যশোধরা রায়চৌধুরী
২০১৯-এর গোড়ায় কাজের সূত্রেই যাওয়া হয়ে গেল প্রথমে আফ্রিকায় পরে আরবে। লেবাননের বেইরুটে।
যদিও একে আরব ভাবতে কষ্ট, ভেবেছিলাম এ এক পাশ্চাত্যের প্রভাবান্বিত, উজ্জ্বল ইতিহাসের ছায়ায়, মরকত নীল ভূমধ্যসাগরের তীরের দেশ ও শহর। প্রথম দর্শনে প্রেম জাগায় নীল নীল নীল, সবুজের ছোঁয়া কিনা তা বুঝি না… তারই মাঝে শূন্যের আনমনা হাসির শামিল কটা গাংচিল। প্রেমেন্দ্র মিত্রের এই ফ্যান্টাসি বুকে নিয়ে মেডিটেরেনিয়ানের কাছে যাই। ‘চারুলতা’র সেই সুর করে অমলের বলা “মেডিটেরেনিয়ান”-এর মোহটুকু রয়েছে ফরাসি সুগন্ধের মত।
তিন সপ্তাহের সফর। ক্রমশ বুঝলাম, এ শহরে রোজ আপিস যাবার পথটুকু ৩০ মিনিট করে হেঁটে দেখতে শিখেছি বলেই বুঝলাম, এই শহরের স্ববিরোধগুলি। অন্যথা বোঝা যেত না, রাস্তাগুলোর নাম ফরাসিতে হলেও, এ শহরের অন্ধিসন্ধিতে কতটা আরব ঢুকে আছে। আরব দেশগুলোর সবার যে বিপুল স্ববিরোধ অন্তত আমার মত স্ববিরোধী ভারতীয়ের চোখে পড়ার, সবটাই চোখে পড়ল আমার একে একে। বিপুল স্কাইস্ক্রেপারের পাশে উচ্ছিন্ন সিরিয়ার যুবতী, দারুণ সব আশি কিমি গতিতে চলতে পারার হাইওয়ের পাশাপাশি ঘেটোর মত, দেওয়াল তোলা “আরব অঞ্চল” (পড়ুন প্যালেস্টিনীয়), পথের মোড়ে পোস্টিং হয়ে থাকা গোছায় গোছায় মেশিনগানধারী উর্দিধারী, অপরূপ শপিং মলের পাশে বালির বস্তার আড়ালে বেরিয়ে থাকা বন্দুকের নল… এসব ক্রমশ প্রকাশ্য।
আরব মানে আমার কাছে কী?
বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি ইত্যাদি করতে করতেই, এ দুনিয়াতে এমন সব আশ্চর্য দেশ দেখলাম যেগুলির নাম মাত্র পড়েছিলাম কোথাও না কোথাও। যাওয়া হয়ে গেল কাজাখস্তান উজবেকিস্তান ইউক্রেন আর্মেনিয়া। যাওয়া হল ইজরায়েল। যাওয়া হল ফিলিপিন্স রাশিয়া। যাওয়া হল সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মাথার মণি দুবাই।
দুঃখের বিষয়ে আশৈশব আমার বিশ্বভূগোলে হাতেখড়ি কেবলই ম্যাপ ম্যাপ খেলা আর ছোটবেলার ইতিহাস বই জ্ঞানের আলো খেলা (সেই যে ব্যাটারি চালিত, তারে তারে জোড়া দিলে আলো জ্বলে ওঠে ছোট্ট বালবে) বা বিশ্বকোষ চার খণ্ড দিয়ে। ভূগোল বই থেকে কদাচ নয় (আমার প্রজন্মের সরকার বাহাদুর পরিচালিত মাধ্যমিক বোর্ড আমাদের কপালে এমনই দুর্ভাগ্যের বোঝা চাপিয়েছিল যে ওয়ার্ল্ড জিওগ্রাফি বলে কিছুই ছিল না আমাদের শৈশব কৈশোরে পড়ার মত। আমাদের ছিল পশ্চিমবঙ্গের ভূগোল এবং ভারতের ভূগোল)। বলা ভালো অ্যাটলাস বইতে দেখা অদ্ভুত নামের দেশগুলো, আরও পরে সোভিয়েত দেশের বইগুলো, পত্রিকাগুলোতে চেনা আরও কিছু দেশের নাম, এসবের পাশাপাশিই আসলে কোনও বোধ বা ধারণাই তো গড়ে ওঠে না আমাদের, যা নাকি পৃথিবীকে জানতে শেখায়। আমাদের তো কেবল গড়ে উঠেছে একদেশদর্শী এক ভূগোল বোধ, যা মার্কিন পণ্যদুনিয়ার জাদুতে মোড়া।
কাঁচরাপাড়ার কোন্নগরের কাঞ্চননগরের ছুরিকাঁচি মুখস্থ করে, কচ্ছের রান আর রাজস্থানের থর মরুভূমির ক্লাইমেট জেনে, লাফ দিয়ে বাঙালি ছেলেপিলেরা, বিশেষত সায়েন্সের ‘ব্রাইট’ স্টুডেন্টরা, শিখে ফেলত নিউ ইয়র্ক স্টেট আর পেনসিলভানিয়ার অবস্থান, ওয়াশিংটন ডিসি যে ওয়াশিংটন স্টেটের বিপরীত প্রান্তে তাও জেনে যেত… প্রতিটি মার্কিন ‘স্টেটের’ কথা ছাত্রদের খেলাচ্ছলে জিকে আদানপ্রদানে শুনে ফেলেছি, শুনেছি জিকে-তে খুব দড় কোনও বন্ধুর কথা থেকে এটাও, যে, প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে আপাতত কোনও যোগ না থাকলেও, ডেট্রয়েটের সঙ্গে ডালাসের, ডালাসের সঙ্গে বস্টনের দূরত্ব জানা দরকার।
