শতাব্দী দাশ
গত এপ্রিলে ‘দ্য ওয়্যার’ (The Wire)-এর চার মিনিটের একটা ভিডিও দেখেছিলাম ৷ ২০১৮ সালের এপ্রিলে অনেক নাটকের পর ধরা পড়েছিল উত্তর প্রদেশের উন্নাও-এর বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সিং সেঙ্গার। ভিডিওটি ঠিক তার একবছর পর, ২০১৯ সালের এপ্রিলে তোলা।
স্মৃতি হাতড়ালে পাঠকের মনে পড়বে, উন্নাও যখন খবরের পাতায় এসেছিল, তার প্রায় সমসময়েই হৈ চৈ পড়েছিল কাঠুয়াতে হিন্দু মন্দিরে আট বছরের মুসলিম বালিকার ধর্ষণ নিয়ে। প্রতিবাদ-সভা, বিক্ষোভ-সমাবেশ বা মিছিলের স্লোগানে একসঙ্গেই উচ্চারিত হত কাঠুয়া-উন্নাও-বাদাউনের নাম। কাঠুয়ার ঘটনার পরতে পরতে যেহেতু রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক ঘাত-প্রতিঘাত অনেক বেশি, তাই তা অন্য ঘটনাগুলোর থেকে কিছু বেশিই জন-মনোযোগ কেড়েছিল। উন্নাও-এর কিশোরীকে আরও দশজন ধর্ষিতার সঙ্গে বিস্মৃতিতে ঠেলে দিতেই পারতাম আমরা, যদি না মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বাড়ির সামনে গিয়ে সে নিজের গায়ে আগুন ধরাত। ধর্ষণ। পুনঃধর্ষণ। পরিবারকে হেনস্থা। বাবাকে অস্ত্র আইনে গ্রেফতার ও পিটিয়ে মেরে ফেলা৷ মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে আত্মহত্যার চেষ্টা৷ কতটা পথ পেরোলে তবে খবর হওয়া যায়? মনোযোগ কাড়া যায়?
ভিডিওটির কথায় ফিরি। দড়ির খাটিয়ায় বসেছিলেন ধর্ষিতার মা, বড় বোন। মা বলছিলেন, মেয়ের বাবা মারা গেলেন এক বছর হল। এখনও কোনও কেসেরই সুরাহা হল না৷ ধর্ষণের কেসের না। পিটিয়ে মারার কেসেরও না৷ কোনও মন্ত্রী-সাংসদ-বিধায়ক দেখা করেননি। বরং গ্রামের লোকেরাও একঘরে করেছে। সেঙ্গারের সঙ্গে বিবাদে যাবে, এত স্পর্ধা কার? সেঙ্গার আর তার ভাইরা জেলে, তবু বাইরে তাদের প্রতিপত্তি যথেষ্ট। কুলদীপ সিং সেঙ্গার পোড়খাওয়া নেতা। বহুজন সমাজ পার্টি, সমাজবাদী পার্টির ঘাটে ঘাটে জল খাওয়ার পর তার বিজেপিতে যোগদান। চারবারের বিধায়ক। স্থানীয় প্রশাসনকে সে পকেটে রাখে, জেলে বাস করা সত্ত্বেও।
এদিকে কিশোরীর কাকাকেও ততদিনে জেলে পুরেছে ‘ওরা’। কিশোরীর দিদি বলেছিল, ‘চাচা হি তো ফেসবুকমে সারে খবর আপডেট করতে থে। ইসি লিয়ে…।’ কাকার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল কাউকে হত্যার চেষ্টা করার। যে ঘটনার জেরে সেই অভিযোগ, সে ঘটনা আট বছরের পুরোনো। কিশোরীর দিদির মতে, ‘চাচা বিলকুল নির্দোষ হ্যায়। ফির ভি উনকে ভকিল উনহে বাহার হি আনে নহি দেতে।’ পুলিশি হানা, হুমকি, বাড়ির পুরুষদের তুলে নিয়ে যাওয়া, এসব গা সওয়া হয়ে গেছে পরিবারটির। সেই মুহূর্তে মূল সমস্যা ছিল খিদে। দারিদ্র্য। দু-দুজন উপার্জনশীল পুরুষ— এক বছরের মধ্যে একজন মৃত, অপরজন জেলে। বাড়িতে শুধু মহিলা ও শিশুরা।
