সত্যব্রত ঘোষ
আগামী ৯ জুলাই চিত্রপরিচালক, অভিনেতা এবং চিত্রপ্রযোজক গুরু দত্তের ৯৪তম জন্মদিন। আত্মসন্ধানের তাগিদে রোমান্টিক দর্শনকে চলচ্চিত্রায়িত করতে তাঁর যে সাধনা, ভারত তথা বিশ্ব সেই সূত্রে আবিষ্কার করেন এক অনন্য সেলুলয়েড শিল্পীকে, যার প্রভাব আজও অমলিন। তাঁর আগত জন্মদিন উপলক্ষে স্মরণ করার চেষ্টা ‘পিয়াসা’ হয়ে ওঠবার সেই অনিশ্চয়তা ভরা যাত্রাপথটাকে। যার বিভিন্ন বাঁকে কল্পনা ও বাস্তবের চরিত্ররা মিলে মিশে একাকার। সঙ্গে রইল শাহির লুধিয়ানভির লেখা কিছু পঙক্তি, যার জীবন ও দর্শন প্রভাবিত করেছে স্বয়ং গুরু দত্তকেই।
আগে বেশ কয়েকবার আত্মহননের চেষ্টা করেছেন তিনি। শেষ অবধি ১৯৬৪ সালের ১০ই অক্টোবরে স্বপ্নাচ্ছন্ন সব মায়া আর আবেগের অবসান ঘটালেন বসন্তকুমার শিবশঙ্কর পাডুকোন ওরফে গুরু দত্ত। নৃত্যপরিচালনা থেকে চিত্রপরিচালনা, চিত্রনির্মাতা থেকে চিত্রাভিনেতা – উত্থানের প্রতিটি স্তরে প্রতিভার উজ্জ্বল সাক্ষর রয়ে গেছে তাঁর। নতুন নতুন ছবির ভাবনা চাগাড় দিচ্ছে মাথায়। কাছের লোকেদের কোমর বাঁধতে বলছেন তিনি। এরই মাঝে নিরালায় বন্ধুর কাছে তাঁর আক্ষেপ, “উয়ো বাত খতম হো গয়ী।” কোন সে কথা যা মাত্র ৩৯ বছরে শেষ হয়ে যায়?
পার্কটায় তখন বিকেলের মিষ্টি রোদ। ফুলের মৌতাতে মাতোয়ারা ভ্রমরের দল উড়ে বেড়াচ্ছে চারপাশে। অপরূপ এই প্রকৃতির মাঝে বেখাপ্পা কবির চোখ মাটিতে। সেই চোখে অপমানের কালিমা। মধুপিয়াসী ভ্রমর মাটিতে জিরোচ্ছে। একটু পরে আবার উড়বে সে। কিন্তু ভারি একটা বুট পিষে চলে যায় তাকে। মাটিতে থ্যাতলানো ভ্রমরটাকে দেখে কবির মন হাহাকার জেগে ওঠে।
আজ সারি ফজা ভিখারি হ্যাঁয়।
ঔর ম্যায় ইস ভিখারি ফজা মে
অপনে নগমোঁ কি ঝোলি পাসারে
দর-ব-দর ফির রহা হু,
মুঝকো ফির মেরা খোয়া হুয়া সাজ দো। [১]
ধূলি ধূসরিত শহরের পথে হাঁটে নাগরিক কবি। নিজেকে অপাঙতেয় ভাবে বিজয়। ভাইরা বাড়িতে ঢুকতে দেয় না; প্রকাশকরা কবিতাগুলিকে রদ্দি কাগজ বলে ছুঁড়ে ফেলেছে। তবুও দৃপ্ত তার আত্মচেতনা।
শহর কে দোষ পর গুলনার পরচম হম ভি দেখেঙ্গে
তুমহে ভি দেখনা হোগা ইয়ে আলম হম ভি দেখেঙ্গে। [২]
বয়স তখন ৩২। গুরু দত্ত আর অন্যের ফরমায়েশে ছবি বানাবেন না। তিনি এবার জনসমক্ষে আনবেন বিজয়কে। কুটিল সমাজ যে কবিকে এক ব্যর্থ মানুষ বলে সাব্যস্ত করেছে। দুর্বলের উপর সবলের পরাক্রম – এ তো চিরাচরিত ইতিহাস। স্বাধীন ভারত কি তার গতিমুখ পাল্টাতে পেরেছে? সদ্যস্বাধীন দেশে অনেকের মতো গুরু দত্তের মনেও এই প্রশ্নটি বিস্তার পায়। সামাজিক বা আর্থিক – তা সে যে পীড়াই হোক, মুক্তির চেষ্টায় ঈশ্বর বা কংগ্রেস – কারোরই মুখাপেক্ষী নয় মানুষ। সবাই নিজ নিজ উদ্যোগে পথ বেছে নিচ্ছে নিশ্চিত নিরাপত্তার আকাঙ্খায়। জাগতিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে সমষ্টির এই উর্ধশ্বাস দৌড়ে নৈতিকতার কোনও স্থান নেই। লোভ-লালসা-হিংসা-শঠতা-সংকীর্ণতার ঘুঁটি দিয়ে দেশে চলছে সাপ-সিঁড়ি খেলা। যারা এই খেলায় বারবার পিছনে রয়ে যায়, বিজয় তাদেরই একজন।