পাশাপাশি ব্রাত্য থেকে ব্রাত্যতর হয়ে গিয়েছে আমাদের পারিপার্শ্বিক থেকে অনেকগুলো দেশের নাম। অথচ মধ্যপ্রাচ্যের একটা বড় এলাকা জুড়ে আমাদের ঔদাসীন্যেই গজিয়ে উঠেছে ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের অনেক চাকুরিস্থল, দুবাইতে, ইয়েমেনে, তেল আভিভে, অথচ কোনও সাংস্কৃতিক যোগসূত্র আমরা রচনা করিনি। দুবাইয়ের ফুটপাতের দোকানে বসে স্যুপ বলে যে জিনিসটি খেয়েছিলাম সেটি যে অবিকল আমার বরিশালিয়া মায়ের হাতের পেয়াঁজ ফোড়ন দেওয়া মুসুর ডাল, অথবা উজবেকিস্তানের মাংসের পুর দেওয়া সোমসা যে আমাদের সামোসার এক ভাইবেরাদর, এগুলো ওই দেশগুলোতে না গেলে জানতাম না। আর তাইই, আমাদের সবটা মিলিয়ে এক আশ্চর্য অজ্ঞান অন্ধকারই বার বার ফুটে উঠেছে এইসব দেশের লড়াই, এইসব দেশের দারিদ্র্য, এইসব দেশের অপরূপ ইতিহাসের সাক্ষ্য দেখতে দেখতে।
আকৈশোর মধ্যপ্রাচ্য মানেই আমার কাছে গোলাগুলি, মারামারি, তার খ্যাতি আসলে কুখ্যাতি, তাকে জানা কেবল ভুল কারণের জন্য, গাজা স্ট্রিপ থেকে প্যালেস্তিনিয়ান খুদে দশ বছুরে বালক বিদ্রোহীর বোমা বাঁধা ছিন্নভিন্ন দেহের ছবি অথবা ৯/১১-র পরবর্তী আফগানিস্তানের বোমাবিধ্বস্ত চেহারা… তারপর ইরাক, সাদ্দাম।
আমার ভাববিশ্বে এই হল মধ্যপ্রাচ্য। মার্কিন সৈন্যের পদপাত বিধ্বস্ত এক বিশাল মরুপ্রধান ভূমি। মনে পড়ে যায় হার্ট লকার জাতীয় হলিউড ছবির দৃশ্যাবলি, মনে পড়ে যায় সাদ্দামের ফাঁসি, বেইরুট নামের এক সিনেমাতে আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা হয়ে যায় ইজরায়েল প্যালেস্টাইন যুদ্ধ, তথা, আরব কনফ্লিক্ট, যার রণভূমি হিসেবে গোটা সত্তর আশির দশক বিক্ষত হয়েছে লেবানন নামক দেশটির বেইরুট নামক রাজধানী। সেই নীল নীল নীল, স্বপ্নের ভূমধ্যসাগরের পাড়ে অবস্থিত মধ্যপ্রাচ্যের পারী নামে কথিত শহর।
আরও হালের সিরিয়া সমস্যার গল্পও ত কেবল নঙর্থক, ভয়াবহ ঘটনাক্রমের গল্পই, আবারও আইসিসের উত্থান, মেয়েদের ক্রীত-ধৃত-সেবাদাসী করে তোলা আইসিস, নাদিয়া মুরাদের দুঃস্বপ্ন সম বিবরণের দেশ। অথবা ভাইরাল ভিডিওতে দেখা, সিরিয়া সরকারের বম্বিং-এ ছিন্নভিন্ন হওয়া বাবা মায়ের দেহের সামনে বসে ক্রন্দনরত ফর্সা দেবদূতোপম শিশু, ভাঙা বাড়ি, ভাঙা রাস্তা, তোবড়ানো গাড়ি, নৌকোয় চেপে ভূমধ্যসাগরে ভেসে পড়া সিরিয়ান শরণার্থীদের অবিরাম ইউরোপে পাড়ি জমানো, এবং পথের মধ্যে মৃত্যু… সেই ভয়াবহ চিত্র আড়াই বছুরে আয়লান কুর্দির শরীর, মুখ থুবড়ে সমুদ্রতটে পড়ে থাকার… মাথার মধ্যে যে কটি ছবি বহন করি আমি, সেসবই বেদনার, ভয়ের, মৃত্যুমুখিতার।
তবুও শান্তি তবু আনন্দ জাগে আজকের বেইরুটে পা রেখে, কেননা এখন লেবানন চেষ্টা করছে স্বাভাবিকতায় ফেরার। গত কুড়ি বছর শান্তিতেই কেটেছে, আশি দশকের এক ঝাঁক প্যালেস্তিনিয়ান শরণার্থীকে গ্রহণ করেছে লেবানন, আর সদ্য দেড় লাখ সিরিয়ান শরণার্থীকে। রাজনৈতিকভাবে এই বেইরুট আছে নিউট্রাল বা নির্দল-পক্ষপাতহীন অবস্থায়, সে না আছে ইহুদিপ্রাধান্যের ইজরায়েলের দিকে, আবার তীব্রভাবে মুসলমানপন্থী প্যালেস্তাইনকেও সে যুদ্ধে মদত দেবে না। তার নিজের বুকে ইসলাম আর খ্রিস্টধর্মের যে দীর্ঘকালীন ঐতিহ্য, তা কখনও কখনও রক্তক্ষয়ী হলেও, প্রায়শই শান্তিপূর্ণ। অন্তত শেষ কিছু বছরে রাশি রাশি বিখ্যাত মসজিদ ও বিখ্যাত গির্জে বুকে নিয়ে বেইরুট রয়েছে দিব্যিই। প্রথাগতভাবে ফরাসি আর আরবি বলা বেইরুটে এখন জেগে উঠেছে ইংরেজি বলা প্রজন্ম, যাদের একজিট র্যুট তৈরি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিজের দেশের নাগরিকত্বের পাশাপাশি রেখেছেন এই প্রজন্ম, যেহেতু লেবাননে সেটা চলে।
