চার নম্বর নিউজডেস্ক
সিকিম। ভারতবর্ষের মানচিত্রে কতটুকু? কিন্তু ওই, দ্য সাইজ ডাস নট ম্যাটার। তাহলে কী ম্যাটার করে? কাজ। চিন্তা। পথ দেখানো। সিকিম। হিমালয়ের বুকে দাঁড়ানো ছোট্ট সিকিম সেই পথ দেখাচ্ছে। পাহাড়ের নিচের বাকি ভারতবর্ষ সে পথে হাঁটুক।
কোন পথ? চাষ। ওইটুকু রাজ্যে, পাহাড়ি মাটিতে কোন কৃষিপথের দিশারী সিকিম? জৈব চাষ। ১০০ শতাংশ। ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন বা ফাও-এর সম্মান। ২০১৮-র ফিউচার পলিসি অ্যাওয়ার্ড। অন্য নামে, সেরা পলিসির অস্কার। বিশ্বের ২৫টি দেশের ৫১টি পলিসির ভেতর প্রথম সিকিম। সোনার রাজ্য সিকিম। রুপো পেল ব্রাজিল, ডেনমার্ক ও ইকুয়েডর। ফাও-এর সঙ্গে এই পলিসি অ্যাওয়ার্ডের অন্যতম আয়োজক ছিল ওয়ার্ল্ড ফিউচার কাউন্সিল এবং আইএফওএএম — অর্গানিক্স ইন্টারন্যাশনাল।
শুরুটা কবে? কীভাবে? একটা রাজ্যকে এমন একটা সম্মান পেতে গেলে কিছুটা সাহসের দরকার হয়। সেটাই করেছিল পবন চামলিঙের মুখ্যমন্ত্রিত্বের সিকিম। ২০০৩। রাজ্যের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাইরে থেকে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের আমদানি বন্ধ হয়ে গেল। আভ্যন্তরীণ উৎপাদনেও তৈরি হল নিষেধাজ্ঞা। এটাই সাহস। শুরু। কৃষকেরা প্রথমে ভয় পেলেন। চিরাচরিত অভ্যেস। শিক্ষা। দারিদ্র। ভয় তো আসবেই। প্রাথমিক ধাক্কা। লোকসান। শেষমেশ সরকারের ভরসা। ক্রমশ, দু তিন বছর পরেই অঙ্কটা বদলাল। জৈব চাষেই সাফল্য পেলেন তাঁরা। পাশে এলেন সরকারের। কারণ, ব্যক্তিগত গিমিক নয়। হঠাৎ মনে হওয়া মাস্টারস্ট্রোক জাতীয় হুজুগও না। দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও আলোচনার ফল। এই সিদ্ধান্ত পরিবেশের জন্য, মানুষের জন্য। জৈব সার, বিশেষ করে ভার্মিকম্পোস্টিং-এ জোর দেওয়া হল। কীটনাশক ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ হল। জৈব পদ্ধতিতে আগাছানিধন এবং ক্ষতিকর পোকার নির্মূলকরণে আনা হল সনাতন এবং নতুন দুধরনেরই কিছু কৃষি পদ্ধতি। অর্গানিক ম্যানিওর ব্যবহারে জোর দেওয়া হল। অ্যাজোলা এবং অন্যান্য সহায়ক উদ্ভিদ চাষে নজর দেওয়া হল। যার পরিণতি, এই মুহূর্তে রাজ্যের মোট ৭৫ হাজার হেক্টর জমির কোথাও রাসায়নিক পদ্ধতিতে কৃষিকাজ হয় না। যদি কোথাও হয়? অগোচরে? সে আইনও আছে। তীব্র নজরদারি। ধরা পড়লেই চোদ্দশ ডলার জরিমানা অথবা তিনমাসের জেল। রাজ্যের অর্গানিক মিশনের একজিকিউটিভ ডিরেক্টর ড. আনাবালাগান-এর গর্বিত মুখে দৃঢ়তা, যুদ্ধজয়, আলো দেখানোর কথা। দেশের ন্যাশনাল প্রোগ্রাম ফর অর্গানিক প্রোডাকশনের কর্মসূচি অনুযায়ী এই সাফল্য। প্রায় সমস্ত রাজ্যই তো নিয়েছিল। সিকিম পথ দেখাল। এবার মিজোরাম আসছে। আসছে অরুণাচল, কেরল, এবং এক একটা জেলা ধরে পশ্চিমবঙ্গও।
১০০ শতাংশ জৈব চাষের সাফল্য ঠিক কোথায়? স্থিতিশীল চাষের দিক থেকে এই কর্মকাণ্ড মাটি এবং জলের স্বাস্থ্য বজায় রাখছে। রাসায়নিক ব্যবহারের সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়ায় তা থেকে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকছে না মানুষের। ৬৬০০০ কৃষক পরিবার কোনওরকম আর্থিক সমস্যায় পড়েনি এই সিদ্ধান্তে। তরতরিয়ে উঠছে লাভের অঙ্ক। পারিবারিক এবং রাজ্যের সামগ্রিক দিক থেকে। সবচেয়ে বড় কথা, স্থিতিশীল পর্যটন বা সাসটেইনেবল ট্যুরিজম-এর সঙ্গে জুড়ে থাকে এইসব শব্দ। কারণ একটা পাহাড়ি রাজ্য প্রায় সম্পূর্ণই নির্ভর করে আছে পর্যটনের উপর। দেখা গেছে ২০১৪ থেকে ২০১৭— এই চার বছরে সিকিমে পর্যটন বেড়ে গেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। জৈব চাষের এই বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যা প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। শুধু রাজ্য না, সম্ভবত কৃষকসমাজ এবং সামগ্রিক রাজ্যবাসীর একটা সম্পূর্ণ রূপান্তর। সচেতনতার বিকাশ। শিক্ষার বিকাশ।
সম্প্রতি বাইরের আনাজ, ফল এবং আমিষ জাতীয় খাবার আমাদানিও বন্ধ করল সরকার। হোটেল ব্যবসায়ীয়া একটু আশঙ্কায় পড়েছেন। এখানেও ভরসা সরকার। কৃষকদের মতোই তাঁদেরও পাশে দাঁড়াতে রাজ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে যুদ্ধকালীন তৎপরতা দেখাচ্ছে সিকিম। আনাজ এবং ফলে এমনিতেই যথেষ্ট উৎপাদন মজুত সিকিমে। পর্যটন শিল্পের জন্য আমিষ জাতীয় খাবারে ভাবনাচিন্তা চলছে। পশুপালনে জোর দেওয়া হচ্ছে। পাহাড়ি নদীতে মৎস্যচাষে নতুনতর ভাবনাচিন্তা আনা হচ্ছে। আলো ছড়াচ্ছে …
সিকিম। কৃষি অর্থনীতি। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন। এই তিনের সহাবস্থান। ভারতবর্ষের আনাচে-কানাচে এভাবেই তৈরি হোক আরও অনেক সিকিম মডেল। দেশ, মানুষ, গাছপালা, পরিবেশ— ভালো থাকুক।