জয়াশিস ঘোষ
একই রকম আছে। নন্দন চত্বর। অ্যাকাডেমির সামনেটা। বেনফিশের পেছনে চায়ের দোকান। আড্ডা। কবিতা। নাটক। লোকটা শুধু নেই। কেউ খুঁজছে কি? একটা বাড়িয়ে দেওয়া হাত। অনামী পত্রিকা। মৃত্যু কি নীল রঙের হয়? সজল কাঞ্জিলালের জামার মত? না কি ঘন কালো? মেট্রোর সুড়ঙ্গের মত। ভিড়ে ঠাসা কলকাতায় একটা মানুষ হারিয়ে গেলেন। হারিয়ে গেল আপাদমস্তক শিল্পে ডুবে থাকা একটা জীবন। হারিয়ে গেল অনেক স্বপ্ন। হারিয়ে গেলেন কলকাতার একমাত্র মেল মডেল। সজল কাঞ্জিলাল।
আমি তাঁর নাম জানতাম না৷ কীভাবে জানব? তিনি তো বিখ্যাত কেউ নন। ছবি দেখে চমকে উঠলাম। এঁকে তো দেখেছি অনেকবার। সেই হাসিমুখ, বিনয়ী মানুষটির এত গুণ ছিল? ছাত্রের কথা স্মরণ করে কেঁদে ফেললেন মমতাশঙ্কর। নাট্যকর্মীদের চোখে জল। চিত্রশিল্পীদের হাতের তুলি থেমে গেল। নাচ, নাটক, আঁকা, কবিতা, লিটল ম্যাগাজিন এই নিয়েই ছিলেন সজল কাঞ্জিলাল। নন্দনের গাছগুলোর মতই চেনা হয়ে গেছিলেন সবার। – সজলদা, এক কাপ চা হবে নাকি? – সজলদা, সামনে ভালো নাটক কী আছে? – সজলদা, আমার পত্রিকাটা একটু বেচে দাও না! মুখে হাসিটুকু লেগে থাকত। আমরা পরিবার বলতে যেটুকু ভাবি, সজল কাঞ্জিলালের আপনজন ছিল তার থেকে অনেক বেশি। উঠতি কবি, চা-ওয়ালা, চিত্রশিল্পী, পাকা দাড়ি সাহিত্যিক – আঠারো থেকে আশি, সবাই ছিলেন তাঁর বন্ধু। জীবনের কাছে তাঁর চাহিদা ছিল না কোনও। বরং জীবনকে জামার পকেটে নিয়ে ঘুরতেন। কসবায় মামাতো ভাইয়ের সাথে থাকতেন। রোজ সেখান থেকে নন্দন চত্বরে আসতেন। হাতে থাকত নাটকের বই, পত্রিকা। চলমান বইয়ের দোকান।
সেদিন বাড়ি ফেরা হল না। অফিস টাইমে ভিড়ে ঠাসা মেট্রোয় আটকে গেল হাত। যে হাতে নাটক বিলিয়েছেন, কবিতা ছড়িয়ে দিয়েছেন মানুষের কাছে, তাকে দরজার এপারে ফিরিয়ে আনতে পারেননি সজল। রোগা শরীরটা নিজের সাথে নিয়ে বোবা টানেলে ঢুকে পড়েছে মেট্রো। যখন হুঁশ এসেছে, সেই কয়েক মিনিটে সব শেষ। শিল্পী সজল কাঞ্জিলালের নিথর শরীর পড়ে ছিল মেট্রো সুড়ঙ্গে।
‘দুর্ভাগ্যজনক’! খুব সহজে একটা শব্দে তাঁর মৃত্যুকে মালা পরিয়ে দিলেন মেট্রোর আধিকারিকেরা। সাথে সান্ত্বনা পুরষ্কার, ‘তদন্ত’ করবে রেলওয়ে সেফটি কমিটি। হ্যাঁ, তদন্ত হবে। মোটরম্যান, গার্ডের মত দু’একজন সাসপেন্ড হবে। কিন্তু প্রশ্নগুলো? সজল কাঞ্জিলালের মৃত্যুর সাথে মেট্রোর সুড়ঙ্গ থেকে যেগুলো উঠে এসেছে আপামর মেট্রোযাত্রীদের মনে? সেগুলোর উত্তর দেওয়া যাবে কি? কেন সজল কাঞ্জিলালের হাত আটকে থাকা সত্ত্বেও সিগন্যাল দেওয়া হল? কেন দরজার সেন্সর কাজ করল না? কেন ২০ মাস আগে কেনা পাঁচটি রেক চেন্নাইয়ের কোম্পানিকে ফেরত দেওয়া হল? তাহলে কি মেট্রোর এই নতুন রেকগুলির নিরাপত্তা ব্যবস্থা আগে থেকেই ঢিলে ছিল? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়ার আগেই ফাইল চাপা পড়ে যাবে। যেমন ফিরে আসবেন না সজল কাঞ্জিলাল!