বিক গ্যায়ে জব তেরে লব ফির তুঝকো কেয়া সিকোঁয়া আগর
জিন্দগানি বাদহ-ও-সাগর মে বহলাই গয়ী। [৩]
আখ্যানের সূত্রে যে বিষণ্ণতা ‘পিয়াসা’য় ছবি হয়ে ফুটে ওঠে, তার উৎস কিন্তু গুরু দত্তের নিজের জীবন নয়। উর্দু শায়রীর এক দিকপাল এবং প্রথিতযশা গীতিকার শাহির লুধিয়ানভি পাঞ্জাবী কথাশিল্পী অমৃতা প্রীতমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িয়ে উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন এই বিষাদ। শাহির ও অমৃতার প্রেম সোচ্চার হলেও পরিণতি পায়নি। ব্যর্থতাবোধের এই তীব্রতাকে বাগ্ময় করে তোলবার জন্য শাহিরের কাব্যচর্চা গুরু দত্তের অবচেতনে থাকা দুঃখবোধকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে।
পায়ের নীচে শক্ত মাটি পাবার আগে গুরু দত্ত যে ছবিগুলি বানিয়েছিলেন, তা হলিউড বা ব্রিটিশ সিনেমার কুশলী ভারতীয়করণ মাত্র। কিন্তু প্রতিষ্ঠা লাভের পর গুরু দত্ত সেই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, যা তিনি বহুদিন আগে করতে চেয়েছিলেন। পুরনো খাতা খুলে বসে মনে পড়ে গেল বন্ধু দেব আনন্দের কথা। শাহিরের মতো দেবও তো প্রেমপর্বে চরম আঘাত সহ্য করেছে। ঘনিষ্ঠতার পর গায়িকা অভিনেত্রী সুরাইয়া একদিন সরাসরি দেব আনন্দকে জানিয়ে দেন পারিবারিক আপত্তির কারণে তাঁদের বিয়ে সম্ভব নয়। বন্ধুর মনে ধিকিধিকি জ্বলে ওঠা যন্ত্রণার সেই স্মৃতি গুরু দত্তকে নতুন করে কাঁদায়। মনস্তত্বে একে এমপ্যাথি বলা হয়। গুরু দত্তের মনে দেব আর শাহিরের ব্যাথাতুর স্বত্বা দুটি এক হয়ে বিজয়ের জন্ম দেয়। আবরার আলভীর সঙ্গে চিত্রনাট্যটি নতুন করে ঘষামাজা করাকালীন গুরু দত্তের মানসিক বিবর্তন ঘটতে থাকে। ছবির নাম প্রথমে ‘কশমাকশ’ থেকে ‘পিয়াস’ এবং শেষে ‘পিয়াসা’য় পরিবর্তিত হয়।
আও কে কোই খোয়াব বুনে কাল কে ওয়াস্তে
ওয়ার্না ইয়ে রাত, আজ কি সঙ্গীন দৌড় কী
ডস লেগি জান-ও-দিল কো কুছ অ্যায়সে জান-ও-দিল
তা উম্র ফির ন কোই হাসিন খোয়াব বুন সঁকে। [৪]
ক্লান্ত বিজয় রূপোজীবিনী গুলাবোর ভাঙা ঘরের দিকে হাঁটে। সামনে নিদ্রাহীন রাত। তারপর আবার সকাল। রিক্ত বিজয় আরও রিক্ত হবে। গুলাবো তবুও বিজয়ের অনুরক্ত। নিয়তির মতো। ক্যাডিলাক গাড়িটি আচমকা বিজয়ের সামনে দাঁড়ায়। বিজয় চোখ তোলে। গাড়ির পিছনের সিটে মীনা। কলেজে মীনাই ছিল বিজয়ের কাব্যপ্রতিমা।
তুম যো নজরোঁ কো উঠাও তো সিতারে ঝুঁক যায়ে
তুম যো পলকোঁ কো ঝুঁকাও তো জমানে রুখ যায়ে। [৫]
অথচ মীনা আজ মিঃ ঘোষের ঘরণী। বিজয়ের কবিতা সে ভোলেনি। মীনার সমবেদনা মাখা সেই চোখের তীব্রতায় বিজয়ের ক্ষতে জ্বালা ধরায়। রাতে গুলাবোর পাশে শুয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করে সে, “এমন রক্তাক্ত হয়ে বেঁচে থাকবার আদৌ কোনো মানে আছে কি?”
