তৃষ্ণা বসাক
‘আমার জীবনে অদ্ভুত একটা ব্যাপার আছে। বরাবরই দেখে আসছি, তাদের সঙ্গেই আমি জড়িয়ে পড়ি, যাদের জীবনে অনেক কিছু করার ছিল, কিন্তু কিছু হয়নি।’
‘আপনি কি আমার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন?’
‘আর কী-ই বা বলা যায় একে? একদিন তুমি না এলে সারাদিন কী যে অস্থির অস্থির লাগে। এই তো কালই তুমি আসোনি, সারাদিন কোনও কাজ করতে পারলাম না। শুয়ে শুয়ে ভাবলাম তোমার কথা। তুমি কিন্তু এখনও বললে না, কাল তোমার কী হয়েছিল..’
কোনও জবাব না দিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় অপরাজিতা। পাঁচতলার এই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে সন্ধে হওয়া দেখা কেমন অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে তার। ঠিক সতের দিনের অভ্যেস। আর চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই কাজটা শেষ হয়ে যাবে। তারপর হয়তো আর একদিন আসবে অপরাজিতা। কমপ্লিমেন্টারি কপিটা ওঁর হাতে তুলে দিতে। তারপরে আর এক দিনও আসবে না সে, এক দিনও না।
‘কই বললে না তো, কাল কেন আসোনি?’ ঘর থেকে আবার প্রশ্নটা ছোঁড়েন ঋজিপ্রসাদ।
‘কী হবে জেনে?’
উত্তরে চুপ করে থাকেন ঋজি। অপরাজিতা উঁকি মেরে দেখে গম্ভীর মুখে উনি কাগজে আঁকিবুঁকি কাটছেন।
অভিমান! অপরাজিতা সকৌতূকে বলে ‘এখানে আসুন না, বাইরে কী সুন্দর সন্ধে হচ্ছে।’
একবার মুখ তুলে আবার নামিয়ে নেন ঋজি। ওঁর বিষণ্ণ দৃষ্টি অপরাধে ফেলে অপরাজিতাকে। সে সামলে দেবার জন্যে বলে, ‘ইচ্ছে করলেই আপনি আসতে পারেন এটুকু। আচ্ছা, হুইলচেয়ারটা এনে দেব? ওই তো পাশের ঘরে আছে।’
‘না’। আর্তনাদ নয়, আদেশের সুর স্পষ্ট এই নিষেধে। অপরাজিতা আবার মুখ ফেরায়। কেওড়াতলা মহাশ্মশানের স্মৃতিমন্দিরগুলোর ওপর দিয়ে একঝাঁক বক উড়ে যাচ্ছে ডানা ঝটপট করে।
‘তোমার আজকের মতো কাজ শেষ?’
এবার ঘরে আসে অপরাজিতা। পেছন পেছন সন্ধের হাওয়া।
‘কাজ কখনও শেষ হয়, যে কাজের সাব্জেক্ট স্বয়ং আপনি?’
‘বাব্বা! ভালোই ফ্ল্যাটারি করতে পারো তো!’
হেসে ফেলেন ঋজিপ্রসাদ, প্রসন্নতার ঢেউ এসে ভেঙে দেয় অভিমানের ছোট ছোট বালুদুর্গগুলো। অপরাজিতা ওর শিয়রে এসে দাঁড়ায়। শোয়া অবস্থাতেও আন্দাজ করা যায় ওর দীর্ঘ ঋজু শরীরের কাঠামো। ঠিক শুয়ে নয়, পিঠে দু-তিনটে বালিশ নিয়ে আধশোয়া হয়ে আছেন। কোলে ছোটদের যেমন ক্লিপবোর্ড থাকে, তেমনই একটা। কয়েকটা সাদা কাগজ তাতে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট স্কেচ করেন ইচ্ছে হলে। বেশিরভাগ সময়ই অবশ্য ইচ্ছে হয় না। অপরাজিতা রোজই বলে যায় কিছু আঁকার জন্যে। পরের দিন এসে দেখে সাদা পাতা। রাগ করলে ঋজিপ্রসাদ বলেন ‘তুমি না থাকলে কিছুই ঘটে না, কোথাও না। না আমার জীবনে, না কাগজে। তুমি চলে যাবার পর থেকে আবার পরের দিন আসা পর্যন্ত সব পাতাই সাদা, কোথাও একটা পেন্সিলের আঁচড় নেই…’
‘ইস! ছ-সাত ঘণ্টা হতে চলল আমি এসেছি, কিছু এঁকেছেন আপনি?’
