কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়
বেলটা শুনতে পেয়েছিল মিতা। ছাদে ছিল ও তখন। কাপড় মেলছিল। ঠিক মেলছিল না, মেলা হয়ে গিয়েছিল অনেকক্ষণ, ও দাঁড়িয়ে ছিল ছাদের দক্ষিণপূর্বের কোণাটায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রঞ্জনের সঙ্গে কথা বলছিল। ঠিক কথাও বলছিল না, ঝগড়া করছিল। কথা ফুরিয়ে গেছে ওদের। এখন ঝগড়া চলছে। একই ঝগড়া, ছ’মাস ধরে চলছে। বেলটা যখন বাজল তখন মিতা সত্যি বলতে ঝগড়াও করছিল না। ঝগড়াও ফুরিয়ে গিয়েছিল। বেলটা যখন বাজল তখন ও নিমগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে চোখ মুছছে, নাক টানছে। অপেক্ষা করছে কখন ওর চোখের ছলছল ভাব কমবে আর নাকের লাল কমে মুখের বাকিটার সঙ্গে মিশে যাবে।
বেলটা তখনই বাজল। একবার। দু’বার। তিনবার। প্রথমবার আর দ্বিতীয়বারের মধ্যে যতটা ফাঁক ছিল, দ্বিতীয় আর তৃতীয়বারের মধ্যে ফাঁকটা তার থেকে কমে গেল, আর চার নম্বর টিংটং-টা বাজল তিন নম্বর টিংটং-এর একেবারে ঘাড়ে ঘাড়ে। আর সেটার রেশ মেলাতে না মেলাতেই খনখন করে উঠল একটা গলা।
মিতাআআআ! অ্যাই মিতাআআ! একগাদা টাকা নেওয়ার বেলা লজ্জা নেই অথচ কাজের সময় একটারও দেখা নেই। তাড়িয়ে দেব সবক’টাকে।
এখন চাকরি চলে গেলে মিতা জলে পড়বে। স্রেফ টাকার জন্যই এই বদখত চাকরি নেওয়া। তাই ওর এক্ষুণি নেমে যাওয়া উচিত। কিন্তু মিতা নামল না। চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল। বুড়ি ছাড়ালে ছাড়িয়ে দেবে। টাকা লাগবে না ওর। নতুন করে চোখ জ্বালা করল ওর।
মিতা অনেকদিন এই ধরনের চাকরি নেওয়া এড়িয়ে চলেছে। প্রাইভেট চাকরি করলে একটা সময়ের পর মালিক চাকরের সম্পর্কের মাঝখানের দাগটা ঘোলাটে হতে শুরু করে, যেটা মিতার ভয়ানক অপছন্দ। একসঙ্গে বসে চা খেতে হয়, দুঃখের কথা শুনতে হয়। শুনতে মিতার আপত্তি নেই, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে কেউই নিজের খবর ফ্রিতে দেয় না। ওটা হচ্ছে টোপ, অন্যের পেটে হাত বুলিয়ে খবর টেনে বার করার। তারপর আসল কাজ শুরু হয়। গুচ্ছের প্রশ্ন। বাড়ি কোথায়। বাবা কী করে। মা মরল কীভাবে। দাদার যেন কী একটা পুলিস কেস? মিতার বিয়ে হচ্ছে না কেন। প্রেমিক আছে কি না। তার সঙ্গে জাতে মেলে কি না।
অফিসে এইসব ঝামেলা নেই। মিতা এতদিন মোড়ের মাথার ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করত। পাঁচজন লোক পাঁচটা টেবিলে বসে থাকে, কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না, দায় না পড়লে কেউ কারও সাথে কথা বলে না। যাও, কাজ করো, মাসের শেষে মাইনে পাও। খেল খতম।
কিন্তু ও চাকরিতে রেট কম। টাকা এই সব চাকরিতে। আজকাল পাড়া জুড়ে প্রচুর বুড়োবুড়ি। কেউ কেউ দোকা, অনেকে একাও। তাদের সারাদিনের লোক লাগেই। না হলে কে বাথরুমে গিয়ে আছাড় খাবে, চা করতে গিয়ে হাত কেঁপে গরম জল গায়ে ফেলবে। মাসখানেক আগে পাশের পাড়ায় এক বুড়িকে গলায় ছুরি মেরে গয়নাগাঁটি নিয়ে ভেগেছে কাজের মেয়ে। কাজেই ভরসা করার মতো লোক চাই। লোকাল লোক হওয়া চাই। কাজ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হওয়া চাই। কথাবার্তা শিক্ষিত হওয়া চাই। সবদিক থেকে মিতা খাপে খাপ। কাজেই মাইনে বেশি হাঁকতে পারে।