দুবেলার রুটি জোটে কোনওমতে। সবজি কদাচিৎ৷ বাড়ির ছাত ঝড়জলে ধ্বস্ত। ‘বচ্চে পঢ় যায়ে তো বহত মেহেরবানি হোগি, দিদি।’ সাংবাদিককে বলছিলেন ঘোমটা টানা ধর্ষিতার মা। বাচ্চারা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারলেই তিনি কৃতার্থ বোধ করবেন। অদূরে ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে ছিলেন আরেকজন। জেল খাটছেন যে কাকা, তাঁর স্ত্রী। সেই কাকিমা, যিনি এখন ‘গাড়ি দুর্ঘটনায়’ নিহত। আর অন্তরালে ছিল সেই মেয়ে। যাকে দেখা যায় না, কিন্তু যার দীর্ঘশ্বাস অনুভব করা যায়৷ যার আঠারো-উনিশ বছরের ‘ঘটনাবহুল’ জীবনের এক-একটা অধ্যায় আমাদের ভীষণ ভয় পাইয়ে দেয়। হতাশ করে৷
উন্নাও-এর সেই পরিবার একটি ‘পথ দুর্ঘটনা’-র জেরে আবার প্রথম পাতা পেয়েছিল ২০১৯ সালের জুলাই-এর শেষ দু-তিন দিন। তারপরেই অমরনাথ থেকে তীর্থযাত্রী ফিরিয়ে আনা, কাশ্মিরে লক্ষাধিক সৈন্য পাঠানো, ৩৭০ ধারার বদল, ৩৫ক বিলোপ, ভূস্বর্গ অধিগ্রহণ ইত্যাদি ঘটনার জেরে সে খবর ফের ধামাচাপা পড়ে গেল। দেশের রাজনৈতিক ভাষ্য সুচতুরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে কেন্দ্রে আসীন দলটি। কাশ্মির নিয়ে আলোচনার ঢেউয়ে মেডিক্যাল বিল, ট্রান্সজেন্ডার বিল, বিএসএনএল, রেলের বেসরকারিকরণের মতো উন্নাও-এর কথাও ডুবে যায়, ভেসে ওঠে, ফের ডুবে যায়।
************
টীকা-টিপ্পনি ছাড়া উন্নাও ঘটনাক্রম একবার ফিরে দেখা যাক৷ ২০১৭ সালের ৪ জুন সতেরো বছরের এক বালিকাকে এলাকার প্রভাবশালী বিধায়কের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়, কাজ দেওয়ার অছিলায়। নিয়ে গেছিল শশী সিং নামে এক মহিলা। মেয়েটির বর্ণনা অনুয়ায়ী পিছনের গেট দিয়ে ঢুকেছিল তারা। তারপর বিধায়কের ভাই-এর সঙ্গে দেখা হয়। তার সঙ্গে মেয়েটিকে যেতে নির্দেশ দেন শশী সিং। ভাই মেয়েটিকে নিয়ে যায় দাদার কাছে। দাদা অতঃপর বালিকাকে নির্মমভাবে ধর্ষণ করে।
মেয়েটি ঠিক এর এক সপ্তাহের মাথায় নিখোঁজ হয়ে যায়৷ সে জানিয়েছে, শশী, তার ছেলে শুভম ও মেয়ে নিধি তাকে আবার কাজ দেওয়ার নাম করে কানপুর শহরে নিয়ে যায়। মেয়েটি শশীকে কেন দ্বিতীয়বার বিশ্বাস করল, আমরা জানি না। গ্রামে অসম্মানিত হওয়ার পর সে কি লোকলজ্জার ভয়ে শহরে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল?
