অজিত রায়
সম্প্রতি চলে গেলেন প্রবাদপ্রতিম শ্রমিক নেতা, ধানবাদের কয়লাখনি শ্রমিক ও খেটেখাওয়া মানুষজনের কাছের লোক অরুণ কুমার রায় বা এ কে রায়৷ তাঁর মৃত্যুতে কলকাতার বামপন্থী মহলে কোনও আলোড়ন নেই অথচ এ কে রায়-এর জীবন প্রতিটি কমিউনিস্ট-এর কাছে টেক্সটবুক-এর মতো। রায়বাবুর চিন্তাভাবনা নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে আনার তাগিদে এবারের স্টিম ইঞ্জিন বিভাগে বেছে নেওয়া হল এ কে রায়কে নিয়ে সাহিত্যিক শ্রী অজিত রায়-এর উপন্যাস— 'হিরণ্যরেতা'র একাংশ৷ উপন্যাসের প্রকাশকাল: জানুয়ারি ১, ২০১১। প্রকাশক: শহর পাবলিকেশন।
একদিন এন কে রায় রাস্তায় আটকে বললেন, ‘রায়সাহেব, পাওয়ার প্ল্যান্টের ওয়ার্কিং কন্ডিশন জঘন্য হয়ে গেছে৷ ইনসেন্টিভ কম পাচ্ছে বলে মন দিয়ে কাজই করতে পারছে না কেউ।’
পাওয়ার প্ল্যান্টের লেবারদের মনে বহুদিন ধরেই অসন্তোষের ফুলকি উড়ছিল। সেটা অরুণও শুনেছিল। এতদিনে তাহলে সেটা দানা বাঁধতে শুরু করেছে! কিন্তু, ওয়ার্কিং কন্ডিশন বেহাল, তাতে ম্যানেজমেন্ট বুঝে করুক। গোড়াতেই সে খচে গেল, ‘দেখুন রায়বাবু, বোনাস, ইনসেন্টিভ এগুলো নিয়ে আমরা ভাবি না। কোন বড় ইশ্যু আন্দোলন করতে বলুন, রাজি আছি।’
‘কী বলছেন রায়সাহেব!’ যারা শুনল, প্রত্যেকে হোঁচট খেল৷ রায়সাহেবের মুখে এই কথা? মনোরঞ্জন জানতে চাইল: ‘শ্রমিকদের জন্য আমরা কিছু করব না বলছেন? তাহলে ওরা আমাদের সঙ্গে জুড়বে কেন? আমরাই বা কীভাবে ওদের কাছে যাব? ওদের দাবিগুলোকে তো আমরা সিমপ্যাথির চোখেই দেখব, নাকি! শ্রমিকদের দাবি কখনো-সখনো ভুলও হতে পারে, তবু আমাদের সাপোর্ট করতে হবে। ওরা তো আমাদেরই বেশি ভরসা করে। যাই বলুন, এই মওকাটা হাতছাড়া করা ঠিক হবে না।’
এরপর সত্যনারায়ণ আর রামলায়েক সিং এসেও চেপে ধরলেন।
‘না।’ অরুণের গলা তখনও শক্ত: ‘শ্রমিকদের বোনাস-ইনসেন্টিভ এসব ব্যাপার নিয়ে ওদেরকে সংঘবদ্ধ করা শর্টকাট রাস্তা। এতে লেবার-পলিটিক্স স্ট্রেয়েড হবে। পরে কোন বিগ ইশ্যু নিয়ে আন্দোলনে সামিল করতে চাইলে ওরা তখন আসবে না। বিহার বনধের দিন দ্যাখোনি? আমরা কারখানায় কাজ বন্ধ করাতে পেরেছিলাম?’