এই বুড়ির কাছে একটু বেশিই বেশি হেঁকেছিল। এক মাসে এ বাড়ি থেকে তিন তিনটে মেয়ে ভেগেছে। কারও সবজি কাটা পছন্দ নয়। কে ভেজা প্লেটে বিস্কুট নিয়ে আসে। এই সব নিয়ে কুরুক্ষেত্র। এজেন্সিতে যেদিন টহল দিতে গিয়েছিল মিতা সেদিন শেষ তাড়া খাওয়া মেয়েটা দাদুর ওপর তম্বি করছিল। এসব বাড়িতে আর পাঠাবে না খবরদার। তার থেকে দশদিন বেকার বাড়িতে বেকার বসে থাকব সেও ভি আচ্ছা।
মিতাই দাদুর কাছে তদবির করেছিল এই বাড়িতে ঢোকানোর জন্য। তবে বাজার রেটের দেড়গুণ হেঁকেছিল। মিতাও ডেসপারেট টাকার জন্য, বুড়িও ডেসপারেট লোকের জন্য। মিতার অনুমান ভুল হয়নি। পরের দিন দাদু ফোন করে বলেছিল, মাসিমা রাজি।
আরও একটা কারণ ছিল মিতার চাকরিটা নেওয়ার। ফাইনাল কথা বলার আগে দাদু ভুরু নাচিয়ে বলেছিল, কী রে, পারবি তো? ঝামেলার বাড়ি কিন্তু।
মিতাকে কেউ কিছু পারবে না বললে ওর রোখ চেপে যায়। পারবে না বলাতে স্কুলে একবার একটা ছোটগল্প গোটাটা মুখস্থ করে গিয়েছিল। রঞ্জনের সঙ্গে প্রেমটাও রোখ চেপেই। সবাই বলেছিল, রঞ্জনের প্রেমে পড়া বারণ।
মিতা দেখিয়ে দিয়েছে রঞ্জনের সঙ্গে প্রেম করে। চাইলে আরও অনেকের সঙ্গেই করতে পারত। মিতার নাকচোখ বোঁচা, রং শ্যামলা, কিন্তু সব মিলিয়ে একটা চটপটে, ঝকমকে ভাব আছে। মিতার প্রতি অনেকেরই ঝোঁক ছিল। রঞ্জনের তো ছিলই। স্কুলে যাওয়া আসার পথে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। বন্ধুরা বলত, এ তো পুরো কাকু রে। মিতার কাকুই পছন্দ। ওর সমবয়সী ছেলেগুলো, যেগুলোর সঙ্গে ক্লাসের মেয়েরা কোচিং থেকে ফেরার পথে আড়ালে আবডালে দাঁড়িয়ে গল্প করে, সেগুলোকে দেখলে মিতার গা জ্বলত। মিতা চোখ পাকিয়ে তাকালে ছেলেগুলো কুঁকড়ে যেত।
তবে এ বাড়িতে ঢোকার মূল কারণটা টাকাই। এই মুহূর্তে টাকা ওর ভয়ানক দরকার। ওর আর রঞ্জনের ভবিষ্যতের জন্য। বাবা এক পয়সাও দেবে না। মিতা চাইবেও না। রঞ্জনের চাকরি আছে একটা মিউনিসিপ্যালিটিতে। সেভিংস নেই। অর্ধেক সময় সিনেমার টিকিটের দাম, চাউমিনের পয়সা মিতাকেই বার করতে হয়।
বেল থেমে গেছে। বুড়ি নিজেই গেছে নিশ্চয়। না যাওয়ার কিছু নেই। বুড়িকে ডাক্তার বলেছে হাঁটাচলা করতে। সে জায়গায় সারাদিন বসে থাকবে আর খাবে। ভাজা ভর্তা ভাতে মাখা বাটা। রান্নার মেয়েটাকে পাগল করতে শুধু বাকি রেখেছে।
পনেরো মিনিট বাদে মিতা নেমে এল। ভেবেছিল একটা সুনামির মাঝে পড়বে কিন্তু চারদিক আশ্চর্যরকম চুপ। মিতা ওষুধ আর জলের গ্লাস নিয়ে ঘরে ঢুকল।
মাসিমা বসে আছেন জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে। দরজার কাছে দু’সেকেন্ড থামল মিতা। এক্ষুণি রাগ গনগনে ফর্সা মুখখানা ফিরে তাকাবে। পানের রস মাখা ঠোঁট লকলকিয়ে উঠবে। এতক্ষণে সময় হল?
মাসিমা তাকালেন না। ওষুধ আর গ্লাসটা নিয়ে মাসিমার কাছে এগিয়ে গেল মিতা।
এই নাও।
সাড়া নেই।
কী গো, ওষুধ খাও। অলরেডি আধঘণ্টা লেট হয়ে গেছে। সামান্য দ্বিধা করে মিতা বলল, আমার একটা ফোন এসে গিয়েছিল তাই…
সাদা শাড়ির ওপর রাখা নীল চিঠিখানা তখনই চোখে পড়ল ওর। অনেক কাল আগে এইরকম নীল রঙের চিঠি বাড়িতে আসতে দেখেছে মিতা। মায়ের এক পিসিমা বিজয়া আর পয়লা বৈশাখে নিয়ম করে পাঠাতেন। কী যেন বলত… হ্যাঁ, ইনল্যান্ড।
মাসিমার কোলের চিঠিটার নীল অবশ্য প্রায় সাদা হয়ে গেছে। কোণা দুমড়োনো, রোঁয়া ওঠা দুঃস্থ চেহারা।
পিওন এসেছিল?
