সৈকত ভট্টাচার্য
এই তো সেদিনের কথা! ঘুম থেকে উঠে প্রাতরাশের টেবিলে গিন্নির সঙ্গে চেন্নাইয়ের প্রশংসা আর কোলকাতার নিন্দেমন্দ করে চান করে আপিস যাব। এই জাতীয় আলোচনা আমাদের রোজই চলে। কোলকাতায় নিজের বাড়িঘর ছেড়ে চেন্নাইতে ভাড়াবাড়িতে থাকতে কার আর মন চায়? কিন্তু অনন্যোপায়! চেন্নাইতে চাকরির বাজার একেবারে মধ্যাহ্নের সূর্যের মত উজ্জ্বল। কোলকাতা সেখানে গোধূলি গগন! এখানে রোজ আপিস যাতায়াতের পথে নতুন নতুন লম্বা চওড়া আইটি পার্কের কন্সট্রাকশন দেখে ‘সাধু সাধু’ করি! অমন একখানি চকচকে আপিসের ‘সান ফিল্ম’ লাগানো কাঁচের ঘরের মধ্যে থেকে বাইরের পৃথিবীটা মোহময় মনে হয়। দূরে বঙ্গোপসাগরের নীল জলদৃশ্য প্রাণ ঠান্ডা করে দিয়ে যায়… আর সেখানে কোলকাতা! — এমনতর আলোচনা আমাদের রোজকার জীবনের অঙ্গ।
সেদিনকেও এমন একখানি বিদগ্ধ আলোচনার শেষে যখন তোয়ালে নিয়ে বাথরুম ঢুকলাম, কল খুলতেই সে বলল— ফরররত!! ভুরু কুঁচকে বন্ধ করে আবার চালালাম। সে এবার বলল, ঘুরররররর-ফ্রুইত! আমি বললাম, এ কি আপদ! বাইরে থেকে গিন্নি হাঁকল— জল নেই!
সেই থেকে শুরু।
মহাকাশ থেকে যদি চেন্নাই শহরটিকে দেখেন, তবে দেখতে পাবেন যে মোটামুটিভাবে বলতে গেলে দুটো নদী আর একখানি খাল মিলে এই শহরের ইতিকথা, থুড়ি, জলকথা লিখে চলেছে অ্যাদ্দিন। শহরের বুক চিরে আড়াআড়িভাবে দুটি নদী পশ্চিম থেকে পূর্বে প্রবাহিত হয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। তাদের মধ্যে একখানি হল কুয়াম নদী। নুঙ্গামবক্কাম-এর কাছে প্রায় অশ্বখুরাকৃতি বাঁক নিয়ে মেরিনা বিচের শেষ প্রান্তে যেখানে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতাকে সমাধিস্থ করা হল, তার পাশেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে সাগরে। অপর নদীটি হল আডেয়ার নদী। কুয়াম নদীর থেকে কিছুটা দক্ষিণে একইরকমভাবে পশ্চিম থেকে পূর্বে বয়ে এসে বেসান্ত নগর বিচের কাছে পড়েছে সমুদ্রে। এই দুই স্রোতস্বিনীকে ‘নদী’ বললাম বটে, কিন্তু গঙ্গা, পদ্মার দেশের মানুষ ‘নদী’ বলে যাকে বুঝবেন— সেরকম কিছু ভেবে বসলে নিতান্ত বিপদ! একেই দক্ষিণ ভারতের সমস্ত নদীই বৃষ্টির জলে পুষ্ট, তায় এই নগরজীবনের উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে, বর্ধনশীল নগরের বর্জ্যের ভার বহন করতে করতে এই জলধারাগুলির ‘নদীত্ব’ বলে আর কিছু নেই। গত পনেরো কুড়ি বছর আগে যেখানে কুড়ি-একুশ প্রজাতির মাছের সন্ধান পেয়েছিলেন বৈজ্ঞানিকরা, সেখানে এখন মাছের সংখ্যা শূন্য! শহরের সমস্ত পয়ঃপ্রণালী এসে মিশেছে এই নদীদুটিতে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই হ্রাস পেয়েছে তাদের নাব্যতা, বেড়েছে দূষণ। আর সরকার বাহাদুর চকচকে এসইজেড বানিয়ে নিজেদের প্রগতিশীল বলে দাখিল করেই বাহবা কুড়িয়েছেন।
এ তো গেল নদীর কথা। চেন্নাইতে আরও একটি খাল আছে। কুমির আনার জন্য কি না জানা নেই, এই খাল কাটা হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে। বেসিল ককহ্রেন নামে এক স্কটিশ ব্যবসায়ীর উদ্যোগে ১৮০৬ সালে এই খাল প্রথম কাটা হয়। তখন অবিশ্যি উত্তরে এন্নোর থেকে চেন্নাইয়ের উত্তর সীমান্ত অবধি এর দৌড় ছিল। তখন শহরটিই বা আর কত বড় ছিল! (ঊনিশশো এক সালের একটি হিসাব বলছে শহরের আয়তন ছিল মাত্র পঁচাত্তর বর্গকিলোমিটার। আর জনসংখ্যা? মাত্র পাঁচ লক্ষ। সেখান থেকে দুইহাজার এগারোতে জনসংখ্যা ছুঁয়েছে ছিয়াশি লক্ষ আর সঙ্গে শহরের আয়তন বেড়ে দাঁড়িয়েছে একশো চুয়াত্তর বর্গকিলোমিটার।) ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ডিউক অফ বাকিংহামের উদ্যোগে কুয়াম আর আডেয়ার নদীকে জোড়ার জন্য আর একটি খাল কাটা হয়। তার নাম হয় বাকিংহাম ক্যানাল। পরবর্তীকালে ধাপে ধাপে সেই খাল ককহ্রেন ক্যানালের সঙ্গে যুক্ত হয়ে লম্বায় বেড়ে উত্তরে স্পর্শ করল কৃষ্ণা নদীকে, আর দক্ষিণে মারাক্কানাম নামে একটি জায়গার কাছে উন্মুক্ত হল সাগরে। ব্রিটিশ সরকার এই খাল ব্যবহার করত মূলত দক্ষিণ থেকে তৈরি হওয়া নুন বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এমনি নৌকোও চলত অবিশ্যি। উনিশশো ষাট সাল অবধি এই খাল দিয়ে চলা নৌকোই ছিল চেন্নাইবাসীদের কাছে পরিবহণের অন্যতম মাধ্যম। কিন্তু তারপর কালে কালে দুই নদীর মত এই খালও এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে শহরের আস্তাকুঁড়।
দুইহাজার পনেরো সালে যখন বন্যা হল, আমি তখন চেন্নাইতে। আমি যে অঞ্চলে বাস করতাম, সেখানে জল সেভাবে না জমলেও গোটা চেন্নাই যেভাবে জলমগ্ন হয়েছিল, সে কথা ভাবলেই শিউরে উঠতে হয়। এই নদীদুটি বা খাল— কোনওটাকেই দূষণের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা না করে সরকার শহরবাসীকে জলের যোগান দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট করেছিল চারখানি জলাশয়। তাদেরও পরিস্রাবণ প্রক্রিয়া বন্ধ— তাও প্রায় বছর দশেক হয়ে গেল। হ্রদগর্ভে পলি এবং অন্যান্য বস্তু জমে ধারণ ক্ষমতা কমিয়ে দিতে থাকে। তাই প্রতি দুতিন বছরে সেই স্তর পরিষ্কার করে জলাশয়গুলিয়ে পরিস্রুত রাখতে হয়। কিন্তু চেন্নাই জল সরবরাহ দফতরসূত্রে জানা যাচ্ছে যে গত দশ বছরে সে প্রক্রিয়া একবারও হয়নি। তাই স্বাভাবিকভাবেই দুইহাজার পনেরোতে প্রবল বর্ষণে এই হ্রদগুলির ধারণ ক্ষমতা অতিক্রম করে গেল। ফলে অতিরিক্ত জলকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হল কর্তৃপক্ষ। কুয়াম বা আডেয়ার নদী অথবা বাকিংহাম খাল— কারওই নেই জল বহন ক্ষমতা। নাব্যতা গেছে কমে। বর্জ্যে ভরে গিয়ে ধারণ ক্ষমতা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় নর্দমার সমান। যার ফলে সেই বিশাল পরিমাণ জল সমুদ্রে যাওয়ার রাস্তা না পেয়ে এক বেলার মধ্যে ডুবিয়ে দিল গোটা শহর। চলে গেল বেশ কিছু প্রাণ, বিপর্যস্ত হল সমস্ত পরিষেবা।
তারপর কেটে গেছে তিন বছর। বন্যার জল কমে গেছে প্রকৃতির নিয়মে। মানুষের জীবনও আস্তে আস্তে ফিরে গেছে নিজের ছন্দে— কালের নিয়মে। সরকার ফিরে এসেছে দ্বিতীয়বারের জন্য। শহরের বুকে পা রেখেছে নতুন অনেক আন্তর্জাতিক কোম্পানি। গড়ে উঠেছে এসইজেড। কিন্তু নদীগুলির কথা কেউ ভাবেনি। তাদের নাব্যতা কমেছে আরও। দূষণ এসে গ্রাস করে নিয়েছে তাদের জল। শহরের বর্জ্যে ভরে উঠেছে তাদের কোল… শহরের মানুষের জন্য জল জুগিয়ে গেছে ওই চার জলাশয়।
