প্রশান্ত ভট্টাচার্য
‘এবার থেকে কাশ্মিরী সুন্দরী মহিলাদের সবাই বিয়ে করতে পারবে।’ বিজেপি বিধায়ক বিক্রম সাইনির এই উচ্ছ্বাসই বুঝিয়ে দেয় ৩৭০ বাতিলের জন্য এত তড়িঘড়ি কেন। এরপরেই শুক্রবার হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর বলেন, ‘এখন যেহেতু কাশ্মির খুলে গিয়েছে, আমরা সেখান থেকে মেয়েদের আনতে পারি।’
এই নারীমাংস লোভীদের পাশাপাশি আছে জমি মাফিয়ারা। এই লোভাতুর বেনিয়াবুদ্ধির হিন্দুদের রাজনৈতিক দলের প্রধান দুই পাণ্ডা মোদি ও শাহ তাই সবরকম গণতান্ত্রিক প্রথাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা বাতিল করে জম্মু-কাশ্মিরকে এই উপমহাদেশের গাজাস্ট্রিপ তৈরি করার পথে। আরএসএসের যা অ্যাজেন্ডা ছিল তা পূরণ করতেই সংবিধানের ৩৭০ ধারা, ৩৫এ বিলোপ, এই ক্ষেত্রে আদর্শ সঙ্ঘী হিসাবে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ পদক্ষেপ করেছেন। এটা না বললে, সত্যের অপলাপ হবে যে, আজ না হোক কাল কিম্বা কোনও একদিন সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ করতেই হত। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই কি সেই মহালগ্ন যখন তা করতে হল? আর সেটা করতে গিয়ে গোটা জম্মু-কাশ্মিরকে সেনা দিয়ে মুড়ে দিতে হল! বিজেপি বাদ দিয়ে রাজ্যের সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের হয় গ্রেফতার নয় গৃহবন্দি করতে হল। কেন এই শর্টকাট মেথড নেওয়া হল? প্রশ্ন করা যাবে না। প্রশ্ন করলেই আপনি দেশদ্রোহী। আর সরকারের হাতে আছে ইউএপিএ (সংশোধনী) আইন ২০১৯। শুধু সন্দেহের বশে আপনাকে ফাটকে পুরে দিতে পারেন শাহি-পেয়াদাবাহিনী। তার ওপর গেরুয়ার পায়ে ভেড়ুয়ার মতো মাথা খুড়বার লোক হয়ে গিয়েছে প্রচুর। তাই রাজা তোর পোশাক কোথায় জিজ্ঞাসা করার মতো মানুষের বড় অভাব।
বাবাসাহেব আম্বেদকর এক আশঙ্কা থেকে মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমি মনে করি বদলোকের হাতে পড়লে একটি ভালো সংবিধান নষ্ট হয়ে যাবে।’ আমরা কী সেই প্রদোষকালে প্রবেশ করলাম? ৫ আগস্ট সোমবার যে ঘটনাটা হল সেটা কাশ্মিরের জন্য হল বলে যাঁরা উদ্বাহু হয়ে নাচছেন তাঁদের বোঝা উচিত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো যে সংবেদনশীলতা ও সহিষ্ণুতার ওপর টিকে থাকে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের সেই ফেডারেল কাঠামোকে তছনছ করে দেবার এই শাহি-পথ সব রাজ্যের জন্য অশনি সংকেত। ধরুন, কাল সকালে ঘৃম থেকে উঠে কোনও রাষ্ট্রীয় দেশপ্রেমী মনে করল বড়োল্যান্ড দিতে হবে। সেই মতো সব জোগাড়যন্ত্র হল আর অসমের বিধানসভা সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এর বিরোধিতা করল। তবে মোদি সরকার কী করবে? সেখানেও কি কোনও ছুতোয় বিধানসভা ভেঙে দিয়ে তারপর, রাষ্ট্রপতির সই করা একটা কাগজ সংসদে পড়ে দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন নিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বড়োল্যান্ড তৈরি করে ফেলবে? আমার জানা নেই কোনও বিজেপিশাসিত