পিওন এ পাড়ায় শেষ কবে এসেছিল মনে করতে পারে না মিতা। ছোটবেলায় খাকি ইউনিফর্ম পরে সুজিতকাকু রোজ দুপুরে টহল দিত সাইকেলে চড়ে। তখন এ পাড়ায় বাড়ি কম ছিল। বাড়ির বদলে পুকুর ছিল, মাঠ ছিল। কিন্তু যে কটা বাড়ি ছিল তাদের চিঠি আসত প্রচুর। এখন গিজগিজ বাড়ি চারদিকে, কিন্তু চিঠি আর আসে না কারও। সব কথাবার্তা হোয়াটসঅ্যাপেই সেরে নেয় সবাই।
কুর্তার পকেটে রাখা ফোনটার কথা মনে পড়ল মিতার। ঝগড়ার পর প্রায় কুড়ি মিনিট হয়ে গেছে, এখনও একবারও নতুন মেসেজে কেঁপে ওঠেনি ফোনটা।
নাঃ। এমনি একটা লোক। শার্টপ্যান্ট পরা। বলল পোস্টঅফিস থেকে আসছে।
মাসিমার এ রকম নিভুনিভু গলা আগে কখনও শোনেনি মিতা। দৃষ্টি এখনও জানালার বাইরে স্থির।
এই পোস্টঅফিসটা উঠে যাচ্ছে। ওদের না-বিলি হওয়া চিঠির বান্ডিলে এই চিঠিটা ছিল, দিয়ে গেল। মাসিমা চিঠিটা বাড়িয়ে ধরেন মিতার দিকে।
ওষুধ জল টেবিলে নামিয়ে রেখে চিঠিটা নিল মিতা। দূর থেকে যা লাগছিল তার থেকেও ধুদ্ধুড়ে দশা। কাগজ নেতিয়ে ন্যাকড়া হয়ে গেছে। ভেতরের কালি ছেপে বাইরে ফুটে উঠেছে। ধেবড়ে যাওয়া প্রাপকের নাম চোখের কাছে এনে পড়তে গিয়ে একটা সোঁতা গন্ধও পেল।
এ কবেকার চিঠি?
পঞ্চাশ বছর আগের।
মিতা হাঁ হয়ে যায়। পঞ্চাশ বছর কেমন দেখতে হয়, খায় না মাথায় দেয়, কল্পনাই করতে পারে না ও। ওর এখন বয়স কুড়ি। এখনই মাঝে মাঝে মরে যেতে ইচ্ছে করে। পঞ্চাশ বছর বয়স বাঁচা হাস্যকর ঠেকে।
টু-এর নিচে ইংরিজিতে লেখা নামটা আবছা আবছা পড়া যাচ্ছে। এম দিয়ে যে শব্দটা শুরু হচ্ছে সেটা নিশ্চয় মিস্টার বা মিসেস কিছু একটা হবে। দ্বিতীয় শব্দটা এন দিয়ে শুরু। বাকিটা ঝাপসা। তিন নম্বর শব্দটা অনেকটাই বোঝা যাচ্ছে। সেনগুপ্ত।
সেনগুপ্ত? মাসিমার বাড়ির গেটের ফলকে তো দাশগুপ্ত লেখা।
পরের লাইনটা কিছুই পড়তে পারে না ও।
সি… উচ্চারণ করে পড়ে মিতা। এ…
সি এ এস ইউ এ আর আই এন আ। ক্যাসুরিনা লেন। টু মিস নীলিমা সেনগুপ্ত, ক্যাসুরিনা লেন। মাসিমা বলে ওঠেন।
সেটা আবার কোন চুলোয়?
কাছেই। ও রাস্তার নাম বদলে গেছে এখন। পার্থসারথি বসাক রোড।
মিতার ব্রেনে চিড়িক। ওই যে নতুন ফ্ল্যাটবাড়িগুলো উঠেছে যেখানে?
ওর একটা বাড়ির পাঁচতলাতেই অপরাজিতা দিদিমণির বাড়ি। বাড়ি, নারীসমিতির অফিস, যা বলো। মিতা ঝাড়পোঁছ করতে যেত। আর যায় না। গোটা সময়টা জ্ঞান দিত। এই কর, ওই কর, এই কোর্সে ভর্তি হ, ওই ডিপ্লোমায় নাম দে, জীবনটা নষ্ট করিস না। ছেড়ে দিয়েছে মিতা। অত জ্ঞান পোষায় না ওর। নিজের জীবন নিয়ে কী করবে ও সবার থেকে ভালো জানে।
ওখানে তোমার বাপের বাড়ি ছিল? কোনখানটাতে?
ওই যেখানে ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে সেখানেই। মাসিমা ফ্যাকাসে হাসেন। বাপের বাড়ি ছিল, পুকুর ছিল, পাঠশালাও ছিল একটা। স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে আগে আমরা সবাই ওই পাঠশালাতেই যেতাম অ আ ক খ এ বি সি ডি পড়তে। রাস্তার দু’পাশে ঝাউগাছের সারি ছিল। সেই থেকে ক্যাসুরিনা লেন।
তা সেখানকার চিঠি এখানে দিল কেন। আর এতদিন বাদেই বা দিল কেন?