তারপর নিজের কমরেডদের দিকে চেয়ে সে বলল, ‘এইজন্যেই অ্যাদ্দিন আমি লেবার-পলিটিক্সে হাত দিইনি। বোনাস, ইনসেন্টিভের মত প্রশ্নে আমরা তাদের সমর্থন করলে তারা তো আরও অপারচুনিস্ট হয়ে পড়বে। আলটিমেটলি স্বার্থ ছাড়া আর কোনদিকেই তাকাবে না। আমি চাই গ্রামাঞ্চলের মানুষের আন্দোলন শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হোক। শ্রমিকদের মাঝে আমাদের ওটুকু আইডেন্টিটি থাক, তাহলেই হবে।’
‘বেশ। কিন্তু আপনি যদি এসময় ওদের পাশে না দাঁড়ান, ওটুকু আইডেন্টিটিই বা গড়ে উঠবে কেমন করে? আপনি শ্রমিকদের লড়াই লড়বেন না, ওদের মাঝে যাবেন না, ফের ওরা কেন আপনার কথা শুনবে? আমার তো মনে হয় একটা ভালো সুযোগ এসেছে। আপনার গ্রেপ্তার হওয়ার পর এখানে একটা আলোড়ন হয়েছে, এখন আপনাকে লোকে চেনে। আপনার কথা শ্রমিকরা শুনবে৷ আর এই সুযোগে আমরা নিজেদের ইউনিয়ন খাড়া করে নেব।’
অরুণ একটু অস্বস্তি বোধ করল। ‘শ্রমিক সম্পর্কে আপনি ইনকর্পোরিয়াল ঢঙে কথা বলছেন কমরেড।’ সে বলল, ‘আমি একবারও বলেছি যে শ্রমিকদের মাঝে আমরা যাব না, তাদের জন্য লড়ব না? প্রশ্ন হলো, কোন শ্রেণীর শ্রমিকদের পাশে আমরা দাঁড়াব। যারা অর্গানাইজড সেক্টরের লেবার, মানে, হোয়াইট কলার লেবার, তাদের পাশে? নাকি যারা অসংগঠিত, যারা ঠিকে-শ্রমিক, ভূমিহীন চাষী, পিস-রেটেড লেবারাইট— তাদের পাশে? এই দু ধরনের শ্রমিকদের মধ্যে ফান্ডামেন্টাল ক্যারাক্টার আর স্ট্রাগলে বড়সড় ফারাক আছে৷ আমরা বিহার বনধ সমর্থন করেছিলাম, কেননা সেটা ছিল করাপশন আর বেকারত্বের মত ইমপর্ট্যান্ট ন্যাশানাল ইশ্যু— তাতে অসংগঠিত মজদুররা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু অর্গানাইজড সেক্টরের লেবাররা কী করল? জাস্ট ডাম্ব অনলুকার ব’নে থেকে গেল। কারণ এসব ন্যাশানাল ইশ্যুতে তাদের কিছু আসে যায় না। এখন তাদের এই ইনসেন্টিভের দাবি সমর্থন করে আমরা তাদেরকে আরও অপারচুনিস্ট করে তুলব বলছেন?’
যাই হোক, শুধু সত্যনারায়ণরা নন, মনোরঞ্জনও সেদিন বেজার মন নিয়ে ফিরে যায়। তাদের বেরিয়ে যেতেই অরুণ নিজের মুদ্রায় ফিরে আসে— ‘তারপর ব্রজকিশোর! সাথীর কাজকর্ম কেমন চলছে? সেন্টারগুলোতে মাঝেমধ্যে ঢুঁ মারছো তো?’
অবশ্য, মনে মনে অরুণ তখন অন্য কথাই ভাবছে।
***
মনোরঞ্জনের মত সংগঠনের অন্যান্যরাও অরুণের কথায় বিচলিত। পাওয়ার প্ল্যান্টের শ্রমিকদের পাশে না দাঁড়ালে আমাদের নিজেদের ‘জনবাদী শ্রমিক সংগঠন’ গড়ে তোলার স্বপ্নও যে অধরা থেকে যাবে! সুতরাং প্রত্যেকে সমুদয় বিপাকে। শহরপুরার লেবার ইউনিয়নের অফিসে দু-দিন বাদে মিটিং ডাকা হল, তাতে অরুণকে উপস্থিত থাকতে দেখে জনে জনে আর্জি জানিয়ে গেল।
সন্ধের দিকে অফিসে ঢুকে কমরেডদের চোখমুখ দেখে যা বোঝবার অরুণ বুঝে ফেলল। সেও খোলাখুলি কথা বলতে চাইছিল। কমরেডদের কাছে এটা পরিষ্কার হওয়া দরকার যে কোনরকম দুরাগ্রহ-বশত নয়, বরং নিতান্ত সিদ্ধান্তগত কারণেই অর্গানাইজড সেক্টরের শ্রমিকদের নিয়ে সে কাজ করতে চায় না।
মনোরঞ্জন ফস করে জানতে চাইল, ‘তাহলে এটাই আপনার শেষ ফয়সালা?’
