সোমেন বসু
রোমিলা থাপার বলেছিলেন—
…তিন নম্বর বিষয়টা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না, যদিও আমার মতন অনেকের কাছেই সেটা চরম দুশ্চিন্তার বিষয়। সেটা হল সমালোচকের কণ্ঠরোধ। সাধারণ মানুষ, শিক্ষক, আইনজীবী, কবি, লেখক—এঁদের দোষী সাব্যস্ত করে, কোনও আইনি প্রক্রিয়ার পরোয়া না করে এঁদের অপরাধের কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই জেলে ভরে দেওয়া হচ্ছে। এটা একটা দিক। এছাড়া বইয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা, সিনেমার ওপর সেন্সরশিপ। সবচেয়ে নিন্দনীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে শেষ করে ফেলবার চেষ্টা।[1]
অরুন্ধতী রায় বলেছিলেন—
আজকাল অ্যান্টি-ন্যাশনাল হিসাবে দাগিয়ে দেওয়াটা সোজা। বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে যদি ভোট না দেন, তাহলে আপনি একজন পাকিস্তানি। এই বাড়তি জনসংখ্যা নিয়ে পাকিস্তান কী ভাবছে তা আমি অবশ্য জানি না।
এবং তারপর—
এবারে ভোটের আগে যে শিক্ষক, আইনজীবী, অ্যাক্টিভিস্ট এবং লেখকদের জেলবন্দি করা হয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাঁরা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে হত্যা করতে পারেন। প্লটটি এতই খেলো যে একটি ছয় বছরের শিশু এর চেয়ে ভালো কিছু ভাবতে পারে। ফ্যাসিস্টরা ফিকশন রাইটিং কোর্সে ভর্তি হলে ভালো হয়।[2]
আশীষ লাহিড়ী লিখেছিলেন—
এই মুহূর্তে সারা দেশ জুড়ে যেসব ঘটনা ঘটছে, যাকে অঘোষিত জরুরি অবস্থা বললে অত্যুক্তি হয় না, তা পুরোপুরি এই ছক, এই প্যাটার্নের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যাঁরা আমাদের দেশে মানবাধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করছেন, যাঁরা দলিতদের অধিকার নিয়ে কথা বলছেন, আদিবাসীদের সম্পদ বহুজাতিকের হাতে তুলে দেওয়ার বিরোধিতা করছেন, তাঁদেরই মাওবাদী, আরবান নকশাল, দেশদ্রোহী ইত্যাদি তকমা দিয়ে জেলে পুরে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে। ভারভারা রাও ও অন্যান্যদের গ্রেফতার আসলে রাষ্ট্রের প্যানিক রিফ্লেক্স।[3]
এগুলি সবই বিগত সরকারের আমলের কথাবার্তা। বিগত অর্থে প্রথম নরেন্দ্র মোদি সরকার। সময় পাল্টেছে। এখন গদিতে দ্বিতীয় নরেন্দ্র মোদি সরকার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও পাল্টেছেন। রাজনাথ সিং-এর স্থলাভিষিক্ত এখন অমিত শাহ। স্বনামধন্য। অবিসংবাদীভাবেই প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই জুটি কেন্দ্রের শাসকদলের ক্যাপ্টেন-ভাইস ক্যাপ্টেন। যাঁদের সম্পর্কে কিছুদিন আগে, নির্দিষ্ট করে বললে কর্নাটকে সফল ক্যু ঘটানোর পরে, মধ্যপ্রদেশের এক বিজেপি বিধায়ক রাজ্যের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকারকে হুমকি দিয়ে বলেছেন, ক্যাপ্টেন বা ভাইস ক্যাপ্টেন ইশারা করলেই আপনাদের সরকার উলটে দেব। বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না।