সেখানে ১১ জুন মেয়েটি আবার ধর্ষিত হয় শুভম ও তার ড্রাইভার আওধেশের দ্বারা৷ তারপর ৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে তাকে বেচে দেওয়া হয় ব্রজেশ যাদব নামক এক ব্যক্তির কাছে। ব্রজেশ নিজে তো তাকে ধর্ষণ করেই, আরও ঠিক কতজন এবং কে কে তাকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করতে থাকে, তা সে আর মনে করতে পারে না৷ এদিকে মেয়েটির বাবা মেয়ে নিখোঁজ হওয়ায় থানায় রিপোর্ট করেন। মেয়েটিকে আউরাইয়া জেলা থেকে উদ্ধার করে পুলিশ ২১ জুন তারিখে। দেখা যাচ্ছে, ২০ জুন এফআইআর করা হয়েছে শুভম সিং আর আওধেশ তিওয়ারির নামে। তাদের ধারা ৩৬৬ ও ধারা ৩৬৩ দেওয়া হয়েছে। এগুলি অপহরণের ধারা। অর্থাৎ মেয়ে যে এদের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েই বিপদে পড়েছে, তেমনটা আঁচ করেছিল পরিবার।
২২ জুন মেয়ে স্বয়ং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নিজের বয়ান রেকর্ড করে কোড অফ ক্রিমিনাল প্রসিডিওরের ১৬৪ ধারা অনুসারে৷ সে শুভম, আওধেশ ও ব্রজেশকে অপহরণ ও গণধর্ষণে অভিযুক্ত করে। পক্সো (POCSO)-তে আবার দ্বিতীয় এফআইআর দায়ের হয় এদের বিরুদ্ধে। সকলেই জেলে যায়।
কিন্তু এরপরেও মেয়েটি ১৭ই আগস্ট, ২০১৭-তে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে চিঠি লেখে একটি। সেখানে সে বলে, শুভম-আওধেশরা নয়, তাকে প্রথমবার ধর্ষণ করে উন্নাও-এর বিধায়ক, কুলদীপ সিং সেঙ্গার। ২২ জুলাই সে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যে বয়ান রেকর্ড করেছে, সেখানে সে বিধায়কের নাম বলতে পারেনি। কারণ বিধায়কের নাম বলা যাবে না— এই মর্মে আগে থেকেই শাসিয়ে রেখেছিল পুলিশ।
২০১৮ সালের ৫ এপ্রিল। বিধায়কের ভাই অতুল সেঙ্গার সহ তার দলের পাঁচজন এসে পিটিয়ে যায় মেয়ের বাবাকে। তারপরেই অস্ত্র আইনে গ্রেফতার হন তিনি৷ এখানে উল্লেখ্য, উভয় পরিবারই ২০১৭ সাল থেকে একে অপরের বিরুদ্ধে একাধিক এফআইআর, ডায়রি ইত্যাদি করেছিল৷ কিন্তু পুলিশ মেয়েটির বাবার উপরেই খড়্গহস্ত হয়, সেঙ্গার-পক্ষের অভিযোগকে কেন্দ্র করেই অতিতৎপরতা দেখায়।
জুডিশিয়াল কাস্টডিতে মেয়ের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন, সম্ভবত অতুল সেঙ্গার ও তার বাহিনীর মারধোরের জেরেই। জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে৷ মেডিকাল টেস্ট নিশ্চিত করে, শরীরে একাধিক চোট আঘাতের চিহ্ন বর্তমান। ৮ এপ্রিল, ২০১৮। মেয়েটি লখনৌতে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে নিজের শরীরে অগ্নিসংযোগ করতে যায়। ৯ এপ্রিল। মারা যায় মেয়েটির বাবা।
