বিলাল হোসেন
শহরের উপকন্ঠে প্লট কেনা বিষয়ক
শহরের উপকণ্ঠে বেড়ীবাঁধের পাশ ঘেষেই যে বিস্তৃত জমি আছে, অই জমির ওপর আমার যে দুই কাঠার প্লট আছে, সেখানে যে একটা দশ বাই বারো দুইটা রুম সহ এটাচ বাথ কিচেন আছে— এই খবর না জানে আমার আত্মীয়স্বজন, না জানে আমার স্ত্রী লুবনা ম্যাডাম, না আমাদের সন্তান। যে দুচারজন প্রতিবেশী বা বন্ধু আছে, না, তারাও জানে না।
তা প্রায় বছরদুয়েক হবে, লুবনা যখন ফ্রন্ট ডেস্ক অফিসার থেকে হঠাৎ কয়েকধাপ উপরে উঠে গেল, আর অফিসময় সবার কাছে লুবনা ম্যাডাম হয়ে গেল তখন আমি ধপাস করে নিচে পড়ে গেলাম। নিচে মানে নিচে, লুবনার কথার নিচে থাকা শুরু হল। এইরকম—
লুবনা যদি বলে— শোনো, আজ একটু আসতে দেরি হতে পারে। তুমি খেয়ে নিও। রাতুলকে খাইয়ে দিও।
আমি তখন বলি— এসব নিয়ে তুমি চিন্তা কোরো না একদম।
লুবনা যদি বলে— শোনো, রাতুলকে বোর্ডিং স্কুলে দিয়ে দি। এখানে টেককেয়ার হচ্ছে না।
আমি বলি— এসব নিয়ে ভেবো না। আমি দেখে রাখব।
লুবনা যদি বলে— শোনো, তুমি তো জানো, আমাদের অফিসের কাজের এক্সটেনশন এখন বিদেশেও। সেই উপলক্ষ্যে আসছে ১৫ তারিখে একবার থাইল্যান্ড যেতে হবে। ভাবছি…
আমি তখন বলি— এত ভেবো না। যাও। আমি আছি তো।
আর এভাবেই লুবনা ক্রমশ ‘লুবনা ম্যাডাম’ হয়ে দূরে আরও দূরে যেতে লাগল, আর আমি এই ফাঁকে নাগ্রাম নাশহর এমন জায়গায় একটা প্লট কিনে ফেলি কিস্তিতে। সহজ কিস্তিটা আমি পেয়েছি, কেননা জমির মার্কেটিং ছেলেটি বেশ করিতকর্মা। সে এমনভাবে আমার ওপর আছর করেছিল যে আমি কিনতে বাধ্য হই।
–স্যার, এই দেখুন আপনার বাড়ির সামনেই সুরনদী। সারাদিনমান গান শোনাবে। মন জুড়াবে। সুরনদীর কূল ডুবেছে সুধা নির্ঝর ঝরা। রবীন্দ্রনাথ।
–স্যার, এই যে দেখুন ১০০ ফিটের বেড়ীবাঁধ। সকালে বিকালে হাঁটবেন। বাতাস খাবেন।
–স্যার, দেখেন আপনার প্লট ঘিরে গাছপালা। পাখিদের কুজন। ডাকে পাখি খোলো আঁখি, দেখো সোনালি আকাশ। মিতালী মুখার্জী। চলুন স্যার একদিন দেখে আসি।
ছেলেটার কর্মকাণ্ডে আমি হেসে ফেলি।
লুবনা ম্যাডাম একবার কী এক দরকারে সিঙ্গাপুরে গেল কোম্পানির চেয়ারম্যানের সঙ্গে, ভাবলাম— যাই, দেখে আসি, পছন্দ হলে কেনার কথা ভাবব।
প্রজেক্টের নাম…। প্রজেক্টের নাম বলাটা ঠিক হবে না। সেখানে গিয়ে আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল, জানেন। প্রজেক্টটা যে নয়নাভিরাম, সে-কথাই বলছি না শুধু, আমি তো আর স্বর্গোদ্যান দেখিনি, আমার মনে হল স্বর্গোদ্যান বুঝি এমনই হয়। তবে মাথা ঝিমঝিমানির ব্যাপারটা অন্য কারণে। দেখি, আমারই প্লটের পাশে রহমান সাহেবের ডুপ্লেক্স বাড়ি। বারান্দায় দোল চেয়ারে দুলছেন তিনি। আমাকে দেখে হাত নাড়লেন।
আশ্চর্য হয়ে গেলাম।
তার পাশের সুন্দর বাড়িটা আলম সাহেবের। তার পাশেরটা এমরান সাহেবের। উনাকে দেখলাম ছাদে হাঁটাহাঁটি করছেন। আরে অইটা কে— জেসমিন আপা ! উনি এখানে কী করছেন?
