শুভাশিস মৈত্র
শুধু ভোট দিয়ে পাঁচ বছর অন্তর সরকার তৈরি করাটাই গণতন্ত্র নয়। গণতন্ত্রের অর্থ জায়গা বিশেষে পরিবর্তনও হয়। যেমন কাশ্মিরে। সেখানকার স্বকীয়তা বৈশিষ্ট্য রক্ষা করতে পারাটাই গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত ছিল। অনর্গল মিথ্যে কথা, সেনা এবং কার্ফু ব্যবহার করে কাশ্মিরের মানুষের থেকে যা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সংসদীয় প্রক্রিয়া মেনে।
কয়েক বছর আগে মার্কিন সাংবাদিক ‘জশুয়া কুরলান্টজিক’ ‘ডেমোক্র্যাসি ইন রিট্রিট’ নামে একটি বই লিখে দেখিয়েছিলেন কীভাবে ২০০০ সালের পর থেকে মানে ২১ শতকের প্রথম ভাগে পৃথিবী জুড়ে গণতন্ত্র পিছু হটে চলেছে। কীভাবে নির্বাচিত সরকার সংখ্যার জোরে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে চলেছে, কীভাবে নির্বাচিত সরকার এবং সেনা হাত ধরাধরি করে ক্ষমতা বোঝাপড়ার নতুন ইতিহাস লিখছে, বাড়ানো হচ্ছে পুলিশ এবং সেনা খাতে ব্যয়, বহিঃশত্রু নয়, নিজেদের দেশের জনতাকে সামলে রাখতে।
বিজেপি পেরেছে। তার কারণ, বিজেপির সঙ্গে কাশ্মিরের মানুষ না থাকলেও দেশের বড় অংশ ধর্মীয় সাংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আছে। এই মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, একটা পেশীবহুল জাতীয়তাবাদের আদর্শের উপর দাঁড়িয়ে বিজেপি আজ ভারত শাসন করছে। বিজেপির সমকক্ষ কোনও দল নেই এই মুহূর্তে। সঙ্গে আছে দুনিয়ার সব থেকে বড় এনজিও আরএসএস, যাদের সদস্য ২০ লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে অনেক দিন আগে। ওয়ালটার অ্যান্ডারসন এবং শ্রীধর ডি ডামবলে তাঁদের ‘মেসেঞ্জার্স অফ হিন্দু ন্যাশনালইজম’ বইয়ে লিখেছেন, প্রায় ষাট লক্ষ ভলানটিয়ার রয়েছে সঙ্ঘ পরিবারের। সঙ্গে প্রায় ছ’হাজার সর্বক্ষণের কর্মী, ‘প্রচারক’। অখিল ভারতীয় বনবাসী কল্যাণ আশ্রম, বিশ্বহিন্দু পরিষদ, দেশের সব থেকে বড় ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন, বৃহত্তম ছাত্র সংগঠন, ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। ১৯৮৯ সালে আরএসএসের ‘স্বাস্থ্য-শিক্ষা’ প্রকল্প চলত প্রায় ৫০০০টি। ২০১৫ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১ লক্ষ ৬৫ হাজার। বিজেপির নিজস্ব সদস্য সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে কেউ কেউ দাবি করছেন। আর টাকা-পয়সা? সে ব্যাপারেও বিজেপি সব দলকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মসকে উদ্ধৃত করে সম্প্রতি খবর লেখা হয়েছে, ২০০৪-৫ থেকে ১৭-১৮, এই সময়ে ডিএলএফ-সহ বেশ কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান থেকে বিজেপি প্রায় ৬০০ কোটি টাকা পেয়েছে, আর ২০১২-১৩ থেকে ১৭-১৮, এই সময়ে কর্পোরেট ফান্ডিং কংগ্রেস পেয়েছে ৮১ কোটি টাকা। এ থেকে ফারাকটা আন্দাজ করা যেতে পারে। এর সঙ্গে রয়েছে বিরোধীদলের সঙ্কট। এআইডিএমকে, এসপি, আরজেডি, টিডিপি-র মতো বহু বিরোধী দল আগামী