মিডিয়া রিপোর্টের ভিত্তিতে শ্যুও মোটো কেস করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। উত্তরপ্রদেশ সরকারকে বলা হয়, এই কেসের বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করতে। ১২ এপ্রিল। এলাহাবাদ কোর্ট উত্তরপ্রদেশ সরকারকে ভর্ৎসনা করে সেঙ্গারকে ধরতে দেরি হচ্ছে দেখে। মহামান্য আদালত বলেন, এতে প্রমাণিত হয় রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে।
একই দিনে সিবিআই তিন-তিনটি এফআইআর দায়ের করে ২০১৭ সালের ধর্ষণ ও ধর্ষিতার বাবার মৃত্যু নিয়ে। প্রথমটি কুলদীপ সিং সেঙ্গার ও শশী সিং-এর বিরুদ্ধে। দ্বিতীয়টি সেঙ্গারের শাগরেদ বিনীত, বাউয়া, শাইলু, সোনুর বিরুদ্ধে। তৃতীয়টি বিধায়কের ভাই অতুলের বিরুদ্ধে৷ ১৩ই এপ্রিল সেঙ্গার ও ধর্ষিতার পরিবারকে আলাদা আলাদা ভাবে জেরা করে সিবিআই৷ ২০১৮ সালের জুলাই মাসে মেয়েটির বাবার হত্যার দায়ে চার্জশিট জমা পড়ে অতুল সহ পাঁচজনের নামে।
ওদিকে ডিসেম্বরে পালটা এফআইআর জমা পড়ে ধর্ষিতা, তার মা ও কাকার নামে। তারা নাকি মিথ্যাভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন যে মেয়েটি নাবালিকা। ৪১৯, ৪২০, ৪৬৭, ৪৬৮, ৪৭১ ইত্যাদি ধারা দেওয়া হয়, যেগুলো প্রায় প্রতিটিই প্রতারণা সংক্রান্ত।
২৮ শে জুলাই, ২০১৯। এক রহস্যজনক ‘দুর্ঘটনা’-য় গুরুতর জখম হন উন্নাও ধর্ষণের শিকার তরুণী, এখন যাঁর বয়স বছর কুড়ি। একই পথদুর্ঘটনায় নিহত হন তাঁর দুই কাকিমা-মাসিমা। আহত তরুণী এবং তাঁর উকিলকে গুরুতর আহত অবস্থায় লখনৌয়ের কিং জর্জেস মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির ট্রমা কেয়ার সেন্টারে ভর্তি করা হয়। জানা যাচ্ছে, রায়বরেলি জেলার গুরুবক্সগঞ্জ এলাকায় তাঁদের গাড়ির সঙ্গে সরাসরি ধাক্কা লাগে একটি ফাঁকা ট্রাকের। ট্রাকের নাম্বারপ্লেটে কালো কালি লেপা ছিল৷
তরুণী ও তাঁর পরিবার উকিলকে সঙ্গে নিয়ে রায়বরেলির জেলা কারাগারে যাচ্ছিলেন কাকার সঙ্গে দেখা করতে, সেই যাঁকে গত বছর ‘খুনের চেষ্টা’-র মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তরুণীর পরিবার একে ‘পরিকল্পিত আক্রমণ’ বলে অভিযোগ করেন। এই সূত্রে আরও উল্লেখযোগ্য, ধর্ষণের ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষ সাক্ষী যাঁকে ভাবা হচ্ছিল, সেই ব্যক্তিও ইতোমধ্যে কী করে যেন খুন হয়ে যান।
পুরো ঘটনাক্রম এক আশ্চর্য অসহায়ত্বের সামনে দাঁড় করায় আমাদের। একদিকে, নির্যাতিতা, ধর্ষিতা একজন ভারতীয় তরুণী শুধু ন্যায় চেয়ে একে একে হারালেন বাবাকে, আত্মীয়দের। তাঁর নিজের জীবনও আজ সঙ্কটে। অন্যদিকে, লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী হিসেবে জয়লাভের পর সেঙ্গারের সঙ্গে জেলে গিয়ে দেখা করেন নির্বাচিত সাংসদ সাক্ষী মহারাজ। অসহায় বোধ না করে উপায় কী? প্রশ্ন উঠছে, ধর্ষিতা হলে তবে কেউ ন্যায় চাইবেন, না বাঁচতে চাইবেন? দুটোর মধ্যে একটাকে বেছে নিতে হবে?