এক অর্থনীতি রাজনীতির তুঙ্গমুহূর্ত পেরিয়ে এসে আজকের বেইরুট ঈষৎ ক্ষয়িষ্ণু, কিছুটা বেপথু, কিন্তু শান্ত। একটা ফালি দেশ, শুয়ে আছে ভূমধ্যসাগর বরাবর। রাস্তায় হোর্ডিং দেখলে গায়ে কাঁটা দেয়, এই রাস্তা চলে গেছে সিরিয়ার দামাস্কাসের দিকে। মাত্র ১১৪ কিলোমিটারের দূরত্ব। দু ঘণ্টা লাগবে গাড়িতে।
সত্যিই ছোট্ট দেশ। দক্ষিণে ইজরায়েল, আর পুবে জর্ডান ও সিরিয়া।
প্রথম ঝাঁকি
২ তারিখ ভোর, মানে বস্তুত গতকাল মাঝ রাত্তিরে পৌঁছলাম বেইরুট। মসজিদ আর গির্জেগুলো চোখে পড়ল মধ্যরাতেও। আর আমরা যে রাস্তাটির বাড়ি এয়ার বিএনবি থেকে ভাড়া নিয়েছি সেই রাস্তায় উইকেন্ডে সারারাত যুবক যুবতীদের আনাগোনা, লম্বা বার স্টুলে পা দুলিয়ে মদ্যপান আড্ডা, মহাভোজ। প্রবল শীত ফেব্রুয়ারিতে, দোকানের বাইরে তবু বসা চাইই, প্লাস্টিকের স্বচ্ছ চাদরে পুরো বারান্দাটা ঘিরে সেখানে ওভার কোট পরা মেয়েদের, ছেলেদের আড্ডা জমেছে।
মধ্যরাতেও ট্রাফিক জ্যাম পেরিয়ে পৌঁছনো। আমাদের দলটি ছ জনের। এক বাঙালি, দুই উত্তর প্রদেশীয়, দুই দক্ষিণী। এক বিহারি। পাঁচ হিন্দু এক মুসলিম। দুটি ট্যাক্সি এসেছিল, জুড়তে হল আরও এক ট্যাক্সি, এত জিনিস আমাদের। তারপর খুঁজে খুঁজে বাড়ি পাওয়া। এবং সে বাড়ির গেট দিয়ে চত্বর মত একটা জায়গায় জিনিস ঢোকানো। এয়ার বিএনবি-র মালিক ওয়াটস্যাপে সংখ্যা বলে দিয়েছে, সে সংখ্যার চাবি টিপে প্রথমে খুপরি একটা বাক্স খোলা, সেখানে পাওয়া গেল বাড়ির চাবি।
বাড়িটা এক্কেবারে ষাটের দশকে কলকাতায় দেখা ফ্ল্যাট বাড়ির মতন। চওড়া সিঁড়ি, বড় বড় ঘর, উঁচু সিলিং, কাচের দরজা (দিদুর বাড়ির জানালা বা ভবানীপুরের জানালার মতন)… সব মিলিয়ে দিব্যি নস্টালজিক। রাতে সবাই সুটকেস খুলতে লাগল, আমি ঘুমিয়ে নিলাম। সকাল নটা অব্দি ঘুমিয়ে উঠে চিঁড়ের পোলাও খেলাম, চা খেলাম। তারপর জানালা দরজা খুলে বেশ একটা ছিমছাম বারান্দা পেয়ে কাপড় কেচে মেলে রোদ্দুর আসা দেখলাম। কিন্তু দুপুর হতে হতেই বাড়িটা ঠান্ডায় দম মেরে গেল। হাত পা পেটের ভেতর সেঁধিয়ে গেল। কম্বলের তলায় লাঞ্চের আগে এবং লাঞ্চের পরে অনেকক্ষণ রইলাম।
বিকেলে সবাইকে টেনেটুনে নিয়ে হাঁটতে বেরনো হল। চমৎকার এক পাক দেওয়া। শহরের যে অংশে আমরা সেখানে ভাল রেস্তোরাঁর পর ভাল রেস্তোরাঁ।
এখানে লেবানিজ পাউন্ড ১৫০০ = ১ ডলার। কলা মাখন হাম্মাস কিনে ফিরলাম ৭৫০০ পাউন্ডের। মানে পাঁচ ডলারের।
আমাদের লোকজন হাজারের হিসেব দেখেই ঘাবড়ে যাচ্ছে। ১০০ ডলার মানে আসলে দেড় লাখ পাউন্ড। ১০ ডলার পনেরো হাজার পাউন্ড। হিসেব মাথায় ঢুকোলে কাজ করতে সুবিধে হবে। এক গ্যালন তেলের দাম বাইশ হাজার পাউন্ড। পাঁচশ পাউন্ড মানে পঞ্চাশ পয়সার মত, একটা ছেলে চেঞ্জ দিতে ভুলে যাচ্ছিল।
মিষ্টি মিষ্টি সব কাফে আর রেস্তোরাঁ রোববারের সন্ধেবেলা জমে উঠছে ক্রমশ। পথে পথে লম্বা টুল পেতে বসে পড়বে খাদকেরা। আড্ডাবাজেরা।
আমার আজ বড্ড শীত করছে, ইন ফ্যাক্ট এতদিনে এই প্রথম ওপরে নিচে থার্মাল পরে ফেললাম।
বেরোলাম পুরো ওভারকোট পরে। ইথিওপিয়ার ঠান্ডা এ তুলনায় কিছুই না। ঝকঝকে রোদ্দুর থাকত, দিনের বেলা ২৪-২৫ উঠে যেত।
কাছেই ভূমধ্যসাগর। আপিস থেকে নাকি দেখা যায়। আমরা হাঁটতে বেরোলাম মার মিখায়েল দিয়ে… পথে একটা পোর্ট জাতীয় জিনিস পড়ল। দেখা গেল না ভালো।
সিরিয়ার মা
