দেবাশিস মৈত্রের লেখা

উন্নয়ন 

 

টালিগঞ্জের গলফ ক্লাব রোডে আমাদের পুরনো বাড়ির পুব দিকে ছিল খ্রিস্টানদের কবরখানা, টালিগঞ্জ সেমেট্রি। কবরখানার ওপারে বিশাল এক ঝিল, তার নাম ছিল চিত্তর দ’। যাঁর নামে ঝিলের এই বিচিত্র নামকরণ, সেই চিত্তবাবু প্রতি বছর ঝিলটি লিজ নিয়ে সেখানে মাছ চাষ করতেন। ছোটখাটো চেহারার মানুষটি খাটো ধুতি আর পাঞ্জাবি পরে প্রায় সারাদিনই ঝিলের আশেপাশে ঘুরে বেড়াতেন আর মাছ পাহারা দিতেন। গ্রীষ্ম আর বর্ষায় একখানি ছাতা থাকত হাতে। ছাতা-হাতে চিত্তবাবুর তাড়া ছোটবেলায় আমরা বিস্তর খেয়েছি!

কবরখানার সীমানার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ঝিলের লাগোয়া খেলার মাঠটিকে লোকে বলত “দ’এর মাঠ”। বছরে তিনশো পঁয়ষট্টি দিন বিকেলে সেখানে বসত ফুটবলের আসর। কলাবাগান, হরিপদ দত্ত লেন, রাজেন্দ্রপ্রসাদ কলোনি থেকে ছেলেরা খেলতে আসত। সেইসব ছেলেদের মধ্য থেকে কেউ কেউ বড় হয়ে পা রাখত কলকাতার ময়দানে।

চিত্তর দ’এর ওপার থেকে শুরু করে গলফ গ্রিন পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ফাঁকা জমি অযত্নে পড়ে থাকত। আমাদের বাড়ির দোতলার ছাদ থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের আটতলা বাড়িটা দিব্যি দেখতে পেতাম আমরা।
দ’এর মাঠ আর চিত্তর দ’-– দুইয়ের মাঝখানে ছিল একটি খাটাল। তার এক প্রান্তে, রয়াল ক্যালকাটা গলফ ক্লাবের (আর-সি-জি-সি) প্রাচীরের গা ঘেঁষে, একটিই মাত্র একতলা বাড়ি ছিল তখন-– সত্য পালের বাড়ি। সত্য পাল নামে এক পাঞ্জাবি ভদ্রলোক সপরিবারে ওই বাড়িতে বাস করতেন। আমাদের পাড়ায় মাঝে মাঝেই খবর আসত, গত রাতে সত্য পালের বাড়িতে আবার নাকি ডাকাতি হয়েছে! তা, ও বাড়িতে ডাকাতি করা কিছু কঠিন ছিল না তেমন। ত্রিসীমানায় তো একটিও প্রতিবেশীর চিহ্ন নেই। শোনা যায় মোট আঠারোবার নাকি ডাকাতি হয়েছিল তাঁর বাড়িতে। তার জন্য অবশ্য সত্য পালের বিশেষ হেলদোল ছিল না। তিনি চোর-ডাকাত পরিবৃত হয়েই বাস করতেন, আর সু্যোগ-সুবিধামতো আশেপাশের ফাঁকা জমি জলের দরে কিনে ফেলতেন। পরে সেইসব জমিই পঞ্চাশ-একশো গুণ দামে লোকে কিনতে শুরু করল তাঁর কাছ থেকে।
প্রায় কুড়ি বছর আগের কথা। ততদিনে সত্য পাল বাড়ি বিক্রি করে কোথায় যেন চলে গেছেন। চিত্তর দ’-এর ওপারে গলফ গার্ডেনের সুদৃশ্য পল্লী তখন গড়ে উঠতে শুরু করেছে। একদিন সকালে দোতলার ছাদে দাঁড়িয়ে দেখলাম, কবরখানার ওপারে কিছু ‘ডেভেলপমেন্টাল অ্যাক্টিভিটি’-র আভাস পাওয়া যাচ্ছে যেন! চিত্তর দ’-এর চারপাশে প্রচুর লোকজন, লরি আর ডাম্পারের ভিড়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, হ্যাঁ, উন্নয়নই হচ্ছে বটে। চিত্তর দ’ ভরাট করে তার মাঝখান দিয়ে নতুন রাস্তা তৈরি হবে। টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশন থেকে আর-সি-জি-সির মেইন গেট হয়ে সেই রাস্তা সিধে চলে যাবে গলফ গ্রিন।