অরুণ স্মিত হেসে জানায়, ‘আমি বলিনি যে এটা আমার শেষ ফয়সালা। আমি তো স্রেফ নিজের কথা বলেছি। কী করতে হবে, সেটা তোমরা ডিসাইড করো।’
আনন্দ মাহাতো বললেন, ‘রায়দা, আপনার লিয়েই আমরা জনবাদী মজদুর সংগঠন গড়ার দিশায় আগাছি। ইখন মজদুরদের আন্দোলন আমাদের সামুতে। ই-সময় মু বুজে থাইকলে চলবেক? মজদুরগুলান কী বুঝবেক! আমরা ম্যানেজমেন্টের হিতৈষী, সিটাই বুঝবেক ন?’
‘দেখুন কমরেডস’— অরুণ সমবেত প্রত্যেককে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘লোকে কে কী বলবে, বাদ দিন৷ আপনারা নিজেদের কথা ভাবুন। আমার ব্যক্তিগত মত হল, এই শর্টকাট রাস্তাটা ঠিক নয়। যে কোন লড়াইয়ে একটা এথিকাল বেস থাকা উচিত। তবেই সংগ্রাম চলবে। সফলও হবে৷ ব্যর্থ হলেও, দূরগামী সুফল একটা নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।’
মনোরঞ্জন ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল, ‘তার মানে আপনি বলতে চাইছেন পাওয়ার প্ল্যান্টের শ্রমিকেরা কঠিন পরিশ্রমের বিনিময়ে একটু বাড়তি পারিশ্রমিক দাবি করছে, সেটা অনৈতিক?’
‘হ্যাঁ, অনৈতিক।’ অরুণ প্রত্যয়ের গলায় বলল, ‘এই আশেপাশের গ্রামগুলোতে একবার ঘুরে আসুন। মামুলি তিন-চার পয়লা ধানের বিনিময়ে মানুষ পরের জমিতে চাষ করছে। চার পয়লা ধানে দু পয়লা চাল হয়, যার দাম বড়জোর এক টাকা। দিনভর হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে লক্ষ-লক্ষ শ্রমিকের মজুরি এক থেকে সোয়া টাকা। ঠেকা-শ্রমিকরাও তো আছে, ওই পাওয়ার প্ল্যান্টেই আছে— তারা নিজেদের শ্রমের বিনিময়ে ক’টাকা হাজিরা পাচ্ছে? সেই তুলনায় যেসব শ্রমিক আজ ইনসেন্টিভের দাবি তুলেছে, তাদের মিনিমাম ওয়েজ পঁচিশ থেকে তিরিশ টাকা। তার ওপর এই বোনাস-ইনসেন্টিভের দাবি। এরপরেও আপনারা বলবেন ওদের দাবি আন-এথিকাল নয়? ওদের আন্দোলনের এথিকাল বেস কী? যে আন্দোলন ইকোনমিক বৈষম্য বৃদ্ধি করবে, তাকে কীভাবে সমর্থন দিতে পারি আমরা, কমরেডস?’
সভা একেবারে স্তব্ধ। প্রত্যেকের নড়াচড়াও যেন একলপ্তে লোপাট৷
‘হ্যাঁ, ঠিক আছে।’ তারপর প্রথম মুখ খুলল মনোরঞ্জন— ‘আপনার কথা মেনে নিচ্ছি। কিন্তু এও তো ঠিক, আপনি যে নৈতিক আধারের কথা বলছেন, সেটা শ্রমিকদের মধ্যে হুট করে জন্ম নেবে না৷ নৈতিক লড়াইয়ের পথে ওদের নিয়ে আসবে কে? আমাদেরকেই তো আনতে হবে। সেইজন্যই বলছি, ওদের কনফিডেন্সে না নিয়ে আজ যদি আমরা ওদের আন্দোলনকে ডিফেন্ড না করি, তাহলে আরও খারাপ হবে।’
অরুণ অন্ধের দৃষ্টি মেলে কমরেডদের দিকে তাকিয়ে থাকল। মৃদু স্বরে বলল, ‘যা ভাল বোঝেন আপনারা করুন। কিন্তু আমার আজকের কথা মনে রাখবেন৷ শ্রমিকদের বোনাসমুখী করা বিপ্লবীর কাজ নয়। একদিন এর জন্য পছতাতে হবে।’
স্বগতোক্তির মতই শোনাল ওর কথাগুলো।