দিনে সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। বড় বিরোধীদলগুলির মধ্যেও ফাটল ধরাতে সক্ষম হয়েছে বিজেপি। কংগ্রেস কাশ্মির প্রশ্নে দু’টকরো। তৃণমূল কংগ্রেস দিশেহারা। ডেরেক সংসদে দুর্দান্ত বক্তৃতা দেওয়ার পরও ‘হাই কমান্ড’-এর নির্দেশে কাশ্মির প্রশ্নে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দেয়নি তৃণমূল। তৃণমূলের যুক্তি, এই খারাপ বিলের সঙ্গে নাকি তারা কোনও সংস্রব রাখতে চান না, তাই ভোট দেননি। তাৎক্ষণিক তিন তালাক বিলকেও তো তৃণমূল খারাপ বিল বলেছিল, কিন্তু তবু ভোট দিয়েছিলের তৃণমূলের সাংসদরা। ফলে যে যুক্তি তাঁরা কাশ্মির প্রশ্নে ভোট না দেওয়ার জন্য দিচ্ছেন তা হাস্যকর। আসলে গোটাটাই হিন্দু মুসলমানের হিসেব কষে হচ্ছে। এক পক্ষ মুসলমান সংখ্যাগুরু রাজ্যের রাজ্য-মর্যাদা কেড়ে নিয়ে, রাজ্য দু’টুকরো করে দেশ জুড়ে হিন্দুদের থেকে বাহবা কুড়োচ্ছে যা আসলে তাদের কাছে ভোটের ভবিষ্যত, অন্যপক্ষ সংখ্যালঘু তোয়াজের ভান করে তিন তালাক বিলের বিরোধিতা করছে, আবার কাশ্মির প্রশ্নে ‘হিন্দু জাগরণ’-এর বহর দেখে বিরুদ্ধে ভোট দিতে ভয় পাচ্ছে। এর জন্য ভবিষ্যতে তৃণমূলকে খুব খারাপ মূল্য দিতে হতে পারে।
কাশ্মির নিয়ে এই বিল পাশ করানোর আগে এবং পরে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে নানা রকম অসত্য প্রচার করা হয়েছে। এখন বোঝা যাচ্ছে সরকার বিল পাশ করানোর প্রস্তুতি নিয়েছিল অনেক আগেই। তাই সন্ত্রাসের কথা বলে অমরনাথ যাত্রা বন্ধ করে পর্যটকদের ফেরানো হয়, যার নজির অতীতে নেই। প্রচুর সেনা মোতায়েন করা হয়, কিন্তু সরকারের তরফে বলা হয়, এর পেছনে কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য নেই। কার্ফু জারি করেও বলা হয়, উদ্দেশ্য পাক সন্ত্রাসবাদীদের রোখা। বিল পাশের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, সংসদের ভিতরে এবং বাইরে নানা প্রসঙ্গে বলেছেন, কাশ্মির পিছিয়ে পড়েছে, তাকে উন্নত করতেই এই ব্যবস্থা। কাশ্মিরের এই পিছিয়ে পড়ার তথ্য ঠিক নয়। সরকারি সূত্র উল্লেখ করে ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২২টি বড় রাজ্যের মধ্যে গড় আয়ুর বিচারে (লাইফ এক্সপেক্টেন্সি) জম্মু-কাশ্মিরের স্থান হল তৃতীয়। ২০১২-১৬, এই সময়ের প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে জম্মু-কাশ্মিরের গড় আয়ু ৭৩.৫। সবার উপরে কেরল, ৭৫.১, সবার নীচে যোগীর রাজ্য উত্তরপ্রদেশ, ৬৮.৭। প্রতি এক জন সরকারি ডাক্তার পিছু মানুষ, এই সংখ্যাটা জম্মু-কাশ্মিরে ৩,০৬০। সারা দেশে জম্মু-কাশ্মিরের অবস্থান সপ্তম। সবার উপরে কেজরিওয়ালের দিল্লি ২,২০৩, সবথেকে পেছনে বিজেপি শাসিত বিহার, ২৮, ৩৯১। গ্রামীণ কর্মসংস্থানের প্রশ্নে জম্মু-কাশ্মিরের অবস্থান বেশ নীচের দিকে, ২১তম স্থানে। এক নম্বরে বিজেপি শাসিত গুজরাট, সবার নীচে এনডিপিপি-বিজেপি শাসিত নাগাল্যান্ড। প্রতি হাজারে শিশু মৃত্যুর হার, জম্মু-কাশ্মিরে ২৪জন, সারা দেশে অবস্থান