‘এখন এক মুহূর্তও নষ্ট করা যায়? ছবি আঁকতে বসলে তোমায় আর দেখতে পাব না। তুমি চোখের সামনে ঘুরছ, ফিরছ, ব্যালকনিতে দাঁড়ালে, আবার নৃত্যপরা পায়ে ঘরে এলে, আমার মাথার খুব কাছে তোমার বুকের উষ্ণতা টের পাচ্ছি, এখন এক সেকেন্ডের জন্যেও আমাকে চোখ সরাতে বোলো না প্লিজ।’
‘কী অসভ্য লোক রে বাবা!’ অপরাজিতা চট করে ওর মাথার কাছ সরে এসে কাজের চেয়ারে বসে। ওর শরীর শিরশির করে। দীপাঞ্জন ওকে একবার বলেছিল, ‘তুমি খুব ভালনারেবল রিনি। তুমি এত সহজ, এত আন্তরিক, ছেলেরা তোমাকে সুলভ ভেবে বসতে পারে।’
দীপ জানে ওর এই কাজটার কথা। ঋজিপ্রসাদের প্রমত্ত যৌবন, বহু নারী সংসর্গের রোচক ইতিহাস— অজানা নয় ওর। আর অপরাজিতা? তাকেও তো আদ্যোপান্ত চেনে দীপ। ও যে কখন কী করে বসবে, তা কেউ জানে না। ওর সহজ, স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবহার পুরুষের চোখে নেশা ধরায়— এখানেই তার অমোঘ যৌনতা, তার ভালনারেবিলিটি, এসবই বহুবার বহুভাবে তাকে জানিয়েছে দীপ। তবু, তবু সে আশ্চর্য শান্ত, নিশ্চিন্ত হয়ে আছে এই কদিন। ‘ঘর-বাহার’ হিন্দি বলয়ের খুব জনপ্রিয় পত্রিকা। প্রচুর সার্কুলেশন এদের। কয়েকমাস হল এটা বাংলাতেও বেরোচ্ছে, মূলত নারীকেন্দ্রিক পত্রিকা হলেও, আর পাঁচটা পাঁচমেশেলি পত্রিকায় যা যা বিভাগ থাকে, এখানে সবই আছে, কিছুদিন আগেই সম্পাদক ওকে ঋজিপ্রসাদের একটা ইন্টারভিউ করতে দেন। ওঁর শারীরিক অবস্থা এমন, যে কোনও দিনই চলে যেতে পারেন। তাই কাজটা তাড়াতাড়ি করার তাগিদ ছিল। কিন্তু করতে গিয়ে দেখল, একটা সংখ্যাতে এত বড় জীবনকে ধরানো যাচ্ছে না। উনি তো শুধু রং-তুলির শিল্পী নন, জীবনেরও। কোমর থেকে নিচের অংশ অবশ। হাত কাঁপে, হুইলচেয়ারে ওঁর সমগ্র পৃথিবী। এই অবস্থায় ওঁর দীর্ঘদিনের সহবাসিনী ছেড়ে চলে গেছেন ওঁরই এক তরুণ ছাত্রের সঙ্গে। তবু কি আশ্চর্য ব্যাপ্তি ওঁর চিন্তার, কী উজ্জ্বল ওঁর চোখদুটো! অপরাজিতা সম্পাদককে প্রস্তাব দিল একটা ধারাবাহিক জীবন-ভাষ্য লিখবে সে, নিভে যাওয়ার আগে যতটা সম্ভব ধরে রাখবে নক্ষত্রের জ্যোতিপুঞ্জ। সতের দিন ধরে প্রতিদিন টানা সাত-আট ঘণ্টা ওঁর সঙ্গে কাটাচ্ছে সে। বাড়ি গিয়েও একটা ঘোরের মধ্যে কেটে যাচ্ছে। এর মধ্যে দীপের সঙ্গে দেখা হয়েছে মাত্র দু-দিন। ফোনেও সামান্য কথা হয়। কী করে চুপ করে আছে দীপ? ওর একটুও ভয় নেই অপরাজিতাকে নিয়ে? ঋজিপ্রসাদের মুগ্ধতা তো গোপন করেনি সে। প্রথম দিনের আলাপেই ঋজি বলেছিলেন ‘বাঃ, এ মেয়েটার শরীরে তো বেশ আলো-বাতাস খেলে!’