জুলফিকার সাহেব একগাল হেসে বললেন— উনি তো সবার আগে এই প্রজেক্টে এসেছেন।
অবাক থেকে অবাক হচ্ছি; এদের সবার প্লট বাড়ি আছে এখানে!
আমিও কিনব— বলে আমার প্লটের কাছে এসেই থমকে দাঁড়ালাম। দেখি— প্লটের পাশেই একটা কবর বা কবরের মতই।
ছেলেটি বলল— কবরই।
কাছে গিয়ে দেখতেই আমার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। কবরের গায়ে লুবনার নাম লেখা। ছেলেটার দিকে তাকালাম। সে কিছু বলল না, শুধু হাত ইশারায় দেখাল। দেখলাম প্রত্যেক প্লটের সঙ্গে একটি করে কবর।
মানুষ
মানুষটির ছোটবেলার চিন্তা ছিল সারাজীবনে সাড়ে তিনহাত জমি কিনে শেষ জীবনে শুয়ে পড়া। তিনি জমি কিনলেন তবে শুয়ে পড়লেন না, বরং তার কোমর সোজা হল। মেরুদণ্ড শক্ত হল। আর মাথার ভেতরে এমন এক মৌমাছির জন্ম হল যে মধু নয় জমি সংগ্রহে ব্যতিব্যস্ত থাকল। ফলে মানুষটি জমি ক্রয় করলেন ভিটের ডানে বামে। পুবে পশ্চিমে।
তার নেশা বেড়ে গেল।
জমিজমাগুলিও যেন তার হাতে চলে আসার জন্য আবদার শুরু করল মালিকদের কাছে। মালিক মানে গরীব চাষাভুষা জেলে। মানুষেরা দলে দলে দলিল নিয়ে এসে তার লোক বনে গেল। যারা দিল না, তারা ভয় খেল, চোয়াল ফেটে রক্ত বেরুল। নিজ দায়িত্বে মৌমাছিটি বেরিয়ে এসে হূল ফুটিয়ে গেল; তারপর দিল।
আশেপাশের সব জমির মালিকরা জমির বর্গাচাষি হয়ে গেল। নিজের গ্রামের পর দখল হতে থাকল পাশের গ্রাম। যত কান্দি আছে, যত পুর আছে, হাট আর তলী আছে — সবকিছু একে একে তার হয়ে গেল।
জমি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ছেলে হল, মেয়ে হল। ছেলের আবার ছেলে হল; মেয়ের আবার মেয়ে হল। যে মেয়ে হল তারা বড় হল, যে ছেলে হল তারা বড় হল। বড় হওয়া সেইসব অনেক ছেলে আর অনেক মেয়েদের অনেক অনেক ছেলে মেয়ে হলে নিজ গ্রাম হতে পাশের গ্রাম হয়ে অন্যান্য গ্রামে বসবাস শুরু করল। আর এইভাবেই নাতি পুতি খুতি সুতি লুতি গুতি মুতি-রা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল যত পুর-কান্দি-হাট-তলী আছে সবখানে, সব জায়গায়।
এই গ্রাম সেই গ্রাম হয়ে এখন তার উত্তরাধিকার ছাড়া আর কেউ নেই। অন্য কোনও মানুষ রইল না। জমি দখল কিংবা কেনার মত আর কোনও জমি রইল না।
সামনেই শহর।
শহর তার বাহু যেন প্রসারিত করে ডাকছে। শহর আর গ্রামের মধ্যেখানে নদীর ঢেউ তার কাছে সেই বার্তা নিয়ে আসে। শহুরে বাতাসে জমির গন্ধ। কংক্রিট গন্ধে তার নাকে জ্বালা ধরে।
একটি বুড়ো বটগাছের নিচে বসে বসে শহরের বাড়ানো বাহুর দিকে তাকিয়ে থাকেন। আর অই বাড়ানো বাহুর ভেতর থেকে যেন কেউ বেরিয়ে এল, সহসা। কে?