পথে বসে বসে ভিক্ষা করে সিরিয়া থেকে আসা তন্বী মা। বেইরুটে যত জন লেবানিজ আছে সে সংখ্যা হয়ত তিন লক্ষ, আর দেড় লক্ষ এসে পড়েছে সিরিয়ার উদ্বাস্তু শরণার্থী। ২০১৩ থেকে এই ঢল নেমেছে। পার্শ্ববর্তী দেশ। একদা লেবাননে ঢুকতে সিরিয়ানদের পাসপোর্ট ভিসা লাগত না। সেও এক কারণ। বড়লোক সিরিয়ানরা দ্রুত পালিয়ে এসে বেইরুটে ফ্ল্যাট ট্যাট কিনে ফেলে বসে পড়েছেন। সিরিয়ানদের টাকা ঢুকেছে লেবাননের অসংখ্য ব্যাঙ্কে। এ দেশটা সুইজারল্যান্ডের মত, ব্যাঙ্কগুলোতে টাকা রাখা খুব সুবিধের, ট্যাক্স হেভেনও ছিল বটে। তবে হালে দশা পড়েছে। তবু সমৃদ্ধ সিরিয়ানদের এখানে বসতি স্থাপন ভালই হয়েছিল।
এর পর আসতে শুরু করেছেন গরীব সিরীয়-রা। আর তাঁদেরই এক আধজনকে এখানে ওখানে ভিক্ষে করতে দেখতে পাই। ছোট ছেলেমেয়েদেরই এগিয়ে দেওয়া হয় ভিক্ষাকর্মে। শিশুমুখ দেখে মানুষের মনে যদি দয়া আসে। মনে তো পড়ে যাবেই সেই মৃত আড়াই বছরের বালক আয়লান কুর্দির ছবি, ভাইরাল হওয়া ছবি। সমুদ্রের তীরে মুখ থুবড়ে থাকা সেই শিশুদেহের স্মৃতি এখনও অম্লান। সেও ত ছিল ভূমধ্যসাগরেরই তট!
হাসিমুখ বৃদ্ধ খিটখিটে বৃদ্ধ
পথে হেঁটে যেতে যেতে রোজ দেখি দুর্দান্ত গয়না বিক্রি হচ্ছে। সোনার মত দেখতে। সোনা নয়, কারণ খোলা অবস্থায় রাখা, ফ্যাশনেবল, হ্যান্ডক্রাফটেড। একদিন ঝোঁক বুঝে দাম জিজ্ঞেস করি থেমে দাঁড়িয়ে। বৃদ্ধ টুপি কোট পরা ভদ্রলোকের মুখে অনাবিল ফোকলা হাসি, তোমরা ভারতীয়? ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া। নাম বলো, নাম বলো! বলে সাগ্রহে দেখাতে থাকেন তাঁর কাজ।
১৫ ডলার, ১৪ ডলার, ১২ ডলারের বিনিময়ে সোনালি জল করা তামার পাতের ওপর পাথরের মত এবড়োখেবড়ো ছাপছোপ দেওয়া দুল। নিখুঁত তৈরি। প্রফেশনাল লুক।
ভদ্রলোকের কাছে বার বার আসি। তিনিও ভারতীয় বলে আমাদের আদরযত্ন করেন, নাম টুকে রাখেন খাতায়। দোকানটা গিন্নি চালান নাকি, গিন্নিকে দেখা যায় না। একমাত্র ছেলে ক্যানাডায় আছে। ভদ্রলোক বলেন, আগে সোনার ব্যবসা ছিল, তারপর অবস্থা পড়ে গেল। এখন এইসব করি। আমার বিজনেস পার্টনার দরকার। তাহলে তিন তলা দোকানটা পড়ে আছে, সেটাকে কিছু একটা গতি করা যায়। গতিটা বেচে দেওয়া নয়, আবার নতুন করে ব্যবসা ফাঁদা। লেবাননের মানুষ এরকমই। ৯৫ বছর বয়সেও কত উদ্যম। একা একা নানা ধরনের যন্ত্রপাতি নিয়ে বসে আমাদের জন্য একটা অন্য আকৃতির দুল বানিয়ে দেন কারণ আমাদের অত বড় দুল চলবে না।
নিজে সব করছেন। আর ফেরার সময়ে আবার হাতে চুমু খেলেন।
প্রচণ্ড ট্রাফিকজ্যাম এ শহরে। সরু সরু রাস্তা চলে গিয়েছ। মুম্বইয়ে যেমন সমুদ্রের ধারে ধারে মেরিন ড্রাইভ। এখানেও আছে। তাছাড়াও শহরের মাঝে মাঝেই সরু পথে গাড়ির হল্লা, প্যাক প্যাক হর্ন, বাম্পার টু বাম্পার ঠোকাঠুকি ভিড়। যেখানে সেখানে গাড়ি রেখে সব্বোনাশ করা। সব ভারতের যে কোনও শহরেরই মত।
তবে ট্যাক্সি বেশি পথচারী কম। তাই বোধহয় হাঁটতে শুরু করলেই, পথে ট্যাক্সিওয়ালারা থেমে থেমে জিগ্যেস করতে থাকে, কোথায় যাবেন ভাই? আমরা আধ ঘণ্টা হাঁটি রোজ। আমাদের পথ হাঁটা পথ। বৃষ্টি না হলে আমরা ট্যাক্সি চাপিই না বিশেষ।
আজ বৃষ্টি পড়ছিল সকালে। তাই ট্যাক্সির অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিলাম। এক বুড়ো দাদু আমাদের তুলে নিল। এক কলিও ইংরেজি বা ফরাসি বলতে পারে না। আরবি ছাড়া কিছুই বলতে পারে না। হেব্বি মেজাজি বুড়ো। ফলে পাঁচ ডলার-এর পথ ৭ ডলার নিলেন। কিছুতেই দরাদরি করা গেল না। মাথা নেড়ে বললেন, নো ইংলিশ। আর ফ্রেঞ্চ? একটু আধটু বলতে পারি। সেটাও তিনি বলতে অসম্মত।
আরেকদিন তো আরেক বৃদ্ধ আমাদের থেকে মাথাপিছু মাত্র দু হাজার পাউন্ড মানে দেড় ডলার প্রায় নিয়ে, সারা বেইরুট ভ্রমণ করিয়ে, ভুল জায়গায় ছেড়ে দিলেন, একেবারে অন্য কোথাও। তাও বিপুল চেঁচামেচি করে। সেখান থেকে তারপর আর ফিরতে পারি না। বেইরুট দর্শন হল বটে, কিন্তু ফেরার জন্য মাশুল গুনতে হল পাঁচ ডলার করে!!!