শুধু চোখের ভাষা আর কথা দিয়ে যে একটা লোক এত অস্বস্তিতে ফেলতে পারে, ধারণা ছিল না অপরাজিতার। ঋজির একের পর এক নারীতে অবগাহনের কথা শুনেছে সে। কিন্তু এর মধ্যে একদিনও ওকে ছোঁননি ঋজি। লোকে যেমন বলে, ঋজি কি সত্যি ভেজিটেবেল হয়ে গেছেন? নাকি, এ তার একটি কৌশল? কথা আর কথার বুননে এমন জাল রচনা করবেন, অপরাজিতা নিজেই এসে ধরা দেবে সেই জালে। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন না— ‘মাকড়সা যুদ্ধ করে না, জাল পাতে।’ কিন্তু এ তো যুদ্ধই। ঋজি আর তার মধ্যে রুদ্ধশ্বাস দ্বৈরথ চলছে। নিজের বুকে কান পাতলেই সে সেই যুদ্ধের দ্রাদিম দ্রাদিম শোনে। যত ওর কাজ শেষ হয়ে আসছে, উত্তেজনায় ওর স্নায়ু অবসন্ন হয়ে পড়ছে। সত্যিই আর তিন চারদিনের মধ্যে সব শেষ হয়ে যাবে? সব বলতে ঠিক কী তা ওর নিজের কাছে খুব স্পষ্ট। শুধু আস-যাওয়ায় একটা সম্পর্ক তৈরি হয়? মাত্র সতের দিন যার আয়ু। আসলে তো কিছু নয়। ওই মাকড়সার জালের মতোই ভঙ্গুর একটা মোহ ঋজি তাঁর কথা দিয়েই বিস্তার করে চলেছেন, এমন খেলা তিনি কত খেলেছেন সারাজীবন। মানুষটির বয়স সাতষট্টি, শিল্পীর বয়স পঞ্চাশ। সতের বছর বয়সে ওঁর শিল্পী হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ, তার নেপথ্যে একটি ঝোড়ো প্রেমকাহিনী। বয়সে আট বছরের বড় পিসতুতো বউদির সঙ্গে। তারপর সারাজীবন ক্যানভাস বদলের মতো বদলে গেছেন নারী। কোনওটাতেই থিতু হতে পারেননি। দুবার বিয়ে করেছেন, তিন বছরের বেশি টেঁকেনি কোনটাই। কেউ থাকতে আসেনি, ধরেও রাখতে চাননি কাউকে। বিচ্ছেদ, বিরহ সব ধরে রেখেছে ক্যানভাস। ঋজি নিজে থেকেছেন নির্ভার। শুধু শেষের সম্পর্কটা… বোধহয় এই প্রথম জড়িয়ে পড়েছিলেন ঋজি। যতই শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিলেন, ততই নির্ভর করতে শুরু করছিলেন সেই মানুষটির ওপর। নাম বলেননি কখন, তবু সে জানে নামটা। কে না জানে এ নামটা? তনুকা। বয়সে সে অপরাজিতার থেকে খানিকটা বড়। তিরিশ একত্রিশ হবে। তনুকা এখন আছে স্বর্ণেন্দু মাইতির সঙ্গে। স্বর্ণেন্দু ঋজির প্রিয়তম শিষ্য। তনুকার চলে যাওয়া, না, স্বর্ণেন্দুর সঙ্গে তার চলে যাওয়া— কোনটা তাকে বেশি আহত করেছিল কে জানে? ঋজি আগেই শর্ত রেখেছিলেন, জীবনের এই এপিসোডটা নিয়ে কোনও প্রশ্ন চলবে না। এখনও পর্যন্ত তা মেনে এসেছে অপরাজিতা। কিন্তু মাঝে মাঝেই লোভ হচ্ছে লক্ষ্মণরেখা পেরোনোর। ঋজিও কি তাকে যথেষ্ট প্রশ্রয় দিচ্ছেন না?
