হিন্দোল ভট্টাচার্য
পূর্ব প্রকাশিতের পর
মন যখন খুব অশান্ত থাকে, তখন লেখা আসে না, আবার মনকে শান্ত করব, তার পর লেখায় ফিরব, এমনটা সম্ভব নয়। এমন ভাবতে থাকলে, কখনও লেখা আসবেই না বলা চলে। কারণ একজন লেখকের কাছে লেখাটাই হল ধ্যান। আর লেখার মাধ্যমেই মনকে শান্ত করার দিকে এগোনো যেতে পারে। এই আধুনিক কালে একটি বিচিত্র অসঙ্গতির উদ্ভব হয়েছে অনেককিছুর মতো। আর তা হল , কিছু অংশ উঠে এসেছেন যাঁরা আলোবাদী এবং কিছু অংশ অন্ধকারবাদী। তাঁরা বারেবারে ঘোষণা করতে এবং মনে করিয়ে দিতে ভালোবাসেন, আলোর কবিতা লেখ। আলোর কথা বল। যেন একজন কবি বা লেখক একজন গুরুর মতো কেউ, তাঁরা বাণী দিতে এসেছেন। এ কথা ঠিক, একটি মহৎ কবিতা ক্রমে ক্রমে মন্ত্রোচ্চারণের মতো হয়ে যায়। কিন্তু সেই কবিতা যে তার বক্তব্যে, তার ভাবনায় ঐশ্বরিক ভাবনাকে বারবার পৌরোহিত্য করবে, তার তো কোনও মানে নেই। কারণ একজন লেখক আসলে একজন লেখক ছাড়া আর কিচ্ছুটি নয়। সে একজন লেনিন নয়, একজন স্বামী বিবেকানন্দ নয়, একজন রঁমা রঁল্যা নয়, চৈতন্য, মার্ক্স কিছুই নয়। সে একজন অভিযাত্রী মাত্র। প্রত্যেক অভিযাত্রীর মতোই সে জানে, যে রাস্তা দিয়ে সে চলেছে তা বিপদসংকুল। আর তার শেষে যে কী আছে, তা সে জানে না। পথের শেষ এমনিও নেই। কিন্তু ছোট ছোট গন্তব্য তো আছে। একজন লেখক এই সব ছোট ছোট গন্তব্যগুলি নিয়ে যতটা ভাবেন, তার চেয়ে বেশি ভাবেন তার এই যাওয়াটুকু নিয়েই। যাওয়াটুকুই তো আসল গন্তব্য। কিন্তু গন্তব্য হিসেবে ভেবে নিয়ে নির্দিষ্ট কোনও জায়গাকেই শেষ কোনও স্থান বলে মনে করে নিলেই সেই লেখক শেষ। তিনি আর অভিযাত্রাই করতে পারবেন না। আমার মনে হয়, এই গন্তব্য, অভিযাত্রা, এবং লেখা – এই তিনটি বিষয় সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যে কোনও ভাবনাকে সর্বশক্তিমান এবং শেষ ভেবে নিলেই সেই ভাবনা এবং ভাবনার অনুসারী যাঁরা তাঁদের মধ্যে বিপদ আসন্ন হয়ে যায়। ধর্মের ক্ষেত্রে তা যেমন তৈরি করে এক গোঁড়া অনুশাসন, মতবাদের ক্ষেত্রে তা তেমন তৈরি করে একজন রাজনৈতিক অনুশাসন। অনুশাসন আসলে তখনই তৈরি হয় বলে মনে হয়, যখন ‘ভাবনা’ নিজে খুব সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। ভাবনা কখন নিজে পথ আর খুঁজে পায় না? যখন সে নিশ্চিত, যে, সে প্রায় সমস্ত কিছুর উত্তর খুঁজে পেয়েছে। একে অনেকটা মানবিক অসঙ্গতি বলা যেতে পারে। কিন্তু একে অসঙ্গতি বলছি কেন? কারণ মানুষ যখন সেই ভাবনাকে ভাবতে শুরু করেছিল, তখন তার মধ্যে ছিল সংশয়, শ্রদ্ধা এবং অনুসন্ধানের নিষ্ঠা। কিন্তু যখন সে ভাবনা নিয়ে এগোতে এগোতে কোথাও একটা পৌঁছল, সে সেই জায়গাকেই স্বর্গ ভাবতে শুরু করল। সেই ভাবনার মধ্যে যে অসংখ্য দ্বন্দ্ব ও সেই ভাবনাকেই আক্রমণ করার জায়গা থাকতে পারে, সে সম্পর্কে তার আর ভাবনা থাকল না। মানুষের এই ভাবনাকে খুঁজে চলার মধ্যে যে অসঙ্গতি থাকে, তা এটাই বলে মনে হয়, যে মানুষ ভাবতে ভালোবাসে, এই যে নতুন, এই যে অভিনব, এই যে উন্নত একটা স্তরে আমি এসেছি, এর চেয়ে অন্য কোনও স্তর থাকতে পারে না। এই জায়গাতে এসেই শুরু হয়, ভাবনার নিজের মধ্যে বসে থাকা, নিজেকে শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করে। তৈরি