অই গম-এ-দুনিয়া তুঝে কেয়া ইল্ম তেরে ওয়াস্তে
কিন বাহানোঁ সে তবিয়ত রাহ পর লায়ী গয়ী। [৬]
মীনা একদিন বিজয়কে মিঃ ঘোষের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। নব্য-ধনী এই পুস্তক প্রকাশকটির চোখে মীনার সৌন্দর্য শুধু তার বৈভবেরই প্রতীক। স্বামী হিসেবে মীনার স্বত্ব শুধু তারই। স্বামীর কাছে তার আবদার – বিজয়ের কবিতা ছাপতেই হবে। মিঃ ঘোষ ব্যবসায়ী মানুষ। লেনদেন ছাড়া সব সম্পর্ক তার কাছে অর্থহীন। মীনার গতিবিধির উপর নজর রাখতে বিজয়কে তার গোয়েন্দা হিসেবে নিযুক্ত করে মিঃ ঘোষ। সেই বিশ্বস্ততার মুল্য হিসেবে বিজয়ের কবিতা ছাপবে সে।
গো হমসে জাহতি রহি ইয়ে তেজ-গম উম্র
খোয়াবোঁ কে আশরে পে কাটি হ্যাঁয় তা উম্র। [৭]
কলকাতার ভবানীপুরে স্কুলে পড়ার দিনগুলি থেকেই নাচের প্রতি প্রবল আকর্ষণ অনুভব করতো বসন্তরাও ওরফে গুরু। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর ম্যাঙ্গালোরস্থিত মামা বি বি বেনেগালের সুপারিশে চলে যায় আলমোড়ায়। সেখানে উদয়শংকর ব্যালে ট্রুপে যুক্ত হয়ে আধুনিক নৃত্যশৈলী রপ্ত করে সে। তারপর রোজগারের ফিকিরে পুণায় এসে প্রভাত ফিল্ম কোম্পানিতে তিন বছরের চুক্তিতে নৃত্য পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হয়। চিত্রপরিচালনার দিকে ক্রমশ ঝোঁক বাড়ছিল। ধরম দেবদত্ত পিসোরিমল আনন্দ ওরফে দেব আনন্দ তখন নবাগত। ১৯৪৬ সালে দেব আনন্দকে নিয়ে ‘হম এক হ্যাঁয়’ বানাচ্ছেন পি এল সন্তোষী। সেখানে সহকারী পরিচালক গুরু দত্তের সঙ্গে নায়ক দেব আনন্দের ঘনিষ্ঠতা।
স্বপনে জাগরণে সিনেমাপ্রেম দুই বন্ধুকে বেঁধে দিলো প্রতিশ্রুতির এক গ্রন্থিতে। ঠিক হয়, গুরু দত্ত স্বাধীনভাবে ছবি পরিচালনার দায়িত্ব পেলে দেব আনন্দ হবে সেই ছবির নায়ক। দুই বন্ধু যখন আগামীদিনের স্বপ্নে বিভোর, প্রভাত ফিল্ম কোম্পানির মালিক ভি শান্তারাম তখন পুণা ছেড়ে বোম্বে এসে রাজকমল কলামন্দির প্রতিষ্ঠার তোড়জোড় করছেন। কর্মহীন গুরু দত্ত অগত্যা রওনা দেয় বোম্বে। জ্ঞান মুখার্জীর ছবি ‘সংগ্রাম’-এ সহকারী পরিচালকের কাজ জোটে। অন্যদিকে দেব আনন্দ নায়ক হিসেবে সাফল্য পেয়ে ‘নভকেতন ফিল্মস’ নামে নিজের প্রযোজনা সংস্থা খুলেছে। নিত্যনিয়ত সংগ্রামের মাঝে বন্ধুকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রেখে তাঁর প্রথম প্রযোজিত ছবিটির পরিচালনার দায়িত্ব দেন গুরু দত্তকে। বলরাজ সাহনীর লেখা সেই ‘বাজি’ ক্রাইম থ্রিলারটিতে অ্যান্টি-হিরোর ভূমিকায় অভিনয় করে দেব আনন্দ খ্যাতির চূড়ায় ওঠেন। আর পরিচালক গুরু দত্ত ‘বাজি’র সূত্রে তিন গুণী মানুষের সংস্পর্শে আসেন। তাঁদের একজন শাহির লুধিয়ানভি, যিনি ক্ষতবিক্ষত হৃদয় নিয়েও স্বপ্নের জাল বুনতে ভোলেননি।
জুলফোঁ কে খোয়াব, হোঁটো কে খোয়াব ঔর বদন কে খোয়াব
মৈরাজ-এ-ফন্ কে খোয়াব, কামাল-এ-সুখন কে খোয়াব
তহজিব-এ- জিন্দগী কে, ফারোঘ-এ-ওয়াতন কে খোয়াব
জিন্দা কে খোয়াব, কুচা-এ-দর-ও রাশন কে খোয়াব। [৮]
একদিকে গুলাবো। অন্যদিকে একদা প্রেমিকা মীনা। বিজয়ের চেতনায় নারী-প্রেম-দারিদ্র-অপমান-বঞ্চনা-তাড়না-কবিতা-স্বীকৃতি-বাস্তব মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। এবার সে অবশিষ্ট আত্মসম্মানটুকুও যেন হারাবে। শরীর আর মনের এই দ্বন্দ্বে দীর্ণ বিজয় হাঁটতে থাকে দিকবিদিক ভুলে। স্বপ্নপূরণের ব্যর্থতা জীবনের সব রঙ মুছে দেয়।
ইয়ে খোয়াব হি তো অপনি জওয়ানি কে পাশ থে
ইয়ে খোয়াব হি তো অপনে আমল কি আসাস থে
ইয়ে খোয়াব মর গয়ে তো বেরং হ্যাঁয় হায়াৎ