‘বলো তুমি, কখন আঁকব আমি?’
কৌতুক নাচে ঋজির চোখে। ম্লান হাসে অপরাজিতা।
‘আপনার অবস্থা দেখছি সেই ফাঁকিবাজ মেয়েটার মতো। খেলেই ভীষণ ঘুম পায় তার। আবার ঘুম থেকে উঠলেই ভীষণ খিদে পেয়ে যায়। বেচারা পড়বে কখন?’
হা হা করে হাসেন ঋজি। তাঁর হাসির শব্দে সন্ধে যেন ঢুকতে গিয়েও থমকে দাঁড়ায় পর্দার ওপারে।
‘বাসন্তীকে ডেকে দেবে একটু?’ সকালের শিফটে বাসন্তী, রাতের শিফটে সর্বাণী। অপরাজিতা চেষ্টা করে বাসন্তীর আগেই বেরিয়ে যেতে। বেশিরভাগই আটকে দেন ঋজি। আজ সে শুনবে না। আজ ফর্টিন্থ ফেব। দীপকে বলেছে আনন্দমেলার সামনে দাঁড়াতে।
বাসন্তীকে ডেকে দিয়ে পাশের ঘরে যায় অপরাজিতা। এ ঘরে অনেক বার এসেছে সে। ঋজির টয়লেটের সময় তাকে এই ঘরে কাটাতে হয়। এটাই সম্ভবত ঋজির মাস্টার বেডরুম। অসুখের পর থেকে তিনি ওই ঘরে থাকেন। ছয় বাই সাত কারুকাজ করা কাঠের খাটে সাদা কালো ইক্কতের বেডকভার। বেডসাইড টেবল, দেরাজ, আয়না যথাযথ সাজানো। কিন্তু এত নৈর্বক্তিক, কোনও ফোটোগ্রাফ নেই, এমন কোনও চিহ্ন নেই, যা বলে দেবে কিছুদিন আগেই এই ঘরে বাস করে গেছে কোনও নারী। এক দিন, দু-দিন নয়, সাত-সাতটা বছর। কেমন শিউরে ওঠে অপরাজিতা। তনুকা যখন ঋজির সঙ্গে থাকতে শুরু করে, তখন তারই মতো বয়স তার, তেইশ।
ফ্লাশের শব্দ কানে আসে। একটু পরেই ঋজি ডাকেন ‘এসো’। অপরাজিতা তবু বসেই থাকে সেই শূন্য বিছানায়।
‘কী হল এসো…’
সারা ঘরে কড়া রুম ফ্রেশনারের গন্ধ। গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে অপরাজিতার। সে চুপচাপ নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিতে থাকে।
‘কী হল? এখনই যাচ্ছে নাকি?’
‘যাব না? কটা বাজে দেখেছেন?’ একটু কি অসহিষ্ণু শোনায় তার গলা?