দশম। গোয়ায় ৮, দেশের সেরা। সবার নীচে, বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশ, ৪৭। মধ্যপ্রদেশকে বিজেপি শাসিত এই কারণে বলা হল, এই তথ্য ২০১৬ সালের। কংগ্রেসের সরকার মধ্যপ্রদেশে হয়েছে তার অনেকটাই পরে। রাজ্যের মাথাপিছু আয় (২০১৬-১৭), জম্মু-কাশ্মিরের ৬২,১৪৫ টাকা। সবার উপরে গোয়া, ৩,০৮,৮২৩ টাকা। সবার নীচে বিজেপি শাসিত বিহার, ২৫,৯৫০টাকা। ২০১৭-এর মানব উন্নয়ন সূচকের নিরিখে জম্মু-কাশ্মির ০.৬৮ যা অন্ধ্র এবং গুজারাটের থেকে বেশি। কেরল সবার উপরে, ০.৭৭। সবার নীচে বিজেপি শাসিত বিহার, ০.৫৭। আয়, শিক্ষা, গড় আয়ু, স্বাস্থ্য ইত্যাদির বিচারে একটি রাজ্য কোথায় দাঁড়িয়ে আছে তাই দেখা হয় মানব উন্নয়ন রিপোর্টে।
ফলে একটি বিষয় স্পষ্ট, উন্নয়নের জন্য জম্মু-কাশ্মিরের বিভাজন বা রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নেওয়া হয়নি। উদ্দেশ্য ভিন্ন। যে ৩৭০ ধারা বিলোপ নিয়ে তামাম হিন্দুস্থানের সংখ্যাগুরুদের বড় অংশ এত খুশি, ওই রকম বা তার কাছাকাছে আরও বহু ধারা রয়েছে, সেগুলো হল, ৩৭১ এ/বি/সি/ডি/ই/এফ/জি/এইচ/আই এবং ৩৭০জে। এই সব ধারার মাধ্যমে নানা রকমের রক্ষাকবচ দেওয়া হয়েছে মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, অসম, সিকিম, অরুণাচল, বিদর্ভ, মারাঠাও্য়াড়া, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক এবং গোয়ায়। কার্ফু জারি করে, সেনা মোতায়েন করে, বিরোধী নেতাদের গ্রেফতার করে জম্মু-কাশ্মিরের এই রক্ষাকবচই তুলে নেওয়া হল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছেন, নানাভাবে ৩৭১ ধারা যে সব রাজ্যে লাগু আছে সেসব যেমন আছে তেমন থাকবে।
এর পর কী হবে জম্মু-কাশ্মিরের? কেউ কেউ বলছেন অদূর ভবিষ্যতে পাকিস্তানের মদতে সিরিয়ার মতো একটি অশান্ত অঞ্চল হয়ে উঠতে পারে জম্মু-কাশ্মির। এই ভয় যে নেই তা নয়। তবে আমার মনে হয়, পাকিস্তানের যা অর্থনৈতিক অবস্থা এবং উল্টো দিকে ভারতের যা সামরিক শক্তি তাতে অশান্তি দীর্ঘস্থায়ী হবে না। যতই পরমাণু শক্তিধর হোক না কেন, অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত পাকিস্তান ভারতের তুলনায় খুবই পিছিয়ে থাকা একটা শক্তি, আন্তর্জাতিক স্তরেও বেশ কোণঠাসা। কাশ্মিরের সমস্যা আসতে পারে অন্য দিক থেকে। জমি হাঙড়, প্রোমোটার, বিল্ডারদের কাছে খুলে দেওয়া হচ্ছে জম্মু-কাশ্মিরের জমি। এর ফলে জম্মু-কাশ্মিরে মানুষের যে ধর্মীয় ভারসাম্য এখন আছে, সেটা উল্টে যেতে পারে। আজ যারা সংখ্যগুরু তারা তখন সংখ্যলঘু হয়ে পড়তে পারে। হিন্দুত্ববাদীদের স্বপ্ন মনে হয় সেটাই। আর কী হতে পারে? সেটা আগাম বলা সম্ভব নয়, তবে হিন্দুত্ববাদীদের নির্বাচনে জেতা নেতারা ইতিমধ্যেই জম্মু-কাশ্মিরের নারীদের সম্পর্কে যে ধরনের কথা-বার্তা বলছেন, তাতে কারও মনে যদি আরও ভয়ঙ্কর কোনও আশঙ্কা তৈরি হয়, তাকে বা তাদের দোষ দেওয়া যায় না।
আপাতত জম্মু-কাশ্মির নামের রাজ্যের মৃত্যুতে আসুন এক মিনিট নীরবতা পালন করি।