অনির্বাণ ভট্টাচার্য
ডিজাস্টার। হ্যাজার্ড। পার্থক্য পরিবেশ বিজ্ঞানের কোর্সে থাকে। জুলাই। আগস্ট। বৃষ্টি। অতিবৃষ্টি। হঠাৎ বৃষ্টি। মৌসুমি দিনের মুখ না দেখা আমার রাজ্যের বাঁয়ে ডানে বানভাসি পড়শি। ভেসে যাওয়া ছোট বড় মুখ। মানুষ। পশু। ঘর। টাকা। সঞ্চয়। কোথায় চন্দ্রযান দুই? আমার দেশের, আমার গ্রহে মানুষ এখনও পরের দিন বেঁচে থাকবে কিনা নিশ্চিত নয় যে…
নদী। নদীবাঁধ। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস। পাহাড়ি ধ্বস। এসবেরই বহিঃপ্রকাশ অন্তত ৯টির ওপর রাজ্য। গোটা দেশে মৃত্যু ২৪১। কেরল। গডস ওন কান্ট্রি। এই বন্যায় এখনও মৃত ১১১। নিখোঁজ ৩৬। ১১৯০১টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত, যার মধ্যে ১১১৫টি সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ। ৮৯১টি রিলিফ ক্যাম্পে আশ্রয়ে ১.৪৭ লাখ ঘরছাড়া মানুষ। কনৌর, কাসারাগড়ে রেড, ইয়েলো অ্যালার্ট। কোথাও অরেঞ্জ। মালাপ্পুরমের কাভালাপুরা গ্রাম। ওয়েনাদের পুথুমালা গ্রাম। ৮ আগস্টের আচমকা ঝড়, পাহাড় থেকে নেমে আসা কাদাজল, স্রোত। সব শেষ। এখন কাদা থেকে শরীর বের করছেন উদ্ধারকর্মীরা। এখনও অবধি ২২টি বেরিয়েছে কাভালাপুরায়। আর কত…।
কেরলের পুথুমালা গ্রাম, বন্যার আগে ও বন্যার সময়ে
কেরলের কাভালাপ্পারায় বন্যার পর কাদার ভেতর থেকে মৃতদেহ খোঁজার চেষ্টায় উদ্ধারকর্মীরা
বাকি ভারত। খুব পিছিয়ে নেই। মহারাষ্ট্রের শুধু পুনে ডিভিশনেই মৃত ২২। গোটা রাজ্যে সংখ্যাটা ৫৪। ৪ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত। পশ্চিম মহারাষ্ট্রের সাংলি, কোলহাপুরে জল বিপদসীমার বহু ওপরে। ১৮২টি নৌকো নিয়ে ঘুরছেন রিলিফ ক্যাম্পের লোকজন। কৃষ্ণা, পাচগঙ্গা নদীর জলসীমা ভয়ের চেহারা নিচ্ছে। ডেথটোল বাড়বে? আরও…? অসম। মৃত্যু ৫৯। ৬৮৯টি ক্যাম্পে মাথা গুঁজছেন ১.৩২ লাখ মানুষ। ১.৫১ লাখ হেক্টর জমি জলের তলায়। পাহাড়ি মাটি। চাবাগান। কোথায় এখন? ২৪টি জেলার ভয়ঙ্কর ক্ষতির মধ্যে রেহাই নেই কাজিরাঙ্গা অরণ্যেরও। নিহত ১২৯টি পশু, তার মধ্যে দুটি গন্ডারও আছে। এন্ডেঞ্জার্ড। কর্নাটকে ৬১টি মৃত্যু। আক্রান্ত ২২টি জেলার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বেলাগাভিতেই মৃত ১৫। ১০৯৬টি রিলিফ ক্যাম্পে ঠেসেঠুসে ঢোকা ৩.৭৫ লাখ মানুষ। হিমাচল প্রদেশ। গোটা রাজ্যে অরেঞ্জ অ্যালার্ট। তার মধ্যে লাল সঙ্কেত বেশ কিছু জেলায়। সিমলা, কাংরা, লাহুল-স্পিটি, মান্ডি, চাম্বা, কুলু— যোগাযোগ বন্ধ। পর্যটকশূন্য পাহাড়ি রাজ্য। স্থানীয় মানুষ ঘরছাড়া। অন্ধ্রপ্রদেশ। গোদাবরীর জলোচ্ছ্বাসে দেওয়ালেশ্বরমের স্যার আর্থার কটন ব্যারেজের ৭.৩৪ লাখ কিউসেকের সর্বোচ্চ সীমা ছাড়িয়ে গেছে। জল ছাড়া হচ্ছে ক্রমশ। বিজয়ওয়াড়ার প্রকাশম ব্যারেজের ৭ লাখ কিউসেক সীমাও অতিক্রান্ত। সাবধানবাণী। গুন্টুর, কৃষ্ণা জেলাদুটিতেই ৪০০০ মানুষ ঘরছাড়া। কৃষ্ণা নদীর জল বাড়ছে। এখনও অবধি রাজ্যে মাত্র ১টি মৃত্যু ক্রমশ দু অঙ্কের দিকে যাবে কি? ভয়। মধ্যপ্রদেশের সয়াবিন ক্ষেত জলমগ্ন। রাজ্যে মৃত ৭০। ইন্দিরা সাগর বাঁধের ৬টি বড়, মাঝারি জলাধারের স্লুইস গেট খুলে দেওয়া হয়েছে বাধ্য হয়ে। জল বেরচ্ছে হুহু করে। মান্দাসোরে রেড অ্যালার্ট। ৩০০০ জন ঘরছাড়া। পশুপতিনাথ মন্দির। কে বলেছে ঈশ্বর বেঁচে যান, বাঁচান তাঁর গর্ভগৃহে, দেবালয়ে, দুর্যোগের রাতে? পশুপতিনাথের গর্ভগৃহ শেষ। নীলকণ্ঠের লিঙ্গ, ত্রিশূল— শুধু চুড়ো দৃশ্যমান। বিহার। ৯৭টি মৃত্যু রাজ্যে। তিন অঙ্ক ছোঁবে? হয়ত লেখাটা প্রকাশের দিনই। ১২টি জেলা ভয়ঙ্কর ক্ষতিগ্রস্ত। শুধু সিতারমাহি জেলাতেই মৃত ২৭।
