গনপূর্বক মধুর বাক্যে বিভীষণকে কহিলেন, রাক্ষসরাজ! তুমি গিয়া ধর্মানুসারে লঙ্কা শাসন করো। ভ্রাতা কুবের রাক্ষসপুরবাসী ও আমরা সকলেই তোমাকে ধর্মজ্ঞ বলিয়া মানি। তুমি কদাচ অধর্মবুদ্ধি করিও না, বুদ্ধিমান রাজারই রাজ্যভোগ হয়। এক্ষণে নির্বিঘ্নে প্রস্থান করো, তুমি প্রীতিসহকারে সুগ্রীবের সহিত আমাকে নিয়তই স্মরণ রাখিও।

তখন বানর, ভল্লুক ও রাক্ষসেরা রামের এই সমস্ত কথা শুনিয়া তাঁহাকে সাধুবাদপূর্বক পুনঃ পুনঃ প্রশংসা করিতে লাগিল। কহিল, রাজন! তোমার বুদ্ধি বল ও প্রকৃতিমাধুর্য ব্রহ্মার ন্যায় অলৌকিক। হনুমান প্রণাম করিয়া কহিলেন, রাজন! তোমার প্রতিই যেন নিয়ত আমার উৎকৃষ্ট প্রীতি ও ভক্তি থাকে, মনের ভাব যেন আর অন্যত্র না যায়। যাবৎ পৃথিবীতে রামকথা থাকিবে তাবৎ যেন আমি জীবিত থাকি। তোমার এই দিব্যচরিত অপ্সরা-সকল যেন নিয়ত আমায় শ্রবণ করায়। আমি তোমার এই চরিতকথা শুনিয়া বায়ু যেমন মেঘকে দূর করিয়া দেয় তদ্রূপ তোমার অদর্শনজনিত উৎকণ্ঠা দূর করিব।

তখন রাম উৎকৃষ্ট আসন হইতে গাত্রোত্থানপূর্বক হনুমানকে আলিঙ্গন করিয়া স্নেহভরে বলিলেন, বীর! তোমার যেরূপ অভিপ্রায় নিশ্চয় তাহাই হইবে। যদবধি এই জীবলোকে আমার চরিতকথা থাকিবে তাবৎ তোমার শরীর ও কীর্তি স্থায়ী হইবে। যদবধি এই সমস্ত লোক থাকিবে তাবৎ আমার চরিতকথা বিলুপ্ত হইবে না। তুমি আমার যত উপকার করিয়াছ তাহার এক-একটির জন্য তোমাকে প্রাণ দেওয়া কর্তব্য কিন্তু সমস্ত উপকারের যাহা অবশিষ্ট তজ্জন্য আমরা তোমার নিকট ঋণী থাকিলাম। মনুষ্য আপৎকালেই প্রত্যুপকার চায়, অতএব তোমার কোনো বিপদ না ঘটুক, তুমি আমার যে উপকার করিয়াছ আমার দেহে জীর্ণ হইয়া যাক। এই বলিয়া রাম স্বীয় কণ্ঠ হইতে চন্দ্রধবল বৈদূর্যমণিশোভিত হার উন্মুক্ত উহার কণ্ঠে বন্ধন করিয়া দিলেন। হনুমান ঐ হারের প্রভায় চন্দ্রালোকশোভিত সুমেরু পর্বতের ন্যায় উজ্জ্বল হইয়া উঠিলেন। মহাবল বানরেরা ক্রমে ক্রমে গাত্রোত্থান করিয়া রামকে প্রণামপূর্বক নির্গত হইতে লাগিল। রাম সুগ্রীবকে আলিঙ্গন করিলেন। বিভীষণ প্রভৃতি সকলেই যাত্রাকালে দুঃখে বিমোহিত হইয়া অশ্রু বিসর্জন করিতে লাগিলেন। বাষ্পভরে সকলের কণ্ঠরোধ হইয়া গেল। সকলেই শূন্যমনা। দেহাভিমানী দেহত্যাগ করিবার কালে যেমন কাতর হয়, সকলেই সেইরূপ কাতর হইয়া স্ব-স্ব গৃহে যাত্রা করিল।’

(বাল্মীকি রামায়ণ/ উত্তরকাণ্ড/ সর্গ ৪০)

আমাদের মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত গাছ যদি কলম হ’ত আর সাত সমুদ্রের জল যদি কালি হ’ত, তা হ’লেও রামচরিত কথার মহিমা সম্পূর্ণ ধরা দিত না। কিন্তু, আমরা কি অপূর্ণতার স্বাদ নিয়ে ফিরে যাচ্ছি? নিশ্চিত ভাবে না, আমাদের বিয়োগব্যথা ফিরে যাচ্ছে মূলে, জেগে উঠছে এক অন্যতর, মহত্তর পূর্ণতা।

আমরা দুটি ভিন্ন মনোলোকের উল্লেখ করলাম; দুটি ভাবধারাই মানুষের চেতনায় প্রকৃতি দ্বারা রোপিত অভিঘাতের ফসল, একটি শুষ্ক, তপ্ত বালুকারাশির দান, অন্যটি হরিৎ বনস্পতির। বালুকারাশি ও বনস্পতি উভয়ই যেমন সত্য, তেমনই সত্য দুই পৃথক প্রতিবেশে গ’ড়ে ওঠা দুই ধর্ম চেতনা। আমাদের চরম দুর্ভাগ্য, এই ভিন্নতা বিগত এক সহস্র বছরে সংঘাতের চেহারা নিয়েছে, আমরা জয়-পরাজয়ের হিসেব কষতে বসেছি। আমাদের অশেষ দুর্ভাগ্য, সব বুঝেও আমরা এই সরল কথাটি বুঝে উঠতে পারি নি যে ভগবান রামচন্দ্র একটি ধারণা, কয়েক শত বছর পূর্বে মন্দির ভেঙে ফেলে তাঁর চরিতকথার মহিমা যেমন মুছে ফেলতে সক্ষম হ’ননি সম্রাট বাবর, ঠিক তেমনই, আজ, গাঁইতি-শাবল সহযোগে পরম করুণাময় আল্লাহ-র ধারনাটিও চূর্ণবিচূর্ণ করা যাবে না।

 

ঋণস্বীকার:-

 

  1. Interpretations of the Meanings of the Noble Qur’an in the English Language. Dr. Muhammad Taqi-ud-Din-Al-Hilali and Dr Mahammud Muhsin Khan. Maktaba Dar-us-Saleam, Riyah, Saudi Arabia, 2007.
  2. The Meanings of the Holy Quran Mohammed Marmaduke pickthall UBS Publishers Distributors (P)Ltd. New Delhi, 2006.
  3. কোরাণ শরীফ / অনুবাদ মওলানা মোবরক করীম জওহর / হরফ প্রকাশনী কলকাতা ১৯৭৪।
  4. বাল্মীকি রামায়ণ / অনুবাদ হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য / ভারবি, কলকাতা, অখণ্ড সংস্করণ ১৯৭৮।

 

রচনাটি মিরুজিন সূচনা সংখ্যা ১৪১৮-তে পূর্বপ্রকাশিত। শ্রী কৌশিক বাজারীর সৌজন্যে প্রাপ্ত।

 

(ছবি: ইন্টারনেট – পল গগাঁর ‘নীল গাছ’)

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. এ এক আশ্চর্য লেখা। এবং গৌতম বসুর প্রজ্ঞা স্পষ্ট হয়ে ওঠে আবারও।
    এখানে ওনার আরো লেখা চাই।

আপনার মতামত...