উল্লিখিত ‘দুর্ঘটনা’টির পর সারা দেশে আলোড়ন উঠলে বিজেপি চক্ষুলজ্জার খাতিরে বহিষ্কার করে সেঙ্গারকে। জানা গেছে, উন্নাও-এর পরিবারটি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈকেও একটি চিঠি লিখেছিলেন, যে চিঠির কথা গগৈ জানতে পারেন দুর্ঘটনার পর। বক্তব্য ছিল একই: সেঙ্গারের অনুচরদের থেকে তাঁরা দিবারাত্র হুমকি পাচ্ছেন।
অতঃপর গগৈ ও তাঁর বেঞ্চ এই ঘটনা সংক্রান্ত পাঁচটি কেসের স্থানান্তর ঘটান দিল্লিতে,পশ্চিম ডিস্ট্রিক্ট ও সেশন কোর্ট বা টিস হাজারি কোর্টে। পরিবারটির নিরাপত্তা রক্ষার বিধানও দেন প্রধান বিচারপতি। অন্তর্বর্তীকালীন ক্ষতিপূরণ হিসেবে উত্তরপ্রদেশ সরকারকে পঁচিশ লাখ টাকা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মেয়েটির কাকাকে এক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী বিবেচনা করে রায়বরেলি জেল থেকে তিহার জেলে আনার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। টিস হাজরার কোর্ট-এ সিবিআই জানিয়েছে, কুলদীপ সেঙ্গার যে ধর্ষণ করেছে এবং শশী যে তাকে সাহায্য করেছে, এ ব্যাপারে তারা নিশ্চিত। অন্যদিকে মেয়েটির স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকায় তাকে গ্রিন করিডোর তৈরি করে মাত্র তিন ঘণ্টায় লখনৌ থেকে নিয়ে আসা হয়েছে দিল্লির এইমস হাসপাতালে। যোগী আদিত্যনাথের বাড়ির সামনের রাস্তাটি দিয়েই অ্যাম্বুলেন্স হুটার বাজিয়ে নিয়ে আসে মেয়েটিকে।
সেঙ্গার সহ নয়জনকে এই খেপে খুনের চার্জ দেওয়া হয়েছে। ডিস্ট্রিক্ট জাজ ধর্মেশ সিং দিল্লিতে মেয়েটির পরিবারবর্গের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা সংক্রান্ত ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত রিপোর্টও তলব করেছেন সিবিআই-এর কাছে। বলা হচ্ছে, বিচার শেষ হবে নাকি পঁয়তাল্লিশ দিনের মধ্যে। অর্থাৎ এই খেপে বিচার-বিভাগ মেয়েটি ও তার পরিবারের প্রতি সহানুভূতিশীল ও দায়িত্বশীল। কিন্তু যে পথ পেরিয়ে এই সহানুভূতি ও সচেতনতা একটি মেয়েকে আদায় করতে হল, তা স্বস্তি দেয় না। আবারও ভয়, শুধু ভয় জাগায়।
**********
উন্নাও নিয়ে যখনই আলোচনা হচ্ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে, ফেসবুক বা চায়ের ঠেকে, অনেকেই বলছেন, ‘যেন হিন্দি সিনেমা! এমনও বাস্তবে হয়!’ ঘটনার ঘনঘটা, খলনায়কের ক্রূরতা ও প্রতিশোধস্পৃহায় অনেকেই পাচ্ছেন সুলিখিত একটি বলিউডি চিত্রনাট্যের আভাস৷