যাক সে কথা। আপাতত আমরা ইউএপিএ সংশোধনী নিয়ে কথা বলব। আর তা বলতে গিয়েই উপরের উদ্ধৃতিগুলি মনে পড়ল।
হ্যাঁ, শেষ লোকসভা অধিবেশনে রেকর্ড গড়ে আরও ৩৫টি বিলের সঙ্গে ইউএপিএ সংশোধনী বিলটিও পাশ হল। মোট ৩৬টি বিল। আগেই বললাম, রেকর্ড। বোঝাই যাচ্ছে, সরকারের খুব তাড়া আছে। মনে আখতে হবে, নবনির্বাচিত সরকারের এটিই প্রথম অধিবেশন ছিল। এত তাড়ার কারণ ক্রমশ বোঝা যাবে। আপাতত আমরা আমাদের বিষয়ে ফিরে আসি।
কী ছিল, কী হল
সংশোধনীর মূল বিষয় একটিই। সেটি হল, ব্যক্তিকেও এই আইনের আওতায় নিয়ে আসা, আলাদা করে কোনও ব্যক্তির ওপরেও সন্ত্রাসবাদী তকমা প্রয়োগ করার সুযোগ করে দেওয়া। আগের ইউএপিএ আইনে কোনও দল বা সংগঠনকেই সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দেওয়া চলত। কিন্তু এখন থেকে সরকার বাহাদুরের কৃপাদৃষ্টি আপনার ওপর বর্ষিত হলে আপনিও সেই আখ্যা লাভ করতে পারেন। কেন বা কখন সেই কৃপাদৃষ্টি পড়তে পারে? সেটি বলা যাবে না। কারণ আমি সরকার বাহাদুর নই। আপনার খুব ইচ্ছে হলে আপনি উপরের উক্তিগুলি আরেকবার পড়ে আসতে পারেন।
হ্যাঁ, যদি আপনি সন্ত্রাসবাদী তকমা পেয়েই যান, তবে তা অপ্রমাণ করার দায়িত্ব কিন্তু আপনার। আপনাকেই প্রমাণ করতে হবে যে আপনি নিরীহ নির্ভেজাল। রাষ্ট্র ওসব ঝক্কিতে যাবে না। তারা মনে করেছে আপনি সন্ত্রাসবাদী, ব্যস! তারা আপনাকে শ্রীঘরে পাঠাবে, এবং আর যা যা ইতিকর্তব্য, পালন করবে। সেখান থেকে নিজেকে মুক্ত করা আপনার ব্যাপার।
এটিই মূল সংশোধনী। এর সঙ্গে ধরুন এতদিন কোনও তথাকথিত সন্দেহজনক সন্ত্রাসবাদীর বাড়ি রেইড করা বা তার সম্পত্তি ক্রোক করার মতো কাজগুলি করতে গেলে তদন্তকারী অফিসারকে রাজ্য পুলিশের ডিজিপির অনুমতি নিতে হত। কিন্তু এখন থেকে সেই তদন্তকারী অফিসার যদি এনআইএ-র অফিসার হন, তবে তাকে শুধু এনআইএ-র ডিরেক্টর জেনারেলের অনুমতি নিলেই চলবে, আর রাজ্যের ধার ধারতে হবে না; কেন্দ্র সরকার তাদের ইচ্ছা এবং প্রয়োজনমতো সন্ত্রাসবাদীদের তালিকায় যোগবিয়োগ করতে পারবে— এই জাতীয় আরও কিছু টেকনিকাল বিষয়।
এনআইএ— পাঠক অবহিত নিশ্চিত— হল কেন্দ্রের পুলিশ। মুম্বাই হামলার পর ইউপিএ সরকারের বানানো। উদ্দেশ্য সেই সন্ত্রাস দমন। তা, আজ অবধি এমন কোনও তথ্য প্রমাণ নেই যাতে বলা যায় রাজ্য পুলিশ বা কেন্দ্রের সিবিআই মিলেও এমন কোনও ঘটনার কিনারা করতে পারেনি, যা এনআইএ করে ফেলেছে। কেন বলছি এসব? কারণ, জানিয়ে রাখি, সংসদের এই রেকর্ড ব্রেকিং অধিবেশনে এনআইএ অ্যাক্ট বিলও পাশ হয়েছে। এবং তাতে এই কেন্দ্রীয় পুলিশবাহিনীর ক্ষমতা এবং এক্তিয়ার আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যথারীতি রাজ্য পুলিশের থেকে ছেঁটে।[4]
তাহলে বিপন্ন ব্যক্তির স্বাধীনতা এবং অধিকার, এককথায় যাকে মানবাধিকার বলা যেতে পারে, এবং দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। এবং পুরোটা মিলিয়ে সবচেয়ে বিপন্ন নিশ্চিতভাবেই গণতন্ত্র।
কিন্তু কাজে দেয় কতটা?