ইয়ুঁ হ্যাঁয় কি জ্যায়সে দস্ত-এ-তহ-এ-সঙ্গ হ্যাঁয় হায়াৎ। [৯]
প্রথম আলাপের রেশ কাটবার আগেই অখ্যাত সহ-চিত্রপরিচালক গুরু দত্তকে ভুলে গেছিলেন কণ্ঠশিল্পী গীতা রায়। কিন্তু সঙ্গীত পরিচালক শচীন দেব বর্মণের একটি সিদ্ধান্তের জেরে আলাপটি গাঢ় হয়। শাহির লুধিয়ানভি ‘তদবির সে বিগড়ি হুই তকদির বনা লে …” গানটি উর্দু গজলের আঙ্গিকে লেখেন। কিন্তু গানের কথা ও ছবির সিচুয়েশন বুঝে শচীনকর্তা ঠিক করেন গানটি হবে পাশ্চাত্যধর্মী। আর গায়কী যে মাদকতা চাইছে, তা একমাত্র গীতা রায়ই পূরণ করতে পারবেন। তেমনটাই ঘটলো। গানটি রেকর্ডিং-এর সময় চিত্রপরিচালক হিসেবে গুরু দত্ত স্টুডিয়োতে উপস্থিত ছিলেন। শুধু সেই নেশাভরা কণ্ঠই নয়, গায়িকার প্রেমেও আচ্ছন্ন হন তিনি। ‘বাজি’র তুমুল সাফল্যের পর সেই প্রেম যখন পরিণয়ে রূপ পেতে চলেছে, তখন বাধা হয়ে আসে গীতা রায়ের পরিবার। আয়ের একমাত্র উৎসটিকে তাঁরা কাছছাড়া করতে নারাজ। গুরু দত্তের পরের ছবি ‘আরপার’ সফল হলেও তাঁর তৃতীয় ছবি ‘বাজ’ দর্শকদের মনঃপুত হয়নি। ব্যর্থতার প্রথম ধাক্কায় গুরু দত্ত মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন। তাকে সামলাতে গীতা রায় শেষ অবধি প্রেমপর্বের তিন বছর পরে গীতা দত্ত হলেন।
সোচতা হুঁ কি মহব্বত হ্যাঁয় জুনুন-এ-রুসওয়া
চন্দ বেকার সে বেহুদা খয়ালোঁকা হুজুম। [১০]
বিজয় মানতে পারছে না কবিতার বই ছাপানোর জন্য মিঃ ঘোষের শর্ত। আবার, বই ছাপা হলে কবি হিসেবে তার নাম হবে। সেই সম্ভাবনাও লোভ জাগায়। আরো কতটা নামতে হবে তাকে? দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। সারিবদ্ধ ল্যাম্পপোস্টের নীচ দিয়ে বিজয় হাঁটে।
মাইয়ুঁসিয়োঁ নে ছিন লিয়ে দিল কে বলবলে
মেরে বেচ্যাইন খয়ালোঁ কো সকুঁ মিল ন সকা। [১১]
গীতা রায়ের গাওয়া গানটি গীতা বালির নাচের সঙ্গে চিত্রায়িত হচ্ছে স্টুডিয়োতে। সহকারী চিত্রগ্রাহক যুবকটি শট নেওয়ার ফাঁকে গুরু দত্তের পাশে দাঁড়িয়ে বিনীত কন্ঠে জানতে চায়, “স্যার, সেটে লাগানো বড় আয়নাটায় নায়িকার নাচের যে প্রতিফলনটা পড়ছে দেখছেন? লং শটে সেটাকে দেখিয়ে যদি আমরা ক্যামেরা ঘুরিয়ে আয়নার পাশে বসে থাকা নায়কের মুখটা ক্লোজ আপে দেখাই, কেমন হবে?” পরিচালক গুরু দত্তের মনে দাগ কাটে ভাবনাটি। আলাদাভাবে শটে নায়িকার লাস্য আর নায়কের দ্বিধা না দেখিয়ে যদি একটা শটেই দুজনকে একসঙ্গে দেখানো যায়, ব্যাপারটার মধ্যে বেশ নতুনত্ব থাকবে। কিন্তু শটের মধ্যে ক্যামেরা ঘোরানোর জন্য ‘মিচেল’ ক্যামেরাটি অত্যন্ত ভারি। তাছাড়া লেন্স ব্যবহারেও যথেষ্ট মুন্সিয়ানার প্রয়োজন। চিত্রগ্রহণের জন্য স্টুডিয়ো নিযুক্ত ক্যামেরাম্যানটির কি সেই মনোযোগ এবং হাতের সংবদ্ধতা আছে? গুরু দত্ত ভাবলেন যুবকটিকে একবার পরীক্ষা করা যাক।
সহকারী চিত্রগ্রাহকটিকে বলেন, “খুব কঠিন কিন্তু। তোমাকে তিনবার শটটি নেওয়ার সুযোগ দিচ্ছি। হলে খুব ভালো। না হলে, ভুলে যাও।” অনুমতি পেয়েই কৃতার্থ যুবকটি প্রয়োজনীয় আলোকসম্পাত এবং অভিনেতাদের নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণে মন দেয়। সেই অনুযায়ী ক্যামেরার অবস্থান এবং লেন্স নির্দিষ্ট করে। তিনবারে নয়, প্রথমবারেই উতরে গেলেন ভি কে মূর্তি। সেদিন প্যাক আপ-এর পর সহকারী চিত্রগ্রাহকটিকে গুরু দত্ত বাকি ছবিটির চিত্রগ্রহণের প্রস্তাব দেন। যুবকটি বিনীতভাবে তা ফিরিয়ে দিয়ে বলেন, “না স্যার, ছবির মাঝপথে ক্যামেরাম্যান বদলানো উচিৎ নয়। আপনার পরের ছবিতে আমি ক্যামেরাম্যান হবো, কথা দিচ্ছি।” তার পর থেকে গুরু দত্ত আর কাউকে নিজের ছবির চিত্রগ্রহণের দায়িত্ব দেননি। এই সেই আলোকশিল্পী, যার পেলব আলোকরচনা আর সংবেদনশীল চিত্রগ্রহণের সৌজন্যে গুরু দত্তের প্রত্যেকটি সিনেমা হয়ে ওঠে অপরূপ দৃশ্যের সমাহার। ১০০ ও ৭৫ মিলিমিটার ফোকাল লেন্থ-এর লেন্স দিয়ে ক্লোজ আপ, যা এখনও ‘গুরু দত্ত শট’ নামে পরিচিত, তার প্রবর্তন এবং প্রচলন ঘটান এই একদা বেহালাবাদক ও স্বাধীনতা সংগ্রামী ভেঙ্কটরাম কৃষ্ণমূর্তি বা সংক্ষেপে ভি কে মূর্তি।