শাওয়ারমা রোল, গরম গোল রুটি ইত্যাদি ইত্যাদি
যেটা সবচেয়ে বেশি আদর কাড়ল সেটা শাওয়ারমা। বিশাল আকারের লম্বা রোল করা রুটি। ভেতরে রাশি রাশি মাংস।
পথের ধারে বেশ কিছু ফাস্ট ফুড স্টল। সেসবের কোনও একটি দোকানে ঢুকে পড়া গেল। বাবা মা ছেলে মিলে দোকান চালায়। বাবা নীচে কফির মেশিন, কাগজের কাপ ও গেলাস নিয়ে ঘুর ঘুর করে। আর ছেলে অর্ডার নিয়ে মাকে দেয়। মা রাঁধে, দোকানের দোতলায়। দোতলা থেকে একতলায় অর্ডারের শাওয়ারমা আসে, একটা ছোট্ট লোহার লিফট বেয়ে। শাওয়ারমায় লম্বা রুটি, তার ভেতরে মাংস কুচি, আর সাদা মেয়নেস সস আর লেটুস পেঁয়াজ লেবু। অসাধারণ খেতে।
তাছাড়া ভালোবেসে ফেলেছিলাম ছোট সবজি দোকান। যেখানে প্রচুর তাজা কমলালেবু, তাজা আপেল, প্রচুর স্যালাডের উপকরণ পাওয়া যায়। আহা, স্যালাড খাওয়ার স্বর্গ এই জায়গা। কাফেটেরিয়াতে চিকেন সেদ্ধ, আর টমেটো, লেটুস, নানা ধরনের তাজা হার্বের কুচি দিয়ে স্যালাড রাখা থাকে। কিনে ওদের দিতে হয়। ওরা ফ্রেশ মেয়নেজ বা ভিনেগ্রেট সস দিয়ে সেই স্যালাড টস করে দেয়। গ্লাভস পরা হাতে, বড় বোলের মধ্যে।
স্যালাড আর হাম্মাস দিয়েই হাপুস হুপুস করে চ্যাপ্টা চৌকো গোল লম্বা রুমালের মত কতরকমের যে রুটি খেয়ে নিয়ে, লাঞ্চ শেষ করা যায়। সিরিয়ার মায়েদের সঙ্গের শিশুদের হাতেও সেই রুটি… কেউ কিনে দিয়ে গিয়েছে।
ইতিহাস কথা বলে এখানে
বেইরুট থেকে গেলাম আমরা টায়ার সমুদ্রতীরে। ওদিকেই রাষ্ট্রসঙ্ঘের শান্তিরক্ষা বাহিনী আজও আছে। ইজরায়েল বর্ডারের দিক কিনা ওটা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর থেকেও প্রচুর লোক প্রতিবছর আসছে এইখানে চাকরি করতে। বড় সড় জনবসতিও তাই এখানেই, কাছাকাছি।
টায়ার আসলে নয়, আসল উচ্চারণ ত্যীর। রোমান অক্ষরে বানান TYRE…
ভারতসমুদ্রের তীরে
কিংবা ভূমধ্যসাগরের কিনারে
অথবা টায়ার সিন্ধুর পারে
আজ নেই, কোনও এক নগরী ছিল একদিন,
কোনও এক প্রাসাদ ছিল
মূল্যবান আসবাবে ভরা এক প্রাসাদ
পারস্য গালিচা, কাশ্মিরী শাল, বেরিন তরঙ্গের নিটোল মুক্তা প্রবাল…”–জীবনানন্দ দাশ
এই সেই টায়ার বা ত্যীর। স্থানীয় নাম স্যুর। পথে পথে বিশাল করে লেখা আই লাভ স্যুর।
লেবানন একটা সরু লম্বাটে জিনিস। পড়ে আছে ভূমধ্যসাগর বরাবর। এবার ভূমধ্যসাগরের তীর ধরে লম্বা লম্বা হাইওয়ে চলে গেছে। আমরা গেলাম সাউথ অফ লেবানন, রাস্তা এতটাই ভাল যে দেড় দু ঘণ্টায় আরামসে পৌঁছে গেলাম।
আমরা যে সময়ে লেবাননে এসেছি রোজ বৃষ্টি। কোনও থামা নেই। বিশেষত শনি রবিবারে আরও বেশি বৃষ্টি পড়ছে। এমনি সমুদ্রের ধারে যে অতি উন্নত একটা স্ট্র্যান্ড বানানো আছে সেখানে হাঁটতে শুরু করেই বৃষ্টি শুরু হল। তারপর একটা ছোট রেস্তোরাঁয় ঢুকতেই শুনি সেই ছোট্টবেলায় শোনা ফেইরুজের আরবি প্রেমসঙ্গীত হচ্ছে। কী ভাল যে লাগল। গলা কাঁপানো সুরেলা ফেইরুজ। আরবের নাইটিঙ্গেল চল্লিশের দশকের। আমরা তাঁকে ষাটের দশকে শুনেছিলাম। এখনও বেইরুট তাঁর এসব গানে মগ্ন আছে, বোঝাই গেল। রেস্তোরাঁয় তাঁর গান বেজেই চলেছে।