ওখানেই দিয়েছিল। ঠিক সময়েই দিয়েছিল। আমাকে ততদিনে মাসির বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। চিঠি ফেরত দিয়ে দেয় পোস্টাপিসে। পড়ে ছিল পুরনো না বিলি হওয়া চিঠির বান্ডিলে। পোস্টাপিস তুলে দেওয়ার আগে ঝাড়পোঁছ করতে গিয়ে সে বান্ডিল বেরিয়েছে। এই চিঠি নিয়ে প্রথমে ওরা ক্যাসুরিনা… পার্থসারথি বসাক লেনেই গিয়েছিল। ওখানে কেউ যে আমাকে চিনতে পারবে আমি তা ভাবিওনি। কিন্তু বোধহয় রয়ে গেছে এখনও এক দু’ ঘর পুরনো প্রতিবেশী। তারাই আমার নাম দেখে এই বাড়ির ঠিকানা দিয়েছে।
মিতা দাঁড়িয়ে থাকে। ওর কৌতূহল হচ্ছে খুব চিঠিতে কী লেখা আছে জানতে। কিন্তু মাসিমা ওর সামনে পড়তে না-ই চাইতে পারেন। ছেলের সঙ্গে ফোনে কথা পর্যন্ত দরজা বন্ধ করে বলে, চিঠির সম্পর্কে এত কথা যে বলল সেই মিতার চোদ্দ পুরুষের ভাগ্যি। তবু না জিজ্ঞাসা করে পারে না।
পড়েছ? একই সঙ্গে নিজের উদাসীনতা প্রকাশ করতে চিঠি ফেরত দেওয়ার উপক্রম করে।
তুই পড়।
মিতা থতমত খায়।
তোমার চিঠি আমি পড়ব কেন?
কারণ আমি জানি ও চিঠিতে কী লেখা আছে। আমার নিজের চোখে পড়তে সাহস হচ্ছে না।
মিতা মাটিতে থেবড়ে বসল। ইনল্যান্ডটার আঠা জায়গায় জায়গায় খুলে গেছে ঠিকই কিন্তু যে জায়গাগুলো জুড়ে আছে সেগুলো একেবারে চিপটে আছে। একটানে ছিঁড়তে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। সাবধানে জোড়া মুখ আলাদা করল মিতা। ভাঁজের লাইন বরাবর ফোঁকর দিয়ে মাসিমার শাড়ির সাদা দেখা যাচ্ছে। কোলের ওপর শুইয়ে চিঠি মেলল মিতা।
হাতের লেখাটা কী সুন্দর গো।
আর্টিস্ট ছিল তো। লেখার থেকেও ভালো ছিল আঁকা।
ভেতরের লেখা ঝাপসা হয়ে এলেও পুরোটাই পড়া যাচ্ছে। বাংলায় লেখা। হাঁফ ছেড়ে জোরে জোরে রিডিং পড়ে মিতা।
নীলু,
সব মানুষের বেঁচে থাকার জন্য মাটি লাগে। সে মাটি থেকে তারা জীবনধারণের জন্য রস আহরণ করে। মাটি ছাড়া কোনও মানুষ বাঁচতে পারে না। আর কিছু কিছু মানুষ, যারা বাকিদের থেকে আলাদা, তাদের মাটির সঙ্গে সঙ্গে আকাশও লাগে। তুমি যদি আমার আকাশ হতে চাও তো চলে এসো। আমার ট্রেন ছাড়বে শনিবার বেলা বারোটায়। এগারোটা থেকে আমি টিকিট কাউন্টারের সামনে অপেক্ষা করব। আমার সঙ্গে দুটো টিকিট থাকবে। ওয়ান ওয়ে।
যদি এক জীবনভর্তি অ্যাডভেঞ্চার চাও, চলে এসো নীলু। আমার নীলাম্বরী। নীলাঞ্জনা।
ইতি,
তোমার সঞ্জয়।
সঞ্জয়? সঞ্জয়টা আবার কে? মাসিমার বরের নাম, যার ছবি সামনের ঘরে ঝুলে আছে তার নাম ত্রিদিব সেনগুপ্ত। লোকটা নাকি বই লিখত। সেগুলো সব বইয়ের তাকে সাজানো আছে। মোটা মোটা বই। গায়ে লেখকের নাম লেখা। মাসিমা বলেছিলেন, এই দেখ এই বইগুলো সব টং-এর বাবার লেখা। ডিটেকটিভ বই? মলাটের নামগুলো না দেখেই ফস করে বলে বসেছিল মিতা। মাসিমা এমন আঁতকে উঠেছিলেন যেন মিতা দাবি করেছে মেসোমশাই বাজে বই লেখেন। যে সব বই জামাইবাবুর গাড়ির সামনের বাক্সে লুকোনো থাকে। ছবির পাতাগুলো ছিঁড়ে নেওয়া।
ডিটেকটিভ!? এগুলো ইতিহাস বই! কলেজে পড়ানো হয়।
মিতা কলেজে যায়নি। নম্বরের অভাবে না। সময়ের অভাবে। অনেক হয়েছে ধ্যাষ্টামো, এবার ও পয়সা রোজগার করবে। রঞ্জনও সায় দিয়েছিল। রঞ্জনের মাথায় বিজনেস আইডিয়া আছে অনেক। খোকনদাকে বলে নতুন ফ্ল্যাটবাড়িগুলোর একতলায় একটা দোকানঘর নেবে। প্রথমে ভেবেছিল সাইবার ক্যাফে খুলবে। খোকনদাই বুদ্ধি দিল। বাড়ি বাড়ি এখন কম্পিউটার চলে এসেছে, কম্পিউটারের দোকান আর চলে না। জেরক্স মেশিন এখনও আসেনি। ঢাউস বডি, বাড়িতে রাখা অসুবিধে। কাজেই রঞ্জন স্থির করেছে জেরক্সের দোকান দেবে। যার-ই দিক না কেন, দোকান চালাতে লোক লাগবে। আর মিতা থাকতে অন্য লোক রেখে তার জন্য মাইনে গোনার দরকার কি?