চুপ করে যান ঋজি। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরোবার জন্যে তৈরি অপরাজিতা। ঋজির মুখ দেখে অপরাধী মনে হয় নিজেকে। ঋজিপ্রসাদের মতো কিংবদন্তী শিল্পী তাকে যে এতদিন ধরে সময় দিচ্ছেন, এটা তার মস্ত সৌভাগ্য। ওঁর আর কী পাওয়ার আছে? স্টোরিটা বেরোলে ম্যাগাজিনের সার্কুলেশন বাড়বে, অপরাজিতার কাজ প্রশংসা পাবে। গরজটা তো ওরই। ও নিচু হয়ে ঋজির হাত ছোঁয়।
‘প্লিজ রাগ করবেন না। আমাকে কতখানি পথ ফিরতে হবে ভাবুন’… অপরাজিতাকে হতচকিত করে এক ঝটকায় কাছে টানেন ঋজি। তুলি ধরতে গেলে যে হাত কাঁপে, তার জোর দেখে স্তম্ভিত হয় অপরাজিতা। মুখে যাই বলুন, এতদিন একটা সীমার মধ্যে ছিলেন ঋজি। উনি যে এতটা অ্যাগ্রেসিভ হতে পারেন, কল্পনা করেনি সে। সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসে তার। জালে বন্দি মাছির মতো মনে হয় নিজেকে। বাঁ হাতে ওর কোমর জড়িয়ে ধরেছেন ঋজি, ডান হাতের আঙুল ঠোঁট থেকে চিবুক, চিবুক থেকে গলা – আরও অতলে নেমে যেতে চায়।
‘প্লিজ আজ চলে যেও না। সর্বাণী এলে ওকে চলে যেতে বলব, আমাকে ছেড়ে যেও না তুমি!’
একদিকে বাহুর কাঠিন্য অন্যদিকে গলার আকুলতা— দুয়ের ঘূর্ণিতে তলিয়ে যেতে থাকে অপরাজিতা। আজ ফর্টিন্থ ফেব, দীপ দাঁড়িয়ে থাকবে আনন্দমেলার সামনে। সব কুটোর মতো তলিয়ে যেতে থাকে ঘূর্ণিতে পড়ে। ঋজির মুখ ওর খুব কাছে। মিডিয়ার আলো-পড়া সেই মুখ ওর করায়ত্ত আজ। হঠাৎ কড়া রুম ফ্রেশনারের গন্ধ নাকে আসে। মাথার মধ্যে জেগে ওঠে ফ্ল্যাশের শব্দ। এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় সে। ওর ধাক্কায় ঋজি বিছানা থেকে পড়তে পড়তে বেঁচে যান। আর্তনাদ বাজে ওর গলায়। বাসন্তী ছুটে আসে। অপরাজিতার উসকোখুসকো চুল, খসে পড়া ওড়না দেখে নিজের মতো করে বুঝে নেয় কিছু। গজগজ করতে করতে ঠিক করে বসায় ঋজিকে—
‘কেন যে আসে এরা, থাকবে না একটাও। শুধু মানুষটাকে লোভ দেখিয়ে ছিবড়ে করে চলে যাবে।’
হঠাৎ ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠেন ঋজি। সমস্ত শক্তি দিয়ে চড় মারেন বাসন্তীকে। বাসন্তী কঁকিয়ে উঠে বলে ‘পয়সা দিচ্ছেন বলে গায়ে হাত তুলবেন? বিয়ে করা বৌ নই আপনার, ছিনাল মাগিও নই এদের মতো। সেন্টারে গিয়ে রিপোর্ট করব দাদাকে। দেখি কে কাজ করতে আসে।’ দপদপ করে পাশের ঘরে চলে যায় সে।
ঋজি কিন্তু আশ্চর্য শান্ত। হতচকিত অবস্থা আস্তে আস্তে কাটিয়ে ওঠে অপরাজিতা। সে কি পুরো ব্যাপারটার জন্যে ক্ষমা চেয়ে নেবে? আরও যে তিন-চারদিনের কাজ বাকি।
‘সরি, ঋজিদা, আমি বুঝতে পারিনি…’
হাত তুলে থামান তাকে ঋজি।
‘মানে আমি…’
‘তোমার তাড়া আছে বলছিলে না? এসো তুমি এখন।’
ঋজি তাকে চলে যেতে বলছেন! সে ব্যাপারটা হাল্কা করতে চায়।
‘তাড়িয়ে দিচ্ছেন আমাকে? এই তো বলছিলেন থাকতে…’
ওর দিকে সোজা তাকান ঋজি। সেই দৃষ্টিতে বেদনা নেই, বরং অনেক উঁচু থেকে নিচের দিকে তাকালে যেমন লাগে।
‘তোমার আর কত দিন লাগবে?’