হয় তখন সেই ভাবনাকে সামাজিক ভাবে শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করার জন্য মানুষের নানান সামাজিক এবং রাজনৈতিক কৌশল। ব্যাপারটা আর ভাবনার মধ্যে থাকে বলে মনে হয় না। তখন ভাবনার রান্নাঘর থেকে তার স্থান হয় রাজসিংহাসনে। অর্থাৎ একটি বুদ্ধিমান ভাবনা এভাবেই নিজেকে প্রতারিত করতে থাকে তখন। তার গলা টিপে ধরে। তাকে হত্যা করে, স্টাফড করে রেখে দেয়। ভাবনাটি হয়ে পড়ে প্রাণহীন।
মনে হয় এমনটা কেন হল? আমরা তো চেয়েছিলাম এই ভাবনাই হয়ে উঠবে শতজলঝরনার ধ্বনি। কিন্তু তা তো হল না। অথচ সময়ের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে আমরা সেই পূজার বেদীতে বসানো ভাবনাকে বানিয়ে ফেলেছি সত্য। একমাত্র সেই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে সেই সব ভাবনার শিষ্যরা তৈরি করেছেন নানান গল্প। সেই সব গল্প হয়ে উঠেছে সাহিত্য। আর সাহিত্য মিশে গেছে জনজীবনে। যত সাহিত্যের মাধ্যমে গল্প, কথন ও সত্য-রূপে ঘোষিত ভাবনা মিশে গেছে জনজীবনে, তত, তৈরি হয়েছে ভাবনা নিয়ে নানান রীতিনীতি, নানান আচার, বিচার, সংস্কৃতি। এদিকে তো রাজনীতিও গুলিসুতো ছাড়ছে ভাবনার মধ্যে। ক্ষমতা বলতে শুরু করেছে, আমাকে বিশ্বাস করো, কারণ আমি সেই সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই নেমেছি মাটিতে। আমাকে বিশ্বাস করো, কারণ আমি সেই পবিত্র, শক্তিশালী এবং একমাত্র ভাবনার অবতার। ভাবনাটি ততদিনে আরও বেশি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। বরং সেই ভাবনাকে যারা শক্তিশালী, একমাত্র সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে, সেই সব ক্ষমতাই হয়ে উঠেছে ভাবনার প্রতিনিধি। ভাবনার দেবতা। কিন্তু ভাবনা তো কখনও ওইটুকু একটা পরিসরে থাকতে চায়নি। বরং সে তার নিজের মধ্যে থাকা নানান সম্ভাবনাগুলির সঙ্গে সংলাপ চালাতে চেয়েছে। সে জানে, সেও নশ্বর। তাই সে নিজের ছবি বাঁধিয়ে টাঙিয়ে রাখতে চায়নি দেওয়ালে। কিন্তু যাঁরা সেই সব ভাবনাকে পুজো করতে শুরু করে দিয়েছেন, তাঁদের কাছে ভাবনার জীবদ্দশা, আশা, আকাঙ্খ্যা, কামনা বাসনা, প্রেম ইত্যাদি নিয়ে ভাবনা নেই। ভাবনারও যে বার্ধক্য আসে, তারও যে ক্ষয় হয়, সে নিয়েও তাঁরা ভাবতে নারাজ। তাঁদের কাছে সত্য মানেই হল পূর্ণ ও এক। তার ক্ষয় নেই। সুতরাং তার মতো শক্তিশালী বিষয়কে যে দেবতা হিসেবে পুজো করবে, যে রাজছত্র তুলে ধরবে তার মাথায়, সে কত বড় ক্ষমতাবান! কিন্তু তাদের কথা, যারা এই ভাবনার মধ্যবর্তী শূন্যতা ও অপূর্ণতা তথা দ্বন্দ্বগুলিকে নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে দিয়েছেন? তারা বিধর্মী, তারা কাফের, তারা শয়তান, তারা প্রতিক্রিয়াশীল।