মোদ্দা কথা, এই প্রেমপত্তরখানা মাসিমাকে যে পাঠিয়েছে, পাঠিয়েছিল পঞ্চাশ বছর আগে, সে মাসিমার বর নয়। মাসিমা এত ছুপা রুস্তম তো জানা ছিল না। ঠোঁটে আসতে চাওয়া হাসিটাকে ফেরত পাঠিয়ে মুখ তুলেই মিতা দেখে মাসিমার চোখ থেকে বড় বড় ফোঁটায় জল পড়তে শুরু করেছে। কী হচ্ছে বুঝতে না বুঝতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন মাসিমা।
আমার জীবনটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেল রে মিতা…একেবারে নষ্ট হয়ে গেল।
মাসিমার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। মাসিমা চেয়ারের হাতলে মাথা ঠেকিয়ে কেঁপে উঠছেন।
এই চ্-চিঠিটা যদি… ঠিক সময়ে…
মিতা তাড়াতাড়ি মাসিমার মাথায় হাত রাখে। বেশিরভাগই সাদা হয়ে গেছে, তবুও এখনও কত চুল। এলোমেলো চুলগুলোকে যত্নে শুইয়ে দিতে দিতে করতে করতে মিতা বলে, কাঁদে না কাঁদে না, ইস হেঁচকি উঠে গেছে একেবারে.. জল খাও তো, এই নাও… যা বলছি শোনো, ছেলেমানুষি কোরো না…এই তো, লক্ষ্মী মেয়ে।
মাসিমাকে খানিকটা শান্ত করে মিতা বলে, দাঁড়াও এক কাপ চা করে নিয়ে আসি।
বলে রান্নাঘরে পালিয়ে আসে। দাপুটে মানুষটার ওই রকম নাকের জলে চোখের জলে কান্না দেখে ও ঘাবড়ে গেছে। ফুটতে থাকা ছোট বড় বুদবুদগুলোর দিকে তাকিয়ে টের পায় সঞ্জয় লোকটাকে ওর পছন্দ নয়। হাতের লেখা ভালো হলেই মানুষ ভালো হয় না। আকাশ, মাটি, নীলাঞ্জনা, নীলাম্বরী, কী ড্রামা বাপরে বাপ। ড্রামাবাজি মিতা সইতে পারে না।
চায়ে এক চামচ চিনি দেয় মিতা, তারপর আরও এক চামচ চিনি দিয়ে গোলে। শরীরের কষ্ট থেকে মনের কষ্ট কোনও অংশে কম নয়। কখনও কখনও শরীরের অবহেলা করে মন সারাতে হয়।
চা নিয়ে এসে মাটিতে থেবড়ে বসে মিতা। ইনল্যান্ডটা মাসিমার কোলে। সামলে নিয়েছেন অনেকটা। চোখ এখনও ফোলা কিন্তু শুকনো।
সঞ্জয় কে গো মাসিমা?
খোলাখুলি প্রশ্ন করে মিতা।
চায়ে চুমুক দেন মাসিমা।
দাদার আর্ট স্কুলের বন্ধু।
মিতার মনে পড়ে। প্রথম দিন টং-এর মেডেল, ত্রিদিবের বইয়ের সঙ্গে সিঁড়ির দেওয়ালে এ ঝোলানো একটা ছবিও দেখিয়েছিলেন মাসিমা। নাকি ওঁর বড়দার আঁকা। চেয়ারে এলিয়ে বসা এক মহিলার ফুল বডি, বডিতে একটা সুতো পর্যন্ত নেই। কাপড়চোপড় সব পায়ের কাছে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ভদ্রঘরের ছেলে এ ছবি এঁকেছে, আবার এরা বুক ফুলিয়ে সবার চোখের সামনে টাঙিয়েও রেখেছে! মহিলার শরীরের প্রতিটি ইঞ্চি, প্রতিটি ভাঁজ, প্রতিটি লোম চোখে ধাক্কা মারে। সবথেকে বেশি মারে মহিলার চোখের মুচকি হাসিখানা। যেন মিতাকে লক্ষ করেই। রোজ সিঁড়ি ঝাঁট দিতে দিতে মিতা আড়চোখে দেখে মহিলাকে, মহিলার লজ্জাশরম নেই, স্ট্রেট মিতার দিকে তাকিয়ে বেহায়ার মতো হাসতে থাকেন।
এদিকে মেয়েদের পোশাকআশাক নিয়ে মাসিমার চিন্তার শেষ নেই। রাস্তা দিয়ে টাইট জিনস পরা মেয়ে হেঁটে গেলে মাসিমার মুখ বেঁকে যায়। কে বলবে এ সব পাড়া একসময় ভদ্র ছিল। মিতা ঘাঁটায় না কিন্তু একেকবার মনে হয় বলে, চোখের সামনে সর্বদা যে ছবিখান টাঙিয়ে রেখেছ তাতে ভদ্রতা কম পড়ছে না?