যাহোক, ত্যীরের কথা বলি। এ এক প্রাচীন শহর, বা শহরের ধ্বংসাবশেষ। অসামান্য সুন্দর। বেইরুট থেকে ৮৩ কিলোমিটার দক্ষিণে।
প্রথমে বৃষ্টিতে আবার বিরক্ত হয়ে, তারপর আবার রোদ্দুর ওঠার পর দুরন্ত সুন্দর গ্রিক স্তম্ভ ও রুইনস, ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট দেখলাম। টায়ার আসলে সমুদ্রতীরের ফিনিশিয়ান শহর। অনেক ব্যবসা বাণিজ্যে নাম ছিল ফিনিশীয়দের। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে হেরোডোটাস গিয়ে দেখেছিলেন এ শহর একেবারে জমজমাট, অনেক বাড়ি ঘর দোর।
এখন সেসব নেই। কিছু কিছু জায়গায় ভাঙা স্তূপে পাথর আছে। আর আছে এই যে খণ্ডহর, বলা হয় এটা গ্রিকদের, আরও বিশেষ করে বললে, আলেকজান্দারের বানানো। গ্রিকরা দখল করে এ শহর, পরে রোমানরাও। কত হাজার বছরের ইতিহাস, ভাবা যায়?
এখনও ডিজাইনগুলো অক্ষত, ভাঙা স্তম্ভ পড়ে গেছে কয়েকটা, বাকিরা এক ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। পুরোটাই জ্যামিতির খেলা। সেই যুগ থেকে রয়ে গেছে হাঁটার পথ। যা নাকি বুনে দেওয়া হয়েছে টালির নকশায়। ছোট ছোট পাথরের টালি বসানো অসাধারণ সব জ্যামিতিক প্যাটার্নের ডিজাইন করা।
চমৎকার দৃশ্য। পেছনে সবুজ সমুদ্র, সামনে লাইন দিয়ে করিন্থিয়ান স্তম্ভ।
তারপর সাইদাতেও রোদ ছিল। সুন্দর ক্রুসেডারদের ভাঙা দুর্গ দেখলাম। একেবারে জলের মাঝখান থেকে উঠে গেছে। সরু পাথুরে পথ গেছে স্থলপথে যোগাযোগ স্থাপন করে। বাকিটা সমুদ্রের কোলে। অদ্ভুত সেই সৌন্দর্য। হলদে পাথর আর নীল সবুজ ভূমধ্যসাগর মিলিয়ে এক আশ্চর্য রঙের খেলা বইকি।
লেবানন হল ফলের বাগিচার জন্য বিখ্যাত। ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা আঙুর আর লেবু কমলালেবুর বাগিচায় ভরা। ৮৩ কিলোমিটার পথের আশি কিলোমিটারই হয়ত বা ওরকম সুন্দর বাগানে বাগানে ঘেরা। মানুষ এখানে প্রচণ্ড পরিমাণে ফল খায়। ফল আর স্যালাডের ওপরেই বেঁচে থাকে এরা। ভাজাভুজি খাওয়ার চল প্রায় নেইই বলা চলে।
রাস্তায় কমলালেবুর অর্চার্ডের পর অর্চার্ড দেখা গেল। সব কিছুর পর চারশো টাকায় প্রায় চারশোটা কমলালেবু কেনা হল।
এ বেইরুটের মধ্যে আছে আরেকটা বেইরুট
আমাদের রাস্তাটার নাম মার মিখায়েল। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে মার মিখায়েল বলতেই আরবিতে তিনি খ্যাঁশ খ্যাঁশ করে কী যেন বললেন, তারপর আঙুল দিয়ে দুহাজার টাকা করে লাগবে জানালেন। মানে আমাদের দেশের টাকায় সত্তর টাকা। অঙ্ক কষার ভার আমার কলিগ ফয়জানের। বিহারের মুসলিম, টুটাফুটা আরবি বলার চেষ্টা সে সচরাচর করে থাকে এখানে। আমরা ট্যাক্সিতে উঠলাম। ফয়জান পকেট থেকে গুণে গুণে টাকা বার করছে।
চলছি, চলছি। কী দারুণ রাস্তা চলে গেছে সমুদ্রের পাশ দিয়ে।
কিন্তু এ কোন রাস্তা দিয়ে চলেছি আমরা? যে সময়ে রোজ পৌঁছই, তার দ্বিগুণ সময় কেটে গেল, এখনও তো একটাও চেনা মোড়, চেনা রাস্তা চোখে পড়ল না। আমাদের মার মিখায়েল রাস্তাটা তো নয়ই, তার আশেপাশের কোনো মোড়ই আসছে না। আমার বুক ঢিপ ঢিপ করছে। ফয়জান চুপচাপ আপনমনে ড্রাইভারের পাশে বসে দৃশ্য দেখে চলেছে।
চিঁ চিঁ করে বল্লাম, আমরা কোথা দিয়ে যাচ্ছি?