কিতনি বেকার উম্মীদোঁ কা সাহারা লেকর
ম্যায়নে ইওয়ান সজায়ে থে কিসী কি খাতির। [১২]
রাত এখন গভীর। ল্যাম্পপোস্টের আবছায়ার নীচে ক্লান্ত পথবাসীরা নিদ্রামগ্ন। ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলির পাশ দিয়ে হেঁটে যায় বিজয়। হঠাৎ তার পায়ে কিছু আটকায়। বিজয় নীচে তাকায়। শীতে কুঁকড়ে শুয়ে থাকা মানুষটিকে দেখে ভাবে, হতভাগ্য আমি একাই তো নই। না জানি কত ক্লেশ সহ্য করে এরা ঘুমিয়ে পড়ে, আবার জেগেও ওঠে।
মুঝকো কেহতে হো কি ম্যাঁয় আজ ভি জী সকতা হু
ইশক্ নাকাম সহী, জিন্দগী নাকাম নেহি। [১৩]
নিজস্ব প্রযোজনার প্রথম ছবি ‘আরপার’ নিয়ে দেব আনন্দের সঙ্গে আলোচনা চলছে। গুরু দত্ত আবিষ্কার করেন উল্টোদিকে তাঁর বন্ধু আর নেই। বসে আছে সিনেমার নতুন এক তারকা। খ্যাতি আর স্তাবকতায় যে স্বস্তি পায়। ঠিক করেন, তিনি নিজেই নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। আসলে, পেশাগত দিক থেকে সফল মানুষরা নিঃসঙ্গই হন। গুরু দত্তও সেদিক থেকে ব্যতিক্রম নন। তাই নতুন সম্পর্ক স্থাপনে মন দেন তিনি। আবরার আলভীর লেখার হাত ভালো। তাঁর সহায়তায় গুরু দত্ত চিত্রনাট্য রচনা করেন, অভিনয়ে মন দেন। ‘আরপার’ এবং ‘মিস্টার অ্যাণ্ড মিসেস ৫৫’ ছবিদুটি সাফল্যের মুখ দেখলে স্বচ্ছল গুরু দত্ত একটি ফার্ম হাউস কেনেন বোম্বের অদূরে, লোনাভালায়। নিরিবিলির লোভে।
পারিবারিক অশান্তি আর অবসাদের এই পর্বে ওয়াহিদা রহমান গভীর প্রভাব ফেলেন গুরু দত্তের জীবনে। হায়দ্রাবাদে ‘রোজুনু মারায়ি’ নামে তেলেগু ছবির রজত জয়ন্তী সপ্তাহ উদযাপন সমারোহে নবাগতা অভিনেত্রীটির সঙ্গে তাঁর আলাপ। গুরু দত্ত চমৎকৃত হন, যখন তিনি দেখেন ওয়াহিদা রহমান উর্দু ভাষাতেও সাবলীল। আর অন্যদিকে আশাভঙ্গ হয় তাঁর। ‘ট্র্যাজেডি কিং’ পরিচয়ে খ্যাত দিলীপ কুমার ‘পিয়াসা’ ছবিতে বিজয়ের ভূমিকায় অভিনয় করতে নারাজ। তাঁর যুক্তি, এযাবৎ গুরু দত্ত যে কয়েকটি ছবি বানিয়েছেন, তার অধিকাংশ দর্শকধন্য হলেও লঘু মনোরঞ্জনী ছাড়া আর কিছু নয়। ৩২ বছরের ছেলেটি ‘পিয়াসা’র মতো এমন গভীর বিষয় নিয়ে ছবি করতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। দিলীপ কুমারের ‘না’ শুনে বিপদে পড়লেন বটে। তবে হার মানলেন না গুরু দত্ত। ঠিক করলেন বিজয়ের ভূমিকায় তিনি নিজেই অভিনয় করবেন। সেই অনুযায়ী দুই নায়িকা বদল হলো। মধুবালা এবং নার্গিসের পরিবর্তে এলেন মালা সিনহা এবং ওয়াহিদা রহমান।
মুঝসে অব মেরি মোহব্বত কে ফসানে ন কহো
মুঝকো কেহনে দো কি ম্যায়নে উনহে চাহা হী নহী। [১৪]
মুখচোরা গুরু দত্ত ক্রমশ আত্মক্ষয়ের দিকে এগোচ্ছেন। স্ত্রী গীতার থেকে দূরত্ব রচনা হয়েছে। তা নিয়ে অন্তর্দহন চলছে তাঁর মনে। নিজের রচিত শোকান্তিকার আবর্তে তিনি ক্রমশ নিজেই তলিয়ে যেতে থাকেন। ‘পিয়াসা’ এবং তারপরে ‘কাগজ কে ফুল’ থেকে ‘সাহাব বিবি ঔর গুলাম’ – ব্যর্থতার প্রতিমূর্তি হয়েই গুরু দত্ত আমাদের সামনে ধরা দিলেন। মাঝে ‘চৌধবি কি চাঁদ’ ছিল। সেখানেও প্রেমে শরীরী উচ্ছাস উপচে উথলেও তাঁর বিষণ্ণতাকে আড়াল করতে পারেনা।
