হিন্দোল ভট্টাচার্য
পূর্ব প্রকাশিতের পর
যে সব লেখক বা কবিরা ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে লেখার জীবনকে আলাদা রাখতে পারেন, তাঁরা নমস্য। কারণ তাঁরা পারেন সবকিছুকে ব্যালেন্স করে চলতে। এই ভারসাম্য বজায় রেখে চলাটাও খুব দরকার। কিন্তু আমি তা পারি না। জীবনানন্দ কথিত মুদ্রাদোষ-ই বলা হোক অথবা নক্ষত্রদোষ, ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবন আমার সম্পূর্ণই ধ্বংসপ্রাপ্ত। এর জন্য যে প্রবল বিষাদ আমাকে ঘিরে ধরে না, তা নয়। পাশাপাশি বুঝতে পারি, জীবন মানে এক বিরাট অসঙ্গতি। জীবন বলতে আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যা ভেবে নিই, তা জীবন নয়। আমাদের ভেবে নেওয়া বাস্তবটাকে আমরা বাস্তব হিসেবে ভাবতে পারলে বর্তে যাই। কারণ অনিশ্চয়তা আমাদের অস্থির করে দেয়। কোথাও না কোথাও একটা নিশ্চয়তার দিকে আমাদের যেতেই হবে। তা, সে পরিবার হোক বা অর্থানুকূল্য বা সামাজিক খ্যাতি। কিন্তু ভালো করে ভাবলে, এ সবকিছুই অর্থহীন। কারণ মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সব লুপ্ত হয়ে যায়। তবে, আমরা কীসের জন্য দৌড়ই? উদ্ভিদ, প্রাণী সকলের ক্ষেত্রেই নিজেদের সন্তানের প্রতি মায়ের একটা অপত্য স্নেহ কাজ করে। সেই মা, তার সন্তানকে আগলে রাখতে চায়। সে কি নিজে জানে না, তার পক্ষেও সম্ভব নয় মৃত্যু নামক ভয়ানক সত্যের হাত থেকে আগলে রাখা? কিন্তু এই চাওয়াটা অনেক ক্ষেত্রেই রিফ্লেক্স অ্যাকশনের মতো কাজ করে। প্রশ্ন উঠতে পারে, তবে যদি কিছুই না চাইব, সংসার, বাচ্চা, পরবর্তী প্রজন্ম, প্রজন্মের হাতে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার কিছু স্থাবর-অস্থাবর স্মৃতি— তবে তো সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে যাওয়াই সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু এই সঙ্গতির কাজটি তো করছি না কেউ। বরং আবার পাগলের মতো লেখার জগতের মধ্যে ঝাঁপ দিচ্ছি। এটা দেখেও যে এক তীব্র অসঙ্গতি আছে আমাদের এই লেখার জগতে। কোনও প্রকাশক কি একবারের জন্যেও ভাবেন লেখক কীভাবে জীবনধারণ করবেন? না কি তাঁরা জানেন যে লেখক পয়সাওলা মানুষ, বা একটা সুস্থ চাকরি করে বাকি সময়টা তিনি লিখছেন অথবা, জীবনধারণের জন্য লড়াইটা তাঁর ব্যক্তিগত। আমরা বই প্রকাশ করছি এবং তা যথেষ্ট। কীভাবে তিনি বাঁচবেন, তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাব কেন? বই থেকে পয়সা দেওয়ার কোনও চুক্তি বেশিরভাগ প্রকাশক-ই করেন না। বলা যেতে পারে, এটি বাংলায় যাঁরা লেখালেখি করেন এবং যাঁরা প্রকাশ করেন, তাঁদের মধ্যবর্তী এক তীব্র অসঙ্গতি। কিন্তু সেই সব লেখক কী করবেন, যাঁরা নক্ষত্রদোষে শুধু লেখালেখিটাই করেন? যাঁরা পারেননি কোনও সুস্থ পেশা বজায় রাখতে? তবে কি পেশাগত জীবনে সফল হওয়ার রাস্তাটাকেও শিখে জেনে তবে তাকে লেখালেখি করতে হবে? এই সঙ্গতি-অসঙ্গতির মাঝে পড়ে অনেক লেখক আজীবন অসহায় জীবন যাপন করেন। আবার এই কথাগুলি বলতেও পারেন না মুখ ফুটে। তাতে প্রকাশক বলতে পারেন, বই ছাপছি, অনেক। আপনার যদি তাতে না মন ভরে, তবে এমন কিছু লিখুন, যা বাজারে দিলেই কাটবে। ব্যস, শুরু হয় সিরিয়াল সাহিত্য। এই সিরিয়াল-সাহিত্য রচনা করাও কঠিন। কিন্তু একজন লেখককে তা লিখতে হবে দু পয়সা রোজগারের জন্য। কারণ স্কুলের শিক্ষকতা বা কলেজের অধ্যাপনা, কিছুই তার জোটেনি। অনিশ্চয়তার অবসাদের ছায়া পড়ছে তাঁর লেখায়। খুব বেশি তো চাননি তিনি। কিন্তু