রাজ্যের ক্ষেত্রে এমনটা করা সম্ভব হবে কিনা। তবে রাজ্যের গৌরব হরণ করে রাজ্যকে টুকরো করে দেবার এই শাহিপথ যদি মান্যতা পায় তবে কেন্দ্রীয় সরকার যখন চাইবে তখন ভারতের যে কোনও রাজ্যের ভূগোল বদলে দেবে। সংশ্লিষ্ট রাজ্যটির অনুমতির আর কোনও প্রয়োজন রইল না। ভাগ বাঁটোয়ারার এই গুজু পন্থা আর যাই হোক ভারতের শাশ্বত ভাবনার পরিপূরক নয়। মহাত্মা গান্ধি বরাবর লড়াই করে গেছেন, লক্ষ্য আর পন্থা নিয়ে। তিনি মনে করতেন, লক্ষ্যপূরণের জন্য যে কোনও পন্থা অবলম্বন করা যায় না, পথটাও হতে হবে সৎ ও সত্যনিষ্ঠ। আমি জানি, এঁরা গান্ধিবাদী নন, এঁরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কাছে মুচলেকা দেওয়া এক ছদ্ম হিন্দুপ্রেমীর অনুগামী। তাই মারি অরি পারি যে কৌশলে, এটাই ওঁদের নীতি। তবু ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতে আসা সরকারের কাছে আমার প্রশ্ন এরপরেও কি উপত্যকায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে? সংসদে ৩৭০ ধারা বিলোপের বিরোধিতা করে কংগ্রেস সরকারের এই সিদ্ধান্তকে, সংবিধানকে হত্যা করার সঙ্গে তুলনা করেছে। কংগ্রেস নেতা গুলাম নবি আজাদের অভিযোগ, এভাবে বাকি কাশ্মিরকে দেশ থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হল। যদিও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এই অভিযোগকে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, এবারই প্রকৃতপক্ষে কাশ্মিরীদের ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হল। এর সুফল তাঁরা পাবেন। আমি এখানে পাঠকদের বিবিসি বাংলার ৮ আগস্ট রাতের একটা খবর উদ্ধৃত করব। খবরটির শিরোনাম, ‘মনে হচ্ছে যেন মৃত্যু উপত্যকায় এসে পৌঁছেছি’। বিবিসি বাংলার শুভজ্যোতি ঘোষ শ্রীনগর থেকে এই প্রতিবেদনে লিখেছেন, ‘৩৭০ ধারা এবং কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের ঘটনায় এরা যেভাবে তাদের আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন, সেটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তারা আমাকে বললেন, পার্লামেন্টে অমিত শাহ দাবি করেছেন যে কাশ্মিরের আশি শতাংশ মানুষ নাকি এটি সমর্থন করে। যদি তাই হবে, সরকার কেন মাত্র আট মিনিটের জন্য কারফিউ তুলে দিচ্ছে না। কারফিউ তুলে নিক, তারপর তারা দেখতে পাবে কীভাবে মানুষ রাস্তায় নামে প্রতিবাদ জানাতে।’
ঠিক এই জায়গাটাতেই আমার জিজ্ঞাসা, বিজেপি সরকার যে বলছে, কাশ্মির ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল, আর কাশ্মির সমস্যারও সমধান হয়ে গেল, তা কী আদতে সম্ভব? আসলে যে ৩৭০ ধারা রদ করার জন্য এত হইচই হচ্ছে তার গুরুত্ব আগেই ধাপে ধাপে বিলুপ্ত হয়েছে। এখন যেটা হল, সেটাকে বলা যায় ৩৭০ ধারার কঙ্কালটা বাতিল করা হল। এককথায়, এবার যেটা হল, তা হচ্ছে ওই ধারার ১ নম্বর উপধারাটি ছাড়া সব উপধারা সরকারিভাবে বাতিল করা। আগেই ধাপে ধাপে বিলোপ হয়েছিল তা আমাদের স্বাধীন ভারতের সংসদীয় রাজনৈতিক ইতিহাসে চোখ বোলালেই সমঝে যাবেন। জম্মু-কাশ্মিরের রাজা হরি সিং প্রাথমিকভাবে স্থির করেছিলেন তিনি স্বাধীন থাকবেন। কিন্তু পাক সেনা যখন সে দেশে অনুপ্রবেশ করে, তখন তিনি ভারতের সাহায্য চান। ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর হরি সিং ভারতভুক্তির চুক্তি স্বাক্ষর করেন। পরদিন, ২৭ অক্টোবর ১৯৪৭, গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন সেই চুক্তি অনুমোদন করেন। ১৭ মে ১৯৪৯ সালে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এবং গোপালস্বামী আয়েঙ্গারের সম্মতিতে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু জম্মু-কাশ্মিরের প্রধানমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহকে একটি চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে তিনি বলেন, ভারত সরকারের স্থির সিদ্ধান্ত হল জম্মু-কাশ্মিরের সংবিধান সে রাজ্যের অধিবাসীদের নিয়ন্ত্রণের বিষয়।
১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি সংবিধান কার্যকর হওয়ার সময় জম্মু-কাশ্মিরের স্বাতন্ত্র্য, স্বায়ত্তশাসন ও বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয় সংবিধানের ৩০৬এ ধারা মোতাবেক। এরপরে নতুনভাবে ৩৭০ ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। রাজা হরি সিংয়ের দূত গোপালস্বামী আয়েঙ্গারই ৩৭০ ধারার মূল রূপকার ছিলেন। তাই ‘ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন’এ এই ধারার কথা ছিল না। তবে ৩৭০ ধারা অন্তর্ভুক্তির সময়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছিলেন কেননা, এই ধারা অন্তর্ভুক্তির সময়ই বলা হয়েছিল, যতক্ষণ না কাশ্মির বিতর্কের অবসান হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্তই অস্থায়ীভাবে এই ধারা জারি থাকবে। ৩৭০ ধারায় লেখা ছিল, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযগের মতো ৩টি বিষয় ছাড়া কোনও বিষয় ভারতভুক্তির দলিলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কিনা, তা ঘোষণা করার সম্পূর্ণ অধিকার ভারত প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতির রয়েছে। আর এই বোঝাপড়া ছিল বলেই, ১৯৫৪ সালে রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিক নির্দেশ জারি করে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগের বাইরের যে কোনও বিষয়ে ভারত সরকারকে আইন তৈরি করার ক্ষমতা দেন। মনে রাখবেন, এই নির্দেশ আইনে পরিণত হওয়ার কেন্দ্রীয় সরকার জম্মু-কাশ্মিরের যে কোনও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বৈধ অধিকার পায়। এরফলে ১৯৫৭ সাল থেকে ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসাবে জম্মু-কাশ্মিরে সাধারণ নির্বাচন শুরু হয়। ১৯৫৮ সালে ফের সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে জম্মু-কাশ্মিরকে কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক কাজের আওতায় আনা হয়। এরপরেও একাধিক সংশোধনী আনা হয় এবং ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বর মাসে