মেরে মাজি কো আন্ধেরে মে দবা রহনে দো
মেরা মাজি মেরি জিল্লত কে সিওয়া কুছ ভি নহী। [১৫]
শীতে কুঁকড়ে থাকা ঘুমন্ত পথবাসীটির শরীরে নিজের গরম কোটটি খুলে বিজয় ঢাকা দিয়ে দেয়।
হঠাৎ উষ্ণতার পরশ পেয়ে মানুষটি চোখ মেলে তাকায়। বিজয়ের করুণায় অপমানের জ্বালা। অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে সে আর বাঁচতে চায়না। তাই উঠে দাঁড়িয়ে ট্রেন লাইনের দিকে দৌড় দেয়। উল্টো দিক থেকে ট্রেন ছুটে আসছে। বিজয় দৌড়ায় মানুষটিকে আত্মহনন থেকে বাঁচাতে। ধাবমান ট্রেন ছুটন্ত মানুষটিকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। প্রাণহীন দেহটার দিকে তাকিয়ে অনুতাপ হয় বিজয়ের। আবার একবার সে ব্যর্থ হল।
জিনহে নাজ্ হ্যাঁয় হিন্দ পে
উয়ো কহাঁ হ্যাঁয়, কহাঁ হ্যাঁয়, কহাঁ হ্যাঁয়? [১৬]
গুরু দত্তের সংবেদনশীল মনে শাহির লুধিয়ানভি এক গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। মানুষ হিসেবে শাহির ছিলেন উদার এবং আধুনিক। শাহিরের অনন্যতায় গুরু দত্ত রবীন্দ্রনাথের গানের সেই ধূপকে মূর্ত হতে দেখেছিলেন যা পুড়তে পুড়তে গন্ধ ঢেলে যায়। শাহির তাঁর দগ্ধ অনুভবকে ‘তলখিঁয়া’ এবং ‘পরছাইয়া’ নামের দুটি কবিতা সংকলন (দীবান)-এ গন্ধের মতো ছড়িয়ে পাঠকদের কাছে জবাবদিহিতে বলেছেন, “এই দুনিয়া প্রেমের ছলে আমাকে যা কিছু দিয়েছে, তা আমি ফিরিয়ে দিলাম।” এহেন মানুষ যখন আর এক প্রতিভাবান শিল্পীর কল্পনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে তখন ‘পিয়াসা’র মতো এক বিষাদগাঁথা সৃষ্টি হয়।
ন কোই জাদহ, ন মঞ্জিল, ন রোশনি কা সুরাবা
ভটক রহী হ্যাঁয় খলাও মে জিন্দগী মেরি
ইনহি খলাও মে রেহ জাউঙ্গা কভী খোকর
ম্যায় জান্তা হু মেরি হমনফস! মগর ইয়ু হী। [১৭]
ছিন্নভিন্ন শরীর ঢাকা কোটটিকে খুব চেনা মনে হয় গুলাবোর। আত্মঘাতী মানুষটাকে বিজয় বলে সনাক্ত করে সে। বিজয়ের কবিতার তীব্র কথাগুলি বিদ্ধ করে গুলাবোকে। এমন এক মানুষের অকালমৃত্যুকে তার মনে হয় ঘোর অবিচার। কাঁদতে কাঁদতে মনে পড়ে বিজয় তাকে একদিন কণ্ঠে বিষ ঢেলে বলেছিল, “আপনি তো স্রেফ শখ মেটাতে ভালোবাসেন আর আরাম কিনতে চান বলে ভালবাসা বিক্রি করেন।” গুলাবো মনস্থির করে। বিজয়ের কবিতার বই ছাপানোর দায়িত্ব সে নেবে। বিজয় যে শ্লেষ ছুঁড়ে দিয়েছিল তার দিকে, এ তার প্রত্যুপহার।
গুঁজর রহি হ্যাঁয় কুছ ইস তরাহ জিন্দগী জ্যায়সে
উসে কিসীকে সহারা কো আরজু ভি নহী। [১৮]
বিজয়ের কবিতার বই ছাপানোর জন্য মিঃ ঘোষের কাছে কাতর আবেদন গুলাবোর। বিজয়ের প্রতি কিছুটা সমবেদনা নিয়ে সফল প্রকাশক আরেকবার কবিতাগুলি পড়ে। ব্যবসায়ী হলেও সে বুঝতে পারে বিজয়ের কবিতায় যে মর্মজ্বালা ব্যক্ত হয়েছে, তা বিক্রিযোগ্য পণ্য। কারণ, বহু মানুষ এই বই কিনে নিজেদের হৃদয়ে ক্ষরণ ঘটাবে। নব্য-ধনী সে, তাই নীতির কোনো বালাই নেই তার। ‘মৃত’ কবির স্থানে নিজের নামটা ছাপানোর বুদ্ধিটাকে কাজে রূপান্তর করতে দ্বিধা হয়না মিঃ ঘোষের। এবং ধনসম্পদের পাশাপাশি বিদ্বৎজন হিসেবে সামাজিক স্বীকৃতিও মিলবে।
‘মৃত’ বিজয়ের স্মরণসভায় মিঃ ঘোষের কবিতার বই প্রকাশ হলো। সেই মুহূর্তে বিজয়ের নাটকীয় আবির্ভাব ঘটে প্রেক্ষাগৃহে। তার শরীর আর মনে যে অজস্র ক্ষত, তা আলগা কাপড়ে ঢাকা। ক্রুশবিদ্ধ যিশু যেন তার রক্তাক্ত শরীরকে ঢেকে ধরাতলে আবির্ভূত হলেন। উপস্থিত অতিথিদের কাছে বিজয়ের শুধু একটাই জিজ্ঞাসা:
ইয়ে দুনিয়া আগর মিল ভী যায়ে তো কেয়া হ্যাঁয়?