মাথা বেয়ে তার নেমে গেছ জট। চোখের কোটরে বেঁধেছে পাখির বাসা। নাঙ্গা আদুল গায়ে শতাব্দীর ধুলো।
বসলেন পাশেই। বটের ছায়ায়। নরম গলায় বললেন — আর কত চৌদ্দগোষ্ঠীপতি? শতাব্দী কেটে গেছে। দেখো চেয়ে সব তোমারই জমি। তোমারই বংশ।
মানুষটি চারপাশে তাকাল। পুব পশ্চিমে তার বংশ। উত্তর দক্ষিণে তার বংশ।
–ফিরে যাও নিজের ঘরে।
এই প্রথম মানুষটি নিস্তব্ধ হয়ে গেল। ফিরে যেতে চায়, যায়ও।
একটি দরজায় গিয়ে নক করে। বলে — আমি কি এই ঘরের মানুষ?
দরজা খুলে অল্পবয়সী একটি মেয়ে অবাক হয়ে মানুষটির দিকে তাকিয়ে থাকল।
অন্য আরেকটি বাড়ির দরজায় — আমি কি এই বাড়ির কেউ?
না, এরাও তাকে চেনে না।
মানুষটি পাগলের মত পেছন দিকে ছুটতে থাকে, যেখান থেকে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। এক শতাব্দীর পথ ধরে মানুষটি দরজায় দরজায় নক করতে থাকে। ব্যাকুলভাবে বলতে থাকে —
আমি কি এই ঘরের কেউ?
আমি কি এই ঘরের কেউ?
আমি কি এই ঘরের কেউ?
মাথার ভেতর তখন চাক ভেঙে একটি মৌমাছি বেরিয়ে গেল ফুড়ুৎ করে।
খুনে গল্প
বৈশাখের সকালে জেগে উঠেই আমি মারা গিয়েছিলাম। মারা গিয়েছিলাম নাকি খুন হয়েছিলাম? নাকি এখনও মরিইনি — জানি না। যদি মারা গিয়ে থাকি তাহলে তো সব চুকেবুকে গেল। আর যদি খুন হয়ে থাকি তবে শুনতে আশ্চর্য লাগবে — আমাকে খুন করেছে আমার নিজ কন্যাই। যখন তার বয়স তিন। সেই ঘটনাই বলি—
একবার একরাতে মাথায় ভূত চেপেছিল। নিজেই নিজের ছবি আঁকতে বসলাম। স্কেচ। শার্পনার দিয়ে পেন্সিল চোখা করে আঁকাতে মনোযোগ দিতেই কিছুটা অবাক হতে হল। কীভাবে কীভাবে যেন আঁকাঝোঁকার ব্যাপারে আমার ভেতরে একটা জ্ঞান জেগে উঠল। যেমন—
মুখের অবয়ব আঁকতে গিয়ে কতখানি মাপ নিতে হবে, কতখানি অ্যাঙ্গেলে কান থেকে অন্য কান, চিবুক থেকে কপাল বা নাক-ভ্রু-ঠোঁট কিংবা চোখের মাপের মধ্যে যে মুন্সিয়ানা দেখানোর প্রয়োজন ছিল — আমি ঠিক ঠিক পারলাম বলে নিজেই নিজেকে বাহবা দিলাম।
আঁকতে আঁকতে রাত হয়ে গিয়েছিল। ঘুমিয়ে গেলাম তাড়াতাড়ি। বাকিটা পরে আঁকব। কিন্তু —
সকাল সকাল বারান্দায় কিচিরমিচির করে দুটি চড়ুই। কিছু দানাপানি দেওয়াটা প্রতিদিনের কাজ। আজ খুব আলস্য লাগছে, উঠতেই ইচ্ছে করছে না। আর ইচ্ছে না করার ব্যাপারটা তারা জেনে ফেলেছে কিনা জানি না, তবে যা ঘটল তাজ্জব হয়ে গেলাম। তারা নাচতে নাচতে ঘরে ঢুকে গেল। চড়ুইপাখির শরীর জুড়ে সকালবেলার রেণু, পুঁতির চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তারা ঠিকই খুঁজে নিল আমাকে। খাটের ওপর ফুড়ুত করে ডানা ঝাপটে আমার ঠিক কপালের ওপর বসতেই আমি বুঝতে পারি — ওরা আসলে কী করতে চাচ্ছে!
