কেয়ার অফ কোকা কোলা

পবিত্র দাস 

 

 

এই কাহিনী ফ্রয়েডকে নিয়ে নয়। এই ঘটনার সাথে ফ্রয়েডের সরাসরি কোনও যোগাযোগও নেই। তবু আমার মনে হয়েছে ফ্রয়েডের কথা না বললে লেখা অসম্পূর্ণ থাকবে। তাই প্রথমেই তাঁর গল্প। সিগমুন্ড ফ্রয়েড। ভিয়েনাবাসী ডাক্তার। মনস্তত্ত্ববিদ। স্নায়ুবিশারদ। মনের গভীর গোপনে জটিল খেলা নিয়ে তাঁর সব তত্ত্ব। অনেক ইতিহাসবিদ, এমনকি অনেক মনস্তত্ত্ববিদও এই অভিযোগ করেন যে, ফ্রয়েডের অনেক বিখ্যাত তত্ত্ব কখনওই সরাসরি পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। মানুষের অবচেতন মনের এক আশ্চর্য দলিল। কোনওদিন জানা যাবে না সত্যি কী হয়। যেমন, ‘যারা ঘুমের মধ্যে গুহার স্বপ্ন দেখে, তারা কি সত্যি অবচেতন মনে মাতৃজঠরের চিন্তায় বিভোর থাকে?’ না, গবেষণাগারে কয়েকজনকে ধরে এনে তাদেরকে স্বপ্ন দেখিয়ে তাদের মনের ভেতর ঢুকে সেটা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। অন্তত এখনও নয়। কিন্তু এই ফ্রয়েড সাহেবের গবেষণার আর একটা দিক ছিল সেটা তাঁর মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজের ছায়ায় ঢাকা পড়ে আছে। কোকেন। ফ্রয়েডের প্রিয় বন্ধু ছিলেন আর্নেস্ট ফ্লেইস্কল। তাঁর মতনই এক অসাধারণ মনস্তত্ত্বববিদ। একবার এক অপারেশন করতে গিয়ে নিজের বুড়ো আঙুলের অনেকটা কেটে ফেলেন ফ্লেইস্কল। অসম্ভব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে নিয়মিত মরফিন নিতেন তিনি। এই করতে করতে আসক্ত হয়ে পড়েন মরফিনে। কোকেন দিয়ে তাঁর বন্ধুর মরফিনের আসক্তি দূর করার চেষ্টা করেন ফ্রয়েড। সেই ছিল শুরু। সেই সময় একটা নেশার জিনিস দিয়ে আর একটা নেশাতে আসক্তি থামানো ডাক্তারদের মধ্যে প্রচলিত প্রথা হিসেবেই ভাবা হত। প্রায় সাত বছর পর চুড়ান্তরকমভাবে কোকেন এবং মরফিনে আসক্ত হয়ে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ফ্লেইস্কল মারা যান। ১৮৮৪-৮৫ সাল নাগাদ ফ্রয়েড উবের কোকা (অ্যাবাউট কোকা) নামে একটা পেপারও লেখেন– জার্নাল অফ সাবস্ট্যান্স অ্যাবিউজ ট্রিটমেন্ট– বলে এক পত্রিকায়। যদিও মূল গবেষণাপত্রটি জার্মানে। ফ্লেইস্কল মারা যাবার পরেও ফ্রয়েড নিজে নিয়মিত কোকেন নিতেন। এবং নিজের ওপরেই পরীক্ষা করতেন। এভাবে একটা সময় আসক্ত হয়ে পড়েন। কোকেন ছাড়া ভাবনাচিন্তা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। তিনি এটাও ভাবতেন যে তাঁর সেরা গবেষণাগু্লো সব কোকেন নেবার পরই আসে মাথায়। ১৮৯৫ সালে তাঁর নাকে ইনফেকশন হয় এবং একটা অপারেশন করতে হয়। সেসময় এক চিঠিতে তাঁর বন্ধু ফ্লিয়েসকে লেখেন– বন্ধ নাক থেকে তাঁকে একমাত্র মুক্তি দিতে পারে আর এক ডোজ কোকেন। এভাবে আরও এক বছর চলার পর