‘এই তিন-চার দিন।’
‘কাট ইট শর্ট। কালকেই শেষ করে ফেলো। কিছু বাকি থাকলে কোয়ারিগুলো রেখে যেও, আমি কুরিয়ারে পাঠিয়ে দেব।’
‘আমি রিয়েলি সরি ঋজিদা!’
‘ওঃ কাম অন, তুমি দুপুরে যখন লাঞ্চে গেছিলে একটা ফোন এসেছিল। বিবিসি আমার ওপর একটা ডকুমেন্টারি করতে চায়। ওরা পরশু আসবে। আলোচনা হবে। বুঝতেই পারছ, এর মধ্যে তোমাকে অ্যাকোমডেট করা..’
অপরাজিতার গলায় কী যেন দলা পাকিয়ে ওঠে। সে গিলে নেয় সেটা। বিবিসি শব্দটা তাকে মুহূর্তে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে। ডকুমেন্টারির অনেকটাই তো শ্যুট হবে এইখানে। এই ঘরে। স্ক্রিপ্ট কি রেডি হয়ে গেছে? না, না, ঋজিদা তো বললেন আলোচনা হবে। স্ক্রিপ্টের মালমশলা তো সবই তার কাছে মজুত। শুধু সাজিয়ে ফেলার অপেক্ষা। ইংরেজিটা ভালোই লেখে অপরাজিতা। তাছাড়া ঋজির পুরনো পাড়া, আহিরীটোলা— সেখানেও শ্যুট করা হবে নিশ্চয়ই। ওঁর আড্ডার জায়গা, প্রথম স্টুডিও, চেনা মানুষজন। অপরাজিতা ওদের কলকাতার রাস্তাঘাট গাইড করতে পারে। আরও কত কী করতে পারে! ওঃ। কতদিনের স্বপ্ন ওর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় কাজ করা। হয়তো এটাই সেই সুযোগ, আর কত বড় সুযোগ!
‘ওঃ, এত বড় খবরটা দুপুর থেকে চেপে রেখেছেন! এনিওয়ে, আই মাস্ট কনগ্র্যাচুলেট ইউ!’
নিচু হয়ে চুমু খায় ঋজিকে। গালেই। প্রথম দিনেই সোনার হাঁসের পেট কেটে ফেলা বোকামি। ওর ঈষৎ ভারি বুক ছুঁয়ে যায় ঋজির কাঁধ, বাহু। ঋজি ওর কোমর সস্নেহে জড়িয়ে বলেন— ‘যাবে?’
‘হুঁ কাল তো আসছিই। আচ্ছা ঋজিদা, পরশু আমি থাকতে পারি না, ওরা যখন আসবেন? ইন ফ্যাক্ট স্ক্রিপ্ট নিয়েও আমি হেল্প করতে পারি। আমার কাছে প্রচুর মেটিরিয়াল আছে।’
‘পারোই তো। তুমিই তো খালি যাই যাই করো। আরে, কাজে নামলে অত ঘরমুখো হলে চলে না, বোকা মেয়ে!’
ওর ডান স্তনে আঙ্গুল ছুঁয়ে দেন আলতো করে অমনি। অপরাজিতা বোকার মতো হাসে। তারপর মিষ্টি করে বলে ‘আসি তাহলে?’
‘এসো!’