আশ্চর্যের বিষয় হল এই যে, রাস্তা কিন্তু ছিল। ঝিলের দু’পাশ দিয়ে দুটো সমান্তরাল রাস্তা ছিল গলফ গ্রিন যাওয়ার। সেগুলোকেই চওড়া করে ফেলা যেত। কিন্তু জনদরদী সরকারের নাকি মনে হয়েছে, ঝিল ভরাট করে তিন নম্বর একটা রাস্তা না করতে পারলে জনগণের যাতায়াতের খুব অসুবিধা হবে।

কাজ শুরু হওয়ার দিন কয়েক পরেই এক বন্ধু হঠাৎ আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। এক টিভি চ্যানেলের রিপোর্টার সে। আমাদের বাড়ির ছাদ থেকে লুকিয়ে এইসব ডেভেলপমেন্টের ছবি তোলা যায় কি না, তা-ই খতিয়ে দেখতে এসেছে। সরেজমিনে দেখে সে বলল, ‘না, বড্ড দূর। বড় টেলিফোটো লেন্সেও কিছু ধরা পড়বে না।’

আমি বললাম, ‘তুমি তো সাংবাদিক। লুকিয়ে ছবি তুলবে কেন? ক্যামেরা নিয়ে সামনে চলে যাও!’

বন্ধু বলল, ‘সে চেষ্টা কি আর করিনি? মার খেতে খেতে বেঁচে গিয়েছি।’

‘সাংবাদিকের গায়ে হাত তোলার সাহস কার আছে?’ আমি জানতে চাইলাম।

দু’জন বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতার নাম করল সে। পাঠকরা দু’জনকেই চেনেন, আমি নাম উহ্য রাখছি। বর্তমানে তাঁদের মধ্যে একজন বাণপ্রস্থে গেছেন, অন্যজন ধরাধামে নেই। একজন সি-পি-এম, অন্যজন কংগ্রেস (তৃণমূল কংগ্রেসের তখনও জন্ম হয়নি)। স্থানীয় কিছু বাসিন্দা ঝিল ভরাটের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল বলে দুই নেতা বেশ একটা হিন্দি-চীনি ভাই-ভাই গোত্রের সিণ্ডিকেট তৈরি করেছেন। তাঁদের পোষা গুণ্ডারা একজোট হয়ে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে দু’চারজনকে ঈষৎ স্যাম্পল ক্যালানি দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলেছে। বিক্ষোভ শেষ।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘পুকুরপাড়ের রাস্তা দুটোকে চওড়া করলে ক্ষতি কী ছিল?’

বন্ধু বলল, ‘মারাত্মক ক্ষতি। লরি-কে-লরি মাটি ফেলে ঝিল ভরাট করা হবে, তার ওপর মোরাম ফেলে, পিচ ঢেলে তৈরি হবে নতুন রাস্তা, তারপর দু’পাশে হবে সৌন্দর্যায়ন…. কত লক্ষ টাকার কাজ বলো তো? পুরনো রাস্তা চওড়া করে তার দশ পারসেন্টও আমদানি হবে?’

আটকানো যায়নি। চিত্তর দ’-এর বুকের ওপর দিয়ে নতুন রাস্তা ঠিকই তৈরি হয়েছিল। সেই রাস্তা দিয়ে গলফ গ্রিনে যাওয়ার সময় এখনও দেখি, ছোট্ট দুটো মজা ডোবা পড়ে রয়েছে রাস্তার দু’পাশে। তাদেরই সৌন্দর্যায়নের জন্য চলেছে গলফ গার্ডেনের বর্তমান বাসিন্দাদের মর্মান্তিক প্রয়াস।