আসলে বলিউডসুলভ অতিরঞ্জিত প্রকাশভঙ্গি সত্ত্বেও, বাণিজ্যিক ছায়াছবি বাস্তব-প্রসূতই৷ উন্নাও-এর ঘটনা আমাদের যতই বিচলিত করুক, এমন ঘটনা নতুন নয়। একমাত্র নয়। নব্বই-এর দশকে রুচিকা গিরহোত্রা নামে এক কিশোরীর সঙ্গে প্রায় একই ঘটনা ঘটেছিল৷ আমরা ভুলে গেছি।
সে ছিল উঠতি টেনিস তারকা। একাদশের ছাত্রী৷ তার পরিবার অবশ্য ছিল স্বচ্ছল। তার নির্যাতক ছিল তারই বান্ধবীর বাবা, যিনি আবার প্রভাবশালী পুলিশকর্তা৷ যৌন নির্যাতনের পর মেয়েটি কিন্তু ভেঙে পড়েনি। নালিশ জানিয়েছিল। তার পাশে ছিল তার পরিবার, বান্ধবীরা, বান্ধবীর পরিবারও। কিন্তু ফল কী হয়েছিল? প্রভাব খাটিয়ে মেয়েটিকে প্রথমে স্কুল থেকে তাড়ানো হয়৷ তার ছোট ভাইকে ফাঁসানো হয় অটো চুরির কেসে৷ মেয়েটি যেখানে যেত, কিছু লোক ছায়ার মতো অনুসরণ করত তাকে, গালিগালাজ করত। তার চরিত্র নিয়ে ছিছিকার পড়ে গেছিল চন্ডীগড় শহরে। তার পরিবার রাতদিন নানা কিসিমের হুমকি পেত। সতেরোর বালিকার স্নায়ু এত কিছু সহ্য করতে পারেনি৷ রুচিকা আত্মহত্যা করেছিল। করতে বাধ্য হয়েছিল।
রুচিকা আত্মহত্যা করেছিল৷ উন্নাও-এর কিশোরী মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে দিল্লির এইমসের কোনও আইটিইউ-তে। ডাক্তার দুদিন আগে বলছিলেন, নিউমোনিয়া। শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, ইন্টারোকক্কাস ফিকালিস ভাইরাস ছড়িয়েছে রক্তে। সেপ্টিসেমিয়া৷ নিত্যনতুন সংক্রমণে জর্জরিত হচ্ছে একটা বছর কুড়ির মেয়ে। ছরকম অ্যান্টিবায়োটিক ব্যর্থ হয়েছে৷
বাইশে শ্রাবণ। বিষণ্ণ বর্ষা। কবির মৃত্যুচেতনা নিয়ে দু’চার কথা হচ্ছে এদিকে ওদিকে। উত্তর প্রদেশের কোনও মেয়ে-স্কুলে সেইসময় ছাত্রী-নিরাপত্তা নিয়ে দু-চারটে গালভরা কথা শেখাতে আসা পুলিশের অ্যাডিশনাল সুপারিন্টেন্ডেন্টকে জিগ্যেস করছে এক সালোয়ার-কামিজ পরা ছাত্রী—
আমার নির্যাতক যদি জানতে পারে আমি আপনার কাছে গেছি, আর উন্নাও-এর মেয়েটির মতো আমাকে যদি মারতে আসে, তবে কী করব, স্যার?
অধোমুখ বসে আছেন পুলিশকর্তা আর এস গৌতম। সে সব সংলাপ, জিজ্ঞাসা, নতমুখ, লজ্জা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে আন্তর্জালে। আর মাথার মধ্যে হুটার বাজিয়ে অহরহ অ্যাম্বুলেন্স ছুটে যাচ্ছে বলে গভীর মৃত্যুচেতনা সম্পর্কে কিছু দার্শনিক কথা আমাদের না-বোঝা থেকে যাচ্ছে।