জম্মু-কাশ্মিরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত এক রাজ্যে পরিণত করা হয়। সে বছরই সদর-ই-রিয়াসতের বদলে দিল্লি থেকে রাজ্যপাল নিয়োগ হয় রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে। আমাদের সংবিধানের ২৪৯ ধারায় জম্মু-কাশ্মিরের এক্তিয়ারভুক্ত যে কোনও বিষয়ে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়। এরও কয়েক বছর পরে ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে শেখ আবদুল্লাহর চুক্তির পর রাজ্যের বিষয়সূচির অন্তর্ভুক্ত নানান বিষয়ের ওপর শ্রীনগরের সরকারের আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা আরও কমানো হয়। ফলে ৩৭০ ধারার কাগুজে দলিলের চেয়ে বেশি কিছু পরিচয় ছিল না। তাই ৩৭০ ধারা এবং জম্মু-কাশ্মিরকে সমার্থক ভেবে নেওয়াটা নিছক রাজনৈতিক নাবালকত্বেরই পরিচয় বহন করে। আমার সীমিতবুদ্ধিতে মনে হচ্ছে বরং আরও বড় ধরনের সঙ্কটের মধ্যে আমরা পড়লাম। ৩৭০ ধারার উপধারাগুলো যত ধাপে ধাপে লঘু করা হয়েছে, ততই কাশ্মির অস্মিতা প্রবল হয়েছে। এখন ৩৭০ ধারা বিলোপ করে কাশ্মিরীদের স্বাভিমানে যত বড় আঘাত করেছে, তা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা নেই বলেই সেখানে মোদি-শাহ-দোভালরা সেনাশাসন নামিয়ে এনেছে। এটা ঠিক, ৩৭০ ধারা বিলোপ করায়, বাকি ভারতবাসীর কিছুই হারাবার নেই। কারণ, তা আমাদের স্বার্থরহিত বিষয়। কারা ডাল লেকের ধারে জমি কিনবে, কারা শ্রীনগরে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা করবে, তা নিয়ে আমাদের আদার ব্যাপারীদের কিছু যায় আসে না। তবু বলব কাশ্মিরের মধ্যে আছে আরেকটা কাশ্মির, তাকে চিনতে পারেননি। তাই জম্মু-কাশ্মির নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আর নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল যে খেলাটা খেললেন তা যুগপৎ ভুল ও হঠকারী পদক্ষেপ। নিকট ভবিষ্যতেই তা প্রমাণ হয়ে যাবে। বাড়বে অর্থনৈতিক দুর্দশা, চওড়া হবে সাম্প্রদায়িক বিভেদ। যদিও মোদি সরকার আশার কথা শোনাচ্ছে। কাশ্মিরে নতুন শিল্প-লগ্নির বন্দোবস্ত হচ্ছে। আগামী অক্টোবরে সেখানে শিল্প সম্মেলন। দেশবিদেশের উদ্যোগপতিরা থাকবেন। এমন তড়িঘড়ি ৩৭০ বিলোপ করার পর ঘরেবাইরে সমালোচিত নরেন্দ্র মোদি ৮ আগস্ট জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘পরিকাঠামো, পর্যটন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যে উন্নয়নের জোয়ার বইবে, যুব সম্প্রদায় কাজ পাবে— সর্বোপরি জগৎসভায় উপত্যকা আবার ফিরে পাবে ভূস্বর্গের মুকুট।’ ফুল-চন্দন পড়ুক মোদির মুখেমাথায়। উপত্যকা হয়ে উঠুক অনুনাদশীল কাশ্মির। কিন্তু এত তৎপরতায় কাশ্মির কোথায়? সেই ভূখণ্ডটি তো ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভারী বুটের তলায় চাপা পড়ে আছে। অজিত দোভাল যতই খোলা রাস্তায় বিরিয়ানি খান, কাশ্মিরিদের হৃদয় সেখানে বরফের মতো ঠান্ডা। তাঁরা প্রতিটি কোষে কোষে টের পাচ্ছেন তাঁদের প্রতি ভারতের অবহেলা, বঞ্চনা, অবজ্ঞা। ‘এক দেশ, এক রাষ্ট্র, এক পরিবার’ মাথায় রেখে নতুন কাশ্মির বানানোর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এক ঔপনিবেশিক চেতনা থেকেই বলে তাঁরা মনে করছেন। আর এই মনে করাটাও অস্বাভাবিক নয়। কেননা, জম্মু-কাশ্মিরের এত বড় এবং ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটানো হল কাশ্মিরিদের কোনও অনুমোদন না নিয়ে। ঠিক যেভাবে উপনিবেশের বিস্তার হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীতে। এছাড়াও যেভাবে সংসদে তড়িঘড়ি বিল এনে জম্মু-কাশ্মির দ্বিখণ্ডিত করে রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নিয়ে, তাকে কেন্দ্রশাসিত এলাকা করে তোলা হল তা পুরোপুরি অগণতান্ত্রিক। এতদিন এলাকার বাসিন্দাদের চাহিদা ও রাজ্য সরকারের অনুরোধ মেনে রাজ্য পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া হত। এবার মোদি সরকার জোর করে যে কোনও রাজ্য পুনর্গঠনের নজির তৈরি করল। পেল যে কোনও রাজ্য আলাদা করার অধিকার। মোদি-শাহ জুটির এই পদক্ষেপ থেকে বোঝা গেল, বিজেপি সরকার ক্ষমতায় বিশ্বাসী হলেও গণতন্ত্রের মৌলিক শর্তগুলোর প্রতি ন্যূনতম আস্থা রাখে না। মোদি-শাহ ভুলে যাবেন না, আইন গাছ থেকে পড়ে না, মানুষই তৈরি করে, আর তা তৈরি করা হয় মানুষের স্বার্থে।
জানি না কোন কাশ্মিরীদের স্বার্থে ৩৫এ ধারা বাতিল করা হল। অর্থাৎ কাশ্মিরের ভূমিপুত্র না হলেও জমি, বাড়ি কিনে স্থায়ীভাবে বসবাস করা যাবে। আদানিদের মতো জমিহাঙ্গরদের জন্য খুলে দেওয়া হল ভূস্বর্গের দরজা।
মোদি-শাহরা শুধু নেহরুকেই অস্বীকার করেন না, অটলবিহারী বাজপেয়ীকেও মান্যতা দেন না। ইতিহাস সাক্ষী দিচ্ছে, বাজপেয়ী-আদবানির প্রায় ৭ বছরের শাসনে, কাশ্মির উপত্যকায় শান্তি ফিরতে শুরু করেছিল। কাশ্মিরে অনেক ইনস্টিটিউট তৈরি হয়। কর্মসংস্থান হতে শুরু করে। তৈরি হয় সড়ক। ফলে পরিবহণ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হয় এবং এই ৭ বছরে ধীরে ধীরে সেনা মোতায়েন ১ লক্ষ ৭৮ হাজার থেকে ৬৫ হাজারে নামিয়ে আনে বাজপেয়ী সরকার। মনমোহন সিং ক্ষমতায় এসে তাঁর পূর্বসূরির মডেলকে এগিয়ে নিয়ে যান। কাশ্মিরে বিকাশ এবং ভালোবাসার গতি হাত ধরাধরি করে চলে। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উস্কানি, হাতছানি উপেক্ষা করেও সাধারণ মানুষ মূল স্রোতে ফিরে আসতে শুরু করেন। উপত্যকায় সেনা সংখ্যা নেমে আসে ৩৪ হাজারে। কিন্তু সবটাই পাল্টে গেল মোদি শাসনের ৫ বছরে। বুরহানের মৃত্যুর পর সন্ত্রাসবাদীরা বাদ দিয়েও কাশ্মিরে বেশিরভাগ বাচ্চা ছেলেমেয়েরাও নিজেদের হাতে পাথর তুলে নিয়েছে। উপত্যকার কাজ-কর্ম-ব্যবসা সব লাটে গেছে। উল্টো ৭ লক্ষ সৈন্য মোতায়েন করতে হয়েছে। ১০ জন সাধারণ কাশ্মিরীর পিছনে এক জন সৈন্য। তাও কিন্তু পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে। আর ৩৭০ তুলতে গিয়ে কাশ্মিরে এখন বেসরকারি মতে সৈন্য ও আধাসেনা মোতায়েন হয়েছে ২১ লক্ষ। প্রতি আড়াইজন কাশ্মিরবাসীর পিছনে ১ জন করে সৈন্য। মোদি-শাহর এই সেনাশাসন কোনও সুশাসনই ফিরিয়ে আনতে পারবে না ভূস্বর্গে।