ডি ফর ডেভলপমেন্ট। ডি ফর ডেসট্রাকশনও বটে। যে যেভাবে দ্যাখে।

চিত্তর দ’-এরই অনেক বড় একটি সংস্করণ হল ভাবাদীঘি। তার বুকের ওপর দিয়ে পাতা হবে নতুন রেল লাইন। যে কোনও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোজেক্টের কাজ শুরু করার আগে যে তার একটা এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট করতে হয়, একথা আজকাল প্রায় সবাই জানেন। সে তো পরের কথা। কিন্তু নতুন কোনও রাস্তা বা রেল লাইন তৈরি করতে হলে সবার আগে যা করা প্রয়োজন তা হল, বিস্তারিত একটি রুট সার্ভে। দুটি বিন্দুর সংযোগকারী রেখার দৈর্ঘ্য সবচেয়ে কম হবে যদি সেটি হয় সরলরেখা-– একথা ইস্কুলের ছাত্ররাও জানে। তার মানে এই নয় যে, দুটি গ্রাম বা শহরকে নতুন রাস্তা বা রেল লাইন দিয়ে জুড়তে হলে সেটি সরলরৈখিকই হতে হবে। একেবারেই তা নয়। রুট সার্ভের মাধ্যমে অনেকগুলি সম্ভাব্য রুট আগে খুঁজে বার করতে হবে, এবং তাদের ভালো-মন্দ আর সুবিধা-অসুবিধার তুলনামূলক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে সবচেয়ে সুবিধাজনক রুটটিকে বেছে নিতে হবে। এটাই ট্রান্সপোরটেশন ইঞ্জিনিয়ারিঙের গোড়ার কথা। কোন্ রুটে পরিবেশের ক্ষতি হবে সবচেয়ে কম? কোন্ রুটে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে নতুন রাস্তা বা রেল লাইনের সুবিধা পৌঁছে দেওয়া যাবে? কোন্ রুটে জলাশয় বোজাতে হবে না, গাছ কাটতে হবে না, হেরিটেজ বিল্ডিং বা ধর্মীয় স্থান ভাঙতে হবে না? শতকরা নিরানব্বইটি ক্ষেত্রে দেখা যায়, সবচেয়ে সুবিধাজনক সেই রুটটি সরলরৈখিক নয়।

চিত্তর দ’-এর ঘটনাটি কুড়ি বছরের পুরনো। এই কুড়ি বছরে অন্য সব পণ্যের মতো মাটির দামও বেড়েছে বহু গুণ। ভাবাদীঘি ভরাট করে তার বুকের ওপর দিয়ে রেল লাইন পাততে হলে আর্থওয়ার্ক, শিট পাইলিং ইত্যাদিতে খরচ হবে বহু কোটি টাকা। রেল লাইন দীঘির পাড় দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে গেলে লাইনের দৈর্ঘ্য নিশ্চয়ই অনেক বেশি হত। তার ফলে রেল লাইন পাতার খরচ যেমন বাড়ত, তেমনি আনুষঙ্গিক অন্য অনেক খরচ কিন্তু কমেও যেত। ঘুরপথে লাইন পাতা হলে সব মিলিয়ে প্রোজেক্ট কস্ট বাড়ত না কমত? দীঘি ভরাট করলে পরিবেশের যে ক্ষতি হবে, মাছচাষীদের জীবন-জীবিকার যে সর্বনাশ হবে, তার মূল্যায়নের কথা না হয় বাদই দিলাম, কিন্তু নিছক টাকা-পয়সার স্থূল অঙ্কেও কয়েকটি সম্ভাব্য রুটের মধ্যে নির্মাণ-ব্যয়ের কোনও তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়েছে বলে জানা নেই। করার প্রয়োজনও নেই অবশ্য। আমাদের দেশে প্রায় সমস্ত সরকারি প্রকল্প রূপায়ণের সময় যথাসাধ্য খরচ বাড়ানোর চেষ্টা করাটাই প্রথা। কনট্রাক্টরের বিল, কনসাল্ট্যান্টদের ফি, সিণ্ডিকেটের তোলা, সরকারি আধিকারিক আর কর্মচারীদের বাঁহাতের দক্ষিণা-– সবই তো প্রোজেক্ট কস্টের সমানুপাতিক। খরচ কমলে কোনও পক্ষেরই লোকসান ছাড়া লাভ নেই কিছু। তার চেয়ে জনগণের সেবকরা একটু যদি নিজেদের সেবা করে নিতে পারেন…. সামান্য একটা জলাশয়কে বলি দিয়ে। জলাশয়ের কি আর প্রাণ আছে?

তাই স্বপ্নের প্রোজেক্ট না হয়ে ভাবাদীঘির কোনও উপায় নেই। দীঘি ভরাট হবে, নতুন-পাতা রেল লাইনের ওপর দিয়ে ট্রেন ছুটবে। একদিন সেই ট্রেনের আরোহী কোনও স্থানীয় মানুষ জানালা দিয়ে দু’দিকের মজা পুকুর দেখিয়ে বলবে কলকাত্তাই কোনও সহযাত্রীকে, ‘এইখানে একটা বিশাল ঝিল ছিল এক সময়, তার নাম ছিল ভাবাদীঘি।’

আরও একদিন হয়তো কলকাতারই কোনও বাসিন্দা অন্য এক নতুন রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যেতে যেতে দু’পাশের মজা ডোবা দুটি দেখিয়ে বলবে তার সন্তানদের, ‘এইখানে মস্ত বড় একটা হ্রদ ছিল একসময়, তার নাম ছিল রবীন্দ্র সরোবর।’

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...