তাঁর মনে হয় সবকিছু খারাপের মূলে আছে কোকেন এবং আস্তে আস্তে এই আসক্তি থেকে তিনি বেরিয়ে আসেন। এরপর ফ্ল্যাশব্যাকে কুড়ি বছর আগের গল্প। ফ্রয়েডের “উবের কোকা” প্রকাশের প্রায় দু’ দশক আগে, তখন আমেরিকায় ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ শেষ দিকে চুড়ান্ত রূপ নিয়েছে। এক কনফেডারেট আর্মি কর্নেল জন স্মিথ পেমবার্টন যুদ্ধে আহত হন। তিনিও এক ডাক্তার ছিলেন। আঘাতের ব্যাথা থেকে মুক্তি পেতে তিনিও মরফিন নেওয়া শুরু করেন। এবং একটা সময় পর আসক্ত হয়ে পড়েন। তাঁর বিশ্বাস ছিল ক্যাফিন এবং কোকা একসাথে মিশিয়ে সেটাকে মরফিনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এর সাথে রেড ওয়াইন মিশিয়ে পেমবার্টন তৈরি করেন ফ্রেঞ্চ ওয়াইন কোলা। এবং বাজারে বিক্রি করেন। ১৮৮৬ সালে সরকার নিয়ম পালটালে ফ্রেঞ্চ ওয়াইন কোলা থেকে ওয়াইন বাদ দিতে হয়। নতুন নাম হয় কোকা কোলা। এরপরে ঘটনা দু’রকম। পেমবার্টনের শরীর ভেঙে পড়ে এবং কোকা কোলাকে তিনি বিক্রি করতে বাধ্য হন। সাথে কোকেন আসক্তি তো ছিলই। প্রায় কপর্দকহীন অবস্থায় পেমবার্টন মারা যান ১৮৮৮ সালে। অন্যদিকের গল্পটা আরও উত্তেজক। কোকা কোলা প্রথম কেনেন আসা ক্যান্ডলার বলে এক ব্যবসায়ী। তারপর তিনি বিক্রি করেন আর্নেস্ট উডার্ফ এবং ডব্লিউ সি ব্র‍্যাডলিকে। দুই ক্ষুরধার ব্যবসায়ী মস্তিষ্কের মানুষ। এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নিয়ে যাবার সুবিধের জন্য এরাই প্রথম সিক্স প্যাক চালু করেন। একটা প্যাকেটে ছয়টা করে কোকা কোলা। বাকীটা ইতিহাস। আজ প্রায় ১৩০ বছর পর কোকা কোলা আজ পৃথিবীর অন্যতম “ভ্যালুয়েবেল ব্র‍্যান্ড”। শুরুর দিকের কোকা কোলাতে কোকেন থাকত। সেসময় সেটা লিগ্যাল ছিল। ১৯০৩ সাল নাগাদ কোকা কোলা প্রায় সমস্ত কোকেন বাদ দেয় তাদের রেসিপি থেকে। ১৯১৪ সালে কোকেন নিষিদ্ধ হয় আমেরিকায়। যন্ত্রণা দিয়ে শুরু যার সৃষ্টির ইতিহাস। আর সেই ইতিহাসের এক কোণায় খুব অল্প জায়গা নিয়ে শুয়ে আছেন ডঃ কর্নেল জন পেমবার্টন।

(ছবিতে জন পেমবার্টন)

References :
এই ঘটনাটা প্রথম পড়া এই বই থেকে। Irresistible : Why We Can’t Stop Checking, Scrolling, Clicking and Watching, Book by Adam Alter, Bodley Head (2 Mar. 2017).
Uber Cola সম্বন্ধে কিছু তথ্য এই লিংকে : https://scicurious.wordpress.com/…/uber-coca-by-sigmund-fr…/
আর একটা ভালো বই, একটু দুর্বোধ্য : The Interpretation of Dreams: by Sigmund Freud (Author), A. A. Brill (Translator).
Image source: https://herminesplace.files.wordpress.com/…/tmta-coca-cola-…

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...