মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল
কাজী নজরুল ইসলামের ‘ধূমকেতু’ (অর্ধ-সাপ্তাহিক) পত্রিকার সঙ্গে কমরেড মুজফফর আহমদের পৃষ্ঠপোষকতা ও সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ‘ধূমকেতু’ বাংলা সংবাদপত্রের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনাও বলা চলে। এ পত্রিকাকে আশীর্বাদ করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর আশীর্বাদ বাণী নিয়ে পত্রিকাটির মাত্র ৩২টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯২২ (১০২৯) সালের ১১ই আগস্ট এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় - এবং ৩২শ’ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ২৭ জানুয়ারী (১৩২৯)। তারপর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীকালের নবপর্যায় ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা (সাপ্তাহিক) সম্পাদনা করেন কৃষ্ণেন্দু নারায়ণ ভৌমিক। ‘ধূমকেতু’ বন্ধ হবার দশ বছর পরে এটি প্রকাশিত হয়। (এ পত্রিকার সঙ্গে নজরুলের কোন সম্পর্ক ছিল না, তবে কবির কিছু রচনা এতে ছাপা হয়েছিল।) ‘ধুমকেতুর’ কপি এখন দুষ্প্রাপ্য। ‘নজরুল ইন্সটিটিউট’ (ঢাকা) কর্তৃক প্রকাশিত ‘ধূমকেতুর’ ফাইল থেকেই উদ্ধৃতিসমূহ এখানে দেওয়া হলো। ‘দ্বৈপায়ন’ এই ছদ্মনামে মুজফফর আহমদ তিনখানি পত্র লিখেছিলেন। ‘সারথি’কে অর্থাৎ নজরুল ইসলামকে। দ্বৈপায়নের প্রথম পত্রটি মুদ্রিত হয় - ‘ধূমকেতু’র ১৩শ’ সংখ্যায় (২৬ আশ্বিন, ১৩২৯; ১৩ অক্টোবর ১৯২২) ৮ম সংখ্যা থেকে সম্পাদক নয় ‘সারথি’, ছিলেন ‘নজরুল’। রইল সেই চিঠিটি। সৌজন্যে: দৈনিক ইত্তেফাক, ২৫শে আগস্ট এবং ১লা সেপ্টেম্বর, ২০০৬।
ভাই সারথি!
তোমার ‘ধূমকেতু’ আমি রীতিমত পড়ছি, কিন্তু সত্যকথা বলতে কি, সমস্ত প্রাণ-মন দিয়ে যে জিনিসটি চাইছি, সেইটিই ওতে আমি পরিস্ফুটরূপে পাচ্ছিনে। আমাদের দেশের নির্যাতিত জনমণ্ডলীর প্রতি তোমার সহানুভূতি আছে। তোমার লেখাতেই তার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বড় দুঃখ যে তুমি তাদের বিষয়ে পরিষ্কার করে আজো কিছু বলনি। নির্যাতিত জনসাধারণ বলতে আমাদের দেশের কৃষক ও শ্রমিকদিগকেই বুঝি। এরা ছাড়া আর সবাই নির্যাতনকারী নির্যাতিত নয়। আমাদের বেশীর ভাগ কাগজই মধ্য শ্রেণীর লোকেরা লিখছে। আর কাঁদুনীও তারা গাইছে – তাদের আপনাদেরই জন্য। এই সেদিনও ‘সনাতন’ নামে একখানা কাগজ মধ্যশ্রেণীর বাঙালীর জন্য চোখের জল ফেলতে ফেলতে বাজারে বার করেছে। কিন্তু ওই মধ্যশ্রেণীর লোকেরা কি কম অত্যাচারী? দেশের দাসত্বের নিগড়কে সুদৃঢ় করার জন্য যতটা দায়ী জমিদার ও ধনী লোকেরা; তার চাইতে এতটুকুও কম দায়ী নয় এই মধ্যশ্রেণীর লোকেরা। আমাদের মরা-বাঁচাসমূহ নির্ভর করছে কৃষক ও শ্রমিকদের উপরে। কৃষকেরা প্রাণপাত পরিশ্রম করে আমাদের খাদ্যদ্রব্য তৈরী করে দিলে তবে আমরা বেঁচে আছি। আর মজুরেরা কারখানায় খেটে ব্যবহার্য নানা দ্রব্য প্রস্তুত করে দিলে তবেই সকলের সংসার যাত্রা নির্বাহ হয়। যুদ্ধ বিগ্রহের জন্য সৈন্য সংগ্রহও করা হয়ে থাকে এ দু’শ্রেণীরই লোকের মধ্যে দিয়ে। সংখ্যায়ও ওরা বেশী; বোধ হয় শতকরা ৮০ জনেরও উপরে। মোট কথা এই যে দুনিয়ারূপ মেশিনটা চলছে, এটার সমস্ত কলকবজাই কৃষক ও মজুরদের হাতে। ওরা চালালে তবে এ মেশিন চলবে – আর না চালালে একদিনেই বন্ধ হয়ে যাবে।
এখন যে কৃষক ও শ্রমিক, ওদেরকে মধ্য ও উচ্চ শ্রেণীর লোকেরা মেরে রেখে দিয়েছে। শুধু ভাবের দিক দিয়ে নয়, মনুষ্যত্বের দিক দিয়েও। এ অত্যাচারীরা নানা দিক থেকে নানা ভাবে অত্যাচার করে করেও গরীবদের আর কিছু রাখেনি। সব কিছু যারা করছে – তাদেরকেই বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে যে তারা কিছুই নয়। কর্মের সম্মান আমরা করতে জানিনে। তা যদি জানতেম, তাহলে এত দুর্দশা আমাদের কস্মিনকালেও হত না। যে যত অলস, সেই তত বেশী ভদ্রলোক, এই লক্ষ্মীছাড়া দেশে আর যারা কাজের লোক তারাই সব ছোটলোক। চাষা আর মজুর শব্দই এদেশের ভাষার গালি।
কৃষক ও শ্রমিকদের কথা কখনো ভেবেছ কি? একটা কথা সোজা তোমায় বলে দিচ্ছি – যদি ওদের কথা ভাবতে না শেখ তবে তোমাকে দিয়ে দেশের কোন সেবাই হবে না, প্রাণ দিলেও না। ওরাই দেশের শক্তি। ওদেরকে না জাগালে আত্মবোধ না শেখালে তোমাদের তথাকথিত ‘ভদ্দর লোকেরা’ কিছুই করতে পারবে না। কোনো ক্ষমতাই তাদের নেই। তারা জানে শুধু কৃষক আর শ্রমিকদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খেতে। পেটের জ্বালায় ধনীর ঘরে যে সিঁধ কাটতে যায় সে চোর – সমাজে এর স্থান নেই – আর যুগ যুগান্তর ধরে কৃষকের মুখের গ্রাস যারা কেড়ে খাচ্ছে – তারাই ভদ্রলোক সমাজপতি। শস্যের জন্মদাতা হয়েও কৃষকেরা অনাহারে মারা যাচ্ছে। কলকারখানাতে ধনীরা প্রচুর লাভ করছে অথচ শ্রমজীবীরা দু’বেলা পেট ভরে খেতে না পেরে – রক্ত বমি করে মরছে। কেন এমন হয় – সামান্য চিন্তাতেই তা বুঝতে পারবে। চিন্তার হাটে দেউলিয়া হয়েই তো আমরা দেশের সর্বনাশটা করেছি।