পশ্চিম মহারাষ্ট্রের বন্যাক্রান্ত কোলহাপুর
সিমলা হাইওয়ে। বন্যার পরে…
অন্ধ্রপ্রদেশের বিজয়ওয়াড়ায় ঘরছাড়ার আগে টুকিটাকি ব্যবহার্য জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মানুষ
মধ্যপ্রদেশের মান্দাসোরের পশুপতিনাথ মন্দির, এখন…
বিহারের সবেচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সিতারমাহি জেলা
বিপদসীমার দিকে এগোনো বাকি রাজ্য। উত্তরাখন্ড, জম্মু। সতর্কতা। পাঞ্জাব। বন্যার দিকে এগোচ্ছে ৭টি জেলা। ঘর্ঘর নদীর জলোচ্ছ্বাস। রাজস্থান। তপ্ত, রুক্ষ রাজস্থানে জল আর জীবন নয়, মৃত্যুদূত। ১৬০ মিলিমিটারেরও বেশি বৃষ্টিপাত। এখনও অবধি মৃত ৫। যোধপুর, নাগপুর, পালি এলাকায় রেড অ্যালার্ট।
এবার একটু ইতিহাস ঘাঁটি। শুধু দিন পনেরোর বৃষ্টি? শুধু একটা বছর? তথ্য কী বলছে? কী বলছে টানা তিনটে বছরের গ্রাফ? ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৯-২০ এই তিনটে বছর হিসেব করলে মোট মৃত্যু ৬০০০। তার মধ্যে প্রথম চারে বিহার (৯৭০), কেরল (৭৫৬), পশ্চিমবঙ্গ (৬৬৩) ও মহারাষ্ট্র (৫২২)। মোট লাইভস্টক মৃত ২ লক্ষ। যার মধ্যে সর্বোচ্চ কেরলে (৭৬৮৯১)। এই তিন বছরে ৮৭.৮ লাখ হেক্টর জমির ক্ষতির হিসেবে প্রথমে উত্তরপ্রদেশ (১২.৬৭ লাখ হেক্টর)। মোট ৩৯ লক্ষ ঘর শেষ হয়ে গেছে, যার প্রথমে কেরল (৬.৬৭ লাখ)। এই তিন বছরের হিসেব বলছে বন্যা নতুন কিছু নয়। একটা ট্রেন্ড। প্রকৃতি। অসহায় মানুষ। ঐতিহাসিক এক জলসঙ্কটের দেড় মাসও না যাওয়া বিপরীত এক বিপর্যয়। জল, কুশীলব, অন্য এক ভূমিকায়।
কতটা তৈরি মানুষ? সরকার। দুর্যোগের মোকাবিলা? ফোরকাস্টিং? সরকার বলছে যথেষ্ট তৎপর। মানুষ বলছে উল্টোটা। পশ্চিম মহারাষ্ট্রের সাংলি, কোলহাপুরে চল্লিশ দিন পর উদ্ধার অপারেশন হয়েছে। তামিলনাডুতে বেশ কিছু মৎস্যচাসী মাঝসমুদ্র থেকে ঘোরে ফেরেনি। বেশ কিছু জায়গায় চূড়ান্ত ব্যর্থ ফোরকাস্টিং। ডিজাস্টার প্রিপেয়ার্ডনেস। রিলিফ। রেসকিউ। এককথায় দুর্যোগ মোকাবিলার সিলেবাসের সবকটা বিভাগে।
এর বাইরে? আলো কিছু? খুব সামান্যই। পিন্নারাই বিজয়ন। কেরলের ভয়ঙ্করতায় অসম্ভব তৎপর বিজয়ন। টুইটে তামিলনাডুর বন্যার খবরে ছুটে যাচ্ছেন। সাহায্য চাইছেন নিজের রাজ্যেও। রাহুল গান্ধির পক্ষ থেকেও কেরলের ওয়েনাদে নিজের কেন্দ্রে ১৮০০০ কিট দেওয়া হয়েছে। খাবার, পোশাক, ওষুধ। তিন ধাপে।
এবং বাগালকোট। কর্নাটকের এই জেলার সুরপল্লী। বেশ কিছু জায়গায় বানভাসি পাড়ায় পাড়ায় দৃপ্ত মানুষ। আগস্টের পনেরো। নৌকো। হাতে তেরঙা। বন্যা। ঘর নেই। পোশাক নেই। খাবার নেই। হাতে তেরঙা। স্যালুট। আমার দেশ। জলে ভাসুক। না বাঁচি। আমারই তো দেশ। বুকের বাঁদিকে ধুকপুকুনিটা যতক্ষণ আছে, হাতটুকু কপালে থাকুক।
কর্নাটকের বাগালকোটে বন্যার মাঝেও স্বাধীনতা দিবস উদযাপন
জল নামুক …