মিঃ ঘোষ বা তার স্তাবকেরা মানতে চায়না যে বিজয় বেঁচে আছে। অন্যদিকে বিজয়ের ভাইয়েরা উল্লসিত। মিঃ ঘোষ তাদের ঠকিয়েছে। এবার তারা অন্য প্রকাশকের কাছে বিজয়ের কবিতাগুলির স্বত্ব বেচে অনেক বেশি টাকা পাবে।
আপনে সিনে সে লগায়ে হুয়ে উম্মিদ কী লাশ
মুদ্দতোঁ জীস্ত কো নাসাদ কিয়া হ্যাঁয় ম্যায়নে। [১৯]
আবরারের সঙ্গে তুমুল তর্ক হয় গুরু দত্তের। আবরার চাইছেন বিজয়ের নামে কবিতা ছেপে বার হচ্ছে সম্বর্ধনাসভায়। এই দৃশ্যে বিজয় জনসমক্ষে জানাবে কবিতাগুলি তারই রচনা। এরপর কবির যোগ্য স্বীকৃতি নিয়ে বিজয় জনমানসে বেঁচে থাকবে। এমনভাবেই ছবিটি শেষ হোক। কিন্তু গুরু দত্তের মনে হচ্ছে এমন ইতিবাচক সমাপ্তিতে বিজয়ের কবিস্বত্বার পরাজয়। তিনি আবরারের দাবী না মেনে সিদ্ধান্তে এলেন যে বিজয় সেই সভায় মঞ্চে উঠবে। উপস্থিত অতিথি এবং আত্মীয়-পরিজনদের দিকে তাকাবে দীর্ঘক্ষণ। তারপর ঘোষণা করবে, “বিজয় মৃত। আমি এক জালিয়াৎ। বিজয় সেজে আপনাদের ধোঁকা দিয়েছি।” সভায় উপস্থিত সজ্জনেরা বিজয়কে ঠগবাজ বলে তাড়িয়ে দেবে। প্রেক্ষাগৃহের বাইরে এসে বিজয় দেখবে গুলাবো দাঁড়িয়ে আছে। তার হাত ধরে বিজয় অজানা গন্তব্যের দিকে রওনা দেবে।
তুনে সরমায়েঁ কে ছায়ো মে পনপ নে কে লিয়ে
আপনে দিল অপনি মোহব্বত কা লহু বেচা হ্যাঁয়। [২০]
গুরু দত্ত স্থির করে ছিলেন যে শঠ-লোভী-স্বার্থপর মানুষদের স্বীকৃতি নিয়ে বিজয় বাঁচবে না। প্রতিবাদের এই ভাবনা নিয়ে ছবি শেষ করবার পর ছবির পরিবেশকরা আপত্তি জানায়। দর্শকদের মনোরঞ্জনের সহজ অঙ্ক ছাড়া তারা আর কিছু বুঝতে রাজি নয়। ব্যবসায় ক্ষতি করে সিনেমার নতুন ভাষাকে তারা পৃষ্ঠপোষকতা করবে না। তাই তাদের সুচিন্তিত মতামত, বিষন্নতায় ভরা এই ছবি দর্শকরা দেখবে না। অন্তত একটা প্রেমের গান চাই। তা না থাকলে তাঁরা প্রদর্শনের স্বত্ব কিনবেন না। এই কট্টর ব্যবসায়ীদের শিল্পকলা বোঝানো গেল না। গুরু দত্ত অগত্যা শাহির লুধিয়ানভি এবং শচীন দেব বর্মণকে ডেকে এনে নতুন একটি গান রচনা করতে বললেন।
‘হাম আপকী আঁখো মে …’ গানটি অতঃপর চিত্রায়িত হয়ে ‘পিয়াসা’র হল প্রিন্টগুলির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হলো। পরিবেশকরা খুশি মনে টাকা দিলেন। গুরু দত্ত এবার নিশ্চিন্ত মনে পরের ছবির জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন। কিন্তু শাহির লুধিয়ানভির মনে তখন বিশ্বাসভঙ্গের যন্ত্রণা। গুরু দত্তের পরবর্তী ছবি ‘কাগজ কে ফুল’। বিশাল বাজেটের সিনেমাস্কোপ সেই ছবির কলাকুশলীরা এক থাকলেও শাহির লুধিয়ানভি সেই তালিকায় নেই। গুরু দত্তের জীবন ও কর্মকাণ্ড থেকে দূরে সরে গেলেন শাহির। এই বিচ্ছেদের পর গুরু দত্তের জীবন নোঙরভাঙা জাহাজ হবে।
ইসসে কেয়া ফায়দা রঙগীন লবাদোঁ কি তলে
রুহ জ্বলতি রহে গলতী রহে পজমুর্দা রহে। [২১]