তাও পাবেন না। ক্রমে তার মনে এই ধারণা আসে, সব ভারসাম্য বজায় রেখে কি লেখালেখি বা শিল্পের কাজ করা যায় আদতে? এত ভারসাম্য বজায় রাখা মন যদি তাঁর হত, তবে কি তিনি আদৌ লেখালেখিতে আসতেন? এত গৃহস্থ কি তিনি আদৌ? তবে কি তিনি এই জগতের কাছে একজন অতিরিক্ত মানুষ? কারও প্রতি রাগ হয় না তাঁর। বরং সমস্ত শব্দের প্রতি অবিশ্বাস তৈরি হয়। একজন সফল পেশাজীবী এবং একজন সফল লেখক হওয়ার মতো দুঃসাধ্য কাজ একসঙ্গে করতে তিনি ব্যর্থ। তাই তিনি অতিরিক্ত হয়ে পড়েন। নিজের কাছেও।
কিন্তু এটিও একধরনের বাহ্যিক সঙ্কট, যদি একবার সেই ব্যক্তি লেখক অনুভব করেন লেখা মানে জীবন এবং মৃত্যুর মধ্যে এক অমীমাংসিত হাইফেনে তিনি আটকা পড়ে গেছেন। এক একটি লেখা হল তাঁর এক একটি দান, এবং তা মৃত্যুর প্রতি। যেন তিনি মৃত্যুর দিকেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ছেন। সময়ের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ছেন। কিন্তু আবার এই চ্যালেঞ্জ ছোঁড়াটাই তাঁর লেখার মূল বিষয় নয়। এটা এমন একটা যুদ্ধ যা অর্থনৈতিক কষ্টের যে জীবন, তার পাশাপাশিই চলতে থাকে। জীবনানন্দ প্রবল অর্থনৈতিক কষ্টের মধ্যেও লিখে গেছিলেন তাঁর উপন্যাস, গল্প, কবিতাগুলি। অর্থনৈতিক কষ্টের মধ্যে থেকে বারবার বিভিন্ন মানুষকে চিঠি লিখেছেন একটা চাকরির জন্য। কিছুই পাননি। শেষজীবনে হুমায়ুন কবীরের কাছে অনন্যোপায় হয়ে চিঠিও লিখেছেন। সাড়াও পাননি। কিন্তু তাতে কি দমে গিয়ে লেখা ছেড়ে দিয়েছেন? এখানেই হচ্ছে চূড়ান্ত অসঙ্গতি। কিন্তু এই অসঙ্গতির চরিত্র একটু ভিন্ন। আর তা হল, লেখক যে মৃত্যুর সঙ্গে দাবা খেলছেন বলে লিখছেন। তাঁর তো লেখা ছাড়া আর কিছু করার নেই। আর কোনও, যাকে বলে, উইপন নেই। আর কোনও মাধ্যম নেই নিজের অবসাদকে ব্যক্ত করারও। লেখা ছাড়া একমাত্র আত্মহত্যাই তাঁর কাছে হয়ত শেষ আশ্রয়। তবে কি একজন লেখক যখন আত্মহত্যা করেন, তাও একপ্রকার লেখা হয়ে ওঠে?
এই অসঙ্গতির আমি কোনও উত্তরের কথা জানি না। কারণ যাকে অসঙ্গতি বলে ভাবছি, তা হয়ত আদতে চূড়ান্ত সঙ্গতি। কারণ আত্মহত্যা যদি একটি অমোঘ কবিতা হয়ে ওঠে সেই কবির কাছে বা আত্মহত্যা যদি একটি নির্মেদ, অবধারিত লেখা হয়ে ওঠে সেই লেখকের কাছে, তবে তো জীবনের সেই শেষ লেখাটির কাছে তিনি চিরকৃতজ্ঞ এবং ভয়ঙ্করভাবে সৎ। এক্ষেত্রে মনে পড়ে যাচ্ছে ভার্জিনিয়া উলফের সেই চিঠির কথা। কিংবা, জীবনানন্দের সব কবিতাই কি আত্মহত্যার আগের জবানবন্দি নয়? একদিকে বাহ্যিক সামাজিক পারিবারিক জীবনের টানাপোড়েন আর অন্যদিকে নিজের মনোজগতের, আধ্যাত্মিক জীবনের সঙ্কট। সেই সঙ্কটের বিপন্ন বিস্ময়। একজন লেখক আসলে কোথায় থাকেন ঠিক? পুরো বিষয়টাই এখানে এসে খুব অসঙ্গতিপূর্ণ হয়ে ওঠে। অর্থহীন মনে হয়। এই কি তবে সেই চিরকালীন শূন্যতা, যার কথা বলেছিলেন স্বয়ং বুদ্ধদেব? তবে কি আমাদের সেই চরম নীরবতার মধ্যে নিজেদের সঁপে দিতে হবে? তবে কি আমাদের ভুলে যেতে হবে সব? তবে কি একজন লেখককে হয়ে উঠতে হবে একজন নিশ্চেষ্ট মানুষ? তিনি কি ক্রমশই এগিয়ে যাবেন ইচ্ছামৃত্যুর দিকে? অথবা ইচ্ছামৃত্যুর ঠিক আগের পর্যায়ে এসে তিনি শুনবেন সেই পাখির স্বর, সেই বাতাসের মধ্যে দিয়ে গোপন বাতাসের ভেসে যাওয়ার শব্দ, যা কোনও মাসমাইনে দিয়ে কিনতে পারবেন না কেউ। এই যে জীবন, তাঁকে তিনি ধীরেধীরে নমস্কার করবেন আর ধন্যবাদ দেবেন প্রকৃতিকে?
কিন্তু একাকী এই উদযাপন এবং একাকী এই নীরবতার কোনও দোসর নেই লেখকের। কখনও ছিল না।
(ক্রমশ)