মাসিমা ইনল্যান্ডটাতে আঙুল বোলান। লম্বা সরু আঙুল। কুঁচকে যাওয়া পদ্মের কলি। মাসিমাও ভালো ছবি আঁকতে পারতেন নির্ঘাত।
দাদার সঙ্গে এসেছিল বাড়িতে প্রথম। মাসিমার মুখে আলতো হাসি ছুঁয়ে আছে।
মিতা দুই হাঁটুতে হাত, চিবুক রেখে বসল। লাভ স্টোরি ওর প্রিয়। ডিটেকটিভ গল্পের পরেই।
বৃষ্টি হচ্ছিল খুব। দাদা দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে আমার নাম ধরে চেঁচাচ্ছিল, নীলু দরজা খোল দরজা খোল। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললাম। দাদা ভিজে গোবর, দাদার পেছনে আরেকটা লোক। ধুতি পরার চল তখন উঠেই গেছে, আমার দাদারা সব শার্ট প্যান্টই পরত, কিন্তু ও সর্বদা ধুতি পরত। ধুতি আর হাতা গোটানো হেমন্ত-পাঞ্জাবি। ব্যাক ব্রাশ করা কুচকুচে কালো ঝাঁকড়া চুল, খাড়া নাক, কালো ফ্রেমের চশমা আর সে চশমার ভেতরের দৃষ্টি, এমন ঝকঝকে আর বুকের ভেতর এমন সেঁধিয়ে যায়…
শোবার ঘরে ঝোলানো প্লাস্টিকের রজনীগন্ধার মালা পরানো ত্রিদিবের ছবি মনে পড়ল মিতার। গোমড়া মুখ, থ্যাবড়া নাক, কুতকুতে চোখ। দুই ঠোঁট এমন টিপে বন্ধ করা, ওর ভেতর থেকে হাসি বেরোনো সম্ভব কি না সন্দেহ।
গায়ের পাঞ্জাবি জলে ভিজে গায়ে সেঁটে… পঞ্চাশ বছর পরেও মাসিমার কান লাল হয়ে ওঠে।
তারপর কী হল?
আমার তো ভয় করত খুব। ওর ভয়ডর ছিল না একদম। বলত প্রেমই তো করছি, পাপ তো করছি না।
তোমরা কথাবার্তা চালাতে কী করে? ফোনটোন তো ছিল না যে হোয়াটসঅ্যাপ করে দেবে কাকপক্ষী টের পাবে না।
মাসিমা হাসেন। চিঠি ছিল তো। তোদের এই এসেমেস টেসেমেসের চেয়ে অনেক রোম্যান্টিক।
চিঠি কে লিখেছিল প্রথমে? তুমি না ও?
আমি লিখব চিঠি?! মাসিমা হাঁ করেন। আমি বলে তখন একতলায় ওর গলা শুনলে দোতলায় মূর্ছা যাই, আমি চিঠি লিখব কী? ও-ই লিখেছিল। কলেজে যাচ্ছিলাম, রাস্তার একটা চায়ের দোকানের ছেলে দৌড়ে এসে দিয়ে গিয়েছিল। সারাদিন কানমাথা ভোঁ ভোঁ করেছিল। ক্লাসে একটা শব্দও কানে ঢোকেনি। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে দিদির পাশ থেকে পা টিপে টিপে উঠে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় চিঠি পড়েছিলাম।
কী লেখা ছিল?
কিচ্ছু না। খালি একটা জায়গা আর সময়।
দেখা করার ক্লু! পুরো ডিটেকটিভ নভেল তো। কোথায় দেখা করতে গো তোমরা?
সে কত খুঁজে খুঁজে দেখা করতে হত। একা একা তো বেরোনোর সুযোগ হত না। অনেক মিথ্যে কথা বলে কয়েকবার গঙ্গার ধারে গিয়েছিলাম। আর একবার বোধহয় একটা চায়ের কেবিনে নিয়ে গিয়েছিল জোর করে।
ব্যস?
ব্যস। তবে ভাবিস না তাতে প্রেম কম পড়েছিল। আমাদের সময় প্রেমটাও অন্যরকম ছিল।
বাড়ি থেকে রাজি হল না কেন গো বিয়ে দিতে? জাতে মেলেনি বুঝি? মিতার মন খারাপ হয়।
মেলেনি আবার? আমরা বদ্যি ওরাও বদ্যি, আমার ঠাকুমা ওর ঠাকুমা একই গ্রামের লোক। এর থেকে বেশি মিল আর হয় না।
তাহলে?