এই প্রশ্নে ঢোকার আগে প্রথমেই বলে রাখা দরকার, এই ধরনের আইনের কৃতিত্বই বলুন, আর যা-ই বলুন, সে যে শুধুই বিজেপি সরকারের এমনটা নয়। গত দু-তিন দশক ধরেই সন্ত্রাসবাদ শুধু ভারতে নয়, সারা বিশ্বের শাসকদের কাছেই বেশ একটা পছন্দের শব্দ হিসেবে উঠে এসেছে। সাধারণ মানুষের ওপর তাদের যাবতীয় দমনপীড়ন, সে অর্থনৈতিক-সামাজিক সমস্ত ক্ষেত্রেই, চালিয়ে যাওয়া হয়েছে এই তথাকথিত সন্ত্রাসবাদের জুজু দেখিয়ে। এবং সেসবকে বৈধতা দেওয়ার জন্য আইনও হয়েছে বিস্তর। সেই আইনগুলির কার্যকারিতা— কার্যকারিতা অবশ্যই তাদের ঘোষিত উদ্দেশ্য, অর্থাৎ সন্ত্রাস দমনের নিরিখে— দেখা যাক।
সঞ্জয় দত্ত-খ্যাত টাডা। পুরো নাম টেররিজম অ্যান্ড অ্যান্টি-ডিসরাপটিভ অ্যাক্টিভিটিজ (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট। লাগু ছিল এক দশকেরও বেশি। কনভিকশন রেট— অর্থাৎ যত লোককে ধরা হয়েছে তাদের মধ্যে যত লোককে প্রকৃতই দোষী সাব্যস্ত করা গেছে— ১ শতাংশ!
পোটা। প্রিভেনশন অফ টেররিজম অ্যাক্ট। ২০০২ সালে লাগু হয়েছিল। এতে নথিবদ্ধ হওয়া ৪৩৪৯টি কেস যাতে মোট ১০৩১ জনকে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে চার্জ করা হয়েছিল তার মধ্যে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন ১৩ জন![5]
থাক, যথেষ্ট হয়েছে!
তাহলে দরকার কেন?
এটাই লাখ টাকার প্রশ্ন। প্রশ্নটা আরও উঠছে এই কারণে, যে ব্যক্তিবিশেষকে সন্ত্রাসবাদী দাগানোর জন্য এই যে এত তোড়জোড়, তা কোনও ব্যক্তি যদি সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে কোনওভাবে যুক্ত বলে সরকার এর আগে এমনকি সন্দেহও করত, জারি থাকা ইউএপিএ-র বলে কি তাকে আটক করা বা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেত না? পুরোমাত্রাতেই যেত। সরকার (শুধু বিজেপি নয়) এরকম করেওছে বহু। তবে?
এই উত্তরের জন্য, হে পাঠক, যান আবার একবার উপরের উদ্ধৃতিগুলি পড়ে আসুন।
দমনমূলক পদ্ধতির সাহায্যে বিরোধী কণ্ঠস্বর মোকাবিলা করার জন্য এই সরকার যে যথেষ্ট আগ্রহী, তা এদের প্রথম দফাতেই বারে বারে দেখা গেছে। এই দফায়, আরও সংখ্যার বলে বলীয়ান হয়ে এসে, এরা প্রথম থেকেই একদম আইনি আঁটঘাট বেঁধে নিতে চাইছে।
মানবাধিকার
চলুন, শেষে একটু অসমে যাই। অপ্রাসঙ্গিক? আচ্ছা, চলুনই না!