ফয়জান হেসে বলল, ওই দেখুন ম্যাডাম, বাঁদিকে একটা সাবানের দোকান। ও হরি, সত্যি ওখানে লেখা রোমান হরফে, shaban al… কী কী যেন। তারপরেই জামাকাপড়ের দোকানে লেখা jama….
জামা, সাবান, এসব আরবি শব্দ থেকে বাংলায় এসেছে, জানতাম বটে! আক্কেল, আহাম্মক, উকিল, কাগজ, পোলাও, সামোসা… এসব শব্দও আরবি আর ফারসিতে মূলে ছিল।
কিন্তু এবার আমার সত্যি খুব অদ্ভুত লাগছে। আমরা যেটা দিয়ে হাঁটি, আমরা যে পাড়ায় ঘুরিফিরি, সেগুলো সব দিব্যি স্পষ্ট স্ট্রেইট রাস্তা। এ রাস্তাগুলো প্যাঁচালো, খুব ভিড়, আর ভীষণ নোংরা। আবার ভয়ে ভয়ে বললাম কিন্তু এই এলাকায় তো আগে আসিনি কখনও। এটা কোথায়?
আরে অন্য রাস্তা দিয়ে মার মিখায়েল যাচ্ছি, বোধহয়। ফয়জান কুল। এখনও।
তা বটে। একটা শহরে কি শুধু একটাই রাস্তা থাকে? কত বড় শহর বেইরুট, মাত্র দেড় ডলারের বিনিময়ে এই ড্রাইভার দাদু আমাদের বেইরুট দর্শন করিয়ে দিচ্ছে।
আমি শান্ত হয়ে বসে দেখতে লাগলাম। আমাদের গড়িয়াহাট, বা এসপ্ল্যানেডের মত ভিড় গিজগিজে দোকান হাট বাজার। কত ভাল ভাল জামা ঝুলছে, বাচ্চাদের খেলনা। মায়েরা ছোট ছেলের হাত ধরে যাচ্ছে। মাথায় ফিতের ফুল করা বাচ্চা মেয়ে আছে। আবার মাথা ঢাকা, হিজাব পরিহিত মহিলাও অনেক। আরবি এলাকা এটা, ফয়জান যেন বিশ্বরূপ দর্শন করে ফেলেছে এমত আনন্দে ফুট কাটল। হ্যাঁ আমরা যেখানে থাকি সেটা ঠিক এরকম নয়। হয়ত খ্রিস্টান বেশি সেখানে, তাই লোকজন বেশি মার্কিনিদের মত। পাশ্চাত্যের পোশাক পরিহিত।
আরও পনেরো মিনিট পর একটা সুবিশাল চক-এর মত জায়গায় এল ট্যাক্সি। ড্রাইভার দাদু ঘোঁত ঘোঁত করে উঠল। মার মিখায়েল, মার মিখায়েল।
এ আবার কী! এত বড় রাস্তা ত মার মিখায়েল নয়।
তবে? আমরা অন্য কোনও মার মিখায়েলের এসে পড়লাম নাকি। ভূতুড়ে ব্যাপার।
আরবি আমরা জানি না। দাদুও অন্য ভাষা জানে না। গাইঁগুঁই করতে প্রচণ্ড রেগে ঝগড়া করতে লাগল দাদু। দুর্বোধ্য ভাষায় কী বলল বোঝা না গেলেও, তার হাবভাবেই বোঝা গেল সে অতি বিরক্ত। অনেকক্ষণ ধরে সে মার মিখায়েল দিয়ে যাচ্ছে আমরা নামার নামটি করছি না। তাই সে আমাদের এখানেই নামিয়ে দেবে। ঘ্যাঁশ করে গাড়ি থামিয়ে দিয়ে দাদু এক অচেনা জায়গায় আমাদের তিনজনকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। তিন ইন্টু দু হাজার পাউন্ডের সঙ্গে আরও এক হাজার পাউন্ড জবরদস্তি করে নিয়ে চলে গেল। ভুরু কুঁচকে, বকে ঝকে একাকার হয়ে।
এবার শুরু হল আমাদের অ্যাডভেঞ্চার। এতদিনে জানলাম বেইরুটের পথচারীদের মধ্যে নব্বই শতাংশ লোক ইংরেজির অ জানে না। আরবি ছাড়া কিছুই বলে না। শেষে এক বিশাল বালির বস্তা সাজানো ব্যারিকেডের কাছাকাছি পৌঁছে থামলাম। এক সাহেব সাহেব দেখতে সেনাবাহিনীর পোশাকের লোক হাতে মেশিনগান নিয়ে দাঁড়িয়ে।
কাছাকাছি যেতে এমনিতে আমি তো সাহস পেতামই না। ফয়জানেরও দেখলাম মুখ শুকনো। এগিয়ে গিয়ে ইংরেজিতে জিগ্যেস করল, মার মিখায়েল কোথায়?
টুটাফাটা ইংরেজি বলেন ওই সাহেব। বললেন, এটাই ত মার মিখায়েল। ওই ত বিখ্যাত মার মিখায়েল গির্জে!!!