মাসিমা চোখ রাখলেন মিতার চোখে।
ওর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার তিন মাস আগে।
মিতা চোখ সরিয়ে জানালার বাইরে ফেরায়। কাঁঠাল গাছটার গোড়ায় পোকা লেগেছে, পাতাঝরা ডালগুলো দাঁড়িয়ে আছে। হর্ন দিতে দিতে একটা রিকশা গেল। বসাকবাড়ির কুকুরটা চেঁচাচ্ছে।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে মিতা মুখ ভেচকায়। ঠান্ডা হয়ে গেছে। দাও চা করে আনি আরেক কাপ, বলে উঠতে গিয়ে মিতা দেখে, মাসিমার গাল ভিজে গেছে। মাসিমার হাঁটুতে হাত রাখল মিতা।
বউকে ছেড়ে দিত তোমার জন্য?
মাসিমা মাথা নাড়লেন।
ও বলত শিল্পী পুরুষেরা একসঙ্গে একাধিক নারীকে ভালোবাসার ক্ষমতা রাখে। ভালোবাসাবাসির নিয়মগুলো সাধারণ মানুষের জন্য বানানো, শিল্পীদের জন্য নয়।
তুমি রাজি হয়েছিলে?
না হয়ে উপায় ছিল না। বলেছিল, ওর সঙ্গে থাকতে গেলে ওকে ওর মতো করে মেনে নিয়েই থাকতে হবে। কাউকে বলার সাহস পাইনি কখনও, একা একা কাঁদতাম সারা রাত, খাটে শুয়ে তাকিয়ে থাকতাম ফ্যানের দিকে। ভাবতাম গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়লেই মুক্তি। সারাদিন যে রকম সিঁটিয়ে লুকিয়ে ঘুরতাম, বাড়িতে টের পেয়েছিল যে কিছু একটা চলছে তলে তলে। তারপর একদিন দাদার হাতে চিঠি পড়ে গেল।
ওর সঙ্গে পালিয়ে যাবে ভেবেছিলে?
ভেবেছিলাম। ও বলেছিল ভাববে। যা স্থির করে চিঠি দিয়ে জানাবে।
চিঠিটা পেলে চলে যেতে?
চলে যেতাম। আমার জীবনটা বদলে যেত। ওর সঙ্গে দেশবিদেশ ঘুরতাম, এক্সিবিশন, কত সম্মান, সংবর্ধনা। সে জায়গায় গোটা জীবনটা খালি ভাত রাঁধতে আর টিফিনবাক্স গুছোতে গুছোতেই…
মাসিমার গলা ধরে এল।
পরে কখনও দেখা হয়েছিল মাসিমা?
সামনাসামনি দেখিনি। কিন্তু টিভিতে, কাগজে সর্বদা ওর ছবি, সাক্ষাৎকার বেরোচ্ছে, প্রাইজ পাচ্ছে। না দেখে থাকার উপায়ই ছিল না।
বউয়ের সঙ্গে সম্পর্ক আছে?
আছে। তবে শিল্পী মানুষ তো, আরও মহিলাদের সঙ্গেও ছবিটবি দেখি। আমেরিকায়, অস্ট্রেলিয়ায়। কচি কচি মেয়েরা সব।
তোমার ভালো লাগত? সইতে পারতে?
সংসারেও কি অনেককিছু সইয়ে নিইনি?
মিতা দমে যায়। ভুরু কুঁচকে ভাবে। যুক্তিটা মাথায় এসে যায় দুম করে।
বিদেশে থাকতে তোমার ভালো লাগত? ছেলের কাছে গিয়ে তো একের বেশি দেড়মাস টিকতে পারোনি। কেউ কথা বলার নেই, পায়ে হেঁটে এদিকওদিক যাওয়ার নেই। সপ্তাহান্তে যাঁদের সঙ্গে নিয়ম করে পার্টি করতে হয় তাঁরা সব পাতে দেওয়ার যোগ্য নয়, ফোনে বোনকে এই সব নালিশ করো তো।
মিতা এগুলো সব দরজার বাইরে আড়ি পেতে শুনেছে, কাজেই ওর এগুলো ফাঁস করার কথা নয়। কিন্তু সে সব ওর মনে নেই এখন।
এক মাস সইতে পারলে না, গোটা জীবন পারতে?