এই জায়গাতে এসে অসঙ্গতি চূড়ান্ত সঙ্গতি খুঁজে পেতে শুরু করে। যে সব ভাবনা পরিণত হয়েছে ধর্মে, পরিণত হয়েছে অনুশাসনে, তার সঙ্গে সেই সব ভাবনার খুব একটা পার্থক্য তো দেখছি না যারা ধর্ম তথা ভাববাদকে আঘাত করে জড়বাদী বিশ্লেষণকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কারণ সেই ভাবনাকেও যে ক্ষমতা বলে ফেলেছে সর্বশক্তিমান কারণ ইহা সত্য। এবার সে যায় কোথায়? এই যে তার নিজের মধ্যে থাকা মৌলিকে ভিত্তির সঙ্গে ঝামেলা শুরু হল দেবত্বের, সেই ভাবনা আপনা থাকেই নিজের স্থানচ্যুত হল। আমরা দেখলাম, আরেকপ্রকার সত্যের জন্ম হল বিশ্বে। সেই সঙ্গে এল আরেক প্রকার অবতার। আর তার বিরোধী ভাবনা হয়ে গেল প্রতিক্রিয়াশীল। এই যে অসঙ্গতি, তার কারণ কি তবে এটাই, যে মানুষ সহজে সবকিছু সমাধান করে ফেলেছে বলে ভাবতে ভালোবাসে? না কি মানুষের মধ্যে নতুন কোনও ভাবনার জন্মলগ্ন থেকেই শুরু হয় সামাজিক ভাবে সেই ভাবনাকে একটা নিয়ন্ত্রণকারী শক্তিতে পরিণত করার বাসনা? কেন আমরা দেখছি বারেবার, যখন কোনও দর্শন অনুশাসনে পরিণত হচ্ছে, তখন-ই সেই দর্শনের বিশ্ববীক্ষা ভেঙে যাচ্ছে? ঈশ্বরবিশ্বাসী যদি কেউ হন, তবে তাঁকে আমার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, ঈশ্বর তো নিজে এইসব ধর্মের সৃষ্টি করেননি। তিনি শুধু সৃষ্টি করেছেন প্রকৃতিকে, এই মহাজগতকে। মহাজগতের কারণগুলির মধ্যে যে সুন্দর এবং শক্তি আছে, তাকে মানুষ অনুধাবন করেছে, সুন্দরে মুগ্ধ হয়েছে। যা কিছু দেখা যাচ্ছে, এবং যা কিছু দেখা যাচ্ছে না, সেগুলির মধ্যে একধরনের প্রাকৃতিক সঙ্গত আছে। অসঙ্গতি নেই। সেই সঙ্গতকে আপনি কি সত্য বলবেন? সেই সঙ্গতকে সত্য বললে, আপনি প্রাকৃতিক বিভিন্ন ঘটনা ও ঘটনার বাইরের রূপকেই সত্য বলছেন। কিন্তু রূপ পরিবর্তনশীল। সবাই জানেন। আপনিও জানেন। কিন্তু পরিবর্তনশীলতা যখন এলো, আপনি তখন খুব সংকটে পড়ে গেলেন। আপনি ভাবতে শুরু করেদিলেন সত্য কেমন করে বহু হবে? তাকে তো এক হতেই হবে। অতএব পরিবর্তনগুলি সত্য নয়, মায়া। এইবার আপনাদের মধ্যে তর্ক শুরু হল এক এবং বহুর মধ্যে। আপনারা অনুশাসন বেঁধে দিতে শুরু করলেন। কিন্তু কাদের জন্য? ঈশ্বরের জন্য নিশ্চয় নয়। প্রকৃতির জন্যও নয়। আপনাদের নিজেদের অসহায়তার জন্য। ঠিক যেভাবে মার্কসবাদের অনুসরণকারীরাও দেখল, মার্কসবাদকে খোলা পাতা হিসেবে রাখলে মুশকিল। একে করে তুলতে হবে একটি কোরান, গীতা , জেন্দ আবেস্তার মতো পবিত্র। কারণ এর অনুসরণকারীদের মনে জাগাতে হবে এই ধারণা, যে তারা অনুসরণ করছে এমন একটা দর্শনকে, যা সর্বশক্তিমান, কারণ তা সত্য। মার্ক্সবাদ-ও পরিণত হল একটি ধর্মে, যার অনুসরণকারীরা ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে হয়ে উঠল ভাবনার জগতে মৌলবাদী।
একটা ভাবনার মধ্যে যদি উঠোন না থাকে, যদি, সংশোধন বা কাটাকুটি না চলতে থাকে ক্রমাগত, তবে সেই ভাবনা তো কেবলমাত্র তার সময়ের একটি প্রত্নভাবনায় পরিণত হবে। ধর্ম থেকে শুরু করে সমাজবাদের বিভিন্ন দর্শন এখন সেটাই হয়েছে। আর তার মূলে আছে মানুষের তীব্র অসঙ্গতি। একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরঘুর করে সবসময়। তবে আমরা যে এখন অসহিষ্ণুতা অসহিষ্ণুতা বলে প্রতিরোধ করছি অসহিষ্ণুতার, তার মূলে কী আছে? সমস্ত কিছুই এখন মনে হয় এক মাটির নীচে ফসিলে পরিণত। আমরা দেখতে পাচ্ছি মাটির উপরে বাগান, হয়ত একটা নদী বয়ে গেছে, হয়ত রাজপ্রাসাদ, হয়ত মেট্রো রেল চলছে, আবার হয়ত বা বসে গেছে বিরাট বড় বাজার। আমরা দেখতে পাচ্ছি না, সেই কবর, যা ফসিল। তবে কীভাবে আমরা এই অসঙ্গতির ইতিহাসের ধ্বংসস্তূপের ভিতর দিয়ে সেই সব ভাবনার মূলে গিয়ে পৌঁছতে পারব?
(ক্রমশ)