এইবার বোঝা গেল, এটা হল মার মিখায়েল গির্জের গায়ে মার মিখায়েল চক। আর আমরা থাকি মার মিখায়েল রাস্তায়।
সেটা ফয়জান অনেক কসরত করে তাঁকে বোঝাল। তিনি তখন দু চোখ কপালে তুলে দুবার দোমাজ! দোমাজ! বলে উঠলেন।
ভাগ্যিস ফরাসি জানি সামান্য, বুঝলাম, ফরাসিতে বলছে ঘোর বিপদ।
আমার অনভ্যস্ত ফরাসি আর সেনাবাহিনীর ছোপছাপ দেওয়া ইউনিফর্মের সাদাচামড়ার যুবকের ফাটাফুটো ইংরেজি, মিলেমিশে বোঝা গেল, আমাদের আবার ট্যাক্সি নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কারণ আমাদের মার মিখায়েলটা শহরের অন্যপ্রান্তে।
এবার চলল ইংরেজি জানা ট্যাক্সি ড্রাইভারের খোঁজ। অনেককেই ‘স্পিক ইংলিশ?’ বলে বলে ছেড়ে দিতে হল তাঁরা হাঁ হাঁ করে না না বলায়। শেষমেশ একজন হাসি মুখে বললেন ইউ ইন্ডিয়ানস? ইউ ফরেনার? ওকে ওকে কামান কামান।
উঠে বসার পর যুবক ড্রাইভার সোৎসাহে এক গাদা কথা বলে গেলেন। তাঁর নাকি ইন্ডিয়ান ভারি পছন্দ। ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়ার কথা তিনি পড়েছেন, জানেন। যাক, আমাদের আর কোনও চিন্তা নেই, শুধু সঠিক মার মিখায়েলে পৌঁছুতে পারলেই হয়।
ঘণ্টাখানেক এ গলি ও গলি দিয়ে ঘুরে শেষে চেনা চেনা ঘরবাড়ি, রাস্তার মোড় দেখা গেল। আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। নামার সময়ে এই ট্যাক্সি ড্রাইভারকে অনেক থ্যাঙ্কু বলে, আরও হাজার দশেক পাউন্ড দিয়ে বেরোলাম।
আজকের এই মিসহ্যাপটা না হলে আমাদের জানাই হত না বেইরুট শহরটা অ্যাত্ত বড়। একটা মুম্বই, বা একটা দিল্লি (পুরনো দিল্লি নতুন দিল্লি মিলিয়ে) বা একখানা কলকাতাও কি এরকমই বর্ণময়, মাথাগুলিয়ে দেওয়া, তেতোমিষ্টি নয়?
এই নীলচে ছোপছাপ দেওয়া পোশাকের পুলিশটা বোধহয় অন্য দেশের। হয়ত ইউরোপের কোন ফরাসিভাষী প্রজাতির লোক। বলা যায় না, হয়ত আলজিরিয়ার শ্বেতাঙ্গ। বিপুলা এ পৃথিবীর সন্তান হাজার হোক। যেমন আমরা।
আশি সাল নাগাদ বেইরুটে বড় গৃহযুদ্ধ হয়েছিল। এখনও সেনাবাহিনী, যাদের দেখলাম, তারা শান্তিরক্ষার জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকে মোতায়েন করা সেনা। ইজরায়েলের সঙ্গে প্যালেস্টাইনের ঝগড়া যতদিন, সেই থেকে লেবাননেও এসে পড়েছিল অনেক প্যালেস্টিনি। কিছু কিছু এলাকা প্যালেস্টাইনের রিফিউজিদের দখলে এখনও। খুব বিপজ্জনক সেসব এলাকা, আজও, ওয়ালড সিটির মত এও আরেক। এবং মোড়ে মোড়ে সুরক্ষা।
এসব বিষয়ে ফয়জানই আমাদের টিমের ফেলুদা। মনে পড়ল ফয়জানই বলেছিল, ইয়াসের আরাফাত সাতের দশকে লেবাননে অধিষ্ঠান হয়েছিলেন। কে আরাফাত মনে আছে আশা করি, পিএলও, মানে প্যালেস্টিনিয়ান লিবারেশন অর্গ্যানাইজেশনের মাথা, ৯৪ থেকে ২০০৪ অব্দি ছিলেন প্যালেস্টিনিয়ান ন্যাশনাল অথরিটির প্রেসিডেন্ট। সাত দশকে বেইরুটে বসে প্যালেস্টিনীয় কার্যক্রম চালিয়ে লেবাননের গৃহযুদ্ধের অন্দরমহলে তিনি দিব্য প্রবেশ করেছিলেন। ফলে লেবানন হয়েছিল ইজরায়েলের টার্গেট। ৭৮ ও ৮২-তে দু দুবার ইজরায়েল ইনভেশন চালায় লেবাননে। যুদ্ধ শেষ হবার পরও বেইরুটের কিছু অংশ দাগিয়ে দেওয়া আছে প্যালেস্টিনীয় রিফিউজিদের জন্য। প্যালেস্টিনীয়দের আদিগন্ত উচ্ছিন্নতার গল্পটা পুরো আবার মনে করিয়ে দিল সে।
ওই জানাল, আজ আমরা সেরকম কিছু প্যালেস্টিনীয় এলাকা দিয়েই ঘুরে এলাম, সম্পূর্ণ পরিকল্পনাহীনভাবে।
রাস্তা না হারালে এই বেইরুটকে চেনাই হত না।
খুব সুন্দর লেখা। এই যুদ্ধবিদ্ধস্ত, জনযুদ্ধে বিপর্যস্ত এই শহর যে আবার ধীরে ধীরে তার প্রাক্তন রূপটি ফিরে পাচ্ছে, এ সন্দেশ ভরসা যোগায়। ওই টায়ার নগরীর অখ্যানে (অশিক্ষিত বঙ্গ সন্তান, এই ভুল উচ্চারণ ভুলতে পারলাম না!) রক্ত ক্লেশ নয়, কেবল রোমহর্ষ সঞ্চিত হল।
বিশ্ব পরিব্রাজক এই লেখককে ধন্যবাদ, এইসব অজানা না দ্যাখা পৃথিবীর অচেনা স্বাদগন্ধ এ লেখাটি না পড়লে অনেকটাই অচেনা থেকে যেত।
হাতের তীর একবার বেরিয়ে গেলে আর প্রত্যাবর্তন করেনা! ‘অখ্যানে’ জাতীয় অনভিপ্রেত চ্যুতি তাই আর সংশোধিত হলনা। মার্জনা প্রত্যাশী।