গা শিউরে উঠল।
তাড়াতে গিয়ে বুঝতে পারি কোথাও একটা গণ্ডগোল হয়ে গেছে। আমি নড়তে পারছি না। আমার হাত পা একদমই নড়ছে না। আমি মরিয়া হয়ে হাত পা নাড়াতে চাইছি — কাজ হচ্ছে না।
এদিকে আমার কপালে চড়ুইপাখি উদ্যত। চোখ উল্টে ভয়াবহ দৃশ্য দেখতে পেলাম। চড়ুই কই? চড়ুই পাখির কি এত বড় চঞ্চু থাকে! এত তীক্ষ্ম, ধারালো!
বালিশ থেকে মাথা তুলতে চেষ্টা করলাম, সামান্যই পারলাম। পায়ের দিকে তাকিয়ে আমি আঁতকে উঠলাম।
আমার পা কোথায়? আমার দুই হাত কোথায়?
পুরো খাট জুড়ে হাতহীন পাহীন আমি পড়ে আছি। মাথা আর বুকটাই সম্বল।
আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম।
হুসস হুসস…
মুখ দিয়ে চড়ুইপাখি তাড়াতে চাই। চড়ুইপাখি নড়ে না। চড়ুই কই এ যে দেখছি — বিশাল কোন পাখি। অনেকটা চিলের মত। শকুন নয়ত!
হুসস হুসস…
এই সময়ে আমার মেয়ে একটা খাতা নিয়ে ঢুকে বলল — বাবা দেখো, একটা ছবি।
গতরাতের আঁকা আমার ছবি। আবক্ষ। ছবিতে হাত নাই পা নাই। আঁকতে পারিনি।
—বাবা ছবিটা পচা। তুমি আঁকতে পারো নাই। মুছে ফেলি?
বলেই রাবার দিয়ে মুছতে শুরু করতেই আমি চিৎকার করে উঠি — না না না।
মেয়ে হকচকিয়ে আমার দিকে তকিয়ে থাকে।
বলি — মা রে! ছবি মুছলে আমিও মুছে যাব। তুই আমার হাত আঁক। পা আঁক।
মেয়ে বলে — আমি তো ছোট। আঁকতে পারি না। মুছতে পারি। তোমার কানটা ভাল হয় নাই। বড় হয়েছে। একটা কান মুছে দেই।
—না না না।
আমি অনুভব করলাম আমার একটা কান অদৃশ্য হয়ে গেল।
—দেখো তোমার ডান চোখটাও ভাল আঁকা হয় নাই। মুছে দেই?
—না না না…
কপালের ওপর চড়ুই/ চিল/ শকুন পাখিটা চঞ্চু বাড়িয়ে দিল।
ঠোকর দেয়ার আগে মেয়ের মুখটা আরেকবার দেখি। কচিহাতে অবলীলায় আমাকে মুছে দিচ্ছে। আমি মুছে গেলাম। অদৃশ্য মানুষ হয়ে সেই থেকে ঘুরিফিরি। কবে আমার কন্যা আমার একটি ছবি এঁকে ফিরিয়ে আনবে সেই আশায়।
আমি শুধু বাতাসে তারে ডাকি — মা, মা রে!
ভিন্ন স্বাদের তিনটি চমৎকার অণুগল্পের জন্য লেখককে অভিনন্দন! আপনার আরো লেখা পড়বার আগ্রহ থাকলো। শুভকামনা।