কাঁধে ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে অপরাজিতা। একবারও পেছনে না ফিরে। লিফটের জন্যে না দাঁড়িয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামে। গেট পেরিয়ে ছোট গলিটা যেন উড়ে পার হয়। আলো-জ্বলা চেতলা ব্রিজের ওপর থেকে অটোয় উঠে বসে ঘোরলাগা মাথায়। রাসবিহারীর সিগন্যাল খেয়ে ফেলে দাঁড়িয়ে থাকে অটোটা। সহযাত্রীরা উত্তপ্ত।
‘বার বার বললাম বাসটার পাশ দিয়ে ঢুকিয়ে দিতে…’
অপরাজিতার এসব কথা কানে যাচ্ছে না। মেপলের পাতাগুলো কি সত্যিই অত লাল? ঝিরিঝিরি তুষারপাতের মধ্যে দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছে একটা মেয়ে। তার অপেক্ষায় শান্ত ফায়ারপ্লেস… একটা গিফট শপের পাশ দিয়ে অটোটা যায়। লাল রঙের বিশাল প্লাস্টিকের হার্ট দিয়ে সাজানো দোকানটা। কী অলীক লাগে।
এহেঃ! আজ তো ভ্যালেন্টাইন্স ডে। দীপের জন্যে কিছু কেনা হল না। একঝলক ঘড়ির দিকে তাকায় অপরাজিতা। পৌনে নটা। দীপের তো দাঁড়াবার কথা সাড়ে সাতটায়। বরাবরই লেটে পোঁছয় অপরাজিতা। আর দেখে দাঁড়িয়ে আছে দীপ। ওর দাঁড়িয়ে থাকাটাই অপরাজিতার জীবনে রেফারেন্স পয়েন্ট যেন। এতদিন জীবন বলে যাকে জেনে এসেছে অপরাজিতা। কিন্তু আজ কি দাঁড়িয়ে থাকবে আদৌ? আজ যে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। প্রায় দেড় ঘণ্টা। অপেক্ষার মাঝে কোনওদিন ফোন করে না দীপ। কখনও জানতে চায় না এত দেরি হল কেন। অপরাজিতাও ক্বচিৎ ফোন করে জানায় দেরি হবে বা কতটা দেরি হবে। যত দেরি হোক, দীপ অপেক্ষা করে থাকে। ক্লান্তি আসে না তার। অপরাজিতাও গ্লানিহীন পায়ে গিয়ে পৌঁছয় তার কাছে, ভাগাভাগি করে নেয় সারাদিনের ক্ষোভ, হতাশা, জয়, সফলতার মুহূর্তগুলো। এতেই অভ্যস্ত তারা। হঠাৎ ভীষণ বিরক্ত হয়ে উঠল অপরাজিতা এই অভ্যেসের, এই অভ্যেসের দাসত্বের ওপর। কেন এত রাতেও দীপের সঙ্গে দেখা করতেই হবে তাকে? তার ওপর কোনও গিফট কেনা হয়নি, খালি হাত? দীপই বা কেন দাঁড়িয়ে থাকবে? কেউ এত বোকা-বোকা করে এখন? ক্লান্তি এসে গ্রাস করে সহসা। সেই গড়িয়াহাট যাওয়া, কোথাও বসা, বকবক করা, বাড়ি ফিরতে দশটা, সাড়ে দশটা মিনিমাম। মেপলের পাতাগুলো শুকিয়ে যাবে না ততক্ষণ? ফিকে হয়ে যাবে না তার লাল রং?
অপরাজিতা টুক করে দেশপ্রিয় পার্কে নেমে পড়ল। এখান থেকে সোজা বাড়ি চলে যাবে। হ্যাঁ, দীপকে একটা মেসেজ পাঠানো দরকার। বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে টকাটক লেখে সে—
‘লাভ ইজ নট আ ডিসিশন, ইটস আ ফিলিং, ইফ উই কুড ডিসাইড হু টু লাভ, দেন লাইফ উড বি মাচ সিমপ্লার, বাট দেন লেস ম্যাজিক্যাল।’