সারা ভারতবর্ষে যখন বর্ষাকাল, চেন্নাইতে তখন প্রখর তপনতাপ। এপ্রিল মে মাসের ‘অগ্নিনক্ষত্রম’ পার হয়ে জুন-জুলাই-অগাস্টে তাপমাত্রা একটু কমে বটে, কিন্তু বর্ষা হয় না। দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমীবায়ু আরব সাগর থেকে জল সংগ্রহ করে কেরল বা মহারাষ্ট্রের পাহাড়ে বাধা পেয়ে তুমুল বৃষ্টিপাত ঘটায়। প্রতি বছরই মুম্বাই শহরের জনজীবন বিপর্যস্ত হওয়ার খবর আসে। ফলে উল্টোদিকে যখন মৌসুমীবায়ু আসে, তখন তার জলভাণ্ডার শূন্য। চেন্নাইতে ‘প্রখর দারুণ অতি দীর্ঘ দগ্ধ দিন’ গুনতে থাকি আমরা। আবার মৌসুমীবায়ু পূর্বতট পার হয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে আবার জল সংগ্রহ করে আষাঢ় নিয়ে আসে পূর্ব ভারতে। এতে চেন্নাইবাসী অভ্যস্ত। অসুবিধা হচ্ছিল না এতদিন। কারণ, নভেম্বর ডিসেম্বর ম্যাসে যখন ফেরার পালা হয়, উত্তরের তুষারস্পর্শী মৌসুমীবায়ু শৈত্য আনে বাংলায়, কিন্তু তারপর বঙ্গোপসাগর পার হতে হতে সংগ্রহ করে জল। আর বৃষ্টি হয় চেন্নাইতে। সেবার বন্যারও সময়ও তাই হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতির খেয়াল! গত বছর ফিরতি মৌসুমীবায়ুতেও ঝরল না বৃষ্টি। প্রচুর ঘাটতি রয়ে গেল জলের। জলাশয়গুলি নিজেদেরকে পূর্ণ করে নিতে পারল না। তাহলে? উপায়? আগামী প্রায় এক বছর জলের যোগান আসবে কোথা থেকে? আপনি বলবেন, কেন? মাটির বুকের ভিতর বন্দি যে জল? কম পড়িয়াছে? উত্তর হল, হ্যাঁ!
দুইহাজার ষোল সাল থেকেই চেন্নাই সেইসব শহরের তালিকার প্রথমদিকে স্থান নিয়েছে যারা মাটির বুকের ভিতর থেকে বন্দি জলকে হুড়হুড়িয়ে তুলে নেয়, কিন্তু ফিরিয়ে দেওয়ার বেলায় কাঁচকলা! তার উপরে ফিরতি মৌসুমীবায়ু স্বাভাবিক বর্ষণের কণামাত্রও ভরাতে পারেনি। ফল— আরও তিনশো মিটার নীচে চলে যাওয়া জলস্তর! সেই জলস্তর থেকে জল তুলে আনার ক্ষমতা নেই পাম্পগুলির। নতুন করে পাম্প বসিয়েও লাভ হচ্ছে না। কারণ, শহরের প্রতিদিনের কয়েক হাজার কোটি লিটার জলের যোগান দিতে দিতে সেই স্তরও রোজ আরও আরও নীচে পিছিয়ে যাচ্ছে। ফলে সেই শূন্যগর্ভ থেকে জলের বদলে উঠে আসা বায়ু হাহাকারের মত পাক খেয়ে চলেছে শহরের বুক জুড়ে। আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রতীক্ষা একটু বৃষ্টির। একটু বৃষ্টি যদিও এই সমস্যার সমাধান করবে না। দরকার টানা তিন-চারদিন বৃষ্টি। কিন্তু সেই মেঘ তো আটকা পড়েছে পশ্চিম ঘাটের ওপারে— সূর্য অস্ত যাওয়ার কূলে।
এই জলকষ্টের দিনে গাড়ি ভরে জলের জোগান দেওয়ার চেষ্টা চলছে। বাইরে থেকে ট্যাঙ্কারে করে জল এনে সামাল দেয়াড় চেষ্টা চলছে জলের। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় সে আর কতটুকু? প্রকৃতি যতদিন না করুণাবর্ষণ করবে ততদিন অপেক্ষায় থাকা ছাড়া গতি নেই।
কিছুদিন আগে একটি ওয়েব সিরিজ দেখছিলাম। ‘লেইলা’। সে এক ভবিষ্যতের ভারতবর্ষের ছবি। কিন্তু ভারতবর্ষর সমাজ ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেছে কয়েক শতক। বর্ণভেদ, জাতিভেদ রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রযুক্তিতে উন্নতি হয়েছে আকাশছোঁয়া। সুউন্নত অভ্রভেদী বাড়িঘর তার প্রমাণ রেখেছে। আর এই সব কিছুর সঙ্গে ফুরিয়ে গেছে জল। জলের জন্য হানাহানি শুরু হয়েছে। কল খুললে কালো তরল বের হয়। পরিশ্রুত পানীয় জলের দেখা মেলে না। সন্দেহ নেই যে আমরা, এই গ্রহের উন্নততম প্রাণীরা, একদিন তেল ছেড়ে জলের অধিকারের জন্যই আবার অস্ত্র তুলে নেব হাতে, আবার লোকক্ষয়ী, ইতিহাস-বিধ্বংসী লড়াই হবে। আমাদের ‘নীল গ্রহ’ তার রং হারিয়ে হয়ে উঠবে ভীষণ ভীষণ ধূসর।
This is amazing. I have never seen such a project. I am really really impressed.
What project?