প্রতিদিন শহরতলি, মফস্বলের প্রান্ত থেকে লাখে লাখে মানুষ বমি করে ভিড়ে ঠাসা লোকাল ট্রেন। চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে মানুষগুলো দৌড়োয় মেট্রো ধরার জন্য। সংখ্যাটা প্রতিদিন ৯ লক্ষ। আপনি যখন পড়বেন তখন মিলিয়নে পৌঁছে যাবে। এই ভিড় সামলানোর ক্ষমতা আছে তো কলকাতা মেট্রোর? এর সাথে উৎসব, অনুষ্ঠান, পুজোর শপিং, প্যান্ডেল হপিং, ঈদের জাকারিয়া, শীতের ভিক্টোরিয়া তো আছেই। লোকাল ট্রেনের দরজায় ঝুলে থাকা ভিড়টা এসি মেট্রোর দরজা বন্ধ হতে দেয় না। তার মধ্যে ব্যাগ, জলের বোতল, ফাইল বা জুতোর আগা কোনওমতে দরজার ফাঁক দিয়ে গলিয়ে সেন্সরের অগ্নিপরীক্ষা। ভিড়ের চাপে এক একটি স্টেশনে পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকে ট্রেন। দরজায় মারামারি, হুঙ্কার। ভেতরের লোক বাইরে আসতে পারে না। বাইরের লোক ভেতরে ঢুকতে। জানেন নিশ্চয়ই, এর মধ্যে বেশ কয়েকবার দরজা খোলা রেখেই ছুটে গেছে ট্রেন। কয়েকদিন আগে এক তরুণীর জুতো আটকে গেছিল দরজায়। ভাগ্য ভালো ছিল, অ্যালার্ম টাইমে বেজেছিল। ট্রেন স্টার্ট নিয়েও থেমে গেছিল।
তারপর, সেই আগুন লাগার ঘটনা? ভোলার তো কথা নয়! দুই স্টেশনের মাঝে শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লেগে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্যুৎ বন্ধ করে আতঙ্কিত যাত্রীদের একে একে সরিয়ে নেওয়া হয়। কিছু যাত্রীকে হাসপাতালেও ভর্তি করা হয়েছিল। সবথেকে আতঙ্কের ব্যাপার, যাত্রীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনার কাজটা শুরু করতে আধ ঘণ্টা সময় লেগেছিল! আগুন লাগার খবর জানার পর আধ ঘণ্টা! ভেবে দেখুন কী কী হতে পারত। শুধু ভিড়ের চাপেই লোক মরে যেতে পারত। শুধু তাই নয়, একবার তো এসকালেটর হঠাৎ করে উলটো পথে চলতে শুরু করে। যাত্রীরা ছিটকে পড়ে যায়। অনেক বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারত।
অথচ অদ্ভুত ব্যাপার, সেফটি নিয়ে রেল মন্ত্রকের প্রশ্নের উত্তরে কলকাতা মেট্রো জানিয়েছে কোনও দুর্ঘটনা হয়নি। ওনারা না হয় মৃত্যু না হলে সেটাকে দুর্ঘটনা বলতে রাজি নন। কিন্তু আমি, আপনি? রোজ প্রাণ হাতে করে পাতালে প্রবেশ করছি। এই নিরাপত্তা ব্যবস্থায় লাখ লাখ মানুষের সাথে যুদ্ধ করে নিজের পা রাখছি। আমাদের নিরাপত্তা কোথায়?
সজল কাঞ্জিলাল পারলেন না। হেরে গেলেন। তাঁর নাটক, শিল্প, চিত্রকলা মানুষ ভুলে যাবে। অ্যাকাডেমিতে মডেল হিসাবে তাঁর ছবিতে কেউ হাত বুলোবে না। ধুলো জমবে। হয়ত একসময় সরিয়ে দেওয়া হবে। সবাই জানবে কলকাতা মেট্রোর ইতিহাসে দুর্ঘটনায় মৃত প্রথম ব্যক্তির নাম – সজল কাঞ্জিলাল!
মেট্রো সুরক্ষা ও পরিষেবা নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্নতা ক্রমশই বেড়েই চলেছে। কর্তৃপক্ষকে সচেতন হতে হবে। সজলদার এই মর্মান্তিক ঘটনাটা তুলে ধরতে গিয়ে লেখক অতি দক্ষতার সাথে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর আলোকপাত করেছেন।
ভালো লিখেছো জয়াশিস-দা … এই একটু আগে পড়লাম, একজন-ও প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষ্য দিতে যাননি আজকে … যদিও সত্যি বলতে তাতে আশ্চর্য হলাম এমন নয়! এই ভয়ানক নির্লিপ্তি থেকে উদ্ধার পাওয়া খুব কঠিন মনে হয় !