পেশাগত জীবনে শাহির লুধিয়ানভি অসংখ্য ছবিতে দুষ্টু মিষ্টি প্রেমের গান লিখেছেন। কিন্তু ‘পিয়াসা’কে তিনি অমন দেখনসর্বস্ব প্রেমের উদযাপনে কলুষিত করতে চাননি। আবার একথাও ঠিক, বানিজ্যিক কারণে গুরু দত্ত তাঁর প্রতিটি ছবিতেই এমন কিছু আপোষ করলেও শিল্পীজীবনে তিনি বারবার সিনেমার পর্দায় প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতির উত্তরণ ঘটাতে চেয়েছিলেন।
ভাবান্তর
১। আজ চারপাশটা ভিক্ষুক।
আর এই কাঙাল পরিবেশে আমি
নিজের গানগুলি থলেতে ঝুলিয়ে
এক একটা দরজায় দাঁড়িয়ে বলছি,
আমার হারানো সুরগুলিকে ফিরিয়ে দাও।
২। শহরের যত অন্যায় বেদানার মতো পতাকায় ফুটতে আমিও দেখব
সেই পতাকা তুমিও যে দেখছো তাও আমি দেখব।
৩। তোর ঠোঁটই যখন বিকোল তোর কাছে আর কী নালিশ আমার
জীবনটাই দেখি হা-হুতাশের সমুদ্রে ভেসে গেছে।
৪। এসো কোনো স্বপ্ন বুনে ফেলি আমরা আগামীর জন্যে
তা না হলে আজকের এই ভয়ঙ্কর সময়
এমনভাবে প্রাণে আর মনে ছোবল মারবে প্রিয়তমা
যে সারা জীবন আর সুখস্বপ্ন বুনতে পারবে না।
৫। তুমি চোখ তুললেই নক্ষত্ররা নুইয়ে পড়ে
তোমার আঁখিপল্লব নোয়ালে এই জগৎ থমকে যায়।
৬। ওরে বিষন্ন পৃথিবী তুই কি জানিস তোর জন্যে
কত ছল করে এই শরীর মনকে চাঙ্গা রেখেছি।
৭। সম্ভাবনাই জাগিয়ে রেখেছে দ্রুত বিষণ্ণতায় কেটে যাওয়া বছরগুলি
স্বপ্নের আশ্রয়ে কেটে গেল সারা জীবন।
৮। ঘন কেশরাশির স্বপ্ন, ঠোঁটের স্বপ্ন আর শরীরের স্বপ্ন
শিল্পের মরীচিকার স্বপ্ন, অসামান্য শব্দের স্বপ্ন
সভ্য এক জীবনের স্বপ্ন, পরিত্যক্ত মাতৃভূমির স্বপ্ন
বেঁচে থাকবার স্বপ্ন, আতঙ্কে ত্রস্ত গলিতে হত্যার স্বপ্ন।
৯। এই স্বপ্নই তো নিজের যৌবনের সহচর ছিল
এই স্বপ্নই তো নিজেকে শাসনের যন্ত্র ছিল
এই স্বপ্ন মরলে জীবন বেরঙিন
যেন শূন্যতার মধ্যে বেঁচে থাকা।
১০। ভেবে দেখলাম প্রেম হলো অপমানিত হওয়ার নেশা
কিছু বেকার অর্থহীন ভাবনার ভিড়।
১১। বিষণ্ণতা ছিনিয়ে নিয়েছে হৃদয়ের সতেজ ভাব
আমার অস্থির ভাবনাগুলি আর শান্তি পেলো না।
১২। অর্থহীন কত আশাকে জড়িয়ে ধরে
আমি ঘরটাকে সাজিয়ে ছিলাম কেউ আসবে বলে।
১৩। বলছো আমি আজও বাঁচতে পারি
প্রেম ব্যর্থ হলে হোক, জীবন তো নয়।
১৪। আর আমাকে আমার ভালোবাসার গপ্পো নাই বা বললে
আমাকে বলতে দাও আমি তাকে কোনও দিন চাইনি।
১৫। আমার অতীতকে অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে থাকতে দাও
আমার অতীত আমার অপমান ছাড়া আর কিছু নয়
১৬। যাদের গর্ব ছিল হিন্দ নিয়ে
তাঁরা আজ কোথায়, কোথায়?
১৭। না কোনো আঘাত, না লক্ষ্য, না আলোর উৎস
এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছে শূন্যে আমার জীবন
এই শূন্যে হারিয়ে রয়ে যাবো দেখো
একথা জানি আমার আমি! তবে শুধুই জানি।
১৮। কেটে যাচ্ছে এই জীবন এমনভাবে
যেন কারোর থেকে আশ্রয়ের কোনো আকাঙ্খাই নেই।
১৯। নিজের বুকে আশার মৃতদেহ জড়িয়ে ধরে
বহুকাল আমি জীবনকে দুঃখ দিয়েছি।
২০। তুমি লজ্জা পেয়েছো ছায়ায় তরতাজা হবো বলে
নিজের হদয় নিজের প্রেম ঝরা রক্ত বেচেছি।
২১। কী লাভ হবে রঙিন আলখাল্লার নীচে রয়ে
আত্মা জ্বলতে থাকবে গলতে থাকবে শুকোতে থাকবে।