পাঞ্চালী কর
ফ্যাসিবাদের লক্ষণ নিয়ে পর্যালোচনা করলে কয়েকটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায়: যথেচ্ছ জাতীয়তাবাদ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, সংবাদমাধ্যমের বিকিয়ে যাওয়া, সর্বত্র একটা ভয় কায়েম করা যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ শক্তিশালী হয়ে উঠছে, তাদের রুখে দিতে হবে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে। এ ছাড়া রয়েছে ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় অনুভূতির অযৌক্তিক বাড়বাড়ন্ত, কর্পোরেটদের বাড়বাড়ন্ত, শ্রমজীবী মানুষের হতভাগ্য অবস্থা, শিল্পী এবং মুক্তমনা যুক্তিবাদী মানুষের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ। বর্তমান ভারতের রাজনৈতিক অবস্থানে এইসব বৈশিষ্ট্য গভীরভাবে লক্ষণীয়। এমতাবস্থায় যখন কেউ সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে চায়, তাদের দুঃখ, দুর্দশার কথা বলতে চায়, তাদের দাবী নিয়ে সরব হতে চায় তখন তার ওপরে নেমে আসে রাষ্ট্রের প্রকোপ। এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের হাতে খুন হতে হয়েছে বিশিষ্ট সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশকে কারণ তিনি এই ফ্যাসিবাদী মডেলের বিরোধিতা করে আসছিলেন অহরহ। নরেন্দ্র দাভলকরকে গুলি করা হয় পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে, কারণ তিনি কুসংস্কারের বিরোধিতা করছিলেন, এতে হিন্দুত্ববাদী মানুষের ভাবাবেগ আহত হয়েছিল। তারা মেনে নিতে পারেননি যে যুগ যুগ ধরে জিইয়ে রাখা অন্ধ বিশ্বাসের ওপর কোনও যুক্তিবাদী মানুষ আঘাত হানছেন। এম এম কালবুর্গির ধর্মীয় সাহিত্যের বিশ্লেষণ তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল। গোবিন্দ পানসারে শিবাজির হিন্দুত্ববাদী ভাবমূর্তি খণ্ডন করে তাকে ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে সনাক্ত করায় শিবসেনার রোষের মুখে পড়েন এবং অকালে প্রাণ হারান। রোহিত ভেমুলা দলিত মানুষের অধিকারের জন্য সরব হওয়ার কারণে তাকে আত্মহত্যার মুখে ঠেলে দেয় স্বয়ং রাষ্ট্র। এ ছাড়াও বিভিন্ন মানবাধিকার কর্মী, সমাজকর্মীদের UAPA-র আওতায় গ্রেফতার করা হয়েছে। দেশের প্রতি ভালোবাসা আর সরকারের প্রতি অন্ধ আনুগত্যের ব্যবধান ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে ক্রমশ। ঠিক-ভুলের কষ্টিপাথর এখন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, ধর্মান্ধতা, এবং সংখ্যালঘুর প্রতি অত্যাচার। এগুলো করতে বা সাপোর্ট করতে পারলেই তুমি সাচ্চা নাগরিক।
এমতাবস্থায় যারা স্রোতের উল্টো দিকে বইবেন তারা ফ্যাসিবাদী শক্তির চক্ষুশূল হবেন এটাই স্বাভাবিক। আমাদের কমরেড শুভঙ্কর দাশশর্মা এমনই এক ষড়যন্ত্রের শিকার। গত ১৫ আগস্ট আর্টিস্টস ইউনাইটের পক্ষ থেকে কিছু পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়, গৌরী লঙ্কেশ, নরেন্দ্র দাভালকর, এম এম কালবুর্গি, গোবিন্দ পানসারে, এবং রোহিত ভেমুলা সম্বন্ধে, সাধারণ ভাষায়, মূলত ছবি বা ইলাস্ট্রেশনধর্মী কিছু পুস্তিকা যাতে সব বয়সের সমস্ত মানুষ বুঝতে পারেন, জানতে পারেন এই মানুষগুলো সম্পর্কে, কারা এঁরা? কেন মরতে হল এঁদের? এই অনুষ্ঠানের এক উল্লেখযোগ্য আয়োজক ছিলেন আমাদের বন্ধু শুভঙ্কর দাশশর্মা। শুধু এই অনুষ্ঠানই নয়, ধর্মীয় মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দূর দূরান্ত গিয়ে বিভিন্নরকম কাজ করে থাকেন শুভঙ্কর, তাই রাষ্ট্রের ডেটাবেস-এ শুভঙ্কর চিহ্নিত। ওয়ান্টেড। মোস্ট ওয়ান্টেড। ১৫ আগস্ট সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে তৃণমূলের গুন্ডারা বেধড়ক মারে শুভঙ্করকে। ও মাথায় গুরুতর ছোট পায় এবং হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বর্তমানে সিঁথি থানায় এই ঘটনার তদন্ত চেয়ে FIR করা হয়েছে। থানায় একটি ডেপুটেশনও জমা জমা দেওয়া হয়েছে, দ্রুত তদন্তের অনুরোধ করে, এবং দোষীদের শাস্তির দাবিতে। শুভঙ্করের শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল হলেও এখনও ও সম্পূর্ণ সুস্থ নয়।
অবাক লাগতে পারে এই ভেবে যে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধীপক্ষে দাঁড়ালে মূল প্রতিপক্ষ বিজেপি, অথচ শুভঙ্করকে টার্গেট করেছিল তৃণমূলের গুন্ডারা। বলাই বাহুল্য তৃণমূল কংগ্রেস এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে এমনই সব কীর্তি করে চলেছে যাতে বিজেপির পথ আরও প্রশস্ত হয়। শুভঙ্কর একজন নাট্যকর্মী। একজন শিল্পী। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের সর্বপ্রথম চক্ষুশূল শিল্পীরাই, কারন এঁরা এঁদের শিল্প-মাধ্যমকে হাতিয়ার বানিয়ে সাধারণ মানুষের, শ্রমজীবী মানুষের, সংখ্যালঘু মানুষের কথা জনসমক্ষে নিয়ে আসেন, তাই বারবার শিল্পীর ওপর হামলা এবং শিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র। এই হামলার বিরোধিতা করে দমদম স্টেশন চত্বরে জমায়েতের ডাক দিয়েছে শুভঙ্করের বন্ধু ও হিতাকাঙ্ক্ষী কিছু মানুষ। ডাক দেওয়া হয়েছে আজ, ১৮ আগস্ট, বিকেল ৪টে থেকে। জমায়েতের মূল উদ্দেশ্য বিপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়া যে আমরা পিছিয়ে নেই। শুধু পড়ে পড়ে মার খাব না।
প্রসঙ্গত এত ঘটনা ঘটার পরও দমদম এলাকার MLA শ্রী ব্রাত্য বসু মহাশয়ের তরফে কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। ব্রাত্য বসু নিজে বিশিষ্ট নাট্যকর্মী, কিন্তু তিনি সবার আগে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের অপরেশনাল ইউনিট। তাই তিনি রাষ্ট্রের অ্যাজেন্ডা চরিতার্থ করবেন। একই সঙ্গে রাষ্ট্র ও শিল্পী হওয়া যায় না। দ্বান্দ্বিকতা গুলে খেলেও, যায় না।