আলতাফ পারভেজ লিখেছেন—
…১৯৪৮-এ রাষ্ট্রসঙ্ঘে গৃহীত সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের অনুচ্ছেদ ১৫ অনুযায়ী “প্রত্যেক মানুষের একটা জাতীয়তার অধিকার রয়েছে। কাউকে যথেচ্ছভাবে তার জাতীয়তা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।” বিশ্বের প্রত্যেক দেশে নিজস্ব আইনের আলোকেই মানবাধিকারের ঐ সনদের প্রতি একরূপ দায়বদ্ধতা রয়েছে। ‘নাগরিকত্ব’ বিষয়ে কোনও রাষ্ট্র এমন কোনও অভ্যন্তরীণ আইন করতে পারে না— যা মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক ঐ অগ্রগতিকে লঙ্ঘন করে। কিন্তু অসমে তার উল্টোটাই ঘটেছে।
সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের ‘অনুচ্ছেদ ১৫’-কে বিবেচনা করা হয় যেকোনও জনপদে রাষ্ট্রের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের একটা বড় নির্দেশনা হিসেবে। এই অনুচ্ছেদ ধরে নেয়, প্রত্যেকের অন্তত একটি দেশে নাগরিকত্ব থাকবে। এই বিবেচনায় কারও রাষ্ট্রবিহীন হওয়া বা কাউকে রাষ্ট্রবিহীন করা অন্তর্নিহিতভাবেই মানবাধিকারবিরোধী পদক্ষেপ। ‘নাগরিকত্ব’ বিশ্বের যেকোনও প্রান্তে যেকোনও রাষ্ট্রনৈতিক পটভূমিতেই একজন মানুষের এমন একটা মৌলিক অধিকার— যা অন্যান্য মানবাধিকার পাওয়ার প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ এও দেখায়, কাউকে যুক্তিসঙ্গত কারণে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করতে হলেও পদ্ধতিগত কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান। কিন্তু অসমে অনেকের ক্ষেত্রে তাও করা হয়নি।
…২০১৯-এর ২ জুলাই ভারতীয় লোকসভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কৃষাণ রেড্ডি জানিয়েছেন, অসমের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল ১৯৮৫ থেকে ২০১৯-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অন্তত প্রায় ৬৪ হাজার ব্যক্তিকে ‘বিদেশি’ ঘোষণা করা হয়েছে কথিত ব্যক্তিদের তরফ থেকে বক্তব্য না শুনেই। অর্থাৎ এসব ব্যক্তিকে তাদের এতদিনকার জাতীয়তা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে তাদের মতামত ছাড়াই। তাদের আপত্তি না শুনেই। ভারতীয় লোকসভায় ভয়াবহ এই তথ্য প্রকাশের আগে অসমের বিধানসভায় এটা কোনও আলোচ্য বিষয় হয়নি।[6]
বোঝা গেল, আমাদের সরকার বাহাদুর মানবাধিকারের প্রশ্নটাকে ঠিক কী চোখে দেখেন?
আন্তর্জাতিক আইনের কথা আসায় মনে পড়ে গেল এই ইউএপিএ সংশোধনের সময় অমিত শাহ আন্তর্জাতিক আইনের দোহাই পেড়ে জানিয়েছেন এই সংশোধনী আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে। সে প্রসঙ্গে অ্যমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পলিসি অ্যাডভাইসর মৃণাল শর্মা বলছেন—
সরকারের এই সংশোধনী পাশ করার সময়ে আন্তর্জাতিক আইনের দোহাই দেওয়া চরম দ্বিচারিতার লক্ষণ, কারও পুরো আইনটিই মানবাধিকারের প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সনদকে লঙ্ঘন করে। ভারতের এই প্রধান সন্ত্রাস দমন আইনটি বিভিন্ন সরকার লাগাতারভাবে যে সমস্ত মানবাধিকার কর্মীরা গরীব এবং প্রান্তিক মানুষদের জন্য কাজ করেন এবং যাঁরা সরকারের নিষ্ক্রিয়তা বা অতি-সক্রিয়তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে গেছে।[7]
আর কী!
শেষ প্রশ্ন
আর কতদিন ভারত কাগজে কলমেও গণতন্ত্র থাকবে?
[1] https://www.4numberplatform.com/?p=12948
[2] https://www.4numberplatform.com/?p=13438
[3] https://www.4numberplatform.com/?p=7402
[4] https://thewire.in/government/the-centre-wants-to-give-the-nia-more-powers-but-it-wont-explain-why
[5] https://www.firstpost.com/india/uapa-amendment-bill-2019-violates-the-very-international-laws-it-quotes-defies-principles-of-natural-justice-7104391.html
[6] https://www.4numberplatform.com/?p=14205
[7] https://amnesty.org.in/news-update/central-government-claims-on-new-uapa-bill-misleading/