পারতাম। ভালোবাসার জন্য সব পারা যায়। তুই বুঝবি না।
জিভের ডগায় আসা জবাবটা গিলে নিল মিতা। এখন যুক্তির সুতো ধরে রাখাটা বেশি জরুরি।
ভালো তো তোমাকে এ বাড়ির লোকও বাসত। তোমার স্বামী তোমাকে কত ভালোবাসত বল।
মিতার সন্দেহ আছে ওই গোমড়ামুখো লোকটা মাসিমাকে কেন কাউকেই ভালোবাসতে পারত কি না, তবু একটা চান্স নেয়।
মাসিমার মুখ নরম হয়। আঁচল তুলে চোখের কোণের ভেজা শুষে নেন।
তা বাসত। অফিস ছুটি হলেই দৌড়ে বাড়ি আসত। অফিসের কয়েকটা বদ লোক স্ত্রৈণ টইন বলে খেপাত, গায়ে মাখত না। কোনও বক্তৃতা টক্ত্রিতা দিতে যাওয়ার আগে, এত দিন ধরে অভ্যেস করা সত্ত্বেও, নার্ভাস হয়ে থাকত খুব। বারবার জিজ্ঞাসা করত, সব ভালো হবে তো নীলিমা, সব ভালো হবে তো? নিজে সমুদ্র ভালোবাসলেও আমার জন্য প্রতিবার ছুটিতে পাহাড় বেড়াতে যেত। কোনওদিন কষ্ট দেয়নি।
আকাশমাটি সব তুমিই ছিলে।
মাসিমা হাসলেন। সব আমি।
তারপর দেখ, টংদাদা তোমার কত ন্যাওটা। তুমি অত তেজ দেখিয়ে চলে এলে তাও দিনের মধ্যে পাঁচশোবার ফোন করে মা এসো মা এসো করছে। তোমার ছেলে তোমার হাতে গোছানো টিফিন খেয়ে কত বড়মানুষ হয়েছে।
তা হয়েছে। আমার হাতের ছাড়া আর কারও খাবার মুখে রোচে না।
মিতা উৎসাহিত বোধ করে। শুধু বর ছেলে? তুমি বলে কিনা এই পাড়ার মাথা। প্রত্যেকবার পাড়ার স্পোর্টসে মেমোরি গেমে প্রাইজ পাচ্ছ, বিদেশে গিয়ে ইংরিজিতে মশলাপাতির নাম লিখতে হলে পারতে?
মাসিমা ভাবেন। এইটা ভালো বলেছিস, বিদেশে স্পোর্টস হতে দেখিনি তো, অন্তত মেমোরি গেমওয়ালা স্পোর্টস হতে দেখিনি।
তবে? পাড়ায় তোমার কত সম্মান, বর তোমাকে কত ভালোবাসত, ছেলে কত ন্যাওটা। ওই সঞ্জয় না কে, তার সঙ্গে চলে গেলে এসব হত? তাছাড়া…
মিতা সাহস করে বলেই ফেলে।
তুমি চলে গেলে তোমার বাড়িতে আমার চাকরিও তো হত না।
মাসিমা হাসেন। আঙুল দিয়ে মিতার গালের টোলটা আলতো ছুঁয়ে দেন।
*****
ওই আলতো ঠোনাতেই হয়তো, ঘোরটা কেটে গেল। মাসিমা নড়েচড়ে উঠলেন।
কত বেলা হয়ে গেল। তুই যা এবার কাজ সার। তারপর ছ’টা বেজে গেছে বলে ছাদের জামাকাপড় না নামিয়ে পালাবি না খবরদার।
মিতা চায়ের কাপপ্লেট নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
এটা নিয়ে যা। মাসিমা চিঠিটা বাড়িয়ে ধরলেন।
কী করব?
ফেলে দে ময়লার ঝুড়িতে।
*****
জলট্যাঙ্কের ছাদে সূর্যটা বিশ্রাম নিচ্ছে। অল্প তেতে থাকা কাপড়ের ঢিবি হাতে নিয়ে রেলিং-এর পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল মিতা। চিঠিটা আসলে মাসিমা অন্য মাসিমা হয়ে যেতেন। চিঠিটা মাসিমার পক্ষে বড় লেট করে এসেছে। কিন্তু মিতার পক্ষে? মিতারও খুব অন্য মিতা হতে ইচ্ছে করছে আজ দুপুর থেকে।
মিতা ফেসবুক চেক করল। রঞ্জন ছবি দিয়েছে। বউয়ের গলা জড়িয়ে শপিং মলের সামনে দাঁড়িয়ে। চোখে সানগ্লাস, হাতে থামস আপ। ক্লিক করে ছবিটা বন্ধ করতে করতেই হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ এল।
রাগ কোরো না জানেমন। বউ চেপে ধরল তাই যেতেই হল। নেক্সট শনিরবি ফ্রি রেখো, তোমাকে আরও ভালো জায়গায় ঘোরাতে নিয়ে যাব। প্রমিস।
একটা ফুলের তোড়া আর তিনটে কিস।
বোতাম টিপে ফোনের পরদা অন্ধকার করে ছাদ থেকে নেমে আসার তোড়জোড় করল মিতা। আজ ফেরার পথে অপরাজিতা ম্যাডামের বাড়ি ঘুরে যাবে একবার। বিউটিশিয়ানের কোর্সটায় নাম লিখিয়েই ফেলবে এবার। আর দেরি করে লাভ নেই।
(Julia Darling-এর ছোটগল্প Lost Letters অবলম্বনে)
ধন্যবাদ, রুকসানা। যত বুড়ো হচ্ছি তত যুক্তির মর্ম বুঝছি।
😀
ভালো লাগলো। জীবনের কাছাকাছি থাকা গল্প। চেনা মানুষের গল্প।
ধন্যবাদ, প্রতিভা।