শতাব্দী দাশ
তারাশঙ্করের ‘তারিণী মাঝি’ গল্পে অম্বুবাচীর মেলা বসেছিল ময়ূরাক্ষী তীরে। পরে সে নদীরই হড়কা বানের ঘূর্ণিতে পড়ে যায় তারিণী ও তার বউ সুখী। সুখীকে গলা টিপে হত্যা ক’রে প্রাণে বাঁচে তারিণী। একজনই বাঁচতে পারত যে!
অথচ গল্প জুড়ে আমরা দেখেছিলাম কী অপরিসীম প্রেম তারিণীর! বর্ষণমুখর সেই রাতে যুগলে ফিরলে প্রেম হত, ভালবাসাবাসি হত। সেসব মিথ্যে নয়, তবে টিকে থাকার প্রবৃত্তির চেয়ে বড় সত্য নয়। টিকে থাকা– নিজে বেঁচে থাকা, আপন প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখা।
অম্বুবাচী। অর্থাৎ বর্ষারম্ভ। বর্ষার সাথে প্রবৃত্তি-মিলন-যৌনতা-প্রজনন প্রভৃতি নিরক্ষীয় দেশসমূহে কেমন বাঁধা পড়ে গেছে!
পৃথিবী আর আকাশের ‘মিলন’ উদযাপন করছিল হয়তো সেদিনও মানুষজন, আজও করছে। প্রেম নয়, ভালবাসা নয়। যৌনতা, মিলন। উদযাপন করছিল, কারণ পৃথিবী এবার আর্দ্র হবেন কামরসে। অতঃপর তিনি গর্ভিণী হবেন। ক্ষেতে ফসল ফলবে। গাছেরা জলসিঞ্চনে সবুজ হবে। চাষী হাঁফ ছাড়বে। হলকর্ষণ হবে না অবশ্য– তিনদিন। অলৌকিক সে মিলন সভ্যতার স্বার্থে সম্পূর্ণ হতে দেওয়া হবে।
মতান্তরে, এই সময় ধরণী রজঃস্বলা হবেন। ‘মা’-কে বিশ্রাম দেওয়া হবে। তারপর তাঁর থেকে কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নেওয়া হবে যা যা কিছু তাঁর প্রদেয়।
আর নারীপুরুষও উৎসবে, পিঠেপুলিতে, মেলামোচ্ছবে, আদরে সোহাগে মেতে উঠবে। জীবনের বহতা ধারা… ইত্যাদি।
বিধবারা কিন্তু প্রজননক্রিয়ায়, উৎপাদনক্রিয়ায় তেমন প্রয়োজনীয় নন। তাঁদের প্রবৃত্তিবশে গর্ভবতী হয়ে যাওয়াও সভ্যতার চোখে বালির মতো খচখচ করবে। তাই তাঁরা আরও খানিক সংযমী হবেন। অম্বুবাচীর উপবাস, ধম্মোকম্মো করবেন।
প্রাচীন সভ্যতা বড় খোলাখুলি এইসব প্রয়োজনসর্বস্ব (ইউটিলিটেরিয়ান) সম্পর্ক, কার্যবিধি, যাপনের কথা বলত ফার্টিলিটি মিথের মাধ্যমে। সোজা কথা সোজাভাবে বললে নিরেট মাথায় সহজে ঢোকে। তার উপর কাব্যময় রুমানি প্রলেপ এক পোঁচ, দু’ পোঁচ পড়লে ভ্রম ঘনায়। যেমন করে মেঘ ঘনায়। আর কে না জানে, মেঘ ঘনালে আমাদের মালবিকা অনিমিখে বাতায়নে চেয়ে থাকে! অথচ বিষয় হরে দরে একই তো। এক, কাম নির্বাপণ। দুই, প্রজননের মাধ্যমে ‘পিতৃতান্ত্রিক’ সভ্যতার ক্রমবিবর্তন।
অতএব প্রথমত– কাম। শাস্ত্রমতে না, কিন্তু সামাজিক মতে যাতে নারীর অধিকার নেই। অথচ যোনিপূজা সুপ্রাচীন। এশিয়া থেকে ইউরোপ থেকে মধ্যপ্রাচ্য– জুডাইক ধর্মের প্রচারের আগে পর্যন্ত সর্বত্র ছিল– যোনিপূজা। এ সময়ে ‘রজঃস্বলা’ হন দেবী কামাখ্যা। কামাখ্যা পীঠেই নাকি দেবীর যোনি পতিত হয়েছিল তাণ্ডব-কালে। দেবীর নামের মধ্যেও ‘কাম’।
এদিকে, এমনকি মহম্মদের জনৈক জীবনীকারের মতে ‘কাবা’ও নাকি পূর্বে ছিলেন এক নারীশক্তি। কৃষ্ণপ্রস্তরের কাবাও নাকি আসলে যোনি-আকৃতির।
নারীর কামের অবদমন আর কামের লিঙ্গায়ন তবে শুরু হল কবে থেকে? কীভাবে অম্বুবাচী মূলত বিধবার উপবাসের দিন হয়ে গেল?
অতঃপর দ্বিতীয়টি, অর্থাৎ পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতার ক্রমবিবর্তন। যাতে নারীর ভূমিকা জননীর, ধাত্রীর। চালকের নয়, কর্ত্রীর নয়। যোনি যেখানে শুধু ও শুধুমাত্র প্রজননের প্রতীক, কামেরও নয়। যোনি সৃষ্টির উৎস বটে। কিন্তু মোক্ষলাভ মানে হল ‘লক্ষ যোনি ভ্রমণ’ থেকে মুক্তি। আর পূর্বজন্মের পাপের ফল হল পরজন্মে ‘রাক্ষস যোনি’ লাভ, অর্থাৎ রাক্ষসমাতার যোনি বেয়ে পৃথিবীতে আগমনের দুর্ভাগ্য।
এই সম্পূর্ণ ঐতিহ্যে, লৌকিক আচারে, ধর্মে, যাপনে, পুরাণে– নারীর অবমাননা ছাড়া কিছু দেখি না। দেবী রজঃস্বলা হন বটে, কিন্তু রজঃস্বলা হলে দেবী অপবিত্র ও পরিত্যক্ত হন। ‘মা’ পূজিত হন ঊর্বর হলে ক্ষুন্নিবৃত্তি ঘটাবেন বলে। নারীকেও (পৃথিবীর মতো) দেবী রূপে পূজা ক’রে কর্ষণ করার ঐতিহ্য এভাবেই মান্যতা পায়।
জীবনের বহতা ধারা… ইত্যাদি… এসবই তো…
(উপরের ছবির দেবীমূর্তির নাম ‘লজ্জা গৌরী’। ইনি প্রাচুর্য ও উর্বরতার দেবী। সুফলন ও সুস্থ সন্তানের কামনায় এই দেবীর পূজা হত। সিন্ধু সভ্যতার নমুনায় এই দেবীর উল্লেখ পাওয়া গেছে। পণ্ডিতেরা বলেন, মেসোপটেমিয়া-অঞ্চলেও কিছুটা অন্য রূপে এই দেবীর পূজা হত। কেউ কেউ অনুমান করে থাকেন – এই দেবীর ভারতে আগমন আলেকজান্ডারের সৈন্যবাহিনীর হাত ধরে)