সুমন গুণ
রবার্ট লিন তাঁর সম্পাদিত একটি ইংরেজি কবিতা সঙ্কলনের ভূমিকায় লিখেছিলেন, কবিতা আমাদের জীবন থেকে সরিয়ে দিয়ে আবার জীবনেই ফিরে আসতে শেখায়। একই সঙ্গে তাঁর সমান শিহরণ-জাগানো ভাষ্য ছিল, দ্বিতীয় প্রত্যাবর্তনটি না ঘটলে প্রথমটির কোনও মর্যাদা নেই। এই সময়ের বিভিন্ন কবির লেখা পড়ে কথাটির মানে আমি টের পাই। কবিতা যে এখনও অন্তত কিছু মানুষের কাছে অবলম্বনের মতো, সেটা তাঁদের লেখা পড়ে বোঝা যায়। এটা আমি পৃথিবীর সর্বত্র দেখেছি। প্যারিসের যে-পাবে গিয়েছিলাম বোদল্যেরের জন্মদিনে, সেখানে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বল তরুণ তরুণীদের দেখে, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে আমি টের পেয়েছি যে সৃজনশীলতার প্রতি মানুষের মনস্কতা আরও বাড়ছে।
প্যারিসের শার্ল দ্য গল বিমানবন্দরে আমি যখন নামি, তখন ওখানকার সময় বিকেল সাড়ে ছটা। শেন নদীর ওপর দিয়ে প্লেন তখন নামছে। সরু, উজ্জ্বল আর দীর্ঘাঙ্গী নদীটিকে আমার দেখেই ভালো লেগে যায়। এরপর যে-ক’দিন ছিলাম প্যারিসে, নদীটির সঙ্গ ছাড়িনি। অবশ্য শেন নদী এমনভাবে প্যারিসকে ঘিরে রেখেছে যে, যেদিকেই যাই না কেন, খুব বেশিক্ষণ তাকে চোখের আড়ালে রাখা যাবে না। কোনও না কোনও দিক থেকে সে ফুটে উঠবেই। কিছুদিন আগেই দাহ করা হল ভুবনবিখ্যাত যে-নটরদাম গির্জার, তার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শেন নদীর সূর্যাস্তকালীন রূপটি আমি কোনওদিনও ভুলব না। গির্জার সর্বাঙ্গে তখন সূর্যাস্তের উচ্ছ্বাস। পাশেই শেন নদী। নদীর জলে গির্জার ছবি সোনালি আগুনের মতো জ্বলছে। নদীপথে কারুকার্যখচিত জাহাজ যাচ্ছে একের পর এক। নদীর ওপর একটা ব্রিজে উঠে অনেকক্ষণ ধরে দেখেছি স্ট্যাচু অব লিবার্টি। নদীর একটা বাঁকে বসানো স্ট্যাচুটি আসলে নিউ ইয়র্কের স্ট্যাচু অব লিবার্টির সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। নব্বই দশকের মাঝামাঝি আমেরিকায় গিয়ে নিউ ইয়র্কের স্টেটেন আইল্যান্ডে মূল স্ট্যাচুটি দেখেছিলাম। তার উদাত্ত দাপটের তুলনায় প্যারিসের রেপ্লিকাটি অনেক নিরীহ। ছোট। মূল স্ট্যাচুটি আগে ফ্রান্সেই ছিল। পরে ফ্রান্স সেটা আমেরিকাকে উপহার দিয়ে একটা রেপ্লিকা বানিয়ে প্যারিসে রেখে দেয়। নিউ ইয়র্কের স্ট্যাচুর বেদিতে এমা ল্যাজারাস-এর একটা কবিতাও ছিল মনে পড়ছে। এখনও নিশ্চয়ই সেটা আছে।
সেখান থেকেই গিয়েছিলাম প্যারিসের সেই কবিতা-ক্লাবে। club des poets. দেয়াল থেকে উঠে আসা কালো অক্ষরে লেখা এই শিরোনামেই স্পষ্ট বাড়িটির চরিত্র। কবি আর কবিতার নানা ছবি দেওয়ালে টাঙানো। এই ক্লাবটিতে প্রতি মঙ্গল, শুক্র ও শনিবার নিয়মিত সন্ধে থেকে রাত পর্যন্ত খাদ্য, পানীয় আর কবিতাচর্চা চলে। তবে সবকিছুর সময় বেঁধে দেওয়া আছে। মোটামুটি আটটা থেকে দশটার মধ্যে খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ করতে হয়। আটটা থেকে খাবার পাওয়া যায় কিন্তু ন’টার আগে পানীয় নয়। তারপর গোটা ক্লাবটিই চলে যায় কবিতার দখলে। ক্লাবটি ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন Jean-Pierre Rosnay, তিনি নিজে ছিলেন একজন পরিচিত কবি। ক্লাবে তাঁর বইগুলিও সসম্মানে সাজানো আছে, যে-কেউ দেখতে বা কিনতে পারেন। তিনি প্রয়াত হয়েছেন, তাঁর সুন্দরী স্ত্রী Tsou এখন এই পাব সামলাচ্ছেন পুত্রকে নিয়ে। খাবারের দামও, সম্ভবত, বাইরের যে-কোনও দোকানের চেয়ে কম। ক্লাবে ঢুকতেই সহাস্যে অভ্যর্থনা জানালেন ক্লাবের কর্ত্রী। ইজিপ্টের মহিলা। তাঁকে নিয়ে লেখা Jean-Pierre Rosnay-র কবিতাটি আমি পরে পড়েছি। আসক্ত, ইশারাময় কবিতা। অনুবাদে কবিতাটিকে আহত না করে আমি পুরো কবিতাটিই তুলে দিলাম:
On top of you guitars
His blue eyes and smile
The night mingled with her hair
Each train forgot his station
The ebb and flow of the inland sea
Who drove my heart to the cause of his
Made me like the shadows dog
We see lap night leftover glow
My Egyptian my mythical
When we bathe us again
At the port of Alexandria between these old ships
Which sail burst gave the music
The top of the tallest pyramid
Licked by millions tourist gaze
Between The Light legends and songs
I bring you these words still wet with blood
These inhuman verses superhuman love
When love writing to his beloved poet
He loads his ink pen eternity
Then said Madam I just love you
And I would be grateful for noticing
যেদিন পৌঁছেছিলাম প্যারিস, সেদিনই রাত বারোটা নাগাদ বেরিয়েছিলাম আমি আর আমার সঙ্গী কবিবন্ধু, নগর দর্শনে। প্যারিসে রাত যত বাড়ে, তত জমে। সেদিন আবার ছিল শুক্রবার। সপ্তাহান্তের আমোদ নিতে প্রথম বিশ্বের এই ধ্রুপদী শহর মধ্যরাতের কুঞ্জে কুঞ্জে ছড়িয়ে পড়ছে। দিকে দিকে আলোর পাগল-করা উচ্ছ্বাস, তুমুল ঠান্ডায় প্রত্যেকে উষ্ণতার জন্য উৎসুক। আমি কলকাতার ছিপছিপে একটি জ্যাকেট পরে ঘুরছি, কাঁপতে কাঁপতে। আমার সঙ্গীর তো অসুবিধে নেই, ফ্রান্সের বনেদি নাগরিক সে, এপ্রিলের সামান্য শৈত্যে কাবু হবার উপায় আছে তাঁর!
হাঁটতে হাঁটতে একসময় এসে দাঁড়ালাম মুলাঁ রুজ-এর সামনে। সারা পৃথিবীতে বিনোদনের সঙ্গমস্থল হিসেবে এই বহুমুখী ক্লাবটির কোনও জুড়ি নেই। তবে সে বিনোদনের ভাগ নিতে হলে পকেটের দাপট থাকা চাই। ক্লাবের বাইরে দীর্ঘ কিন্তু সংযত লাইন, একটু বেচাল দেখলেই বিশালকায় নিরাপত্তাকর্মীরা নির্দয়ভাবে তা সামাল দিতে দ্বিধা করছেন না। আমার বন্ধু অর্ধেকেরও কম মূল্যে দুটি বিশেষ প্রবেশপত্র কিনে রেখেছিল, আমরা সেটা দেখিয়ে দাপটের সঙ্গে ভেতরে ঢুকেছিলাম। নাচ-গান-অভিনয়-হুল্লোড়ের অবারণ আতিথ্যে মুলাঁ রুজ আমাদের যেভাবে মাতিয়ে দিয়েছিল, সে-কথা পুরো লিখলে প্রাপ্তবয়স্কের খাদ্য হয়ে যাবে। শুধু এটুকু বলি, নব্বইয়ের দশকের নিউইয়র্কেও এইরকম প্রমোদাভিসারের অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল, কিন্তু প্যারিসের আয়োজনে একটা কল্পনাপ্রবণতার ঐশ্বর্য ছিল, সেটা আর কোথাও পাওয়া যাবে বলে আমার মনে হয় না। আর সুখাদ্যের যে কত মধুর বৈচিত্র্য হতে পারে, সেটাও এখানে না এলে বোঝা অসম্ভব।
তবে প্যারিস তার সব রূপ আর রসদ নিয়েও ক্রমশ নোংরা হয়ে যাচ্ছে। আশেপাশের দেশ থেকে সেনজেন ভিসার সুযোগ নিয়ে নানা ধরনের মানুষ জড়ো হচ্ছেন এখানে, সবার উদ্দেশ্য সমান নয়, অনেকেই আসছেন পর্যটকদের বোকা বানিয়ে সর্বস্ব হাতিয়ে নেবার লক্ষ্যে। তাই শেষ কয়েকদিন আমাকে খুব ভয়ে ভয়ে কাটাতে হয়েছিল বিশ্বসংস্কৃতির এই পীঠস্থানে। এমনকি ফরাসি রূপসীদের ছোঁয়া নেবার সময়ও আত্মহারা হতে পারতাম না। তাছাড়াও, গলিতে দাঁড় করানো দুটো গাড়ির ফাঁকে, এমনকি অত্যুজ্জ্বল মেট্রো স্টেশনের কোণায় দাঁড়িয়ে দৈত্যাকার য়ুরোপীয়দের নির্বিবাদে মুক্ত হতে দেখে আমার প্রথম বিশ্বের নাগরিক সভ্যতা সম্পর্কে ধারণা এমনিতেই ঘেঁটে গিয়েছিল।